পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
নারী
শিবপ্রসাদ মুস্তোফি,বি,এ,
(লেখকের পরিচয় জানা যায় নি।
ভবিষ্যতে পেলে প্রকাশ করা হবে)। দীপক
সেনগুপ্ত।
প্রায়
পাঁচ বছর পরে তা’র চিঠি পেলুম। সে খিদিরপুরে বাপের বাড়ীতে এসেছে।
আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য আমাকে যেতে লিখেচে।
সকালে চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে সব কিছুই ভারী ভাল লাগচে। এমনও হয়,দীর্ঘ
পাঁচ বছর কেটে যাওয়ার পরেও স্মৃতি মরে না,সে কলকাতার এক প্রান্ত
থেকে অন্য প্রান্তে ব্যাকুল চিঠির ইসারা করে।
ফিটফাট হয়ে রাস্তায় বেরিয়েচি। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা দেশবন্ধু-পার্কের
দিকে যাচ্চে। সাঁ করে একটা বাইসিকল এক দিকে হেলে চলে গেলো। মোটরে
যাচ্চে একটি পুরুষ ও একটি নারী,দুজনেরই মুখে চোখে অত্যন্ত খুসীর
ভাব।
হ্যারিসন রোড,ওয়েলিংটন,ধর্ম্মতলা,ভবানীপুর,কালীঘাট,বলতে বলতে শ্যামবাজারের
বাস ছাড়লো। চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কত মোটর,ট্রাম,বাস। ফুটপাতে
অগণ্য নরনারী। আমাদের বাস একটু আস্তে চলচে।
হঠাৎ দেখলুম একটি বৃদ্ধ স্থানাভাবে দাঁড়িয়ে রয়েচেন। তৎক্ষণাৎ উঠে
দাঁড়িয়ে বললুম,এই যে,আপনি এইখানে বসুন না।
থাক,থাক বাবা,তুমি বসো -
সে কি হয়? আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ যাবেন ?
বৃদ্ধকে বসানো গেলো। তুমি বৃদ্ধ,তোমাকে কি কেউ আজ তার পাঁচ বছরের
অদর্শনে ব্যথা অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় লিখে জানিয়েচে ?
ধর,ধম্মতলায় বাস বদল করে ট্রামে উঠলাম। ও-দিকে ট্রামে যেতেই ভালো
লাগে,তা ছাড়া বেশ জোরেই যায়।
খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে শব্দ করে ট্রাম ছুটে চলে যায়। যেন কি এক
অভাবনীয় সম্ভাবনার দিকে মহা আনন্দে সমস্ত পৃথিবী সশব্দে ছুটে চলেচে।
বাইরে দুটি একটি ঘোরায় চড়া সাহেব দেখা যায়। কেউ বা গলফ খেলচে।
আবার সামনের সিতে দুটি তরুণী মেম বসেচে,মাথার টুপী খুলে রেখেচে,বব
করা সোনালী চুল উড়চে।
তখন সন্ধ্যা হ’তে আর বেশী দেরী নেই। যখন গিয়ে দাঁড়ালাম,দেখি ঘরের
দরজার কাছে ব’সে গা-ধোয়ার পরে মাথার খোপা ঠিক করচে। সীঁথিতে সিঁদুর।
আমাকে দেখে মাথা তুলে একবার বললে,কি ভাগ্যি।
আমি কোন উত্তর না দিয়ে ঘরের ভিতরে গিয়ে বসলাম। খোঁপা ঠিক ক’রে
এবং নিজের আরো কি কাজ শেষ করে যখন ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালো,তখন
আমার ভারী বিশ্রী লাগচে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে যার সঙ্গে দেখা হবে,সে
কোথায় ?
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ও অন্তঃসত্ত্বা।
বাইরে সন্ধ্যার আকাশে কি চাঁদ উঠলো ? আজও বোধ হয় একটি একটি করে
তারাগুলি ছড়িয়ে পড়বে।
কবি,তোমার বীণায় ছন্দের তাল কাটেনি ত ? দেখো তোমার কাব্যের শেষ
যেন সত্যের অপমান না হয়।
ওর বিবাহের সময় ভেবেছিলাম,বিধাতা মানুষের চেয়ে নিষ্ঠুর।
-কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা বলো ত,বিজনদা। ওঃ,তা প্রায় চার বছরেরও
বেশী হবে। তা তোমারা ত আর আমাদের খবর নাও না,মরে গেলেও না। মা
বলেছিলেন তুমি নাকি অনেকদিন এখানে আসো নি। মা বলেছিলেন আমি চলে
গেছি বলেই আসো না। আচ্ছা,এইবার আসবে ত ? এসো,এসো,মাঝে মাঝে -একবার
তোমার গরীব বোনটির কাছে এলে তোমার পয়সা বাজে খরচ হবে না। এখনো
সেই রকম বন্ধুদের আড্ডা আছে ত ? আচ্ছা এটাই বা তোমার কি রকম হল
শুনি ? একজামিনে যে পাশ করলে,সন্দেশ কই ? দেখো সে আমি আদায় করে
নেবোই। তুমি কি আর আমার হাত থেকে এড়ান পাবে ? হ্যাঁ,আমাকে কিন্তু
ভাই খানকতক গল্পের বই এনে দিতে হবে,বুঝলে ?
তার কথায় উত্তর দেওয়ার অবসর পেয়ে বললাম,হ্যাঁ,তার আর কি ?
গল্পের বই কিন্তু,বুঝলে ত,গল্পের বই। তোমার সেই কবিতার বই পোষাবে
না কিন্তু। এই সংসারে কি আর কবিতা করবার সময় আছে আমার ?
এমনি জিজ্ঞাসা করলাম,সময় নেই ত গল্পের বই পড়বে কখন ?
সে অমি পড়বো’খন,তোমাকে ভাবতে হবে না। খেয়ে নিয়ে বই হাতে করে শুলে
ঘুমটা খুব শীঘ্র আসে। তা’ছাড়া .... অনেকগুলি বই দিয়ো কিন্তু,তখন
তো আর কোন কাজ থাকবে না।
একবার জিজ্ঞাসা করলে,আমি এখনো কবিতা লিখি কি না ?
যাক,যাক সে সব পাগলামী -
তার মুখের দিকে একবার অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে চেয়ে দেখলাম। হেসে উঠলো,বললে
এইবার বলচি,বিজনদা,বিয়ে-থা করো। একটি টুকটুকে বউ আসবে ঘরে,তকে
কবিতা পড়িয়ে শোনাবে - সমস্তটা অত্যন্ত কুৎসিত মনে হলো,যাকে বলে
vulgar ; এত বিশ্রী লাগলো যে তখনই সেখান থেকে চলে আসতে ইচ্ছা হলো।
হাতে যদি তখন চায়ের বাটি থাকতো এবং সেটা পড়ে গিয়ে ভেঙে গিয়ে ঝনঝন
আওয়াজ করে উঠতো,তবেই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মিলতো। আমি সমস্তই
শুনে গেলাম। অত্যন্ত কুৎসিত ভাবে ‘জলটল’ খেয়ে,আবার আসার প্রতিজ্ঞা
করে চলে এলাম।
তবু আশা ছিল যে যখন বিদায় দেবে তখন তার চিখের মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত
ইঙ্গিত থাকবে,যা শুধু বুঝবো আমি; এবং যা আমার সমস্ত ব্যথাকে মধুর
করে দেবে। ওর ঠোঁটের একটু হাসি,ওর চোখের একটু চাওয়া !
যে পথ দিয়ে এসেছিলাম,সেই পথ দিয়েই ফিরে যাই। ট্রামের শব্দ শুধু
কানে শুনচি। আরো জোরে চলুক। যেন কি একটা ভীষণ কুৎসিতের সামনে থেকে
পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি। পথে আসতে বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিনি। নিজের
কথাই ভাবছিলাম। ওর পাঁচ বছর আগেকার কথা ভাবছিলাম। ওর লেখা চিঠিগুলো
এখনো আমার কাছে আছে। ওর দেওয়া মাথার কাঁটা আমার বালিশের তলায় রয়েচে।
একবার মনে হলো যে,আমরা একদিন পালিয়ে যাওয়ার কল্পনা করেছিলাম। কোন
সুদূর দেশে গিয়ে নিজেদের কুটীর তৈরী করবো,সেখানে আমাদের সন্ধান
পাবে না কেউ। গাড়ীতে গাড়ীতে ধাক্কা লেগেচে। যাত্রীর চোখের ওপরে
হঠাৎ একসঙ্গে অনেক আলো,হাসি,রঙ নেচে ওঠে। তার পড়েই অন্ধকার। ......
( ‘ভারতবর্ষ’, জ্যৈষ্ঠ,১৩৩৯
)।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।