বাগদা
চিংড়ির কাটলেট
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী
[
লেখক পরিচিতি – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ১৪টি সন্তানের তৃতীয়
পুত্র হেমেন্দ্রনাথ। রসায়নবিদ হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল
মহর্ষির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে নৃপময়ীর।
হেমেন্দ্রনাথ ও নৃপময়ীর ১১টি সন্তান – প্রতিভাসুন্দরী, হিতেন্দ্রনাথ,
ক্ষিতিন্দ্রনাথ, ঋতেন্দ্রনাথ, প্রজ্ঞাসুন্দরী, অভিজ্ঞা, মনীষা,
শোভনাসুন্দরী, সুনৃতা, সুষমাসুন্দরী ও সুদক্ষিণা। হেমেন্দ্রনাথের
মেজ মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েদের মতই
বিবিধ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক ইত্যাদি
বিষয়ে উৎসাহ ছাড়াও একটি বিষয়ে ছিল বিশেষ আগ্রহ; সেটি হল রন্ধনশিল্প।
তিনি যে শুধু ভাল রাঁধতে পারতেন তাই নয়-একাধিক রান্নার পদ
আবিষ্কারও করেছিলেন।
প্রজ্ঞার বিয়ে হয় আসমিয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার
সঙ্গে। তারিখটা ছিল ১৮৯১ সালের ১১ই মার্চ। কন এক সূত্রে প্রজ্ঞার
ছবি দেখে লক্ষ্মীনাথ মুগ্ধ হন; মনস্থির করেন একেই তিনি বিয়ে
করবেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্রাহ্ম পরিবারে বিয়ে দিতে
নিজের আত্মীয় স্বজনদের ঘর আপত্তি উপেক্ষা করেই লক্ষ্মীনাথ
বিয়ের আসরে অবতীর্ণ হন। শুভদৃষ্টির সময় প্রজ্ঞার ঠোটের কোণে
মৃদু হাসি সম্বন্ধে লক্ষীনাথ পরে কারণ জানতে চাইলে, প্রজ্ঞার
উত্তর –“বিয়ের অনেকদিন আগেই তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম”।
অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও কিন্তু প্রজ্ঞার রান্নাঘরের আকর্ষণ
কমে নি। বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে আসামে গিয়ে থেকেছিলেন প্রজ্ঞা।
শ্বশুর মশায় ছিলেন রাজপরিবারের গৃহচিকিৎসক। স্বামীর কর্মসূত্রেও
হাওড়া, সম্বলপুর ও ঝাড়সুগুদায় গিয়ে থাকতে হয়েছে প্রজ্ঞাকে।
এতেই তার সুযোগ ঘটে বিভিন্ন অঞ্চলের রান্না শেখার। হেমেন্দ্রনাথের
পুত্রকন্যাদের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ‘পুণ্য’ নামে একটি মাসিক
পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রজ্ঞা ছিলেন পত্রিকা সম্পাদক। এই পত্রিকায়
প্রকাশিত রচনায় তার বহু রান্নার উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালীর
পরিচয় মেলে। চিত্রা দেব জানিয়েছেন – “অনেক রান্নার অধিষ্ঠাত্রী
তিনি নিজেই। মাঝে মাঝে সেগুলির সঙ্গে যোগ করে দিতেন প্রিয়জনের
নাম, যেমন ‘রামমোহন দোল্মা পোলাও’, ‘দ্বারকানাথ ফির্নি পোলাও’,
‘সুরভি পায়েস’-তার অকালমৃতা মেয়ের নামে। রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম
জন্মদিনে ফুলকপি,খোয়া ক্ষীর বাদাম কিশমিশ জাফরানপাতা সোনা-রুপার
তবগ দিয়ে তৈরি করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘কবি সম্বর্ধনা বরফি’।
খেয়ে কেউ বুঝতে পারেনি যে সেটি ফুলকপি দিয়ে তৈরি”।
লক্ষ্মীনাথ ও প্রজ্ঞার চার মেয়ে - সুরভি, অরুণা, রত্না ও দীপিকা।
বড় মেয়ে মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে প্রয়াত হয়। অরুণা ও রত্নার
ভাল ঘরেই বিয়ে হয়েছিল। ছোট মেয়ে দীপিকা ডায়োসেশন স্কুলে পড়ত,
স্কুলের সন্ন্যাসিনীদের সে ছিল প্রিয় পাত্রী। যে কারণেই হোক
দীপিকা সন্ন্যাস গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাবা-মা’র শত
অনুরোধও তাকে টলাতে পারে নি।
অল্প বয়সেই (১৩০৭ বঙ্গাব্দে) প্রজ্ঞার রান্নার বই ‘আমিষ ও
নিরামিষ আহার’ (প্রথম খণ্ড) প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বইটি বের
হয় ‘আরও নিরামিষ’ নামে। সম্পূর্ণ আমিষ রন্ধন প্রণালী নিয়ে
তার তৃতীয় বই প্রকাশিত হয় ১৩১৪ সালে। বাছাই করা আমিষ ও নিরামিষ
খাবার নিয়ে তার আর একটি বই বের হয় ১৩২১ সালের চৈত্র মাসে।
এ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছিল অসমিয়া ভাষায় তার বই ‘রন্ধা-বঢ়া’
ও আচার চাটনি সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় ‘জারক’। একটি প্রজ্ঞা উৎসর্গ
করেন তার অকালপ্রয়াতা মেয়ে সুরভির নামে। রন্ধন বিষয়ক বহু নতুন
শব্দেরও আমদানি করেছেন প্রজ্ঞা যা সাধারণত: শোনা যায় না। প্রজ্ঞা
রান্না নিয়ে মেতে থাকলেও স্বামী লক্ষীনাথ কিন্তু নাটক-অভিনয়
বিষয়ে আকৃষ্ট ছিলেন। ১৯১২-১৪ মধ্যে অভিনীত ‘বাল্মিকী প্রতিভা’য়
প্রায় প্রতিবারই তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
পথ্য, স্ত্রীশিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে রচনা প্রকাশের ইচ্ছা
ছিল প্রজ্ঞার,কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে নি। ১৯৩৭ সালে স্বামী মারা
যাবার পরই তার মানসিক পরিবর্তন ঘটে। স্বামীর জীবনী রচনার সঙ্গে
আধ্যাত্মিক চিন্তায় তিনি সময় কাটাতেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রজ্ঞাসুন্দরী
লোকান্তরিত হন।]
দীপক সেনগুপ্ত ।
উপকরণ।
- বাগদা চিংড়ি সাত ছটাক, আদা এক তোলা,পেঁয়াজ পাঁচ কাঁচ্চা,দই
তিন কাঁচ্চা,দুইটা ডিম,গোলমরিচ গুড়া দু আনি ভর,শুকন লংকা গুঁড়া
তিন আনি ভর,দালচিনি দুয়ানি ভর,ছোট এলাচ একটি,লঙ্গ পাঁচ ছয়টি,বাগানেমশলা
(পাসলি ও সেলেরির পাতা,এগুলি সৌগন্ধের জন্য ব্যবহার করে,ইহা
না দিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই। টেরিটির বা হকসাহেবের বাজারে বাগানেমশলা
পাওয়া যায়) দু আনি ভর, কাঁচা লঙ্কা তিনটি,বিস্কুট এক পোয়া ,নুন
প্রায় তিন আনি ভর,ঘি আধ পোয়া।
প্রণালী।
- বাগদা চিংড়ি যতটা পার বড় বড় দেখিয়া বাছিয়া আনিবে। চিংড়ীগুলার
প্রথমে মুড়াগুলি কাটিয়া ফেল। মুড়া কাটিতে গিয়া যেন একটুও মাছ
কাটিয়া না যায়। হাত দিয়া মাছের সমস্ত খোলা ছাড়াইয়া ফেল। ইহার
ছোট ছোট যে পা আছে সেই পায়ের দিক হইতে খোলা খুলিতে আরম্ভ কর,সহজে
খুলিয়া যাইবে,অথচ মাছটিও নষ্ট হইবে না। সব শেষের দিকে যে লেজের
খোলা থাকিবে তাহা আর খুলিতে হইবে না,খোলা সমেত লেজগুলি রাখিতে
হইবে। দেখিবার বাহারের জন্য এরূপ করা হইয়া থাকে। মাছগুলি ধুইয়া
লও। এখন চিংড়ীর পিঠের
উপরে ঠিক মেরুদণ্ডেতে চিরিতে হইবে। নীচের দিকে যে লেজের খোলা
রাখিয়াছ ঠিক সেই খলা হইতে আরম্ভ করিয়া একটি ছুরি দিয়া উপর দিক
পর্যন্ত চিরিয়া আইস, কিন্তু একেবারে দুই খণ্ড করিয়া চিড়িয়া ফেলিবে
না। এইরূপে চিরিলে মাছটি প্রস্থে যতটা ছিল তাহার দ্বিগুণ হইবে।
প্রত্যেক মাছ চিরিবার পর, ইহার মেরুদণ্ডে একটি কাল শিরা বা রগ
দেখিতে পাইবে সেটা ফেলিয়া দিবে।
একটি মোটা কাঠ বা পিড়া পাত। মাছ যেমন চিরিয়া চেপ্টা করিয়াছ সেই
চেপ্টা ভাবে এই কাঠের উপার বিছাইয়া দাও। এইবারে একটি ‘চাপড়ি’
(চপার) বা ছুরি দিয়া আস্তে আস্তে খোড়; একপিঠ খোড়া হইলে আর এক
পিঠ উল্টাইয়া খুড়িতে হইবে। ইহা মাছ,মাংস নয়,কাজেই অধিক জরে খুড়িতে
গেলে তাহা একেবারে কাটিয়া টুকরা টুকরা হইয়া যাইবে;এইজন্য অতি
সাবধানে খুড়িতে হইবে। খুড়িবার পর এক একটি মাছের কাটলেট প্রায়
চার পাঁচ অঙ্গুলি চওড়া হইব। এইরূপে সব মাছগুলি খুড়িয়া রাখিয়া
দাও।
একটি গাঢ় বা গভীর বাসন আনিয়া রাখ;এক ছটাক পেঁয়াজ এবং এক তোলা
আদা ছেঁচিয়া নিংড়াইয়া তাহার রস ঐ পাত্রে রাখ। এক কাঁচ্চা পেঁয়াজ,তিনটি
কাঁচা লঙ্কা ও দুয়ানি ভর বাগানেমশলা কিমা অর্থাৎ খুব কুচি কুচি
এই পেঁয়াজের রসের উপর রাখ। দুইটি ডিম ভাঙ্গিয়া দাও,দালচিনি,ছোট
এলাচ,লঙ্গ ও একটি শুকনা লঙ্কা মিহি করিয়া কুটিয়া ইহাতে মিশাও
এবং ইহাতে গোলমরিচ গুঁড়া,নুন এবং দই একত্রে রাখিয়া ফেটাও। -
ইহাই গোলা।
বিস্কুট গুঁড়াইয়া থালার ন্যায় একটি চেপ্টা পাত্রে অথবা একটি
কুলায় রাখিয়া দাও। প্রথমে চিংড়ীর কাটলেটগুলা বিস্কুট গুঁড়ায়
একদফা মাখিয়া, ঝাড়িয়া ঝাড়িয়া গলার উপরে ফেলিয়া দাও; আবার গোলা
হইতে উঠাইয়া বিস্কুট গুঁড়ার উপরে ফেলিয়া মাখাও। কাটলেটের দুপিঠে
চাপড়াইয়া চাপড়াইয়া যতটা বিস্কুট গুঁড়া খাওয়াইতে পার খাওয়াও।
তারপরে ঝাড়িয়া ঝাড়িয়া শুকন পাত্রে উঠাও।
একটি তৈয়ে বা কড়ায় আধ পোয়া ঘি চড়াও; ঘি প্রায় তিন চার মিনিট
গরম হইলে, চার পাঁচখানা করিয়া একেবারে কাটলেট ছাড়। এক পিঠ খানিকটা
লাল হইয়া আসিলে, আবার অন্য পিঠ উল্টাইয়া দিবে। ক্রমে বেশ দুই
পিঠ লাল হইয়া আসিলে,নামাইয়া উঠাইবে। এক এক খোলা ভাজিতে প্রায়
মিনিট পাঁচ করিয়া সময় লাগিবে।
(
‘পুণ্য’ মাসিক পত্রিকা, আশ্বিন ১৩০৪ )
মেটের
দোপেঁয়াজা
উপকরণ
। - পাঁটার বা ভেড়াঁর মেটে দেড় পোয়া, জিরা তিন আনি ভর,আস্ত গোলমরিচ
সিকি তোলা, ধনে তিন আনি ভর,শুকন লঙ্কা তিন চারিটি,হলুদ দুই গিরা,পেঁয়াজ
দেড় ছটাক,আদা এক তোলা,ঘি দেড় ছটাক,তেজপাতা দুইখানা,নুন প্রায়
তোলা,দই তিন কাচ্চা,তেঁতুল এক কাচ্চা,জল আধপোয়া।
প্রণালী।
- দেড় পোয়া মেটে ধুইয়া আগে ভাপাইতে দাও, প্রায় মিনিট কুড়ি পরে
সিদ্ধ হইয়া গেলে, হাঁড়ি নামাইয়া ঢাকনা খুলিয়া দাও। হাঁড়ির ভাপ
বাহির হইয়া যাক. মিনিট সাত আট পরে, মেটে উঠাইয়া ঠাণ্ডাজলে ফেলিয়া
ধুইয়া রাখ. মেটেগুলা ছোট ডুমা ডুমা করিয়া কাট. তিন কাঁচ্চা পেঁয়াজ
স্লাইস বা কুচা করিয়া কাট. জিরা, গোলমরিচ,ধনে এবং একটি শুকন
লঙ্কা পিষিয়া রাখ।
হাড়িতে ঘি চড়াও। ঘিয়ে স্লাইস করা পেঁয়াজগুলি ছাড়। পাঁচ ছয় মিনিট
আধ-ভাজা করিয়া,হলুদ,পিঁয়াজ,আদা ও লঙ্কা এই মশলা গুলির বাটনা
ছাড়। হাঁড়ি ঢাকিয়া রাখ। শোঁ শোঁ করিয়া হাঁড়ির ভিতর হইতে আওয়াজ
হইতে থাকিলে,ঢাকনা খুলিয়া নাড়িয়া কসিতে থাক। দু তিন মিনিট পরে
মশলার জল জল মরিয়া গেলে,খণ্ড মেটেগুলি ছাড়িয়া দাও এবং নুন দাও।প্রায়
মিনিট চার ধরিয়া নাড়িয়া,আধ ছটাক আন্দাজ জল দাও,হাঁড়ি ঢাকা দাও।
যেই ফুটিয়া উঠিবে দই দিবে। মিনিট চারের মধ্যে ক্রমে দইয়ের জল
মরিয়া আসিলে,খুন্তি দিয়া নাড়িয়া নাড়িয়া চমকান মশলা গুড়া দাও।
লাল করিয়া কস। চার মিনিট কসিয়া আবার আধ ছটাক জল দাও;মিনিট পাঁচ
পরে সে জলটুকু মরিয়া হাঁড়ির গায়ে মশলা লাগিতে থাকিলে আবার এক
ছটাক জল দাও। আবার পাঁচ মিনিট পরে এ জলটুকু মরিয়া আসিলে,এক কাঁচ্চা
তেঁতুল আধ ছটাক জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। দু এক মিনিট পরেই নামাও।