সোমবারের
সকালে উঠিয়াই ছয় বৎসরের ছেলে বুধা ঘুমন্ত পিতার কাণে কাণে
কহিল, "বাবা আজ সোমবার -আজ আনবে বাবা?"
নটবর
ছেঁড়া মাদুর খানার উপর একবার পাশ মোড়া দিয়া নিদ্রাজড়িত
কণ্ঠে কহিল, "আনব।" বালকের সমস্ত মুখ হাসিতে
ভরিয়া গেল, তাড়াতাড়ি ছুটিয়া বাহিরে গিয়া তাহার সমবয়সী
বড়বাড়ির ছেলে শ্রীকান্তকে ডাকিয়া কহিল, "আজ বাবা
আনবে বলেছে, দেখিস সন্ধ্যে বেলা।"
পিতা
পুত্রের এই গোপন পরামর্শের বস্তু ছিল একটা আপেল। সেদিন
শ্রীকান্ত রাস্তায় দাঁড়াইয়া যখন একটা রক্তবর্ণ ফলে মহা
উৎসাহে দন্তবেধ করিতেছিল, বুধা অনেকক্ষণ ধরিয়া দরজার ছেঁড়া
চটের আবরণের মধ্য দিয়া শ্রীকান্তের এই ভোজনলীলা দেখিল,
তাহার পর যখন লোভ সামলানো দুঃসাধ্য হইল তখন বাহিরে আসিয়া
শ্রীকান্তকে কহিল, "কি খাচ্ছিস রে ছিরিকান্ত ?"
শ্রীকান্ত নির্বিকারচিত্তে কহিল, "আপেল" বুধা
কহিল, "আমাকে এক কামড় দেনা ভাই!"
শ্রীকান্ত ফলটির শেষ অবশেষটুকু তাড়াতাড়ি গালে
পুড়িয়া কহিল, "উহু!" তারপ চর্বণ সমাপ্ত করিয়া
কহিল, "আমার বাবা এনে দিয়েছে, তোর বাবা কেন এনে দেয়
না রে?"
সাড়ে বাইশ টাকা মাহিনার কেরাণীর ছেলে পাঁচশত টাকা মাহিনার
পুত্রের এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না। সে কাঁদ
কাঁদ মুখে পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। নটবর তখন ছেঁড়া
কামিজটির উপর পাট করা মলিন চাদরখানা জড়াইয়া ন'টার গাড়ি
ধরিবার উদ্দেশে যাত্রা করিতেছিলেন, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া
বুধা কহিল, "বাবা আমাকে একটা আপেল এনে দিও।"
"আচ্ছা" বলিয়া নটবর বাহির হইয়া গেলেন।
সন্ধ্যার গাড়িতে নটবর যখন আপিস হইতে ফিরিতেছিল তখন রাস্তার
মোড়ে বুধার সহিত দেখা হইল। অন্যদিন বুধার এতক্ষণ দুপুর
রাত, আজ আপেলের লোভে আর সে ঘুমাইতে পারে নাই। মাতা জোর
করিয়া বিছানায় শোয়াইয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সন্ধ্যার
গাড়ি যখন বাঁশীর শব্দ করিয়া ষ্টেশনে প্রবেশ করিল তখন সে
নিদ্রার ভাণ ত্যাগ করিয়া রান্না ঘরের দিকে সভয়ে চাহিয়া
একেবারে পথে গিয়া উপস্থিত হইল। পিতাকে দেখিয়াই ডান হাত
খানি প্রসারিত করিয়া কহিল, "বাবা, আমার আপেল?' নটবর
কহিল, "ওঃ যাঃ ভুলে গেছিরে বুধা, কাল দেব।"
মুহুর্ত্তে
বুধার মুখখানা এতটুকু হইয়া গেল, একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলিয়া
সে কহিল, "আচ্ছা।" নটবর সত্য কথা বলে নাই। পথে
যাইতে আপেলের দোকান দেখিয়া বুধার ফরমাইসের কথা মনে হইয়াছিল
কিন্তু পকেটে একটি পয়সাও ছিল না। দারোয়ান রাম শরন সিংহের
কাছে চারি আনা পয়সা ধার চাহিয়াছিল কিন্তু পায় নাই। কাল
কোথা হইতে চার আনা জুটিবে তাহা নটবর জানিত না, শুধু নিরাশ
পুত্রকে আশ্বাস দিবার জন্য আবার এই প্রতিজ্ঞা করিল।
তারপর দিনও বুধা দিনরাত সন্ধ্যার প্রতীক্ষায় কাটাইল। আজ
যে আপেল আসিবে তাহাতে তাহার সন্দেহ মাত্র ছিল না। বাহিরের
দ্বারের পাশে সে দাঁড়াইয়াছিল, দূর হইতে পিতাকে দেখিয়াই
ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল, "বাবা আপেল দাও।"
নটবর ক্ষণিকের জন্য মুখ বিকৃত করিলেন তাহার পর পকেটে হাত
দিয়াই বলিলেন, "এই রে! সেটা বুঝি পড়ে গেছে। হ্যাঁ
তাই তো।" এ উপায় ছাড়া আজ আর শিশুকে প্রবোধ দেওয়ার
অন্য উপায় ছিল না। কিন্তু এই ছলনাটুকু করিতে নটবরের চোখ
ফাটিয়া জল আসিল।
বুধা
পিতার হাত ছাড়িয়া দিল। তারপর পিতার সঙ্গ ছাড়িয়া সম্মুখে
গিয়া আবার ফিরিয়া কহিল, "হ্যাঁ বাবা, সেটা কতবড় ছিল?"
নটবর
অঙ্গুলিগুলি বিস্তার করিয়া একটা কল্পিত পরিমাণ দেখাইয়া
দিলেন।
বুধা কহিল, "উঃ খুব বড় ত বাবা!
আচ্ছা বাবা আবার কাল আনবে?"
পরশু সোমবার মাহিনার দিন। নটবর কহিল,
"কাল না বাবা, সোমবার আনব।"
বুধা প্রশ্ন করিল,"সোমবার কবে
বাবা?"
"কালকের দিন বাদ সোমবার। দুটো
এনে দেব।"
মহা উল্লাসে বুধা কহিল, "অমনি
বড় আর লাল এনো, হ্যাঁ বাবা?"
নটবর কহিল, "আচ্ছা।"
বুধা নাচিতে নাচিতে বাড়ির উঠানে গিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, "মা
বাবা আমায় দুটো আপেল এনে দেবে, জানো? খুব বড়।"
রন্ধনশালা হইতে বুধার মাতা স্বামীর দিকে চাহিয়া কহিলেন,
"দেখছ? না পেতেই এই, পেলে যে কি করবে খোকা!"
বৌবাজারের মোড়ে দাঁড়াইয়া এক কাবুলির দোকানে নটবর বাছিয়া
বাছিয়া দুটি বড় আপেল পছন্দ করিয়া দাম স্থির করিয়া খাঁ
সাহেবকে কহিলেন, "এ দুটো আলাদা ক'রে রেখে দিও ফিরবার
পথে নিয়ে যাব।"
দোকানের সেরা আপেল দুটি। অনেক দিনের প্রার্থিত ফল দুটি
পুত্রের হাতে দিলে তাহার মুখে যে পুলকের হাসিটুকু দেখা
দিবে, কল্পনায় তাহা দেখিয়া নটবর দত্তের শীর্ণ মুখখানি
উল্লাসে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
বেলা তিনটা বজিতেই মাহিনার বিল লইতে নটবর উঠিয়া বড় বাবুর
ঘরে গেলেন। বড় বাবু বিলখানি নটবরের সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন।
বিল দেখিয়াই নটবরের বুকের মধ্যে ধড়াস করিয়া উঠিল। বিলের
পাশে কাজ সম্পূর্ণ না করিবার অজুহাতে নটবর দত্তের মাহিনা
দেওয়া স্থগিত রাখিবার হুকুম লেখা ছিল। লাল পেন্সিলের এই
ইংরাজী অক্ষর কয়টা যেন হাতুড়ী দিয়া তাহার বুকের পাঁজর
কয়খানি একেবারে চূর্ণ করিয়া দিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া
ভীতকণ্ঠে নটবর কহিলেন, বড়বাবু-"
বড়বাবু কহিলেন, "আমি কিছু করতে পারব না মশাই, সাহেব
বড় কড়া লোক জানেন তো? আপনি সাহেবের কাছে যান।" বিলখানি
তুলিয়া লইয়া নটবর আকাশ পাতাল ভাবিতে ভাবিতে বড় সাহেবের
দরজায় গিয়া দাঁড়াইল। চাপরাশি খবর দিলে ভিতর হইতে হুকুম
আসিল, "কম ইন।"
নটবর
সুদীর্ঘ প্রণতি করিয়া কহিল, "হুজুর আমার মাহিনা-"
সাহেব তখন ওয়ালটেয়ারে তাঁহার পত্নীকে আগামী বড়দিনের
উপহার পাঠাইবার আয়োজন করিতেছিলেন, তাঁহার সকল কথা শুনিবার
সময় ছিল না, ইংরাজিতে কহিলেন, "হবে না, কাজ ফাঁকি
দিলে আমার কাছে কোনও মাফ নেই। যাও।"
নটবর
কাঁদিয়া ফেলিলেন। কহিলেন "হুজুর। কালই সারারাত খেটে
সব শেষ করে দেব।"
সাহেব চিঠি হইতে কলম তুলিয়া কহিলেন,
"তা হলে পরশু মাইনে পাবে।"
"হুজুর, একটি টাকা অন্ততঃ আট
আনা পয়সা দেওয়ার হুকুম-"
"নট এ ফার্দ্দিং! যাও," বলিয়া ফলের দুইটি ঝুড়ি
টেবিলের উপর তুলিয়া লেবেল আঁটিয়া দিলেন "ফর হ্যারি"।
"ফর নেলী।" হ্যারি সাহেবের পুত্র, ও নেলী কন্যা;
উভয়ে তখন মাতার সহিত স্বাস্থ্যাবাসে ছিল।
একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নটবর বাহির হইয়া অসিলেন এবং
বিলখানি বড়বাবুর হাতে দিয়া কহিলেন, "কিছু হোলো না।"
একবার মনে হইল বড়বাবুর কাছে টাকা ধার চাহিয়া লইবেন। কিন্তু
হঠাৎ যেন সমস্ত জগৎটার উপর কেমন ঘৃণা জন্মিয়া গেল, ইচ্ছাটা
কাজে পরিণত করিবার আর প্রবৃত্তি হইল না, সমস্ত পথ মনে
পড়িতে লাগিল বুধার কথা। কাল রবিবার সমস্তটা দিন বুধা তাঁহাকে
তাঁহার সোমবারের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করাইয়া দিয়াছে;
সে বেচারা যে আজ সারাদিন তাঁহার প্রতীক্ষা করিবে তাহাতে
আর তাঁহার সংশয় ছিল না। এইক্ষণে নিশ্চয়ই সে ষ্টেশনের রাস্তার
ধারে পিতার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে। তাঁহাকে দেখিলেই
আগ্রহে ছুটিয়া আসিবে- তাহার পর?
ভাবিতে ভাবিতে নটবর যে বৌবাজারের মোড়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন
সে খেয়াল আদৌ ছিল না। হঠাৎ এক ঝাঁকা মুটের ধাক্কা খাইয়া
তাঁহার চমক হইল। রাস্তার অপর ধারেই সেই আপেলের দোকান।
ধীরে ধীরে রাস্তা পার হইয়া গিয়া দোকানের সম্মুখে দাঁড়াইয়া
নটবর সেই আপেলের দুটির দিকে চাহিলেন। বুধার কথা মনে হইল;
মনে হইল যে একটি নগ্নকায় শিশু আগ্রহে হাত বাড়াইয়া তাহার
মুখের দিকে চাহিয়া বলিতেছে, "বাবা আপেল।"
আবিষ্টের মত নটবর আপেল দুটো তুলিয়া লইলেন। পর মুহুর্ত্তেই
কে আসিয়া তাঁহার হাত চাপিয়া ধরিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল,
" এই চোট্টা হ্যায়!" তাহার পর আর কিছু মনে ছিল
না, যখন জ্ঞান হইল তখন নটবর থানার গারদ ঘরে।
বেলা
পাঁচটা হইতে বুধা ষ্টেশনের পথে দাঁড়াইয়াছিল। সাড়ে ছয়টায়
যখন গাড়ি হুস হুস করিয়া ষ্টেশনে প্রবেশ করিল, তখন আনন্দে
তাহার বুক কাঁপিয়া উঠিল। তাহার পর যখন যাত্রীরা পথ দিয়া
চলিতে লাগিল তখন আর তাহার ধৈর্য্য রহিল না। প্রতি মুহুর্ত্তেই
সে একবার করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। প্রত্যেক দূরের মানুষটিকেই
পিতা বলিয়া মনে হইতেছিল, আগ্রহে অগ্রসর হইয়া পথচারীর মুখের
দিকে চাহিয়া আবার সে ফিরিয়া আসিতেছিল। এমনি করিয়া একঘন্টা
কাটাইয়া যখন আর কেহ রাস্তায় চলিবার রহিল না। তখন শুষ্কমুখে
সে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, "বাবা আসে নি মা। বাবা এলে
আমাকে ডাকবে হ্যাঁ, মা ?"
হার
পরে ন'টার গাড়ি ছিল। আজ মাহিনার দিন; হয়তো জিনিষপত্র কিনিয়া
আনিতে দেরী হইয়া গেছে ভাবিয়া হৈমবতী কহিলেন, "আচ্ছা,
তুই ঘুমো এখন।"
রাত্রে যখন বুধা স্বপ্ন দেখিতেছিল যে তাহার ছেঁড়া জামার
পকেট দুটি আপেলের ভারে ফুলিয়া উঠিয়াছে তখন দারোগা রিপোর্ট
লেখা শেষ করিয়া নটবর দত্তকে চুরী অপরাধে কোর্টে উপস্থিত
করিবার অর্ডার লিখিতেছিলেন।
(‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, আষাঢ় ১৩৩৩)