প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

চোর

নারায়ণ ভট্টাচার্য্য

[ লেখক পরিচিতি : নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে হুগলি জেলার খানাকুলস্থ কৃষ্ণনগরের পোলগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম পীতাম্বর ভট্টাচার্য্য। কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি ও বেদান্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকার থেকে তিনবার বৃত্তি লাভ করেন। 'স্বদেশী' মাসিক পত্রিকার (১৩১৩ - ১৩১৫) সম্পাদক ও পরিচালক ছিলেন। 'বিদ্যাভূষণ' উপাধি ও যোগেন্দ্র রিসার্চ পুরস্কারও লাভ করেছেন নারায়ণচন্দ্র। তত্‍‌কালীন বহু পত্রিকাতে তিনি রচনা প্রকাশ করেছেন। তার রচিত উপন্যাস : 'কুলপুরোহিত' ; 'পরাধীন' ; 'মতিভ্রম' ; 'পরাজয়' ; 'মানরক্ষা' ; 'ডিক্রিজারী' ; 'ভবঘুরে' ; 'বিয়েবাড়ি' ; 'নিষ্কর্মা' ; 'স্বামীর ঘর' ; 'গরীবের মেয়ে' ; 'বন্ধুর মেয়ে' ; 'অপরাধী' ; 'নিষ্পত্তি' ; 'নাস্তিক' ; 'প্রেমিকা' ; 'প্রবঞ্চক' ; 'সুরমা' ; 'গিনির মালা' ; 'ঘরজামাই' ; 'একঘরে' ; 'কালোবউ' ; 'রাঁধুনী বামুন' ; 'পূজা' ; 'বন্ধন মোচন' ; 'রাঙা কাপড়ের মূল্য' ; 'সঙ্গীহারা' ; 'স্নেহের জয়' ; 'বারবেলা' ; 'প্রায়শ্চিত্ত' 'মনের বোঝা' ; 'মেয়ের বাপ' ; 'বিধবা' ; 'হিসাব নিকাশ' ; 'পরের ছেলে' ; 'পতিতা' ; 'নিরাশ প্রণয়' ; 'পরাজয়' ; প্রতিদান' ; 'গঙ্গারাম' ; 'গ্রহের ফের' ; 'সতীন পো' ; 'পূজার আমোদ' ; 'অনুরাগ' ; 'অপবাদ' ; 'অভিমান' ; 'মায়ার অধিকার' ; 'ব্রহ্মশাপ' ; 'মণির বর' ; 'দাদা মহাশয়' ; 'জেল ফেরত্‍‌' ; 'ঠাকুরের জন্য' ; 'সুখের মিলন' ; 'বৈরাগী' ; 'ত্যাজ্যপুত্র' ; 'আকালের মা' ; 'উত্তরাধিকারী' ; 'নববোধন' ; 'দুর্বাসা ঠাকুর' ; 'গুরু মহাশয়' ; 'কথাকুঞ্জ' ; 'কণ্ঠিবদল' ; 'মাণিকের মা' ; 'হিন্দু স্ত্রী-ধনাধিকার'। তিনি জৈন পুরোহিত হেমচন্দ্রের 'অভিধান চিন্তামণি' বঙ্গানুবাদ সহ প্রকাশ করেছেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে নারায়ণচন্দ্রের মৃত্যু ঘটে। ] দীপক সেনগুপ্ত ।


[১]

      বিষ্ণু হাজরার ছেলে কেষ্ট হাজরাকে লোকে বোকারাম বলিয়া জানিত| বাপ বিষ্ণুচরণ যখন মারা যায়, তখন কেষ্টধনের বয়স আঠার বৎসর| মা যে কবে মারা গিয়াছিল, তাহা সে জানে না, বাপকেই সে মা-বাপ দুই বলিয়া জানিত এবং উভয়ের নিকট প্রাপ্য স্নেহযত্ণ একজনের নিকটেই আদায় করিয়া লইত| মা বলিয়া কেহ না থাকিলে যে বিশেষ কোন অসুবিধা ভোগ করিতে হয়, এ ধারণাটা তাহার আদৌ ছিল না|
     বাপও অনেক কষ্টে মা-মরা ছেলেটিকে মানুষ করিয়াছিল, পাঠশালায় দিয়া একটু লিখিতে পড়িতেও শিখাইয়াছিল| তারপর লক্ষ্মীমন্ত বৌ ঘরে আনিয়া ভাঙ্গা সংসারে হাট পত্তন করিবার অভিপ্রায়ে মেয়ে খুঁজিতে লাগিল| অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাড়ারই নকুড় পালের মেয়ে সুবাসিনীকে পছন্দ হইল| মেয়েটি দেখিতে শুনিতে যেমন, তেমনই শান্ত শিষ্ট| নকুড় পাল দুই শত টাকা পণ এবং তিনখান সোণার ও পাঁচখান রূপার গহনা চাহিয়া বসিল| অনেক দর কষাকষির পরে পণের পঁচিশ টাকা কমিল, গহনা আটখানাই বজায় রহিল| বিবাহ-সম্বন্ধ পাকা হইয়া গেল|
     মাঘ মাসে বিবাহ| পৌষের শেষে বিষ্ণুচরণ গুড় নারিকেল দিয়া পৌষ পার্ব্বণের তত্ত্ব করিল| সেই সঙ্গে রূপার একখানা জিনিষ মল এবং সোণার মুড়কি মাদুলি দিল| কিন্তু রঘুনাথপুরে গুড় কিনতে গিয়া বিষ্ণুচরণ সেই যে জ্বর লইয়া আসিল, সে জ্বর আর ছাড়িল না| সাত দিনের দিন ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বিষ্ণুচরণ পরলোক যাত্রা করিল|
     কেষ্ট বাপকে হারাইয়া সংসার শূন্য দেখিল| বাপের দাহকার্য্য শেষ করিয়া আসিয়া সেই যে শুইল, তিন দিন তিন রাত্রি আর উঠিল না| শেষে পাঁচ জনের উপদেশে ও সান্ত্বনায় উঠিয়া পিতার পারলৌকিক সদ্গতির ব্যবস্থায় মনোনিবেশ করিল|
     পুরোহিত আসিয়া উপদেশ দিলেন, "বাপু, বিষ্ণুচরণ একটা লোকের মত লোক, ছেলে রেখে গিয়ে সে পরলোকে হা হা করে বেড়াবে, সেটা কি ভাল দেখায়? আহা, বেচারা তোমার মুখ চেয়েই আর বিয়ে পর্য্যন্ত করলে না|"
     বাবা পরলোকে হা হা করিয়া বেড়াইবেন? যিনি বুকের রক্ত দিয়া তাহাকে আঠার বৎসরের করিয়া গিয়াছেন, ছেলের জন্য সকল কষ্ট, সব দুঃখ মাথা পাড়িয়া লইয়াছেন, সেই স্নেহময় পিতা ইহলোকের পরপারে গিয়াও একটু শান্তি পাইবেন না? কেষ্টধনের বুকটা যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল| কাঁদিতে কাঁদিতে পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করিল, "বলুন, কি করলে পরলোকে বাবা সুখে থাকেন|"
     পুরোহিত বৃষোৎসর্গ করিতে উপদেশ দিলেন| কিন্তু পাঁচজন বলিল, "সে অনেক টাকার ফের| তার চেয়ে তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ আর একটী ভাল রকম ষোড়শ করুক|"
     পাঁচজনের কথাই স্থির হইল| তখন স্বজাতিরা বলিল, "কেষ্টধন বাপকে তো ফিরে পাবে না| এখন পাঁচ কুটুম্বের পায়ের ধুলো নিয়ে তাকে উদ্ধার করে দাও| কুটুম্ব নারায়ণ|ও
     বিষ্ণুচরণ ছেলের বিবাহের জন্য কতক টাকা সঞ্চয় করিয়াছিল, কতক এ হাত ও হাত করিয়া জমাইয়াছিল| কেষ্টধন বাক্স খুলিয়া দেখিল, দুই শত দশ টাকা মজুত আছে| সুতরাং সে পিতার স্বর্গ কামনায় পাঁচ জনের উপদেশমত কাজ করিতে ইতস্ততঃ করিল না| সে যথাবিধি পিতার শ্রাদ্ধ কার্য্য সম্পন্ন করিল| ব্রাহ্মণ ও কুটুম্বগণ পাকা ফলারে পরিতৃপ্ত হইয়া সুদীর্ঘ উদ্গারের সহিত কেষ্টধনের পিতৃভক্তি ও তদীয় পিতার স্বর্গলাভের অবশ্যম্ভাবিতা নির্দ্দেশ করিতে করিতে যখন প্রস্থান করিলেন, তখন কেষ্টধন বাক্স খুলিয়া দেখিল, তাহাতে আর পাঁচ টাকা সাত আনা মাত্র মজুত আছে|
     ভাবী শ্বশুর নকুড় পালকেই মাথা হইয়া দাঁড়াইতে হইয়াছিল| কার্য্যে শেষে তিনি হিসাব নিকাশ বুঝাইয়া দিয়া পথে বুক ফুলাইয়া বলিলেন, "আমি ব'লেই দুশো টাকায় কাজ সেরেছি| আর কেউ হ'লে তিনশো টাকার এক পয়সা কমে এ ব্যাপার সম্পন্ন হ'তো না| তার অন্ততঃ পঞ্চাশটা টাকা নিজের পকেটে ফেলিত|"
     কেষ্টধন ভাবী শ্বশুরের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল|
     কিন্তু শ্রাদ্ধান্তে কেষ্টধন একটু ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল| বামুন পিসি আসিয়া বলিলেন, "বাবা কেষ্টধন, তোমার বিয়ের তরে বিষ্টুদাদা আমার কাছ থেকে শুধু হাতে দশগণ্ডা টাকা এনেছিল| বিষ্টুদাদাকে তো অবিশ্বাস ছিল না, এমন কতবার নিয়েছে, দিয়েছে| বাবা, এই অনাথা বামুনের মেয়ের টাকাগুলির কি হবে? আমার অনেক কষ্টের টাকা|
কেষ্টধন বলিল, "না বামুন পিসী, আমি যেমন ক'রে পারি, তোমার টাকা ফেলে দেব|"
     বামুন পিসী সহর্ষে বলিলেন, "তাই তো বলি, কেষ্টধন কি তেমন ছেলে| বাপের কাজে আঁজলাভরা টাকা খরচ করলে, আর বাপকে কি ঋণপাপে জড়িয়ে রাখবে?"
     শুধু বামুন পিসী নয়, ক্রমে ঘোষ গিন্নী, গয়লা-বৌ, রামু সেকরার মা প্রভৃতি একে একে আসিয়া কেহ পাঁচ গণ্ডা, কেহ আট গণ্ডা, কেহ সাড়ে এগার গণ্ডা টাকার তাগাদা আরম্ভ করিল| কেষ্টধন হিসাব করিয়া দেখিল, মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় শত টাকা| এত টাকা যে কি উপায়ে পরিশোধ করিবে, তাহা ভাবিয়া পাইল না| ভাবী শ্বশুরকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিল, শ্বশুর পরমর্শ দিলেন, "যখন লেখাপড়া কিছু নাই, তখন ও সব দেনা দেনাই নয়| এখন ধানগুলো বেচে জমি-জায়গাগুলো বাঁধা ছাঁদা বিয়েটা ক'রে ফেল| আমি তো আর দুব'ছর মেয়ে রাখতে পারব না|"
কেষ্টধন ধান বেচিল; তিন বিঘা জমি ছিল, এক শত টাকায় বাঁধা দিল| কিন্তু সে টাকায় সে বিবাহ করিল না, পিতাকে ঋণমুক্ত করিয়া দিল| নকুড় পাল রাগে আগুন হইয়া উঠিলেন| তিনি কেষ্টধনকে ডাকিয়া বলিলেন, "হয় বাপের বাৎসরিক দিয়ে বোশেখ মাসের ভিতর বিয়ে কর, নয় পাঁচ জনের জবাব দাও, আমি দোসরা চেষ্টা দেখি|"
     কেষ্টধন দেখিল, জবাব দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় নাই| দুই শত টাকা সংগ্রহ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব, বাঁধা রাখিয়া ধার করিবার মত কোন সম্পত্তি নাই| অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া শেষে পাঁচ জন স্বজাতির সম্মুখে জবাব দিয়া অসিল| পাল মহাশয় পাকা দেখার সময় পণ বাবদ চল্লিশ টাকা অগ্রিম লইয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, "টাকা আমি খরচ ক'রে ফেলেছি| অন্যত্র পণের টাকা পেলে ফেলে দেব| কেষ্টধন তাহাতেই সম্মত হইল| গহনা দুই খানের কথার উত্থাপনা আর হইল না|
     বৈশাখের শেষেই পাল মহাশয় মেয়ের বিবাহ দিলেন| কিন্তু কেষ্টধন টাকা ফেরত পাইল না| সে কোন উচ্চাবাচ্যও করিল না, শুধু বিবাহের রাত্রে নিমন্ত্রণ খাইয়া আসিল|
     কেষ্টধনকে অতঃপর উদরান্নের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইতে হইল| অনেক ঘুরিয়া ফিরিয়া শেষে বাজারে বৃন্দাবন লাহার গোলদারি দোকানে আট টাকা মাহিনায় বেচা-কেনার চাকরী পাইল| চাকরী কিন্তু বেশী দিন টিকিল না| লাহা মহাশয় যে দিন খরিদ্দার বিশেষে দুই প্রকার বাটখারার ব্যবহারের জন্য তাহাকে উপদেশ দিল, তখন সতেরো দিনের মাহিনা চুকাইয়া লইয়া চলিয়া আসিল| লোকে-বিশেষতঃ পাল মহাশয় তাহার নির্বুদ্ধিতার উল্লেখ করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন এবং এরূপ বোকারামের হস্তে কন্যা সম্প্রদান না করিয়া যে বুদ্ধিমানের কার্য্য করিয়াছেন, ইহাই জ্ঞাপন করিয়া যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ অনুভব করিলেন|
     অনেকে কেষ্টধনকে পুনরায় চাকরীর চেষ্টা করিতে পরামর্শ দিল| কেষ্টধনের কিন্তু আর চাকরী করিতে প্রবৃত্তি ছিল না| ঘরে একটা গাই ছিল| গাইটা বেচিয়া সেই টাকায় মালা, ঘুনসী, চুড়ী, চিরুণী কিনিয়া মণিহারী জিনিষের ফেরী করিতে আরম্ভ করিল|
     কেষ্টধন সকালে উঠিয়া ঘরে চাবী দিয়া ফেরী করিতে বাহির হইত| ফিরিতে কোন দিন অপরাহ্ণ, কোন দিন বা সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া যাইত| ঘরে ফিরিয়ে রাঁধিয়া খাইয়া শুইয়া পড়িত| পাড়ার বা গ্রামের লোকের সঙ্গে তাহার কোন সম্পর্ক ছিল না| তথাপি তাহার নামে পাড়ায় পাড়ায় যথেষ্ট আন্দোলন হইত এবং এইরূপে নীচকার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য তাহাকে যথেষ্ট নিন্দা করিত|

[২]

    হাট হইতে ফিরিয়া কেষ্টধন রান্না চাপাইয়াছিল| শীতের সন্ধ্যাটা যেমন স্তব্ধ তেমনই অবসাদময় হইয়াছিল| আকাশ থমথমে মেঘে ভরা; উত্তরে বাতাস নৈরাশ্যের গভীর দীর্ঘশ্বাসের মত হুহু করিয়া বহিয়া যাইতেছিল| কেষ্টধন ভাতের হাঁড়িতে চাল দিয়া উনানের পাশে বসিয়া তামাক টানিতেছিল| আর গুন্গুন্ করিয়া গাহিতেছিল-
     "পার কর পার কর ব'লে ডাক্ছি বারে বারে|
     মাঝি বেলা গেল সন্ধ্যে হলো যাব দেশান্তরে|
     পার কর পার কর ব'লে -"
     "কেষ্ট দাদা|"
     গান বন্ধ করিয়া কেষ্টধন তাড়াতাড়ি উত্তর দিল, "কে সুবা?"
     সুবা ওরফে সুবাসিনী উত্তর দিল, "হাঁ, তুমি কি রান্না চাপিয়েছ কেষ্টদাদা?"
     কেষ্ট বলিল, "হাঁ, কেন রে?"
     সুবা ঈষৎ কাতর অথচ ব্যগ্রকণ্ঠে বলিল, "একবার আমাদের বাড়ী যাবে?"
     কেষ্ট| কেন?
     সুবা| আমার ভায়ের বড্ড ব্যামো?
     কেষ্ট হুঁকাটা ফেলিয়া উঠিয়া আসিল; ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিল, "কার? ফকিরের?"
     সুবা| হাঁ|
     কেষ্ট| কি হয়েছে?
     সুবা| দুপুরের পর হ'তে ভেদবমি হ'চ্ছে| বাবাও আজ বাড়ী নেই|
     কেষ্ট ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিল, "বলিস্ কি চল্, চল্|"
     সুবা বলিল, "তোমার রান্না?"
     ধমক দিয়া কেষ্ট বলিল, "চুলোয় যাক্ রান্না| চল্|"
     সুবাকে পেছনে ফেলিয়া কেষ্ট ছুটিতে ছুটিতে তাহাদের বাড়ীতে উপস্থিত হইল| সুবার মা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, "বাবা রে, আমার ফকির বুঝি ফাঁকি দেয়|"
     কেষ্ট তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া ডাক্তার ডাকিতে ছুটিল| গ্রামে ডাক্তার ছিল না; প্রায় এক ক্রোশ দূরে রায়পুরে একজন ভাল ডাক্তার আছে, কেষ্টর গায়ের কাপড়খানা লইবারও অবকশ হইল না; কোঁচার খুঁট গায়ে দিয়াই অন্ধকার মাঠের উপর দিয়া ছুটিয়া চলিল| তখন ঝিম্ ঝিম্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে| কেষ্ট সেই বৃষ্টিতে ভিজিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে ডাক্তারের বাড়ীতে পৌঁছিল|
     ডাক্তার কিন্তু এমন দুর্যোগে বাহির হইতে সম্মত হইলেন না| কেষ্ট অনেক কাঁদাকাটি এবং দশ টাকা ভিজিট স্বীকার করিয়া তাঁহাকে রাজী করাইল| তখন ডাক্তার তাহার মাথায় ঔষধের বাক্স এবং হাতে হ্যারিকেনের আলো দিয়া গরম কাপড় চাপাইয়া বাহির হইলেন|
     ডাক্তার আসিয়া রোগী দেখিলেন, ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন| তাঁহাকে বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিবার জন্য কেষ্টধন আট আনা স্বীকার করিয়া একজন লোক ঠিক করিয়া দিল| কিন্তু ডাক্তারের ভিজিট ও ঔষধের দাম দিবার সময় বড় গোল বাধিল| সুবার মা বলিল, "কি হবে বাবা কেষ্ট, বাক্সের চাবী যে কত্তার কাছে?"
     কেষ্টধন বড় ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল| সুবার মা নাকের নথ, কানের পাশা খুলিয়া দিয়া বলিল, "এই দুটো কোথাও রেখে ডাক্তারের টাকা মিটিয়ে দাও|
     কিন্তু সে রাত্রে কে জিনিষ রাখিয়া টাকা দিবে? কেষ্টধন মাল গস্ত করিতে যাইবার জন্য ষোলটি টাকা রাখিয়া দিয়াছিল| তাহা হইতেই বারটি টাকা আনিয়া ডাক্তারে ভিজিট ও ঔষধের দাম মিটাইয়া দিল| ডাক্তার চলিয়া গেলেন, কেষ্টধন রোগীর পাশে বসিয়া শুশ্রূষা করিতে লাগিল| সুবা একবার বলিল, "তোমার খাওয়া হ'লো না, কেষ্ট দাদা?"
কেষ্ট সে কথার উত্তর না দিয়া বলিল, "শীগ্গীর একটু আগুন কর দেখি, সেঁক দিতে হবে|"
     কেষ্টধন অনেক চেষ্টা করিল, রোগী কিন্তু বাঁচিল না| ভোরের সময় তাহার সকল যন্ত্রণার অবসান হইয়া গেল|
পাল মহাশয় যখন বাড়ীতে ফিরিলেন, তখন দাহকার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে| তিনি পুত্রের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে খানিকটা হা-হুতাশ করিলেন এবং জাগতিক যাবতীয় ঘটনাই কর্ম্মফল বলিয়া মনকে প্রবোধ দিলেন| তারপর চিকিৎসাদির কথা শুনিয়া আক্ষেপ সহকারে বলিতে লাগিলেন, "হায় হায়, এ সব ব্যারামেও কি মানুষ বাঁচে? হতভাগা না-হোক কতকগুলা টাকা বরবাদ ক'রে দিলে| ও হতভাগা ছোঁড়াকে ডাক্লে কে?"
     "হাঁ কেষ্ট দাদা?"
     "কেন সুবা?"
     "ক'দিন ঘরে ব'সে আছ যে?"
     কেষ্টধন মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, "ঘরে? হাঁ ঘরে ব'সে আছি| বেরুনো হচ্চে না|"
     সুবা মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "আমিও তো তাই জিজ্ঞাসা কচ্চি, কেন, বেরুচ্চ না?
     একটু ইতস্ততঃ করিয়া কেষ্ট বলিল, "বেরুচ্চি না, শরীরটাও ভাল নয়, মালপত্রও আনতে হবে|"
     সু| আনতে হবে তা আনচো না কেন?
     কে| আনবো বই কি, আনতেই হবে, তারই জোগাড়ে আছি|
     সু| কিসের জোগাড়? টাকার?
     কেষ্ট সে কথার কোন উত্তর দিল না| উনানটা তখন নিবিয়া গিয়াছিল, উপুড় হইয়া উনানে ফুঁ দিতে লাগিল| অনেকগুলা ফুৎকারেও উনান জ্বলিল না, শুধু কুণ্ডলী পাকাইয়া ধোঁয়া উঠিতে লাগিল| ধোঁয়ায় কেষ্টর চোখদুটো লাল হইয়া উঠিল, দুই চোখ দিয়া জল গড়াইতে লাগিল| সুবা অগ্রসর হইয়া ঈষৎ তিরস্কারের স্বরে বলিল, "চল আমি দেখছি, এ সব কি বেটাছেলের কাজ!"
     কেষ্ট সরিয়া আসিয়া কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিতে লাগিল| সুবা উনানের ভিতরকার ঘুঁটেগুলাকে বাহির করিয়া পুনরায় ভাল করিয়া সাজাইয়া দিল| তারপর দুই তিনটা ফুৎকার দিতেই জ্বলিয়া উঠিল| সুবা গর্ব্বপ্রফুল্লদৃষ্টিতে কেষ্টধনের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, "দেখলে?"
     কেষ্ট মৃদু হাসিল| তখনও তাহার চোখের জল শুখায় নাই|
     কেষ্ট পুনরায় গিয়া উনানের পাশে বসিল; সুবা একটু সরিয়া দাঁড়াইল| দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, "হাঁ, যে কথা বলছিলাম, ত টাকার জোগাড় হ'য়েছে?"
     কেষ্টধন উত্তর করিল, "না|"
     সু| কত টাকা জোগাড় করতে হবে?
     কে| গোটা পনের ষোল|
     সু| তা আমাদের কাছে তো বার টাকা পাবে?
     কেষ্ট হাঁড়ীতে তেল ও লঙ্কা দিয়া সেই দিকে চাহিয়া রহিল| সুবা নিজের কাপড়ের ভিতর হইতে এক ছড়া মুড়কী-মাদুলী বাহির করিয়া তাহার সম্মুখে রাখিল| কেষ্ট হাতে হাঁড়ীর কাণাটা ধরিয়া বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সুবার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল| সুবা বলিল, "ও কি, হাঁড়ীর তেলটা যে জ্বলে শেষ ওতে কি দেবে দাও না|"
     কেষ্ট তাড়াতাড়ী আলু বেগুনগুলা তাহাতে ফেলিয়া দিল| সুবা বলিল, "ও মা, বেগুনগুলো এখন দিলে কেন? ওগুলো যে সিদ্ধ হবে না|"
     কেষ্ট নিরুত্তরে খুন্তি দিয়া সেগুলা নাড়িতে চাড়িতে লাগিল| সুবা বলিল, "তুমি বুঝি এই রকম করে রেঁধে খাও কেষ্ট দাদা? খাও কি ক'রে?"
     কেষ্ট একটু ম্লান হাসি হাসিল| সুবা তখন মুড়কী মাদুলীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, "এইটা বাঁধা দিয়ে বা বেচে টাকার জোগাড় ক'রো|"
     কেষ্ট বিস্মিতকণ্ঠে বলিল, "এটা বেচে? কেন সুবা?"
     সুবা বলিল, "কেন কি, এটা তো তোমাদেরি, কেন দিয়েছিলে মনে পড়ে না?"
     মনে খুবই ছিল| আজ আবার সে কথাটা নূতন করিয়া মনে হওয়ায় একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস বুকের কাছে ঠেলিয়া উঠিল| কেষ্ট সেটাকে বুকে চাপিয়া রাখিয়া হাত ধুইল এবং মাদুলীছড়াটা লইয়া সুবার পায়ের কাছে রাখিয়া দিল| সুবা জিজ্ঞাসা করিল, "কি কেষ্ট দাদা?"
     কেষ্ট মুখ নীচু করিয়া বলিল, "তুই নিয়ে যা সুবা!"
     সুবা তীব্রদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, "তুমি নেবে না?"
     কেষ্ট বলিল, "ও তোকে দেওয়া হয়েছে|"
     সুবা বলিল, "ছিঃ!"
     কেষ্ট হাঁড়ীতে বাটনা গুলিয়া ঢালিয়া দিল| সুবা কিয়ৎক্ষণ গভীরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর গহনাটা তুলিয়া লইয়া বলিল, "নেবে না?"
     কেষ্ট বলিল, "তুই নিয়ে যা|"
     সুবা উঠানে নামিতে নামিতে ক্রোধরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, "নেবে না তো ফেলে দেব? কিন্তু এই পর্য্যন্ত কেষ্ট দাদা, যে রকমে পারি, তোমার বারোটা টাকা যদি ফেলে না দিই-"
     কেষ্ট ডাকিল, "শোন্ সুবা|"
     সুবা দাঁড়াইল| কেষ্ট হাত পাতিয়া বলিল, "দে|"
     সুবা তাহার হাতে মুড়কী-মাদুলী দিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল| কেষ্ট তাহা বাক্সে তুলিয়া রাখিয়া পুনরায় রন্ধনকার্য্যে প্রবৃত্ত হইল|
     সেই দিন কেষ্টধন বৃন্দাবন লাহার হাতচিঠায় সহি দিয়া ষোল টাকা কর্জ্জ লইয়া এবং পরদিন মাল গস্ত করিবার জন্য কৃষ্ণনগরে গমন করিল|
                                               [৩]

    বছর দুই হইতে পাল মহাশয় জগন্নাথ গাঙ্গুলীর গাঁজা ও আফিমের দোকানটা উচ্চ ডাকে ডাকিয়া লইয়া চালাইয়া আসিতেছিলেন| হিসাব নিকাশে পাল মহাশয়ের তেমন দক্ষতা ছিল না| ইন্স্পেক্টর তদারকে আসিয়া কয়েকবার খাতার ভুল শুধরাইয়া দিয়া গেলেন| কিন্তু সেবারে ভুল শোধরান লইয়া ইনস্পেক্টরের সহিত পাল মহাশয়ের একটু বচসা হইল| ইহার ফলে শীঘ্রই কলেক্টরী আফিস হইতে খাতা তলব হইল|
     পাল মহাশয় খাতাপত্র লইয়া কৃষ্ণনগরে কলেক্টরী কাছারীতে উপস্থিত হইলেন| কলেক্টর সাহেব খাতায় কাটাকূট দেখিয়া তাঁহার ২০ টাকা অর্থদণ্ডের হুকুম দিলেন| টাকাটা সেই দিনই জমা দিতে হইবে, নতুবা হাজতবাস অনিবার্য্য| পাল মহাশয় টাকা সংগ্রহের জন্য ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন| পাল মহাশয় টাকার জন্য যখন উদ্ভ্রান্তভাবে ছুটিয়া বেড়াইতেছিলেন, তখন সহসা একটা দোকান হইতে কেষ্ট তাঁহাকে ডাকিল| কেষ্টকে দেখিয়া তিনি হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন, "কে, কেষ্টধন? এখানে কেন বাবা?"
     কেষ্ট বলিল, "মাল কিনতে এসেছি|"
     পাল মহাশয় অকূলে কূল দেখিতে পাইলেন| তিনি ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, "মাল কেনা হ'য়েছে কি?"
কেষ্ট বলিল, "না, এই দেখা শোনা হচ্চে|"
     পাল মহাশয় সহর্ষে বলিলেন, "তা বেশ হয়েছে, আজ আর মাল কিনে কাজ নেই বাবা, টাকা ক'টা আমায় দাও| আমি বাড়ী পৌঁছেই টাকা দেব, কাল তখন মাল নিয়ে যাবে|"
     কেষ্ট একটু আশ্চর্য্যান্বিত হইল| পাল মহাশয় তখন তাহাকে আপনার বিপদের কথা জানাইলেন এবং অকূলের কাণ্ডারী ভগবানই এ সময়ে তাহাকে এখানে পাঠাইয়াছেন, ইহাও উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন| কেষ্ট কিন্তু পাল মহাশয়কে কতকটা চিনিয়াছিল, সুতরাং সে একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল| তখন পাল মহাশয় তাহার হাত দুইটা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, "বাবা কেষ্টধন, আমাকে রক্ষা কর বাবা, আমার মান ইজ্জত সব যায়| আমি বাড়ী পৌঁছে ঘরের ঘটী-বাটী বেচেও যদি তোর টাকা ফেলে না দিই, তবে আমি মুচির সন্তান!"
     কেষ্ট পেটের কাপড় হইতে একখানা দশটাকার নোট এবং আটটি টাকা খুলিয়া পাল মহাশয়ের হাতে দিল| পাল মহাশয় তাহাকে ধন্যবাদ দিবার অবসর পাইলেন না, টাকা লইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে কাছারীর দিকে ছুটিলেন| কেষ্ট এক পয়সার মুড়ি কিনিয়া জল খাইয়া ঘরে ফিরিল|  
     পরদিন কেষ্ট টাকাটা চাহিতে গেলে পাল মহাশয় বলিলেন, "এই সারাটা দিন তোমার টাকার চেষ্টাতেই ঘুরে বেড়াচ্চি বাবা, তা কোথাও কিছু হ'লো না| লোকে চিৎহস্ত করলে সহজে কি উপুড় হাত করতে চায়? কালের দোষ! গণশা মাঝি সোমবার বলেছে, পাওয়া গেলেই তোমাকে দিয়ে আসব, তাগাদা করতে হবে না|
     তারপর তিনি গৃহিণীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, "আহা বড় ভাল ছেলে, সে দিন আমার বিপদের কথা শুনে তাড়াতাড়ি টাকা বার করে দিলে| বল্লে, তা পাল মশায়, আপনার বিপদ যা, আমার বিপদও তা| তাহা বড় ভাল ছেলে, বেঁচে থাক্, তবু বিষ্টুচরণের নামটা থাকবে|"
     পাল মহাশয় একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিতে লাগিলেন, "কপাল! তা নৈলে আজ কি কেষ্ট আমাদের অপর পর হ'য়ে থাকতো! মেয়েটারও বরাত| কোথায় আজ সুখে ঘর-ঘরকন্না করবে, তা নয় বিধবা হ'য়ে আমার ঘাড়ে এসে পড়লো|
     সশব্দে আর একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া পাল মহাশয় গামছার খুঁটে শুষ্ক চক্ষুটা একবার মুছিলেন| কেষ্ট আপ্যায়িত ও হতভম্ব হইয়া ঘরে ফিরিয়া গেল|
     যথেষ্ট আপ্যয়িত হইলেও কেষ্ট বুঝিল, পাল মহাশয়ের নির্দিষ্ট সোমবার দুই চারি মাসেও আসিবে কি না সন্দেহ| এ দিকে ঘরে মাল নাই, ব্যবসা বন্ধ| অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কেষ্ট শেষে বাক্স হইতে মুড়কি-মাদুলী ছড়াটি বাহির করিল, এবং তাহা চৈতন্য পোদ্দারের দোকানে পনেরো টাকায় বাঁধা দিয়া মাল গস্ত করিতে গেল|

                                            [৪]

    মাল গস্ত করিয়া কেষ্ট যখন ফিরিল, তখন সন্ধ্যা হইয়াছে| অন্ধকার দাবার উপর মোটটা নামাইয়া কেষ্ট সবেমাত্র ঘরের চাবী খুলিতেছে, এমন সময় চৈতন্য পোদ্দার লাঠি ধরিয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল, উচ্চকণ্ঠে ডাকিল, "কেষ্ট, কেষ্ট বাড়ীতে?"
     কেষ্ট চাবী ঘুরাইতে ঘুরাইতে মুখ ফিরাইয়া উত্তর দিল, "কে, পোদ্দার মশাই?"
পোদ্দার রুক্ষস্বরে বলিল, "হাঁ, আজ সমস্ত দিনে তোমার বাড়ী তিনবার এসেছি| বাপু আমাদের বিশ্বাস নিয়ে কাজ কারবার| তুমি বিষ্ণুচরণের ছেলে, কিন্তু তোমার এই কাজ?"
     কেষ্ট আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিল, "কেন পোদ্দার মশাই, আমি কি করেছি?"
     পোদ্দার চড়া-গলায় বলিল, "কি করেছ? চুরী, জচ্চুরী, দমবাজী, যা কিছু সবই করেছ| বাপু, দমবাজীর কি আর জায়গা পেলে না? আমার কাছে চোরাই মাল বাঁধা রাখতে গিয়েছ?"
     কেষ্ট সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, "চোরাই মাল!"
     পোদ্দার বলিল, "আস্ত চোরাই মাল| বলি, মুড়কি-মাদুলীটা কার? এতক্ষণ যে আমার হাতে দড়ি পড়তো| শুধু পাল মহাশয় ভাল লোক বলেই আমাকে রেয়াৎ করেছেন| এখন পুলিশ ডেকে যদি তোমাকে ধরিয়ে দেওয়া যায়, তা হইলে কি হয় বল দেখি?"
     কেষ্ট ভীত-স্তভিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল| এমন সময় পাল মহাশয় এবং গ্রামের পঞ্চায়েৎ তমিজউদ্দীন মুন্সী বাড়ীতে ঢুকিলেন| পোদ্দার বলিল, "এই যে পাল মশায়, এই নিন আপনার আসামী, এখন আমাকে রেহাই দেন|"
মুন্সীসাহেব কেষ্টর দিকে চাহিয়া তর্জ্জন করিয়া বলিলেন, "হাঁ হে কেষ্ট, ভদ্দরলোকের ছেলে তুমি, তোমার এই কাজ?"
কেষ্ট নীরব, নিস্পন্দ| মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, "এই গয়না তুমি পোদ্দারের দোকানে বাঁধা দিয়েছ?"
     কেষ্ট উত্তর দিল, "হাঁ|"
     মু| এ কার গয়না? তোমার?
     কে| না|
     মু| তুমি পেলে কোথায়?
     কেষ্ট নিরুত্তর| মুন্সী সাহেব আরও দুই তিনবার প্রশ্ন করিলেন, কিন্তু কোন উত্তর পাইলেন না| তখন তিনি তাহাকে পুলিশে দিবার ভয় দেখাইলেন| পাল মহাশয় মাঝ হইতে বলিলেন, " যেতে দিন মুন্সী সাহেব, পাবে আর কোথায়, চুরি করেছে, সেটা কি আর নিজের মুখে বলতে পারে| যাক্, এবারকার মত ছেড়ে দিন, ছোঁড়াটা জন্মের মত দাগী হ'য়ে যাবে|"
     মুন্সী সাহেব তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলেন| তখন পাল মহাশয় কেষ্টকে তিরষ্কার করিয়া বলিল, "হাঁ, হে কেষ্ট, তোমার এমন স্বভাব হ'লো কেন? ভাল ছেলে বলে ঘরে দোরে যেতে দিই; ছি ছি, তোমার এই কাজ|"
     কেষ্ট কোন উত্তর দিল না, একটুও নড়িল না, শক্ত কাঠের মত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল| পোদ্দার বলিল, "আপনার জিনিষ তো আপনি পেলেন, এখন আমার টাকা?"
     পাল মহাশয় সদম্ভে বলিলেন, "আপনার টাকা যাবে কোথায়? ওর ঘর ভিটে বেচে আদায় করে দেব| ছোঁড়া দেশ শুদ্ধ লোকের কাছে ধার করেছে, বুঝলেন মুন্সী সাহেব| লাহাদের দোকানে কত টাকা, আর কার কার আছে-"
মুন্সী সাহেব বলিলেন, "অভাবে স্বভাব নষ্ট| কিন্তু পাল মশায়, বারদিগর এমনতর হলে আমি ছেড়ে দেব না তা বলে রাখছি|"

                                            [৫]


     খানিক পরে সুবা আসিয়া মৃদুকণ্ঠে ডকিল, "কেষ্টদাদা!"
     কেষ্ট তখন ঘরে আলো জ্বালিয়া তামাক সাজিয়া কলিকায় ফুঁ দিতেছে| সে চমকিত হইয়া উত্তর দিল, "কে সুবা?"
     সুবা বলিল, "হাঁ, আমি| তুমি শেষে চোর হ'লে?"
     কেষ্ট সহাস্যে উত্তর দিল, "হ'লাম বা!"
     সুবা বলিল, "মনে ছিল না|"
     সু| তোমার তো আচ্ছা মন দেখছি|
     কে| আচ্ছা ব'লে আচ্ছা, বহুৎ আচ্ছা, এখন তুই ঘরে যা দেখি|
     সু| কেন?
     কে| একবার তো চুরীর ফ্যাসাদে ফেলেছিলি, আবার কি ডাকাতীর মামলায় পড়বো| রাত হ'য়েছে, ঘরে যা|
সুবা কথাটার মর্ম্ম বুঝিল, বুঝিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল| যাইতে যইতে শুনিল, কেষ্ট আপন মনে গাহিতেছে,-
     "পার করো পার করো ব'লে ডাক্চি বারে বারে|
     (মাঝি) বেলা গেলো সন্ধ্যে হ'লো যাবো দেশান্তরে||"          

                             

নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য

( 'নারায়ণ' পত্রিকা, ফাল্গুন, ১৩২৪ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।