গ্রাম্য দলাদলির
প্রবল উত্তেজনা, ২নং দেওয়ানী ও ১নং ফৌজদারী মোকদ্দমা ফেলিয়া
এবং দশ বৎসরের ছেলে জগবন্ধুকে সাড়ে সাতশত টাকা ঋণের উত্তরাধিকারী
করিয়া দলের প্রধান মুরুব্বি শিবু হালদার যে দিন মহাবিচারকের
উচ্চ আদালতে জবাবদিহি করিবার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাত্রা করিতে
বাধ্য হইলেন, সে দিন তাঁহার নাবালক পুত্র ও বিধবা পত্নীকে দেখিবার
জন্য উপরে রহিলেন ভগবান্, আর নীচে রহিল গদাই মাঝি|
হালদার মহাশয়ের মৃত্যুতে গ্রামের সমাজ-বক্ষে
হর্ষ-বিষাদ উভয়বিধ তরঙ্গই প্রবাহিত হইল| কেহ কেহ আলোচনা করিয়া
বলিল, "আহা, গাঁয়ের একটা চূড়া খসে গেল|" কেহ বা আশা
করিল, এত কাল পরে বোধ হয় গাঁয়ের দলাদলিটার অবসান হইল| হইলও তাহাই|
দলের কর্ত্তা ও প্রধান উৎসাহদাতা যখন চক্ষু মুদিলেন, তখন আর
দল চালায় কে? সুতরাং একাদিক্রমে ঊনিশ বৎসরের স্থায়ী দলাদলিটা
রামজয় ঘোষের পুত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে এক কথায় মিটিয়া গেল|
ঝড়ে বড় গাছটা ভাঙ্গিয়া পড়িলে তাহার শাখাশ্রয়ী বিহঙ্গকুল যেমন
বৃক্ষান্তরের আশ্রয় গ্রহণ করে, তেমনই হালদার মহাশয়ের মৃত্যুতে
তাঁহার দলের লোকগুলি একে একে প্রতিপক্ষ গোবিন্দ রায়ের আশ্রয়
গ্রহণ করিল| গ্রামের কাজের লোক যাহারা, তাহারা নিশ্বাস ফেলিয়া
বাঁচিল আর নিষ্কর্ম্মা লোকেরা অতঃপর কি উপায়ে দিন গুজরাণ করিবে
তাহারই চিন্তায় বিমর্ষ হইয়া পড়িল|
ফরিয়াদীর মৃত্যুতে ফৌজদারী মোকদ্দমা খারিজ
হইয়া গেল| দেওয়ানী মোকদ্দমায় গোবিন্দ রায় জয়লাভ করিলেন, কিন্তু
ঢাক ঢোল বাজাইয়া বুড়াশিবের পূজা দিয়া বিপক্ষ শিবু হালদারের মাথাটাকে
ভূমিসাৎ করিয়া দিবার সুযোগ না পাওয়ায় তিনি জয়ের আনন্দটা সম্পূর্ণ
উপভোগ করিতে পারিলেন না|
মহাজন দেনার দায়ে জমি জায়গা বেচিয়া সুদ-আসল
বুঝিয়া লইয়া গোবিন্দ রায় নীলামে উঁচু ডাকে শিবু হালদারের খিড়কীর
পুকুরটা কিনিয়া লইলেন| বাকী রহিল কেবল ভিটাটা, আর কয়েক কাঠা
ডাঙ্গা জমি এবং তিন চারি বিঘা ধান-জমি| এগুলা গৃহিণীর নামে বেনামী
করা ছিল, বলিয়াই মহাজনের কবল হইতে আত্মরক্ষা করিয়া হালদার মহাশয়ের
গৃহিণীর এবং নাবালক পুত্রের দিন পাতের উপায় করিয়া দিল|
জমি জায়গা গেল, গরু বাছুর গেল, কিন্তু চাকর
গদাই গেল না| সে খুঁটি গাড়িয়া বসিয়া নির্ব্বিকার চিত্তে আপনার
কাজ করিতে লাগিল| গৃহিণী একদিন তাহাকে যাইবার কথা বলায় গদাই
এমন কড়া-কড়া কথা শুনাইয়া দিয়াছিল, গৃহিণী আর কখনও গদায়ের নিকট
এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে সাহস করেন নাই| লোকে জিজ্ঞাসা করিত,
হ্যাঁরে গদা, গরু বাছুর সব গেল, কিন্তু তুই গেলি না যে?"
গদাই চড়া গলায় উত্তর করিত, "আমি কি
তোদের মত গরু, বাছুরের সামিল?"
চাষবাস নাই, তুই আর থেকে করবি কি?"
মনিব বাড়ী ত আছে; বাড়ীর কাজ করব|"
লোকে ভাবিত, গদাই একটা প্রকাণ্ড নির্ব্বোধ|
গদাই মনে করিত, লোকগুলো কি পাজী! হায় রে কলি!
আর সকলে গদাইকে নির্ব্বোধ স্থির করিলেও গোবিন্দ রায় তাহাকে বিলক্ষণ
চিনিতেন| এজন্য তিনি গদাইকে হাত করিবার জন্য অনেক চেষ্টাই করিয়াছিলেন|
কিন্তু তাঁহার চেষ্টা সফল হইল না| বড় মাকে এবং জগাকে ছাড়িয়া
গদাই কোথাও যাইতে রাজি হইল না| রায় মহাশয় তখন গদায়ের স্ত্রী
ভগীকে ধরিয়া বসিলেন| মেয়েমানুষ, সহজেই জেদাজেদি করিতে লাগিল|
গদাই কিন্তু কোন প্রলোভনেই ভুলিল না| তখন স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া
বাধিয়া গেল| ভগী বলিল, "চাকরী করবি না তো কর্বি কি? ঘরের
খেয়ে বনের মোষ তাড়াবি?"
গদাই বলিল, "আমার খুসী| তোর ভেয়ের
খাই?"
ভগী বলিল, "আমি কিন্তু ধান ভেনে এনে
তোকে খাওয়াতে পার্ব না"|
"না পারিস পথ দেখ|"
"আমি যেন পথ দেখব; তোর ব্যা-টা-?"
গদাই বসিয়াছিল, উঠিয়া দাঁড়াইল; বিকট ভ্রূভঙ্গী
করিয়া বজ্রকঠোর স্বরে বলিল, "ধ্যেৎ তোর ব্যাটা| ব্যাটা
আগে না সাক্ষাৎ ধর্ম্ম মুনিব আগে? তুই তখন কোথা রে মাগী, আর
তোর ছেলেই বা কোথা, য্যাখন পাঁচ বছরের বেলায় মা মরে গেল, বড়
মা-ঐ বামুনের মেয়ে - মুখের খাবার দিয়ে এই চাঁড়ালের ছেলেটাকে
মানুষ করলে? আর আজ কি না তুই মাগী পয়সা দেখাস! সেই বড় মাকে ছেড়ে
যেতে বলিস্? পাজী মাগী-নচ্ছার|"
বলিতে বলিতে গদায়ের বড় বড় চোখ দু'টা রাগে
জ্বলিয়া ও জলে ভরিয়া উঠিল| গদাই বসিয়া পড়িয়া, দুই হাতে রগ চাপিয়া
ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া উঠিল|
স্বামীকে কাঁদিতে দেখিয়া ভগী ভ্যাবাচাকা
লাগিয়া নরম হইয়া গেল| বলিল, "আমি কি তাই বলচি; আমি বলি
ওখানেও কাজ কর, আর এনাদেরও দেখ শোন|"
গদাই কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া অশ্রুশিক্ত
দৃষ্টিতে ভগীর দিকে চাহিয়া বলিল, "আমি তা পারব না ভগী,
আমি গেলে জগা ছোঁড়ার লেখা-পড়ার দফা রফা| ছোঁড়া, যদি টেনে বুনে
দু'কলম লিখতে পারে, তবু বাপের নামটা রাখবে| আমি চলে গেলে কি
সে লেখা-পড়া কর্বে! আর তুই কি রায় মোশায়ের মতলব বুঝতে পারিস
নে?"
ভগী বলিল, "কিন্তু চলবে কি ক'রে?"
গদাই মুখভঙ্গী করিয়া বলিল, "দূর হ
মাগী, এতটা বয়সে এই বুঝি তোর আক্কেল হ'ল! কে কার চালায়? যে চালাবার
সেই চালাবে, তোর আমার বাবারও সাদ্দি নেই যে, একটা বেলা চালাই;
বুঝলি? রায় মোশায়ের অত পয়সা ক'টা লোকের চালিয়ে দিচ্চে?"
বুঝুক না বুঝুক, ভগী আর কোন প্রতিবাদ করিল
না|
ইহার পর একদিন সে রায় মহাশয়ের প্রশ্নের
উত্তরে বলিয়াছিল, " না বাবু, আমরা চাষা নোক, অধম্ম কত্তে
পারবুনি!"
চাষের কাজ না থাকিলেও গদাই যে বসিয়া থাকিত,
তাহা নহে| সংসারের সামান্য খুঁটিনাটি কাজ লইয়া সে এত ব্যস্ত
থাকিত যে, তাহার আহার-নিদ্রারও সময় থাকিত না| সে কোথাও মাটী
খুঁড়িয়া শাক বুনিত, কোথাও কুমড়ার চারা বসাইত, কোথাও বা লাউগাছের
মাচা বাঁধিত| যে কয়েক কাঠা ডাঙ্গা জমি ছিল, তাহাতে বেগুণ গাছ
বসাইত, কলাই বুনিয়া দিত| লাঙ্গলের প্রয়োজন ছিল না| গদায়ের হাতে
কোদালই কার্য্য করিত|
গদায়ের এই বিরামবিহীন পরিশ্রমের ফলে এত
অভাবের মধ্যেও গৃহিণীকে বড় একটা কষ্ট অনুভব করিতে হইত না| দিন
একরূপ সুখে দুঃখে গুজরাণ হইত|
গদায়ের মনে কিন্তু বড় একটা কষ্ট ছিল| তাহা
জমি জায়গা যাওয়ার জন্য নয়, খিড়কী পুকুরটা রায় মহাশয়ের হাতে যাওয়ার
জন্য| পুকুরটা যাওয়া অবধি জগাকে মাছ কিনিয়া খাইতে হইত, আর রায়
মহাশয়ের লোক আসিয়া পুকুর হইতে রাশি রাশি মাছ ধরিয়া লইয়া যাইত|
কাজের একটি ফুরসৎ পাইলেই গদাই জাল হাতে বাহির হইত, এবং খাল বিল
হইতেই কোঁচড় ভরিয়া মাছ ধরিয়া আনিত| তার পর কোন মাছটা কিরূপে
রাঁধিতে হইবে, কোন মাছের কোন্ অংশটা জগা বেশী ভালবাসে, তাহা
বড় মাকে বিশদরূপে বুঝাইয়া দিত| জগা খাইতে বসিলে সে একটু তফাতে
বসিয়া জগাকে মাছ খাওয়াইত এবং খুড়োঠাকুরের আমলে প্রভু ভৃত্যে
বাহির হইয়া কিরূপে বড় মাছগুলা শীকার করিয়া আনিত, হাট পুকুরে
মাছ ধরিতে গিয়া সেবার ভূতের হাতে কিরূপে নিগৃহীত হইয়াছিল, বড়
মাকে সেই সকল গল্প শুনাইত| আর মধ্যে মধ্যে জগাকে আরও মাছ দিবার
জন্য অনুরোধ করিত| জগা বেশী মাছ খাইতে আপত্তি প্রকাশ করিলে সে
দাদাভাই বলিয়া আদর করিয়া, ধমক দিয়া, চোখ রাঙ্গাইয়া, ইচ্ছামত
মাছ খাওয়াইত| গদা দাদার ভয়ে জগাকে মাথা গুঁজিয়া দাদার ইচ্ছা
পালন করিতে হইত| প্রভুপুত্র এবং ব্রাহ্মণ সন্তান হইলেও জগাকে
মধ্যে মধ্যে গদাদা'র চড় চাপড়ের আস্বাদ অনুভব করিতে হইত|
জগার মাছ খাইতে আপত্তি দেখিয়া, গৃহিণী যদি
বিরক্তভাবে বলিতেন, "না খেতে পারে থাক, বাদলার জন্য নিয়ে
যা|" তাহা হইলে গদাই মাথা নাড়িয়া বলিত, "এতো আর তোমার
বাবার পুকুরের মাছ নয় যে যাকে ইচ্ছে বিলিয়ে দিবে|"
চাঁড়ালের ছেলের মুখে এইরূপ পিতৃ-উচ্চারণ
শুনিয়াও গৃহিণী হাসিয়াই ফেলিতেন| সেকাল আর একাল!
গদাই যে জগাকে কেবল আদর যত্নই করিত, তাহা নহে| কঠোর প্রকৃতি
অভিভাবকের ন্যায় তাহাকে শাসনও করিত| পিতৃহীন হওয়াও জগা যে স্কুলে
যাইত, তাহা কেবল গদা দাদার ভয়ে| কোন দিন যদি জগা স্কুলে যাইতে
আপত্তি প্রকাশ করিত, তাহা হইলে গদাই তাহার কান ধরিয়া হিড়-হিড়
করিয়া টানিয়া লইয়া যাইত| একে চাকর তায় চাঁড়ালের ছেলের এতদূর
স্পর্দ্ধা দেখিয়া কোন কোন প্রতিবেশিনীর গাত্রদাহ উপস্থিত হইত|
তাঁহার গৃহিণীর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিতেন, "হ্যাঁগা জগার
মা, চাঁড়াল হ'য়ে বামুনের ছেলের কান ধরে, আর তুমি কিছু বল না?"
গৃহিণী হাসিয়া উত্তর করিতেন, "কি করব মা, ওর ওপর কি কথা
কবার যো আছে|"
গৃহিণীর মুখে হাসি দেখিয়া উপদেশদাত্রীরা
হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া যাইতেন, কিন্তু নিজের ছাগশিশুকে লাঙ্গুলের
দিকে ছেদন করিলে অপরের তাহাতে বাধা দিবার অধিকার নাই ভাবিয়া
তাঁহার নিরস্ত হইতেন|
এক দিন গৃহিণী এ সম্বন্ধে গদাইকে সাবধান
হইতে বলিয়াছিলেন| শুনিয়া গদাই রাগে হাত মুখ নাড়িয়া উত্তর করিয়াছিল,
"আরে মোর বামুনের ছেলে! বামুনের ছেলে নেখা পড়া করবে না,
আর আমি চুপ করে তাই দেখব|"
গৃহিণী বলিয়াছিলেন, "কিন্তু ওতে যে তোর পাপ হয়|"
গদাই বলিল, "পাপ হয় আমার হবে, আমিই
না হয় নরকে যাব, কিন্তু ও ছোঁড়া তো মানুষ হবে| আর আমি চাঁড়ালের
ছেলে কিসে? আমায় মানুষ করেছে কে? জগার কি আমি মিথ্যে দাদা?"
"কিন্তু লোকে যে দোষ দেয়|"
"দোষ দেয় দেবে| গদাই মাজি কারও পরচালায়
ঘর করে না| তোমার মনে আজ কাল বুঝি ঐ সব হচ্ছে?"
এ কথার পর গৃহিণী মূক হইয়া গেলেন|
রায় মহাশয কেবল যে গদাইকে হাত করিতে
পারিলেন না, এমন নহে, তাহার নিকট এমন একটু আধটু অসম্মানজনক ব্যবহার
পাইলেন, যাহাতে গদাকে দমন করাই তাঁহার প্রধান কার্য্য হইয়া উঠিল|
কিন্তু তিনি এই নীচ জাতীয়ের সহিত সম্মুখযুদ্ধে অগ্রসর হওয়া সঙ্গত
মনে করিলেন না; কৌশলে তাহার সর্ব্বনাশ করিতে স্থির করিলেন|
রায় মহাশয় অনুমান করিতেন, তাঁহার নব-ক্রীত পুষ্করিণীর মাছ কেহ
গোপনে ধরিয়া খায়| এজন্য তিনি মাঝে মাঝে পুকুর দেখিতে আসিতেন,
এবং পুকুরের পাড়ে দাঁড়াইয়া অশ্রাব্য ভাষায় কাল্পনিক চোরের উদ্দেশ্যে
গালিবর্ষণ করিতেন| সে গালাগালির প্রত্যেক কথাটাই গৃহিণীর কানে
যাইতে| তিনি বাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া কাঁদিতে থাকিতেন| গদাইও সে
গালাগালি দুই একদিন শুনিল, বড় মাকে কাঁদিতে দেখিল| তাহার আর
সহ্য হইল না| সে রায় মহাশয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দুই হাত জোড়
করিয়া অবিলম্বে বলিল, " দেখুন রায় মোশাই, আপনকারা ভদ্দর
নোক, আপনকারদের মুখের জোর বেশী; কিন্তু আমরা ছোটনোক, আমাদের
মুখের চেয়ে হাতটাই বেশী চলে, এই বলে রাখলাম কিন্তু|"
সেই দিন হইতে রায় মহাশয়ের গালাগালি আর শুনা গেল না বটে, কিন্তু
কয়েক দিন পরে তাঁহর চাকর আসিয়া পুকুরের চারি ধারে এমন কাঁটা
গাছ ফেলিয়া গেল যে,পুকুরের ঘাট-সরা পর্য্যন্ত বন্ধ হইল| নিকটে
আর পুকুর ছিল না, সুতরাং গৃহিণী গদাইকে বলিলেন, "কি হবে
রে গদা?"
গদাই গিয়া আস্তে আস্তে কাঁটা গাছগুলিকে
একত্র করিয়া বোঝা বাঁধিল; তারপর সেই বোঝা মাথায় তুলিয়া রায় মহাশয়ের
বাড়ীর দরজায় ফেলিয়া দিয়া আসিল| রায় মহাশয় বৈঠকখানায় বসিয়া ইহা
দেখিলেন, কিন্তু একটা কথাও বলিতে সাহস করিলেন না| গলায় গামছা
দিয়া গদাই তাঁহাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিল|
ঘাটের ধারে একটা আম গাছ ছিল| গাছটা পুকুরের
সামিল কি ভিটার সামিল, তাহার কোন মীমাংসা হয় নাই| সেই গাছের
আম পাড়িয়া আনিবার জন্য রায় মহাশয় চাকরকে পাঠাইয়া দিলেন| চাকর
আম পাড়িতে আসিল, কিন্তু গদাই তাহাকে মারিয়া তাড়াইয়া দিল, এবং
গাছের সব আম পাড়িয়া আনিয়া উঠানে ঢালিল|
পরদিন সকালে রায় মহাশয় আট দশজন লোক গাছটা
কাটিতে আসিলেন| গদাই তখন বেগুন বাড়ী কোপাইতে গিয়াছিল| জগা কাঁদিতে
কাঁদিতে গিয়া তাহাকে এ সংবাদ দিল| গদাই শুনিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে
ছুটিয়া আসিল, এবং বড় ঘরের দরজার আড়া হইতে পাকা বাঁশের লাঠিখানা
পাড়িয়া লইয়া উঠানে লাফাইয়া পড়িল| কিন্তু সে বাহির হইতে পারিল
না; গৃহিণী ছুটিয়া গিয়া খিড়কী দরজা বন্ধ দরজার পাশে আড় হইয়া
পড়িলেন| গদাই তাঁহাকে সরিয়া যাইবার জন্য মিনতি করিল, ধমক দিল,
কিন্তু তিনি উঠিলেন না; উচ্চস্বরে বলিলেন, "চুলোয় যাক্
আম গাছ, আমার জগাকে ওখানে কেটে ফেল্লেও আমি দরজা খুলব না|"
ওদিকে আম গাছের উপর কুড়ালির চোট ধপাধপ্
শব্দে পড়িতে লাগিল| গদাই সে চোটগুলো যেন আপনার বুকের উপর পড়িতেছে
অনুভব করিল| ক্রোধে ক্ষোভে গর্জ্জন করিতে করিতে সে উঠানময় পাগলের
মত ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল; তীব্র-ভাষায় বড় মার পিতৃকুলের কাপুরুষতা
সম্বন্ধে সুতীব্র মন্তব্য ব্যক্ত করিতে থাকিল; কিন্তু বড় মা
তাহাতে কাণ দিলেন না, দরজা ছাড়িয়া উঠিলেন না|
তারপর গাছটা যখন ছিন্নমূল হইয়া মড় মড় শব্দে
পড়িয়া গেল, তখন গদাই উঠানের মাঝখানে বসিয়া পড়িয়া হাউ-হাউ করিয়া
কাঁদিয়া উঠিল| কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, "খুড়োঠাকুর নিজের
হাতে গাছটা রুয়েছিল গো!"
পরদিন গদাই যখন মাঠে যাইতেছিল, তখন রায় মহাশয় তাহাকে ডাকিয়া
বলিলেন, "তোর বাবার গাছটাকে কাটল কে রে গদা?"
গদাই রোষকষায়িত নেত্রে রায় মহাশয়ের দিকে
চাহিল| রায় মহাশয় হাসিতে হাসিতে বলিলেন, "তোর মা বেরিয়ে
গাছটা রাখতে পারলে না?"
গদাই দাঁতে দাঁতে করিয়া বলিল, "আপনি বামুন, না চামার?"
"তবে রে হারামজাদা" বলিয়া মহাশয়
গদায়ের গণ্ডদেশে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিলেন| গদাই আহত ব্যাঘ্রের
ন্যায় গর্জ্জন করিয়া উঠিল, এবং এক হাতে রায় মহাশয়ের গলাটা, অপর
হাতে তাঁহার পা দুইটা ধরিয়া শূন্যে তুলিয়া পাশের জমিতে ফেলিয়া
দিল| আশে পাশে অনেক কৃষাণ কাজ করিতেছিল; তাহাদের কেহ বা হাসিয়া
উঠিল, কেহ কেহ বা ছুটিয়া আসিয়া রায় মহাশয়কে তুলিয়া ঘোলাজলে তাঁহার
গায়ের কাদা ধুইয়া দিতে লাগিল| গদাই দুই হাতে তাঁহার পায়ের ধুলা
লইয়া বলিল, "অপরাধ নিও না রায় মোশাই, রাগের মাথায় গায়ে
হাত দিয়ে ফেলেছি| চাঁড়ালের রাগ কি না!"
গদাই চলিয়া গেল| রায় মহাশয় সম্মুখবর্ত্তী
কৃষাণদের দিকে ক্রুদ্ধ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, "দূর
বেটারা নেমকহারামের দল|"
ইহার দুই তিন মাস পরে রাইপুরের ডাকাতি মোকদ্দমার
সংস্রবে যে দিন পুলিশ আসিয়া গদাই মাঝির হাতে হাতকড়ি লাগাইল,
সে দিন গ্রামের অনেকেই বিস্মিত না হইয়া থাকিতে পারিল না| গদায়ের
কুঁড়ের ভিতর খানাতল্লাসী ত হইলই, শিবু হালদারের বাড়ীও ফাঁক গেল
না| বাক্স পেঁটারা ভাঙ্গিয়া, চাল-ডাল ছড়াইয়া যখন মহা উৎসাহে
খানাতল্লাসী চলিতেছিল, গৃহিণী তখন রানাঘরের এক কোণে বসিয়া যুক্তকরে
আকুল হৃদয়ে ডাকিতেছিলেন, "হে বাবা হরি, হে মা কালি, গদাকে
রক্ষা কর ঠাকুর!"
ঠাকুরের মনে কি ছিল ঠাকুরই জানেন; গদাই
রক্ষা পাইল না; খানাতল্লাসী শেষ করিয়া পুলিশ তাহাকে চালান দিল|
যাইবার সময় গদাই ক্রন্দনপরায়ণা ভগীর দিকে চাহিয়া বলিল, "বড়
মা রইল ভগী, জগা রইল, তাদের দেখিস্|"
যথাসময়ে দায়রার বিচারে গদাই অন্যান্য ডাকাতদের
সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য কারাগারে গমন করিল| দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত
হইয়া গদাই যখন জেলে যায়, তখন জনৈক উকীল দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন,
"লোকটা বিনা দোষে জেলে গেল| আমার হাতে যদি কেসটা পড়ত?"
গদাই তাঁহার দিকে চাহিয়া সবিনয়ে বলিয়াছিল,
"না হুজুর, ভগবান্ বিনি দোষে কাউকে সাজা দেন না| আমার পাপ
আছে, আমি বামুনের গায়ে হাত দিয়েছিলাম| ঘোর কলি, তবু এখনো দেবতা
বামুন আছেন|"
গদাই আপনার শৃঙ্খলাবদ্ধ যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করাইয়া দেবতা ব্রাহ্মণের
উদ্দেশে প্রণাম করিয়াছিল|
পাঁচ বৎসর - আজকালকার কালে সে কত দীর্ঘ
সময়! এই দীর্ঘকাল পরে একদিন শীতের স্তব্ধ সন্ধ্যায় আপনার ছিন্ন-মলিন
বাসে অঙ্গ ঢাকিয়া গদাই শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে শিবু হালদারের বাড়ীর
দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল; চীৎকার করিয়া ডাকিল, "বড় মা"
"বড় মা!", তাহার কাপড়ের এক খোঁটে বাঁধা নেবু ও নূতন
গুড়ের সন্দেশ এবং বামহস্তে থোড়ের শুঁটাতে ঝোলান সের পাঁচেক এক
রোহিত| তাহার মাথার চুলে জটা বাঁধিয়া গিয়াছে; এবং কাঁচায় পাকায়
দাড়ি আবক্ষলম্বিত|
গণশা বাগ্দী বাহির হইয়া আসিয়া বলিল-"কে
রে?"
"আমি গদাই!"
"এখানে কেন?"
"বড় মা কোথায়?"
"মারা গেছেন|"
গদাই সেইখানে বসিয়া পড়িল| গণশা বলিল, "আ
মর্, বসে পড়লি যে ?"
গদাই কাঁপিতে কাঁপিতে জিজ্ঞাসা করিল, "জগা-জগা?"
গণশা বলিল, "জগবাবু ? তিনি বাইরে গেছেন,
দু'টো পাশ করেছেন| আজ একমাস হ'ল তাঁর বিয়ে হয়েছে|"
গদাই উঠিয়া দাঁড়ালই; উৎফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, "বিয়ে
হয়েছে? কোথায় বিয়ে হ'ল?"
"রায় মশায়ের মেয়ের সঙ্গে!" গদাই
দুই হাত দিয়া মাথাটা চুলকাইতে লাগিল| একটু পরে বলিল, "ভগীর
খবর-আমার বাদলার খবর? জানিস?"
গণশা বলিল, "তোর বাদলা নেই|"
গদাই শূন্যদৃষ্টিতে গণেশের মুখের দিকে চাহিল|
জণেশ বলিল, "দুই বছর আগে জগাবাবুর ওপের মায়ের কৃপা হয়|
ভগী বুক দিয়ে প'ড়ে বাবুকে বাঁচায়| তারপরই তোর বাদলার ওঠা-নামার
ব্যারাম হল| বাদলা বাঁচল না, মা ঠাকুরোন তার সেবা করে ঐ রোগেই
গেলেন| তোর ভগী মাগীও পাগল হ'য়ে কোথায় চলে গেল|
গদাই দুই হাত দিয়া আপনার শীতবায়ুকম্পিত
বুকটা চালিয়া ধরিল| এক নবোদগত শ্মশ্রু যুবক দ্বারপ্রান্তে আসিয়া
জিজ্ঞাসা করিল, "কে রে গণশা?" গণশা বলিল, "ও
গদাই|"
গদাই সন্ধ্যার অস্পষ্টালোকে একবার যুবকের
মুখের দিকে চাহিল, তারপর ছুটিয়া তাহাকে দুই হাতে জড়াইয়া ধরিয়া
উচ্ছ্বসিত-কণ্ঠে বলিল, "জগা জগা"- জগাবাবু তাহাকে
ঠেলিয়া দিয়া তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, "মর বেটা, স্পর্দ্ধা
দেখ| বেটা ছোটলোক, ডাকাত! দূর হ! বেরো বেটা! আমার কান মলে দিত!"
জগবাবু দ্রুতপদে বাড়ীর ভিতর চলিয়া গেলেন|
বাম হস্তের তর্জ্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলীর মধ্যে চিবুক ধারণ করিয়া
সন্ধ্যার স্তব্ধ স্তম্ভিত অন্ধকারে গদাই নীরব নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া
রহিল| এক ফকির গাইতে গাইতে গেল-
মানী লোকের রাখবা মন
গরীব লোককে করবো দান
দরগায় গিয়ে ফয়তা দেবা ক্ষীর|
গণেশ আর গোটাকতক চড়া কথা শুনাইয়া গদার মুখের
উপর ঝনাৎ করিয়া সদর দরজা বন্ধ করিতে যাইতেছিল এমন সময় সাক্ষাৎ
দুর্গা প্রতিমার মত এক তরুণী তুলসী-তলায় সন্ধ্যা দিতে আসিয়াছিল,
"গদাই দাদা" বলিয়া গদায়ের হাত দুখানা নিজের দুই হাতের
মধ্যে লইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল; -গণেশ দেখিল, তাহার
প্রভুপত্নী গোবিন্দ রায়ের কন্যা-সতী!
ঠিক সেই মুহুর্তে অদূরে সন্ধ্যা-গগনে তরঙ্গ
তুলিয়া এক কৃষক গাইয়া যাইতেছিল,-
"দিন ফুরাল সন্ধ্যা হ'ল হরি পার কর
আমারে|"
(
'নারায়ণ' পত্রিকা, পৌষ, ১৩২৩ )