বড়দিনের
ছুটিতে বড়বাবু যে কেন থিয়েটার দেখ্তে যান,-যে কাজ তিনি ইতিপূর্বে
এবং অতঃপর কখনও করেন নি, সেই একদিনের জন্য সে কাজ তিনি যে কেন
করেন,- তার ভিতর অবশ্য একটু রহস্য আছে| তিনি যে আমোদপ্রিয় নন
এ সত্য এতই স্পষ্ট যে, তাঁর শত্রুরাও তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার
কর্ত| তিনি বাঁধাবাঁধি নিয়মের অতিশয় ভক্ত ছিলেন, এবং নিজের
জীবনকে বাঁধা নিয়মের সম্পূর্ণ অধীন করে নিয়ে এসেছিলেন| পোনেরো
বৎসরের মধ্যে তিনি একদিনও আপিস কামাই করেন নি, একদিনও ছুটি নেন
নি, এবং প্রতিদিন দশটা পাঁচটা ঘাড় গুঁজে একমনে খাতা লিখে এসেছেন|
আপিসের বড়সাহেব Mr. Schleiermachar বলতেন, " 'ফবানী' মানুষ
নয়-কলের মানুষ; ও দেহে বাঙ্গালী হলেও, মনে খাঁটি জর্মাণ"|
বলা বাহুল্য যে, "ফবানী" হচ্ছে ভবানীরই জর্মাণ সংস্করণ|
এই গুনেই, এই যন্ত্রের মত নিয়মে চলার দরুনই, তিনি অল্প বয়সে
আপিসের বড়বাবু হয়ে ওঠেন| সে সময়ে তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশের বেশী ছিল
না, যদিচ দেখতে মনে হত যে, তিনি পঞ্চাশ পেরিয়েছেন| চোখের এরকম
ভুল হবার কারণ এই যে, অপর্যাপ্ত এবং অতিপ্রবৃদ্ধ দাড়িগোঁফে,
তাঁর মুখে বয়সের অঙ্ক সব চাপা পড়ে গিয়েছিল| বড়বাবু যে সকলপ্রকার
সখসাধ আমোদ আহ্লাদের প্রতি শুধু বীতরাগ নয়, বীতশ্রদ্ধও ছিলেন,
তার কারণ আমোদ জিনিসটে কোনরূপ নিয়মের ভিতর পড়ে না| বরং ও বস্তুর
ধর্মই হচ্ছে, সকলপ্রকারের নিয়ম ভঙ্গ করা| "রূটীন"
করে আমোদ করা যে কাজ করারই সামিল, এ কথা সকলেই মানতে বাধ্য|
উৎসব ব্যাপারটি অবশ্য নিত্যকর্মের মধ্যে নয়, এবং যে কর্ম নিত্যকর্ম
নয় এবং হতে পারে না, তাকে বড়বাবু ভালবাসতেন না, ভয় করতেন| তাঁর
বিশ্বাস ছিল যে, সুচারুরূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ কর্বার একমাত্র
উপায় হচ্ছে জীবনটাকে দৈনন্দিন করে তোলা; অর্থাৎ সেই জীবন আদর্শ
জীবন, যার দিনগুলো কলে-তৈরী জিনিসের মত, একটি ঠিক আর একটির মত|
বৈচিত্র্য
না থাকলেও, বড়বাবুর জীবন যে নিরানন্দ ছিল, তা নয়| তাঁর গৃহের
কৌটায় এমন একটি অমূল্য রত্ন ছিল, যার উপর তাঁর হৃদয় মন দিবারাত্র
পড়ে থাকত| তাঁর স্ত্রী ছিল পরমা সুন্দরী| বাপ মা তার নাম রেখেছিলেন
পটেশ্বরী| এ নামের সার্থকতা সম্বন্ধে তার পিতৃকুলের তার মাতৃকুলের
কেউ কখনও সন্দেহ প্রকাশ করেন নি; তাঁরা সকলেই একবাক্যে বল্তেন,
এ হেন রূপ পটের ছবিতেই দেখা যায়, রক্তমাংসের শরীরে দেখা যায়
না-এমন কি চাকরদাসীরাও পটেশ্বরীকে আরমানির বিবির সঙ্গে তুলনা
কর্ত| বড়বাবুর তাদৃশ সৌন্দর্যবোধ না থাকলেও, তাঁর স্ত্রী যে
সুন্দরী-শুধু সুন্দরী নয়, অসাধারণ সুন্দরী,-এ বোধ তাঁর যথেষ্ট
ছিল| তাঁকে জিজ্ঞাসা কর্লে, তিনি অবশ্য তাঁর স্ত্রীর রূপ বর্ণনা
করতে পার্তেন না, কেননা বড়বাবু আর যাই হ'ন,-কবিও নন, চিত্রকরও
নন| তা ছাড়া বড়বাবু তাঁর স্ত্রীকে কখনও ভাল করে খুঁটিয়ে দেখেন
নি| একটি প্রাকৃত কবি বলেছেন যে তাঁর প্রিয়ার সমগ্ররূপ কেউ কখন
দেখতে পায় নি; কেননা যার চোখ তার অঙ্গে প্রথম পড়েছে, সেখান থেকে
আর উঠতে পারে নি| সম্ভবতঃ ঐ কারণে বড়বাবুর মুগ্ধ নেত্র পটেশ্বরীর
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কখন আয়ত্ত করতে পারে নি| বড়বাবু
জানতেন যে তাঁর স্ত্রীর গায়ের রঙ কাঁচা সোনার মত, আর তার চোখদুটি
সাত রাজার ধন কালো মাণিকের মত| এই রূপের অলৌকিক আলোতেই তাঁর
সমস্ত নয়ন মন পূর্ণ করে রেখেছিল| বড়বাবুর বিশ্বাস ছিল যে, পূর্বজন্মের
সুকৃতির ফলেই তিনি এ হেন স্ত্রীরত্ন লাভ করেছেন| এই শাপভ্রষ্ট
দেবকন্যা যে পথ ভুলে তাঁর হাতে এসে পড়েছে এবং তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি
হয়েছে, এ মনে করে' তাঁর আনন্দের আর অবধি ছিল না|
কিন্তু
মানুষের যা অত্যন্ত সুখের কারণ, প্রায়ই তাই তার নিতান্ত অসুখের
কারণ হয়ে ওঠে| এ স্ত্রী নিয়ে বড়বাবুর মনে সুখ থাকলেও সোয়াস্তি
ছিল না| দরিদ্রের ঘরে কোহিনুর থাক্লে তার রাত্তিরে ঘুম হওয়া
অসম্ভব| বড়বাবুর অবস্থাও ঠিক তাই হয়েছিল| এ রত্ন হারাবার ভয়
মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনকে ছেড়ে যেত না, তাই তিনি সকালসন্ধ্যা
কিসে তা রক্ষা করা যায়, সেই ভাবনা সেই চিন্তাতে মগ্ন থাক্তেন|
আপিসের কাজে তন্ময় থাকাতে, কেবলমাত্র দশটা-পাঁচটা তিনি এই দুর্ভাবনা
থেকে অব্যাহতি লাভ কর্তেন| বড়বাবুর যদি আপিস না থাক্ত, তাহলে
বোধহয় তিনি ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যেতেন|
বড়বাবুর
মনে তাঁর স্ত্রীর সম্বন্ধে নানারূপ সন্দেহের উদয় হত| অথচ সে
সন্দেহের কোনও স্পষ্ট কারণ ছিল না| কিন্তু তার থেকে তিনি কোনরূপ
সান্ত্বনা পেতেন না,-কেননা অস্পষ্ট ভয় অস্পষ্ট ভাবনাই আমাদের
মনকে সব চাইতে বেশী পেয়ে বসে এবং বেশী চেপে ধরে| তাঁর স্ত্রীকে
সন্দেহ করবার কোনরূপ বৈধ কারণ না থাকলেও, বড়বাবুর মনে তার স্বপক্ষে
অনেকগুলি ছোটোখাট কারণ ছিল| প্রথমতঃ, সাধারণত স্ত্রীজাতির প্রতি
তাঁর অবিশ্বাস ছিল| "বিশ্বাসং নৈব কর্ত্তব্যং স্ত্রীষু
রাজকুলেষু চ" এ বাক্যের প্রথম অংশ তিনি বেদবাক্য স্বরূপে
মানতেন| তারপর তাঁর ধারণা ছিল যে, রূপ আর চরিত্র প্রায় একাধারে
পাওয়া যায় না| তারপর তাঁর শ্বশুরপরিবারের অন্ততঃ পুরুষদের চরিত্রবিষয়ে
তেমন সুনাম ছিল না| পাটের কারবারে হঠাৎ অগাধ পয়সা করায়, সে পরিবারের
মাথা অনেকটা বিগড়ে গিয়েছিল; ফলে, তাঁর শশুরবাড়ির হালচাল অসম্ভবরকম
বেড়ে গিয়েছিল| তাঁর শ্যালক তিনটি যে আমোদ আহ্লাদ নিয়েই দিন কাটাতেন,
এ কথা ত সহরসুদ্ধ লোক জান্ত,-এবং এদের ভাইবোনের ভিতর যে পরস্পরের
অত্যন্ত মিল ছিল, সে সত্য বড়বাবুর নিকট অবিদিত ছিল না| ভাইদের
সঙ্গে দেখা হলে পটেশ্বরীর মুখ হাসিতে ভরে উঠ্ত, তাদের সঙ্গে
তার কথা আর ফুরত না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে অনর্গল বকে যেত, আর
হেসে কুটি কুটি হত| এ সব সময়ে বড়বাবু অবশ্য উপস্থিত থাক্তেন
না, তাই এদের কি যে কথা হত, তা তিনি জান্তেন না| কিন্তু তিনি
ধরে রেখেছিলেন যে, তখন যা বলা কওয়া হত, সে সব নেহাৎ বাজে কথা|
ভাইদের সঙ্গে এই হাসি তামাশা, তিনি পটেশ্বরীর চরিত্রের আমোদ-প্রিয়তার
লক্ষণ বলেই মনে করতেন| এ অবশ্য তাঁর মোটেই ভাল লাগ্ত না| বড়বাবুর
স্বভাবটি যেমন চাপা, পটেশ্বরীর স্বভাব ছিল তেমনি খোলা| তার চালচলন
কথাবার্তার ভিতর প্রাণের যে সহজ সরল স্ফূর্তি ছিল-বড়বাবু তাকে
চঞ্চলতা বল্তেন, এবং এই চঞ্চলতাকে তিনি বিশেষ ভয় কর্তেন| তারপর
পটেশ্বরীর কোনও সন্তানাদি হয় নি, সুতরং তার যৌবনের কোনও ক্ষয়
হয় নি| যদিচ তখন তার বয়স চব্বিশ বৎসর, তবুও দেখতে তাকে ষোলোর
বেশী দেখাত না, এবং তার স্বভাব ও মনোভাবও ঐ ষোলো বৎসরের অনুরূপই
ছিল| বড়বাবুর পক্ষে বিশেষ কষ্টের বিষয় এই ছিল যে, এই সব ভয় ভাবনা
তাঁকে নিজের মনেই চেপে রাখ্তে হ'ত| পটেশরীর কোন কাজে বাধা দেওয়া
কিম্বা তাকে কোনও কথা বলা, বড়বাবুর সাহসে কখনও কুলোয় নি| এমন
কি, বাঙ্গালী ঘরের মেয়ের পক্ষে, বিশেষতঃ ভদ্রমহিলার পক্ষে, শিশ্
দেওয়াটা যে দেখ্তেও ভালো দেখায় না, শুনতেও ভাল শোনায় না,-এই
সহজ কথাটাও বড়বাবু তাঁর স্ত্রীকে কখনও মুখফুটে বল্তে পারেন
নি! তার প্রথম কারণ, পটেশ্বরী বড়মানুষের মেয়ে,-শুধু তাই নয়,
একমাত্র কন্যা| বাপ মা ভাইদের আদর পেয়ে পেয়ে, সে অত্যন্ত অভিমানী
হয়ে উঠেছিল-একটি রূঢ় কথাও তার গায়ে সইত না, অনাদরের ঈষৎ স্পর্শে
তার চোখ জলে ভরে আস্ত| আর পটেশ্বরীর চোখের জল দেখবার শক্তি
আর যারই থাক-বড়বাবুর দেহে ছিল না| তা ছাড়া দেবতার গায়ে হস্তক্ষেপ
করতে মানুষমাত্রেরই সঙ্কোচ হয়, ভয় হয়,-এবং তাঁর শ্যালকদের বিশ্বাস
অন্যরূপ হলেও, তিনি মনুষ্যত্ববর্জিত ছিলেন না| সে যাই হোক, বড়বাবুর
মনে শান্তি ছিল না বলে যে সুখ ছিল না,-এ কথা সত্য নয়| বিপদের
ভয় না থাকলে মানুষে সম্পদের মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না|
এই সব ভয় ভাবনাই বড়বাবুর স্বভাবতঃ-ঝিমন্ত মনকে সজাগ, সচেতন ও
সতর্ক করে রেখেছিল| তা ছাড়া পটেশ্বরী সম্বন্ধে তাঁর ভয় যে অলীক
এবং তাঁর সন্দেহ যে অকারণ, এ জ্ঞান অন্ততঃ দিনে একবার করেও তাঁর
মনে উদয় হত-এবং তখন তাঁর মন কোজাগর পূর্ণিমার রাতের মত প্রসন্ন
ও প্রফুল্ল হয়ে উঠ্ত|
বড়বাবুর
মনে শুধু দুটি ভাব প্রবল হয়ে উঠেছিল, স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ,
আর ব্রাহ্মসমাজের প্রতি রাগ| ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অবশ্য তাঁর
কোনরূপ বিদ্বেষ ছিল না, কেননা তিনি ধর্ম নিয়ে কখনও মিছে মাথা
বকান নি| দেবতা এক কি বহু, ঈশ্বর আছেন কি নেই,-যদি থাকেন, তাহলে
তিনি সাকার কি নিরাকার, ব্রহ্ম সগুণ কি নির্গুণ, দেহাতিরিক্ত
আত্মা নামক কোনও পদার্থ আছে কি না, থাকলেও তার স্বরূপ কি,-এ
সকল সমস্যা তাঁর মনকে কখনও ব্যতিব্যস্ত করে নি, তাঁর নিদ্রার
এক রাত্তিরের জন্য ব্যাঘাত করে নি| তিনি জানতেন যে, বিশ্বের
হিসাবের খতিয়ান করবার জন্য তিনি জন্মগ্রহণ করেন নি| তবে এর থেকে
অনুমান করা অসঙ্গত হবে যে, তিনি নাস্তিক ছিলেন| আমাদের অধিকাংশ
লোকের ভূতপ্রেত সম্বন্ধে যে মনোভাব, ঠাকুর দেবতা সম্বন্ধে বড়বাবুর
ঠিক সেইরূপ মনোভাব ছিল; অর্থাৎ তিনি তাদের অস্তিত্বে সম্পূর্ণ
বিশ্বাস না করলেও, পুরো ভয় কর্তেন| আফিসের হয়ে মিথ্যা সাক্ষী
দিতে হলে, তিনি কালিঘাটে আগে পূজো দিয়ে পরে আদালতে আস্তেন,-এই
উদ্দেশ্যে যে মা কালী তাঁকে জেরার হাত থেকে রক্ষা কর্বেন|
ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মমত নয়, সামাজিক মতামতের বিরুদ্ধেই তাঁর সমস্ত
অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠত| স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা,
যৌন-বিবাহ, বিধবা-বিবাহ-এ সকল কথা শুনে তিনি কাণে হাত দিতেন|
এ সব মত যারা প্রচার করে, তারা যে সমাজের ঘোর শত্রু-সে বিষয়ে
তাঁর বিন্দুমাত্রও সন্দেহ ছিল না| তাঁর পক্ষে কি ভালমন্দ, তারই
হিসেব থেকে তিনি সমাজের পক্ষে কি ভালমন্দ তাই স্থির করতেন| স্ত্রী-স্বাধীনতা?
তাঁর স্ত্রীকে স্বাধীনতা দিলে কি প্রলয় কাণ্ড হবে, সে কথা মনে
কর্তেও তাঁর আতঙ্ক উপস্থিত হ'ত! যিনি নিজের স্ত্রীরত্ন্কে সামলে
রাখবার জন্য ছাদের উপরে ছ-হাত উচুঁ দরমার বেড়ার ঘের দেয়েছিলেন,
যাতে করে তাঁর বাড়ির ভিতর পাড়াপড়শির নজর না পড়ে - তাঁর কাছে
অবশ্য স্ত্রীকে স্বাধীনতা দেওয়া আর ঘরভাঙ্গা - দুইই এক কথা|
তার পর স্ত্রী-শিক্ষা সম্বন্ধেও তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল| স্ত্রীজাতির
শরীরের অপেক্ষা মনকে স্বাধীনতা দেওয়া যে কম বিপজ্জনক, এ ভুল
ধারণা তাঁর ছিল না| তিনি এই সার বুঝেছিলেন যে, স্ত্রীলোককে লেখাপড়া
শেখানোর অর্থ হচ্ছে, বাইরের লোকের এবং বাজে লোকের সঙ্গে তার
মনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় করিয়ে দেওয়া| পটেশ্বরী যে সামান্য লেখাপড়া
জানত, তার কুফল ত তিনি নিত্যই চোখে দেখতে পেতেন| তিনি তাকে যত
ভাল ভাল বই কিনে দিতেন, যাতে নানারূপ সদুপদেশ আছে-পটেশ্বরী তার
দুই এক পাতা পড়ে ফেলে দিত; আর সে বাপের বাড়ি থেকে যে সব বাজে
গল্পের বই নিয়ে আসত-দিনমান বসে বসে তাই গিল্ত| সে সব কেতাবে
কি লেখা আছে তা না জানলেও, বড়বাবু এটা নিশ্চিত জান্তেন যে,
তাতে যা আছে, তা কোনও বইয়ে থাকা উচিত নয়| স্ত্রীলোকের অল্প লেখাপড়ার
ভোগ যদি মানুষকে এইরকম ভুগতে হয়, তাহলে তাদের বেশী লেখাপড়ার
ফলে যে সর্বনাশ হবে, তাতে আর সন্দেহ কি?-তারপর যৌন বিবাহ| যৌন
বিবাহের প্রচলনের সঙ্গে যে স্বেচ্ছাবিবাহের প্রবর্তন হওয়া অবশ্যম্ভাবী,
এ জ্ঞান বড়বাবুর ছিল| আমাদের সমাজে যদি স্বেচ্ছাবিবাহের প্রথা
প্রচলিত থাকত, তাহলে বড়বাবুর দশা কি হ'ত! পটেশ্বরী যে স্বয়ংবরা
সভায় তাঁর গলায় মালা দিতেন না, এ বিষয়ে বাবু নিঃসন্দেহ ছিলেন|
বড়বাবুর যে রূপ নেই, সে জ্ঞান তাঁর ছিল,-কেননা তাঁর সর্বাঙ্গ
সেই অভাবের কথা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করত; এবং পটেশ্বরী যে মনুষ্যত্বের
মর্যাদা বোঝে না-এ সত্যের পরিচয় তিনি বিবাহাবধি পেয়ে এসেছেন|
পটেশ্বরী যে মানুষের চাইতে কুকুর বিড়াল, লাল-মাছ, সাদা-ইঁদুর,
ছাই-রঙের কাকাতুয়া, নীল-রঙের পায়রা বেশী ভালবাসত, তার প্রমাণ
ত তাঁর গৃহাভ্যন্তরেই ছিল| বাপের পয়সায় তাঁর স্ত্রী তাঁর অন্দরমহলটি
একটি ছোটখাটো চিড়িয়াখানায় পরিণত করেছিল| তারপর বিধবা-বিবাহের
কথা মনে করতে বড়বাবুর সর্বাঙ্গ শিউরে উঠত| তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত
ছিলেন যে, তিনি স্বর্গারোহণ করলে পটেশ্বরী যদি পত্যন্তর গ্রহণ
করে, আর সে সংবাদ যদি স্বর্গে পৌঁছয়, তাহলে সেই মুহূর্তে স্বর্গ
নরক হয়ে উঠবে|
(২)
বড়বাবুর
মনের এই দুটি প্রধান প্রবৃত্তি, এই অনুরাগ আর এই বিরাগ, একজোট
হয়ে তাঁকে বড়দিনে থিয়েটারে নিয়ে যায়; নচেৎ সখ করে তিনি অর্থ
এবং সময়ের ওরূপ অপব্যয় কখনও কর্তেন না|
বড়দিনের ছুটিতে পটেশ্বরী তার বাপের বাড়ি গিয়েছিল| আপিসের কাজ
নেই, ঘরে স্ত্রী নেই,-অর্থাৎ বড়বাবুর জীবনের যে দুটি প্রধান
অবলম্বন, দুই এক সঙ্গে হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে, তাঁর কাছে পৃথিবী
খালি হয়ে গিয়েছিল| স্ত্রী ঘরে থাকলেও ছুটির দিনে বড়বাবু অবশ্য
বাড়ির ভিতর বসে থাকতেন না| তবে এক ঘরে ফুল থাকলে তাঁর পাশের
ঘরটিকে তার সৌরভে যেমন পূর্ণ করে রাখে, তেমনি-পটেশ্বরী অন্তঃপুরে
থাক্লেও-অদৃশ্য ফুলের গন্ধের মত তার অদৃশ্য দেহের রূপে বড়বাবুর
গৃহের ভিতর বার পূর্ণ করে রাখত| প্রতিমা অন্তর্হিত হলে মন্দিরের
যে অবস্থা হয় - পটেশ্বরীর অভাবে তাঁর গৃহের অবস্থাও তদ্রূপ হয়েছিল|
বড়বাবু এই শূন্য মন্দিরে কি করে দিন কাটাবেন, তা আর ভেবে পেতেন
না| প্রথমতঃ, তাঁর কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না,-তিনি কারও সঙ্গে
মেলামেশা কর্তে ভালবাসতেন না| গল্প করা কিংবা তাস পাশা খেলা,
এ সব তাঁর ধাতে ছিল না| তারপর তাঁর বাড়িতে কোনও ভদ্রলোক আসা
তিনি নিতান্ত অপছ্ন্দ কর্তেন| তাঁর স্ত্রীর স্বভাবে কৌতূহল
জিনিসটে কিঞ্চিৎ বেশীমাত্রায় ছিল; তার স্বামীর কাছে কোনও লোক
এলে, পটেশ্বরী খড়খড়ের ভিতর দিয়ে উকিঝুঁকি না মেরে থাকতে পারত
না|
তারপর সময় কাটাবার একটি প্রকৃষ্ট উপায় - বই পড়া - তাঁর কোন কালেই
অভ্যাস ছিল না| তাঁর বাড়িতেও এমন কেউ ছিল না, যার সঙ্গে তিনি
বাক্যালাপ করতে পার্তেন| তাঁর পরিবারের মধ্যে ছিল-তাঁর স্ত্রী
আর তিনি| তিনি গাঁ-সম্পর্কের যে মাসিটিকে পটেশ্বরীর প্রহরীস্বরূপে
বাড়িতে এনে রেখেছিলেন, তার সঙ্গে কথা কইতে বড়বাবু ভয় পেতেন|
কেননা ঐ ধারকরা মাসিমাটি, তাঁর সাক্ষাৎ পেলেই দুঃখের কান্না
কাঁদতে বসতেন, এবং সর্বশেষে টাকা চাইতেন| বড়বাবু টাকা কাউকেও
দিতে ভালবাসতেন না,-আর উক্ত মাসিমাতাটিকে ত নয়ই,-কারণ তিনি জানতেন
যে, সে টাকা মাসির গুণধর ছেলেটির মদের খরচে লাগবে| এই সব কারণে
বড়বাবু নিরুপায় হয়ে দুটি গোটা দিন খবরের কাগজ পড়ে কাটিয়ে ছিলেন|
ওরি মধ্যে একখানিতে একটি বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ল| তাতে তিনি
দেখলেন যে, সাবিত্রী থিয়েটারে খৃষ্ট্ মাস রজনীতে "সংস্কারের
কেলেঙ্কার" নামক প্রহসনের অভিনয় হবে| বলা বাহুল্য উক্ত
প্রহসনের নাম শুনেই সেটির প্রতি তাঁর মন অনুকূল হয়ে উঠল| তারপর
তিনি সেই বিজ্ঞাপন হতে এই জ্ঞানসঞ্চয় করলেন, যে উক্ত প্রহসনে
সংস্কারকদের উপর বেশ এক হাত নেওয়া হবে| এই বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে
তাঁর মন "সংস্কারের কেলেঙ্কারের" অভিনয় দেখবার জন্য
নিতান্ত উৎসুক হয়ে উঠল| কিন্তু থিয়েটারে যাওয়া সম্বন্ধে তিনি
সহসা মনস্থির করে উঠ্তে পারলেন না|
তার প্রধান কারণ, তিনি ইতিপূর্বে কখনও থিয়েটারে যান নি,-শুধু
তাই নয়, তাঁর স্ত্রীর সুমুখে তিনি বহুবার থিয়েটারের বহুনিন্দা
করেছেন| থিয়েটারের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রোশের কারণ এই ছিল যে, সেখানে
ভদ্র-ঘরের মেয়েরাও যাতায়াত করে| তাঁর মতে অন্তঃপুরবাসিনীদের
থিয়েটারে যেতে দেওয়া যা, আর পত্র-আবডাল দিয়ে স্ত্রীস্বাধীনতা
দেওয়াও তাই| ওর চাইতে মেয়েদের গড়েরমাঠে হাওয়া খেতে যেতে দেওয়া
শতগুণে শ্রেয়ঃ| আর তিনি যে, সময়ে অসময়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে এ-বিষয়ে
তাঁর কড়াকড়া মতামত সব প্রকাশ কর্তেন, তার কারণ তিনি শুনেছিলেন
যে, থিয়েটার দেখা তাঁর শ্যালাজগণের নিত্যকর্মের মধ্যে হয়ে উঠেছিল|
পাছে তাঁর স্ত্রী, তার বৌদিদের কুদৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, এই ভয়ে
তিনি পটেশ্বরীকে শুনিয়ে শুনিয়ে থিয়েটারের বিরুদ্ধে যত কটূকথা
প্রয়োগ কর্তেন| তাঁর মনোগত অভিপ্রায় ছিল, শ্বশুরকুলের বৌকে
মেরে ঝিকে শেখানো| এর ফলে পটেশ্বরীর মনে, থিয়েটার সম্বন্ধে এমনি
একটি বিশ্রী ধারণা জন্মেছিল যে, তার বৌদিদিদের হাজার পীড়াপীড়ি
সত্ত্বেও, সে কখনও কোন থিয়েটারের চৌকাঠ ডিঙ্গয় নি| অন্ততঃ সে
ত তার স্বামীকে তাই বুঝিয়েছিল| বড়বাবু তাঁর স্ত্রীর এ কথা বিশ্বাস
কর্তেন, কেননা তা না কর্লে তিনি জানতেন যে, তাঁর মুখের ভাত
গলা দিয়ে নামবে না, রাত্তিরে চোখের পাতা পড়বে না, আফিসের খাতায়
ঠিক নামাতে ভুল হবে,-এক কথায় তাঁর বেঁচে আর কোনও সুখ থাক্বে
না| এর পর তিনি নিজে যদি সেই পাপ থিয়েটার দেখতে যান, তাহলে তাঁর
স্ত্রী কি আর তাঁকে ভক্তি কর্বে? বলা বাহুল্য তাঁর স্ত্রী স্বামীভক্তির
উপরে তিনি তাঁর জীবনের সকল আশা, সকল ভরসা প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন|
একদিকে স্বচক্ষে সংস্কারকদের লাঞ্ছনা দেখ্বার অদম্য কৌতূহল,
অপরদিকে স্ত্রীর ভক্তি হারাবার ভয়-এই দুটি মনোভাবের মধ্যে তিনি
এতদূর দোলাচলচিত্তবৃত্তি হয়ে পড়েছিলেন যে, সমস্ত দিনের মধ্যে
তাঁর আর মনস্থির করা হ'ল না| এক্ষেত্রে প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তি
উভয়েরই বল সমান ছিল বলে, এর একটি অপরটিকে পরাস্ত কর্তে পারছিল
না|
অতঃপর সূর্য যখন অস্ত গেল, তখন, "সংস্কারের কেলেঙ্কারের"
অভিনয় দেখাটা যে তাঁর পক্ষে একান্ত কর্তব্য, এই ধারণাটি হঠাৎ
তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল| একা বাড়িতে দিনটা বড়বাবু কোনমত প্রকারে
কাটালেও, ও অবস্থায় সন্ধ্যেটা কাটানো তাঁর পক্ষে বড়ই কষ্টকর
হয়ে উঠেছিল| সেই গোধূলিলগ্নে পটেশ্বরী সম্বন্ধে যতরকম দুশ্চিন্তা,
সংশয়, ভয় ইত্যাদি চামচিকে বাদুড়ের মত এসে তাঁর সমস্ত মনটাকে
অধিকার করে বসত| তিনি দুদিন এ উপদ্রব সহ্য করেছিলেন,-তৃতীয় দিন
সহ্য করবার মত ধৈর্য ও বীর্য বড়বাবুর দেহে থাকলেও, মনে ছিল না|
তিনি স্থির করলেন থিয়েটার যাবেন, এবং সে কথা পটেশ্বরীর কাছে
চেপে যাবেন| তিনি না বললে, পটেশ্বরী কি করে জানবে যে তিনি থিয়েটারে
গিয়েছিলেন,- সে ত আর ও সব জায়গায় যায় না? এক ধরা পড়বার ভয় ছিল
তাঁর শ্যালাজদের কাছে| যদি তারাও সে রাত্তিরে ঐ একই থিয়েটারে
যায়, এবং সেখানে বড় বাবুকে দেখতে পায়, তাহলে সে খবর নিশ্চয়ই
পটেশ্বরীর কানে পৌঁছবে| যদি তা হয়, তাহলে তিনি অম্লানবদনে সে
কথা অস্বীকার করবেন, এইরূপ মনস্থ করলেন; চিকের -আড়াল থেকে দেখলে
যে লোক চিনতে ভুল হওয়া সম্ভব-এ সত্য, তাঁর স্ত্রীও অস্বীকার
করতে পারবেন না|
(৩)
সে রাত্তিরে বড়বাবু সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে,-অর্থাৎ একরকম না খেয়েই-গায়ে
আল্ষ্টার চড়িয়ে, গলায় কম্ফার্টার জড়িয়ে, মাথা মুখে শাল ঢাকা
দিয়ে, সাবিত্রী থিয়েটারের অভিমুখে পদব্রজে রওনা হলেন| পাছে পাড়ার
লোক তাঁকে দেখতে পায়, পাছে তাঁর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের সুনাম একদিনে
নষ্ট হয়, এই ভয়ে তিনি নীল নিচোলাবৃত অভিসারিকার মত ভীত চকিত
চিত্তে, অতি সাবধানে অতি সন্তর্পণে পথ চল্তে লাগলেন| এখানে
বলে রাখা আবশ্যক যে, তাঁর আল্ষ্টারের বর্ণ ছিল ঘোর নীল, আর
নিচোল-পদার্থটি শাড়ি নয়-ওভারকোট| অনাবশ্যক রকম শীতবস্ত্রের ভার
বহন করাটা অবশ্য তাঁর পক্ষে মোটেই আরামজনক হয় নি; বিশেষতঃ কম্ফার্টার
নামক গলকম্বলটি, তাঁর গলদেশের ভার যে পরিমাণে বৃদ্ধি করেছিল,
তার শোভা সে পরিমাণে বৃদ্ধি করে নি| পাঁচহাত লম্বা উক্ত পশমের
গলাবন্ধটি কণ্ঠে ধারণ করা তাঁর পক্ষে একান্ত কষ্টকর হলেও, প্রাণ
ধরে তিনি সেটি ত্যাগ করতে পার্তেন না; তার কারণ পটেশ্বরী সেটি
নিজ হাতে বুনে দিয়েছিল| বড়বাবুর বিশ্বাস ছিল, পাঁচরঙা উলে-বোনা
ঐ বস্তুটির তুল্য সুন্দর বস্তু পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই| কারুকার্যের
ওই হচ্ছে চরম ফল| সৌন্দর্যে, আকাশের ইন্দ্রধনুর সঙ্গে শুধু তাঁর
তুলনা হতে পার্ত| স্ত্রীহস্তরচিত এই গলবস্ত্রটি ধারণ করে তাঁর
দেহের যতই অসোয়াস্তি হোক, তাঁর মনের সুখের আর সীমা ছিল না| তিনি
মর্মে মর্মে অনুভব কর্ছিলেন যে, পটেশ্বরীর অন্তরের ভালবাসা
যেন সাকার হয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে|
অবশেষে বড়বাবু থিয়েটারে উপস্থিত হয়ে দেখেন, সে জায়গা প্রায় ভর্তি
হয়ে গিয়েছে| এই লোকারণ্যে প্রবেশ করবামাত্র তিনি এতটা ভেবড়ে
গেলেন যে, নিজের "সীটে" যাবার পথে এক ব্যক্তির গায়ে
ধাক্কা মারলেন, আর এক ব্যক্তির পা মাড়িয়ে দিলেন| তার জন্য তাঁকে
সম্বোধন করে যে সব কথা বলা হয়েছিল, তাকে ঠিক স্বাগত সম্ভাষণ
বলা যায় না!
তখন Dropscene ওঠে নি, সবে কন্সার্ট সুরু হয়েছিল; বেয়ারাগুলো
সব সমস্বরে চি চি করছিল, Cello গ্যাঙরাচ্ছিল, Bass Viola থেকে
থেকে হুঙ্কার ছাড়ছিল, এবং Double bass দ্বিগুণ উৎসাহে হাঁক্কাহোঁক্কা
করছিল| তবে ঐ ঐক্যতান সঙ্গীতের প্রতি বড় কেউ যে কাণ দিচ্ছিলেন
না, তার প্রমাণ - দর্শকবৃন্দের আলাপের গুঞ্জনে ও হাসির ঝঙ্কারে
রঙ্গভূমি একেবারে কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল|
তারপর Dropscene যখন পাক্ খেয়ে খেয়ে শুন্যে উঠে গেল, তখন ডজন
দুয়েক অভিনেত্রী,-লালপরী, নীলপরী, সবজাপরী, জরদাপরী প্রভৃতিরূপে
রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে, খামকা অকারণ নৃত্যগীত সুরু করে দিলে|
বড়বাবুর মনে হল তাঁর চোখের সুমুখে স্তবকে স্তবকে সব পারিজাত
ফুটে উঠল, আর এই সব স্বর্গের ফুল যেন নন্দনবনের মন্দ পবনের স্পর্শে
কখন জড়িয়ে, কখন ছড়িয়ে, ঈষৎ হেলতে, ঈষৎ দুলতে লাগল| ক্রমে এই
সকল নর্তকীদের কম্পিত ও আন্দোলিত গেহ ও কণ্ঠ হতে উচ্ছ্বসিত নৃত্য
ও গীতের হিল্লোল, সমগ্র রঙ্গালয়ের আকাশে বাতাসে সঞ্চারিত হ'ল,-সে
হিল্লোলের স্পর্শে দর্শকমণ্ডলী শিহরিত পুলকিত হয়ে উঠল| মিনিট
পাঁচেকের জন্য অর্ধচন্দ্রাকারে অবস্থিতি করে এই পরীর দল যখন
সবেগে চক্রাকারে ভ্রমণ করতে লাগল, তখন চারিদিক থেকে সকলে মহা
উল্লাসে Encore Encore বলে চীৎকার কর্তে লাগ্ল| এত আলো, এত
রঙ এত সুরের সংস্পর্শে বড়বাবুর ইন্দ্রিয় প্রথম থেকেই ঈষৎ সচকিত
উত্তেজিত হয়েছিল, তারপর সমবেত দর্শকমণ্ডলীর এই তরঙ্গিত আনন্দ
তাঁর দেহমনকে একটি সংক্রামক ব্যাধির মত আক্রমণ করলে| পান করা
অভ্যাস না থাকলে একপাত্র মদও যেমন মানুষের মাথায় চড়ে যায়, আর
তাকে বিহ্বল করে ফেলে,-এই নাচগান বাজনাও তেমনি বড়বাবুর মাথায়
চড়ে গেল| আমোদের নেশায় তাঁর ইন্দ্রিয় একসঙ্গে বিকল হয়ে পড়ল,
ও চঞ্চল হয়ে উঠ্ল| অতঃপর নেচে নেচে শ্রান্ত ও ঘর্মাক্ত-কলেবর
হয়ে নর্তকীর দল যখন নৃত্যে ক্ষান্ত দিলে, তখন একটি স্থূলাঙ্গী
বয়স্কা গায়িকা, অতি-মিহি অতি-নাকী এবং অতি-টানা সুরে একটি গান
গাইতে আরম্ভ করলেন| সে ত গান নয়, ইনিয়ে বিনিয়ে নাকে-কান্না|
বড়বাবু কতদূর কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন, তার প্রমাণ,-সেই
গান যেমনি থামা, অমনি তিনি বড়গলায় encore encore বলে দু-তিনবার
চীৎকার কর্লেন| তাই শুনে তাঁর এপাশে ওপাশে যে সব ভদ্রলোক বসেছিলেন-তাঁরা
বড়বাবুর দিকে কট্মট্ করে চাইতে লাগ্লেন|
এ গানের যে সুরতালের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না, সে জ্ঞান অবশ্য
বড়বাবুর ছিল না; তাই উক্ত ভদ্রলোকের মধ্যে একটি রসিক ব্যক্তি
যখন তাঁকে এই প্রশ্ন করলেন যে, "ঢাকের বাদ্যি থামলেই মিষ্টি
লাগে, এ কথা কি মহাশয় কখনও শোনেন নি? আর এটাও কি মালুম হ'ল না
যে, উনি যে পুরিয়া উদ্গার করলেন, সেটি সরপুরিয়া নয়-ক্যালমেলের
পুরিয়া?" তখন তিনি লজ্জায় আধোবদন ও নিরুত্তর হয়ে রইলেন|
নৃত্যগীত সমাধা হবার পর আবার Dropscene পড়ল, আবার কনসার্ট বেজে
উঠল| তাঁতের ছোট বড় মাঝারি বিলাতি যন্ত্রগুলো, বাদকদের ছড়ির
তাড়নায় গ্যাঁ গোঁ ক্যাঁ কোঁ প্রভৃতি নানারূপ কাতর ধ্বনি করতে
লাগল; ক্লারিওনেট ও কর্নেট পরস্পরে জ্ঞাতিশত্রুতার ঝগড়া সুরু
করে দিলে, এবং অতি কর্কশ আর অতি তীব্র কণ্ঠে, যা মুখে আসে তাই
বললে; তারপর ঢোলকের মুখ দিয়ে ঝড় বয়ে গেল; শেষটা করতাল যখন কড়্
কড়্ কড়াৎ করে উঠলে, তখন কনসার্টের দম ফুরিয়ে গেল| বড়বাবু ইতিমধ্যে
এ সব গোলমালে কতকটা অভ্যস্ত হয়ে এসেছিলেন, সুতরাং ঐ ঐক্যতান
সঙ্গীতের বিলিতি মদ তাঁর অন্তরাত্মাকে ততটা ব্যতিব্যস্ত কর্তে
পারলে না|
এর পর নলদময়ন্তীর অভিনয় সুরু হল| বড়বাবু হাঁ করে তাই দেখ্তে
লাগলেন| এ যে অভিনয়, এ জ্ঞান দু'মিনিটেই তাঁর লোপ পেয়ে এল,-তাঁর
মনে হল নলদময়ন্তী প্রভৃতি সত্যসত্যই রক্তমাংসের দেহ ধারণ করে,
সাবিত্রী থিয়েটারে অবতীর্ণ হয়েছেন| তারপর রঙ্গ মঞ্চের উপরে যখন
স্বয়ংবরা-সভার আবির্ভাব হ'ল তখন, থিয়েটারের অভ্যন্তরে অকস্মাৎ
একটা মহা গোলযোগ উপস্থিত হ'ল| পুরুষদের মাথার উপরে চিকের অপর
পারে, রঙ্গালয়ের যে প্রদেশ মেয়েরা অধিকার করে বসেছিলেন, সেই
অঞ্চল থেকে একটা ঝড় উঠল| কোনও অজ্ঞাত কারণে সমবেত স্ত্রীমণ্ডলী
ঐক্যতানে কলরব করতে সুরু কর্লেন| ফলে আকাশে স্ত্রী-কণ্ঠের কনসার্ট
বেজে উঠল, তার ভিতর ক্লারিওনেট কর্নেট প্রভৃতি সবরকমেরই যন্ত্র
ছিল, এবং তাদের পরস্পরের ভিতর কারও সঙ্গে কারও সুরের মিল ছিল
না| তারপর সেই কনসার্ট যখন দুন্ থেকে পরদুনে গিয়ে পৌঁছল,-তখন
অভিনয় অগত্যা বন্ধ হল| এই কলহ শুনে দময়ন্তীর বড় মজা লাগল, তিনি
ফিক্ করে হেসে দর্শকমণ্ডলীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর
সখীরা সব অঞ্চল দিয়ে মুখ ঢাকলেন, আর ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ
প্রভৃতি অভ্যাগত দেবতাগণ তটস্থ হয়ে রইলেন| অমনি silence! silence!
শব্দে চতুর্দিক ধ্বনিত হতে লাগল, তাতে গোলযোগের মাত্রা আরও বেড়ে
গেল| অতঃপর দর্শকদের মধ্যে অনেকে দাঁড়িয়ে উঠে, আকাশের দিকে মুখ
করে, গলবস্ত্রে যোড়করে, উক্ত স্ত্রী-সমাজকে সম্বোধন করে-"মা
লক্ষ্মীরা চুপ করুন" এই প্রার্থনা কর্তে লাগলেন; তাতে
মা লক্ষ্মীদের চুপ করা দূরে থাকুক, তাঁদের কোলের ছেলেরা জেগে
উঠে কোকিয়ে কাঁদতে সুরু কর্লে| তখন দর্শকদের মধ্যে দু'চার জন
ইয়ারগোছের লোক, অতি সাদা বাংলায় ছেলেদের মুখ বন্ধ করবার একটা
সহজ উপায় বাৎলে দিলে, তা শুনে দময়ন্তী ও তাঁর সখীরা অন্তর্রুদ্ধ
হাসির বেগে ধুঁক্তে লাগলেন| বড়বাবু যদিচ জীবনে কখন কারও প্রতি
কোনরূপ অভদ্র কথা ব্যবহার করেন নি, তথাচ তিনি ভদ্রমহিলাদের এই
অপমানে খুসি হলেন| কেননা, তাঁর মতে যারা থিয়েটারে আসতে পারে,
সে সব স্ত্রীলোকের মানই বা কি, আর অপমানই বা কি? মিনিট দশেক
পরে, এই গোলযোগ বৈশাখী ঝড়ের মত যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ
থেমে গেল|
অভিনয় যেখানে থেমে গিয়েছিল, সেইখান থেকে আবার চল্তে সুরু কর্ল|
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বড়বাবু সেই অভিনয়ে তন্ময় হয়ে গেলেন| এই
অভিনয় দর্শনে তিনি এতটা মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তাঁর মনে সাত্ত্বিকভবের
উদয় হ'ল, তাঁর কাছে রঙ্গালয় তীর্থস্থান হয়ে উঠল| তারপর নলদময়ন্তীর
বিপদ যখন ঘনিয়ে এল, তখন তাঁর মন নায়ক নায়িকার দুঃখে একেবারে
অভিভূত দ্রবীভূত হয়ে পড়ল| নলের দুঃখেই অবশ্য তিনি বেশী করে অনুভব
করছিলেন, কেননা পুরুষমানুষের মন পুরুষমানুষেই বেশী বুঝতে পারে|
নলের প্রতি তাঁর এতটা সহানুভূতির আর একটি কারণ ছিল| তিনি প্রথম
থেকেই লক্ষ্য করেছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে ঐ রঙ্গমঞ্চের নলের যথেষ্ট
আকৃতিগত সাদৃশ্য আছে; কিন্তু পটেশ্বরীর সঙ্গে দময়ন্তীর কোন সাদৃশ্যই
ছিল না| নল রাজবেশ পরিত্যাগ কর্বার সময় সে সাদৃশ্য এতটা পরিস্ফুট
হয়ে উঠেছিল যে, মধ্যে মধ্যে বড়বাবুর মনে ভুল হচ্ছিল যে উক্ত
নল তিনি ছাড়া আর কেউ নয়! সুতরাং নল যখন নিদ্রিতা দময়ন্তীর অঞ্চলপাশ
মোচন করে, "হা হতোস্মি হা দগ্ধোস্মি" বলে, রঙ্গমঞ্চ
হতে সবেগে নিষ্ক্রমণ কর্লেন, তখন বড়বাবু আর অশ্রুসম্বরণ কর্তে
পার্লেন না;-তাঁর চোখ দিয়ে, তাঁর নাক দিয়ে দরবিগলিতধারে জল
তাঁর দাড়ী চুঁইয়ে তাঁর কম্ফার্টারের অন্তরে প্রবেশ কর্লে-ফলে
সেই গলকম্বলটি ভিজে ন্যাতা হয়ে তাঁর গলায় নেপ্টে ধর্লে| বড়বাবুর
ভ্রম হ'ল যে, কলি তাঁর গলায় গামছা দিয়ে,-শুধু গামছা নয়, ভিজে
গামছা দিয়ে,-টেনে নিয়ে যাচ্ছে!
(৪)
ঠিক এই সময়ে, একটি জেনানা-বক্স থেকে, একটি হাসির আওয়াজ তাঁর
কাণে এল| সে ত হাসি নয়, হাসির গিটকারি; জলতরঙ্গের তানের মত;
সে হাসি থিয়েটারের এক কোণ থেকে আর এক কোণ পর্যন্ত সাত সুরের
বিদ্যুৎ খেলিয়ে গেল| অভিনয়ের দোষে, নলের সজোরে পলায়নটি যে ঈষৎ
হাস্যকর ব্যাপার হয়ে উঠেছিল, তা যাঁর চোখ আছে, তিনিই স্বীকার
করতে বাধ্য-কিন্তু সেই হসিতে বড়বাবুর মাথায় বজ্রাঘাত হ'ল| তাঁর
কাণে সে হাসি চিরপরিচিত বলে' ঠেকল - এ যে পটেশ্বরীর হাসি! যে
অঞ্চল থেকে এই হাসির তরঙ্গ ছুটে এসেছিল, সেই অঞ্চলে মুখ ফিরিয়ে,
ঘাড় উঁচু করে নিরীক্ষণ করে' তিনি দেখ্লেন যে, চিকের গায়ে মুখ
দিয়ে যে বসে আছে, তার দেহের গড়ন ও বস্বার ভঙ্গী ঠিক পটেশ্বরীর
মত| অবশ্য চিকের আড়াল থেকে যা দেখা যাচ্ছিল, সে হচ্ছে একটী রমণীদেহের
অস্পষ্ট ছায়া মাত্র, কারণ সে বক্সের ভিতরে কোনও আলো ছিল না|
তাই নিজের মনের সন্দেহ ঘোচাবার জন্য তাকে ভাল করে দেখে নেবার
জন্য, বড়বাবু দাঁড়িয়ে উঠে সেই বক্সের দিকে ফ্যাল্ফ্যাল্ করে
চেয়ে রইলেন| এবারও তিনি সে স্ত্রীলোকটির মুখ দেখতে পান নি, তাঁর
চোখে পড়েছিল শুধু কালো কস্তাপেড়ে একখানি সাদা সুতোর শাড়ী| বড়বাবু
জানতেন যে, ওরকম শাড়ী তাঁর স্ত্রীরও আছে| এর থেকে তাঁর ধারণা
হ'ল যে, ও শাড়ী যার গায়ে আছে, সে নির্ঘাত পটেশ্বরী| তরপর তাঁর
মনে পড়ে গেল যে, ও শাড়ীর "আঁচরে উজোর সোণা" লুকানো
আছে| সেই তপ্তকাঞ্চনের আভায় তাঁর চোখ ঝল্সে গেল, তার আঁচে তাঁর
চোখের তারা দুটি যেন পুড়ে গেল, তিনি চোখ চেয়ে অন্ধকার দেখ্তে
লাগলেন|
ও ভাবে দণ্ডায়মান বড়বাবুকে সম্বোধন করে চারদিক থেকে লোকে Sitdown
SitDown বলে চীৎকার কর্তে লাগল| তাঁর পাশের ভদ্রলোকটি বল্লেন-"মশায়
থিয়েটার দেখ্তে এসেছেন থিয়েটার দেখুন, মেয়েদের দিকে অমন করে'
চেয়ে রয়েছেন কেন? আপনি দেখছি অতিশয় অভদ্র লোক!" এই ধমক
খেয়ে তিনি বসে পড়্লেন| বলা বাহুল্য তাঁর পক্ষে অভিনয়ে মনোনিবেশ
করা আর সম্ভব হ'ল না| তাঁর চোখের উপরে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে যাচ্ছিল,
আর বুকের ভিতর কত কি তোলপাড় করছিল, ছ্ট্ফট্ করছিল| এক কথায়,
তাঁর হৃদয়মন্দিরে দক্ষযজ্ঞের অভিনয় সুরু হয়েছিল|
তারপর অভিনয়ের টুকরো টাকরা যা তাঁর চোখে পড়্ছিল, তাতে তিনি
আরও কাতর হয়ে পড়্লেন, এই মনে করে-কোথায় দময়ন্তী, আর কোথায় পটেশ্বরী!
তারপর তাঁর মনে হ'ল যে, পটেশ্বরী যদি তাঁর কাছে মিথ্যে কথা বল্তে
পারে বিশ্বাসঘাতিনী হতে পারে, তাহলে ভূত ভবিষৎ বর্তমানের কোন্
স্ত্রীলোকের পাতিব্রত্যে বিশ্বাস করা যেতে পারে? তিনি স্পষ্ট
দেখতে পেলেন যে, নলদময়ন্তীর কথা মিথ্যা, মহাভারত মিথ্যা, ধর্ম
মিথ্যা, নীতি মিথ্যা, সব মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা!-মানুষের কষ্টই
হচ্ছে এ পৃথিবীতে একমাত্র সত্য বস্তু| তখন তাঁর কাছে ঐ অভিনয়
একটা বীভৎস কাণ্ড হয়ে দাঁড়াল| এদিকে তাঁর হাত পা সব হিম হয়ে
এসেছিল, তাঁর মাথা ঘুর্ছিল, তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে অনবরত ঘাম পড়্ছিল-অর্থাৎ
তাঁর দেহে মূর্ছার পূর্বলক্ষণ সব দেখা দিয়েছিল| তিনি আর ভিতরে
থাকতে পার্লেন না-থিয়েটার থেকে বেরিয়ে গিয়ে খোলা আকাশের নীচে
দাঁড়ালেন| বড়বাবু উপরে চেয়ে দেখ্লেন যে, অনন্ত আকাশ জুড়ে অগন্য
নক্ষত্র তাঁর দিকে তাকিয়ে সব চোখ টিপে হাস্ছে| এ বিশ্ব যে কতদূর
নির্মম, কতদূর নিষ্ঠুর,-এই প্রথম তিনি তার সাক্ষাৎ পরিচয় পেলেন|
তারপর এই আকাশদেশের অসীমতা তাঁর কাছে হঠাৎ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল,
এই নীরব নিস্তব্ধ মহাশূন্যের ভিতর দাঁড়িয়ে তাঁর বড় একা একা ঠেক্তে
লাগল;-তাঁর মনে হল, এই বিরাট বিশ্বের ভিতরে কি বাইরে কোথাও প্রাণ
নেই, মন নেই, হৃদয় নেই, দেবতা নেই;-যা আছে তা হচ্ছে আগাগোড়া
ফাঁকা, আগাগোড়া ফাঁকি| সেই সঙ্গে তিনি যেন দিব্যচক্ষে দেখ্তে
পেলেন যে, ঐ সব গ্রহ, চন্দ্র, তারা প্রভৃতি আকাশ-প্রদীপগুলো
ঐ থিয়েটারের বাতির মত দুদণ্ড জ্বলে' যখন নিবে যাবে, তখন সংসার
-নাটকের অভিনয় চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে,-আর থাকবে শুধু অসীম
অনন্ত অখণ্ড অন্ধকার! অমনি ভয়ে তাঁর বুক চেপে ধরলে, তিনি এই
অনন্ত বিভীষিকার মূর্তি চোখের আড়াল কর্বার জন্য থিয়েটারে পুনঃপ্রবেশ
করবার সংকল্প করলেন-অমনি তাঁর মনশ্চক্ষু হতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
সরে গেল, আর তার জায়গায় পটেশ্বরী এসে দাঁড়ালে| অসংখ্য অপরিচিত
অসভ্য ও আমোদপ্রিয় লোকের মধ্যে তাঁর স্ত্রী একা বসে রয়েছে-এই
মনে করে তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হ'ল| তিনি যেন স্পষ্টই দেখতে পেলেন
যে, চিকের আবরণ ভেদ করে শত শত লুব্ধনেত্রের রক্তদৃষ্টি পটেশ্বরীর
দেহকে স্পর্শ কর্ছে, অঙ্কিত কর্ছে, কলঙ্কিত কর্ছে| এর পর
বড়বাবুর পক্ষে আর এক মুহূর্তও বাইরে থাকা সম্ভব হল না, তিনি
পাগলের মত ছুটে গিয়ে আবার থিয়েটারের ভিতরে প্রবেশ কর্লেন| এবারও
তাঁর আর অভিনয় দেখা হ'ল না; তাঁর চোখের সুমুখে কোত্থেকে যেন
একটি ঘন কুয়াশা উঠে এসে, চারদিক ঝাপসা করে দিলে| দেখতে না দেখতেই
অভিনয় ছায়াবাজি হয়ে দাঁড়াল| অভিনেতা অভিনেত্রীদের কতক কথা তাঁর
কানে ঢুকলেও, তার একটি কথাও তাঁর মনে ঢুকল না| কেননা সে মনের
ভিতর শুধু একটি কথা জাগছিল, উঠছিল, পড়ছিল| যে স্ত্রীলোক খিলখিল
করে হেসে উঠেছিল, সে পটেশ্বরী-কি পটেশ্বরী নয়? এই ভাবনা, এই
চিন্তাই তাঁর সমস্ত মনকে অধিকার করে বসেছিল| তিনি বারবার সেই
জেনানা-বক্সের দিকে চেয়ে দেখতে লাগলেন, এবং প্রতিবার তাঁর মনে
হ'ল যে, এ পটেশ্বরী না হয়ে আর যায় না| শুধু তাই নয়, তিনি রঙ্গালয়ের
অন্দরমহলের যেদিকে দৃষ্টিপাত কর্লেন-সেই দিকেই দেখলেন পটেশ্বরী
বসে আছে| ক্রমে এই দৃশ্য তাঁর কাছে এত অসহ্য হয়ে উঠল যে, তিনি
চোখ বুজ্লেন| তাতেও কোন ফল হল না| তাঁর বোজা চোখের সুমুখেও
পটেশ্বরী এসে উপস্থিত হ'ল,-পরণে সেই কালা কস্তাপেড়ে শাড়ী, আর
মুখ সেই চিকে ঢাকা| তখন তাঁর জ্ঞান হ'ল যে, তাঁর মনে যে সন্দেহের
উদয় হয়েছে তা দূর কর'তে না পারলে, তিনি সত্য সত্যই পাগল হয়ে
যাবেন| তাই তিনি শেষটা মনস্থির কর্লেন যে, থিয়েটার ভাঙ্গবার
মুখে, যে দরজা দিয়ে মেয়েরা বেরোয়, সেই দরজার সুমুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকবেন| কেননা একবার সামনাসামনি স্বচক্ষে না দেখলে, তাঁর মনের
এ সন্দেহ আর কিছুতেই দূর হবে না|
তারপর যা ঘটেছিল, তা দু'কথায়, বলা যায়| থিয়েটার ভাঙ্গবার মিনিট
দশেক পরে থিয়েটারের খিড়কি-দরজায় একখানি জুড়িগাড়ী এসে দাঁড়াল|
বড়বাবুর মনে হ'ল, এ তাঁর শ্ব্শুরবাড়ির গাড়ী; যদিচ কেন যে তা
মনে হল, তা তিনি ঠিক বলতে পারতেন না| তারপর তিনটি ভদ্রমহিলা
আর একটি দাসী অতি দ্রুতপদে এসে সেই গাড়ীতে চড়্লে-অমনি সহিস
তার কপাট বন্ধ করে দিলে| বড়বাবু এঁদের কারও মুখ দেখতে পান নি,
কেননা সকলেরি মুখ ঘোমটাঢাকা ছিল| এই তিনজনের মধ্যে একজন মাত্রায়
পটেশ্বরীর সমান উচুঁ; তাই দেখে বড়বাবু বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে,
পা-দানের উপর লাফিয়ে উঠে, দু'হাত দিয়ে জোর করে গাড়ীর দরজা ফাঁক
করলেন| মেয়েরা সব ভয়ে হাঁউ-মাউ করে চেঁচিয়ে উঠলো, আর রাস্তার
লোকে সব "চোর চোর" বলে চীৎকার করতে লাগল! বড়বাবু অমনি
গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে আরম্ভ কার্লেন, আর
পিছনে অন্ততঃ পঞ্চাশজন লোক "পাহারাওয়ালা পাহারাওয়ালা"
বলে হাঁক দিতে দিতে ছুটতে লাগল| এই ঘোর বিপদে পড়ে বড়বাবুর বুদ্ধি
খুলে গেল| তিনি যেন বিদ্যুতের আলোতে দেখতে পেলেন যে, এ বিপদ
থেকে উদ্ধার পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে মাতলামির ভাণ করা| তাতে
নয় দু-দশ টাকা জরিমানা হবে, কিন্তু গাড়ী চড়াও করে ভদ্রমহিলাকে
বে-ইজ্জত করবার চার্জে, জেল নিশ্চিত| মদ না খেয়ে মাতলামির অভিনয়
করা, যখন দেহের কলকব্জাগুলো সব ঠিক ভাবে গাঁথা থাকে, তখন সে
দেহকে বাঁকানো চোরানো দোমড়ানো, কোঁকড়ান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে
এক মুহূর্তে জড় করা, আর তার পরমুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া,-অতিশয় কঠিন
এবং কষ্টকর ব্যাপার| কিন্তু হাজার কষ্টকর হলেও আত্মরক্ষার্থে-যতক্ষণ
না তিনি পাহারাওয়ালা কর্তৃক ধৃত হন,-ততক্ষণ বড়বাবুকে এই কঠিন
পরিশ্রম স্বীকার কর্তে হয়েছিল| তারপর অজস্র চড় চাপড় রুলের গুঁতো
খেতে খেতে তিনি যখন গারদে দিয়ে হাজির হলেন, তখন রাত প্রায় চারটে
বাজে| সেখান থেকে উদ্ধার পাবার জন্য তিনি শ্বশুরালয়ে সংবাদ পাঠাতে
বাধ্য হলেন| ভোর হ'তে না হ'তেই, তাঁর বড়-শ্যালক তথায় উপস্থিত
হয়ে, বেশ দু-পয়সা খরচ করে, তাঁকে উদ্ধার করে নিজেদের বাড়িতে
নিয়ে গেলেন| রাস্তায় তিনি বড়বাবুকে নানারূপ গঞ্জনা দিলেন| তিনি
বললেন-"এতদিন শুনে আসছিলুম আমরাই খারাপ লোক, আর তুমি অতি
ভাল লোক| ডুবে ডুবে জল খেলে শিবের বাবাও টের পান না-কিন্তু তুমি
ভুলে গিয়েছিলে যে ডুবে ডুবে মদ খেলে পুলিশে টের পায়!" তারপর,
তিনি শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হলে, তাঁর সঙ্গে তাঁর শ্ব্শুর কোন কথা
কইলেন না| শুধু তাঁর ছোট-শ্যালক বললেন, "Beauty and the
Beast"-এর কথা লোকে বইয়ে পড়ে; পটেশ্বরীর কপাল দোষে আমরা
তা বরাবর চোখেই দেখে আসছি| তবে তুমি চরিত্রেও যে beast,-এ কথা
এতদিন জানতুম না; আমরা ভাবতুম "পটের" ঘাড়ে বাবা একটা
জড় পদার্থ চাপিয়ে দিয়েছেন|" তারপর তিনি বাড়ির ভিতর গিয়ে
দেখেন পটেশ্বরী মেজেয় শুয়ে আছে| তার গায়ে একখানিও গহনা নেই-সব
মাটিতে ছড়ানো রয়েছে| তার পরণে শুধু একখানা কালো কস্তাপেড়ে সাদা
সুতোর শাড়ী| কেঁদে কেঁদে তার চোখ দুটি যেমন লাল হয়েছে, তেমনি
ফুলে উঠেছে| সে স্বামীকে দেখে নড়লও না চড়লও না; কথাও কইলে না;
মরার মত পড়ে রইল| তাঁর সোনার প্রতিমা ভুঁয়ে লোটাচ্ছে দেখে, সে
থিয়েটারে গিয়েছিল, কি যায় নি,-এ কথা জিজ্ঞাসা করতে বড়বাবুর আর
সাহস হ'ল না| তারপর তিনি যে কোন দোষে দোষী নন, এবং তাঁর নির্মল
চরিত্রে যে কোনরূপ কলঙ্ক ধরে নি,-এই সত্য কথাটাও তিনি মুখ ফুটে
বল্তে পারলেন না| তিনি বুঝলেন যে, আসল ঘটনাটি যে কি, ইহজীবনে
তিনিও তা জানাতে পারবেন না-তাঁর স্ত্রীও তা জানতে পাবে না-মধ্যে
থেকে তিনি শুধু চিরজীবনের জন্য মিছা অপরাধী হয়ে থাকলেন| ফলে
তিনি মহা অপরাধীর মত মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন| এ
গল্পের moral এই যে, পৃথিবীতে ভাল লোকেরই যত মন্দ হয়; - এই হচ্ছে
ভগবানের বিচার!
(
'সবুজপত্র' পত্রিকা ১৩২৩ ভাদ্র সংখ্যা)|