পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
কৃতজ্ঞতা
সরোজনাথ ঘোষ
[ লেখক পরিচিতি : সাহিত্যিক সরোজনাথ
ঘোষ সম্বন্ধে বিশদ ভাবে কিছু জানা যায় নি| তিনি ধীর্ঘকাল 'মাসিক
বসুমতী'র সহকারী সম্পাদক ছিলেন| 'পল্লীবাণী' পত্রিকারও যুগ্ম-সম্পাদক
হিসাবে কাজ করেছেন| তিনি একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা| তার প্রকাশিত
গ্রন্থ : 'শত গল্প গ্রন্থাবলী' ; 'মস্তকের মূল্য' ; 'জাল সম্রাট'
; 'বিসমার্ক' ; ঐজার্মানীর গুপ্তচর' ; 'বিদ্রোহী শাসক' ; 'যুবরাজ'
; 'যমুনাধারা'| মৃত্যুর পূর্বে তিনি দীর্ঘদিন পাকস্থলীর পীড়ায়
কষ্ট পেয়েছেন| সরোজনাথের মৃত্যু হয় ১৩৫১ বঙ্গাব্দের ২৮শে বৈশাখ
চেতলায়| তার মৃত্যুতে প্রকাশিত শোক সংবাদে দেখা যায় যে মৃত্যুকালে
তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর| এই হিসাবে তার জন্ম ১২৮১ বঙ্গাব্দে
ধরা যেতে পারে| ]
দীপক সেনগুপ্ত|
[ ১ ]
বিধুভূষণকে
যাহারা জানিত, তাহাদের সকলেই একবাক্যে বলিত যে, তাহার বড় 'জোর
কপাল|' তা' যে জন্যই হউক না কেন, সে যে বাণীপাণি ও কমলা উভয়েরই
সু-নজরে পড়িয়াছিল, উত্তরকালে তাহা সকলকেই স্বীকার করিতে হইয়াছিল|
অত্যন্ত কৃশকায় বিধুভূষণ, চৌদ্দবৎসর বয়সে যখন জমীদার রাধামাধব
চৌধুরীর গৃহ-জামাতার আসন অলঙ্কৃত করিয়াছিল, তখন কেহ স্বপ্নেও ভাবে
নাই যে, এই ক্ষীণ-স্বাস্থ্য বালক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়রূপ সমুদ্রের
পরীক্ষার পর্ব্বত-প্রমাণ ঢেউগুলি ভাঙ্গিয়া, অনায়াসে অপর পারে উত্তীর্ণ
হইবে|
রাধামাধব বাবু একালে জন্মগ্রহণ করিলেও অনেক বিষয়ে নেহাৎ 'সেকেলে'
লোক ছিলেন| অল্পবয়সে কন্যার বিবাহ দিয়া, কুলীন ও নাবালক জামাতাকে
গৃহে রাখিয়া, তাহাকে মানুষ করিয়া তোলার দিকে তাঁহার বড় ঝোঁক ছিল|
হাল সভ্যতা তাঁহাকে এ বিষয়ে মোটেই কাবু করিতে পারে নাই| তাই তিনি
পিতৃ-মাতৃহীন, কুলীন বিধুভূষণকে জামাতার পদে বরণ করিয়া লইয়াছিলেন|
কাঁচা সোনার ন্যায় বর্ণ ও অটুট কৌলীন্য-মর্য্যাদা ব্যতীত বিধুভূষণের
গর্ব্ব করিবার আর কিছুই ছিল না| রাধামাধব বাবু এই দুই গুণের জন্যই
তাহাকে মনোনীত করিয়াছিলেন|
বিবাহের পর শ্ব্শুরালয়ই বিধুভূষণ দিনযাপন করিতেছিলেন| তাহার অন্যান্য
আত্মীয়স্বজন ভাবিয়াছিলেন, রাজভোগে থাকিয়া এবং ক্রমোদ্ভিন্নযৌবনা
সুন্দরী পত্নীর সাহচর্য্যে তাহার লেখা-পড়া শিখিয়া মানুষ হওয়া অত্যন্তই
অসম্ভব ব্যাপার| কিন্তু যথাসময়ে সে যখন অবলীলাক্রমে প্রবেশিকা-পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হইয়া কলেজে এফ্ এ পড়িতে আরম্ভ করিল এবং নাকের উপর সোনার
চশমা আঁটিয়া দৃষ্টিকে ঊর্দ্ধ্বগামী করিয়া দিল, তখন বাধ্য হইয়া
সকলেই তাহার 'তারিফ্' করিতে লাগিল|
কলেজে পড়িবার সময় বিধুভূষণ শ্বশুর মহাশয়কে বুঝাইয়া দিল যে, হিন্দু-হোষ্টেলে
থাকিয়াই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া ঠিক; নহিলে লেখা-পড়ার অনেক ব্যাঘাত
ঘটিবার সম্ভাবনা| শ্যামবাজার হইতে প্রত্যহ বাড়ীর গাড়ী অথবা ট্রামে
চড়িয়া কলেজে যাতায়াত করা চলে বটে; কিন্তু তাহাতে অনেকটা সময় বৃথা
নষ্ট হইবে| রাধামাধব বাবু অবিলম্বেই সেইরূপ ব্যবস্থা করিয়া দিলেন|
জামাতাকে মানুষ করিয়া তোলাই তাঁহার বিশেষ লক্ষ্য ছিল, সুতরাং তাহার
কোনও সাধ তিনি অপূর্ণ রাখিলেন না|
অন্যান্য ধনীর সন্তানেরা হোষ্টেলে থাকিয়া যেমন স্বচ্ছন্দে কলেজ-জীবন
যাপন করে, রাধামাধব বাবু নিজ জামাতার জন্যও সেইরূপ ব্যবস্থা করিয়া
দিয়াছিলেন| তিনি তাহাকে পর্য্যাপ্ত অর্থ-সাহায্যই করিতেন| বিধুভূষণও
রীতিমত উঁচু চালে চলিত|
অর্থ মানুষকে অনেক সময় পথভ্রান্ত করে, একথা একেবারে অস্বীকার করিবার
উপায় নাই| প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ হাতে থাকায় বিধুভূষণ যে প্রকৃতই
বিপথে চলিতেছিল, সে সম্বন্ধে কাহারও কাহারও সন্দেহ থাকিলেও এক
শ্রেণীর লোক রটনা করিয়া দিল যে, যৌবন-সুলভ চাপল্য বশতঃ বিধুভূষণ
একটু ভিন্নপথে চলিয়াছে| ক্রমশঃ কথাটা রাধামাধব বাবুর কানে উঠিল|
বিধুভূষণ প্রায়ই নিষিদ্ধ স্থলে যাতায়াত করিয়া থাকে এবং কালোচিত
সভ্যতার অনুমোদিত আনুষঙ্গিক নানাবিধ পান ও ভোজনে ক্রমশঃ দক্ষ হইয়া
উঠিতেছে, এ সংবাদ আর গোপন রহিল না|
উপায়ান্তর না দেখিয়া বিষয়-বুদ্ধিতে পরিপক্ক রাধামাধব ক্রমশঃ বিধুভূষণের
মাসহারার টাকা কমাইয়া দিলেন; যে পরিমাণ টাকা না হইলে হোষ্টেলের
খরচ চলে না, শুধু ততটুকু সাহায্যই করিতে লাগিলেন| বিধুভূষণ শ্বশুরের
এ ব্যবহারে মর্ম্মান্তিক চটিয়া গিয়াছিল| এ অপমানের স্মৃতি সে জীবনে
ভুলিল না|
কয়েকবৎসরের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম উপাধি ও নির্ম্মাল্য
লাভ করিয়া বিধুভূষণ কলিকাতার কোনও কলেজে অধ্যাপনার কাজ যোগাড়
করিয়া লইল| তারপর একদিন সহসা সে রাধামাধব বাবুর নামে আদালতে
চুক্তিভঙ্গের দাবী দিয়া নালিশ রুজু করিয়া দিল| এজন্য তাহার মনে
বিন্দুমাত্র অনুতাপ জন্মিয়াছিল কি না, সে সংবাদ কাহারও জানা
নাই; তবে জামাতার এইরূপ ব্যবহারে মর্ম্মাহত হইয়া অপমান ও লাঞ্ছনার
দায় হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য বিধুভূষণের দাবীর দুই হাজার টাকা
যখন রাধামাধব মিটাইয়া দিয়াছিলেন, তখন বিধুভূষণের স্বভাবগম্ভীর
মুখমণ্ডলে যে হাস্যরেখা বিকসিত হইয়াছিল, তাহা অনেকেরই চোখে পড়িয়াছিল|
[ ২ ]
ইন্দিরার শুভদৃষ্টি যখন যাহার উপর পড়ে, তখন চারিদিক্ হইতে তাহার
মস্তকে অর্থ, মান ও যশঃ অজস্রধারায় বর্ষিত হয়| শ্বশুর-জামাতার
মধ্যে যে মনোমালিন্য জন্মিয়াছিল, কালক্রমে তাহা মুছিয়া দিল|
জামাতার সাফল্যে তিনি তাহার সকল অপরাধ মার্জ্জনা করিলেন| বিধুভূষণ
যেমন মেধাবী, তেমনই কৌশলী| ব্যবসায়-বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা তাহার
বিশেষরূপেই ছিল| কলেজে অধ্যাপনার কাজ করিতে করিতে সে বুঝিতে
পারিল যে, প্রসিদ্ধ অধ্যাপকগণের রচিত গ্রন্থাদির মুদ্রণ ও প্রচারভার
যদি সে আয়ত্তের মধ্যে আনিতে পারে, তাহা হইলে কমলা অচিরে তাহার
ঘরে অচলা হইয়া থাকিবেন| কিন্তু সে জন্য প্রথমতঃ কিছু অর্থের
প্রয়োজন| ধনবান্ শ্বশুর যাহার প্রতি অনুকূল, তাহার পক্ষে অনেক
দুরূহ বিষয়ও সুসাধ্য হইয়া উঠে| বিধুভূষণের সঙ্কল্পের কথা অবগত
হইয়া রাধামাধব বাবু তাহাকে কয়েক সহস্র টাকা দান করিলেন|
উদ্যোগী বিধুভূষণ কয়েক বৎসরের মধ্যে, বহুসংখ্যক সাহিত্যিককে
কবলিত করিয়া অর্থের মঞ্জুষা ও যশের নির্ম্মাল্যের অধিকারী হইল|
তাহার শীর্ণ ঋজু দেহে সৌভাগ্যের সকল প্রকার চিহ্ণ ক্রমশঃ পরিপুষ্ট
হইয়া উঠিল| আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টি দেখিয়া
বিধুভূষণও আত্মপ্রসাদ লাভ করিল|
এইরূপে বিধুভূষণের অদৃষ্টাকাশ যখন শারদগগনের ন্যায় নির্ম্মল
হইয়া আসিতেছিল, ঠিক সেই সময় তাহার শ্বশুর রাধামাধব বাবু একটিমাত্র
একবৎসরের শিশু পুত্র রাখিয়া পরপারে যাত্রা করিলেন| বিপুল সম্পত্তি
অপরিণামদর্শী, মুর্খ এবং লুণ্ঠন-লোলুপ নায়েব-গোমস্তার হাতে পড়িয়া
নষ্ট হইবার সম্ভাবনা দেখিয়া, সুশিক্ষিত বিধুভূষণ শাশুড়ী ঠাকুরাণীকে
বিচক্ষণ ম্যানেজার নিযুক্ত করিবার পরামর্শ দিল| কিন্তু এমন বিচ্ক্ষণ,
বুদ্ধিমান্ ও উচ্চশিক্ষিত জামাতা থাকিতে অন্য কাহারও হাতে তিনি
নাবালক পুত্রের পৈতৃক সম্পত্তির রক্ষার ভার দেওয়া বাঞ্ছনীয় বলিয়া
মনে করিলেন না| বিধুভূষণ প্রথমতঃ 'তানা নানা' করিয়া কিছুদিন
কাটাইয়া দিল বটে; কিন্তু অবশেষে শ্বশ্রূমাতার সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ
সে এড়াইতে পারিল না| কর্ত্তব্যবোধে সে কর্ণধারহীন সম্পত্তির
কর্ণ দৃঢ় হস্তে ধারণ করিল| সঙ্গে সঙ্গে কলেজে অধ্যাপনার কাজ
ছাড়িয়া দিল|
[ ৩ ]
তাহার কাজও ক্রমে অনেক বাড়িয়া গিয়াছিল| জমিদারীর কার্য্যভার
গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিধুভূষণের সুদৃশ্য ত্রিতল অট্টালিকা
যেন গগন ভেদ করিয়া উত্থিত হইল; মোটর-গাড়ী কেনা হইয়াছিল, বাগানবাড়ীর
প্রতিষ্ঠা করিয়া সে সহচরবর্গের বাহবাও লাভ করিল| কংগ্রেস অথবা
কোন প্রকার রাজনীতিক আন্দোলনে বিধুভূষণ কখনও যোগ দিত না| বড়
বড় সাহেবসুবার সহিত মেলা-মেশার দিকেই তাহার বেশী ঝোঁক ছিল| তাহার
ফলে কলিকাতা মহানগরীর কোন বিভাগের অবৈতনিক হাকিমত্ব তাহার ললাটে
জয়টীকা লেপিয়া দিয়াছিল| সকলেই বলিত যে, অদূর-ভবিষ্যতে রায়সাহেব
অথবা রায় বাহাদুরী খেতাব-লাভ বিধুভূষণের পক্ষে অসম্ভব নহে|
তাহার এইরূপ ভাগ্য-পরিবর্ত্তনে নষ্ট-দুষ্ট লোক বলিত, 'শ্বশুরের
চেষ্টায় এবং শ্বশুরালয়ের দৌলতেই বিধুভূষণ আজ লোকসমাজে পরিচিত হইয়াছে'|
অনেকে প্রকাশ্যভাবে এমন ইঙ্গিতও করিত যে, আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের
ন্যায়, নাবালক শ্যালকের লৌহ-সিন্দুক এবং সম্পত্তির ঐন্দ্রজালিক
প্রভাবে তাহার যাবতীয় ঐশ্বর্য্যের অভ্যুদয় হইয়াছে|
এ রটনা বিধুভূষণের কর্ণেও প্রবেশ করিত| সে ন্যায়শাস্ত্র পড়িয়াছিল,
সুতরাং নিন্দাকারিগণের এরূপ কুৎসা সে হাসিয়া ঠেলিয়া ফেলিত| শ্বশুর
তাহার এমনই কি করিয়াছেন? যাহা তাঁহারা করা উচিত ছিল, শুধু সেইটুকুই
তিনি পালন করিয়াছেন| সে কুলীনের সন্তান, মৌলিকে কাজ করিয়া, তাহার
বংশ-মর্য্যাদার প্রভাবে শ্বশুরবংশকে উন্নত করিয়া দিয়াছে| বিনিময়ে
শ্বশুর তাহাকে লেখা-পড়া শিখাইয়াছেন| তাহার নিজের উদ্যম ও চেষ্টা
না থাকিলে কি সে সাফল্য লাভ করিতে পারিত?
মানুষের নিকট এরূপ কৈফিয়ৎ দিলেও তাহার অন্তর কিন্তু ইহাতে প্রবোধ
মানিত না| সত্যকে তাহারা আমল দিতে চাহে না, তাহাদের নিকট সত্য
শুধু কঠোর নহে, উহা বিষের মত তীব্র, জ্বালাময় ও দুষ্পাচ্য| কোনও
কোনও স্পষ্টবক্তা, নির্ভীক আত্মীয় তাহার মুখের সম্মুখে তাহার আকস্মিক
উন্নতির কথা উল্লেখ করিয়া এমন মন্তব্য প্রকাশ করিতেন যে, প্রকাশ্যে
হাসি-মুখে উপেক্ষা করিলেও তাহার হুলটুকু খোঁচার মত সর্ব্বদাই বিধুভূষণের
মনে খচ্-খচ্ করিত এবং জ্বালা দিত| যে শ্বশুরের অন্নে তাহার দেহ
পুষ্ট হইয়াছিল, তাঁহার নামে টাকার জন্য সে নালিশ করিয়াছিল, কথাপ্রসঙ্গে
কেহ কেহ সে কথারও আলোচনা করিতে কুণ্ঠিত হইত না| ঠিক তাহাকে উদ্দেশ
করিয়াই যে এ সকল কথার আন্দোলন হইত, তাহা নহে, কিন্তু নিমকহারামীর
কথা উঠিলে তাহারা গল্পচ্ছলে প্রকাশ্য সভায় এই ঘটনার উল্লেখ করিত|
যাহারা তাহার বাল্য ও যৌবনের ইতিহাস জানিত, তাহারা এই আলোচনায়
আনন্দ পাইত এবং তাহাদের নয়নের বিদ্রপচঞ্চল দৃষ্টি ও আননের কৌতুক-হাস্য
বিধুভূষণের অন্তরতম প্রদেশে বিষম জ্বালা উৎপাদন করিত|
এই সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আলোচনার ফলে শ্বশুরের প্রতিই বিধুভূষণের
চিত্ত শুধু বিরূপ নহে-বিদ্বেষে ভরিয়া উঠিতেছিল|
[ ৪ ]
নিজের পুস্তকের ব্যবসায়, হাকিমী ও অন্যান্য নানাবিধ কার্য্যে
সর্ব্বদা বিশেষ বিব্রত থাকিতে হয় বলিয়া, বোধ হয়, বিধুভূষণ নাবালক
শ্যালকের বিষয়-সম্পত্তি রক্ষার ও পরিচালনের সুব্দোবস্ত করিতে
পারে নাই| নহিলে লাটের খাজানা দেওয়া ও সংসারের মানসম্ভ্রম বজায়
রাখিবার খরচ কুলাইবার জন্যই বা লক্ষ টাকার কোম্পানীয় কাগজ লৌহসিন্দুকের
নিভৃতকক্ষ ত্যাগ করিয়া অনির্দ্দিষ্ট পথে যাত্রা করিবে কেন? দশ
বৎসর ধরিয়া বিধুভূষণ সম্পত্তির কর্ণধার| এই সময়ের মধ্যেই রাধামাধবের
দীর্ঘকালের সঞ্চিত অর্থ রাশি বিষয়ের আয়ের সঙ্গে সঙ্গেই কেন অন্তর্হিত
হইল, বিধুভূষণ তাহার নির্দ্দিষ্ট কারণ কাহাকেও বুঝাইয়া দিতে
পারিত না| যশোদেব তাহার সকল কর্ম্মে সহায় হইয়াও নাবালকের বিষয়-রক্ষার
ব্যবস্থায় তাহার সঙ্গে বড় 'আড়া-আড়ি' করিতেছিলেন|
এ সম্বন্ধে কেহ কোন প্রশ্ন করিলে সে বলিত, "আমি আর পারি না|
নায়েব-গোমস্তাগুলির সবই চোর-কেবল দু'হাতে লুঠ করিবে! কর্ত্তার
আমলের লোক, কাহাকেও কিছু বলিলে শাশুড়ী ঠাক্রুণ অসন্তুষ্ট হ'ন|
তায় ক'বছর খালি অজন্মা| এতে কি জমীদারী আর রাখা যায়? যদি ঠাক্রুণ্
একটু শক্ত হ'তেন, তা' হ'লে বরং কিছু সুবিধা হ'ত| তিনিও দু'হাতে
কেবল টাকা খরচ করবেন|"
শেষে এমন অবস্থা দাঁড়াইল যে, লাটের খাজানার জন্যও দেনা না করিলে
আর বিষয় রক্ষা হয় না| কোন মহালে প্রজার বিদ্রোহ, কোথাও অজন্মা,
আবার কোন কোন স্থূল হইতে নায়েব গোমস্তার তহবিল-তছরূপের সংবাদও
আসিতে লাগিল| বিধুভূষণ ইতিমধ্যে কোন কোন মহালের পুরাতন কর্ম্মচারীদিগকে
বরখাস্ত করিয়া সেই সেই স্থলে নিজের নির্ব্বাচিত বিশ্বস্ত লোক
নিযুক্ত করিয়াছিল| কিন্তু তাহাতেও কোন সুফল দেখা গেল না| পাওনা
অপেক্ষা দেনার ঘরের অঙ্কেই ক্রমশঃ শূন্য বাড়িতেছিল|
রাধামাধবের বিশাল জমীদারীর চারিদিকে হাহাকার উঠিল| আত্মীয়-স্বজন
সকলেই অবস্থা দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলেন| বিধবা মাতাও নাবালক সন্তানের
জন্য চিন্তিত হইয়া উঠিলেন| আন্দোলন-আলোড়নে বিধুভূষণের ধৈর্য্যের
বাঁধও টলিয়া উঠিল|
[ ৫ ]
প্রাতঃস্নানশেষে
সাজিভরা সদ্যচয়িত ফুল ও বিল্বদলে শিবপূজা সারিয়া রাধামাধবের
বিধবা পত্নী সবে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন, এমন সময় ব্যস্তভাবে বিধুভূষণ
সেখানে উপস্থিত হইল| কোঁচান চাদরখানি কোমরে সন্তর্পণে বাঁধিয়া,
সোনার চশমার মধ্য হইতে শাশুড়ীর দিকে চাহিয়া সে বলিল, "আজ
অষ্টম, তা জানেন ত?"
সরলা বিধবা কর্ম্মচারীদিগের মুখে আজ সকালেই সে কথা শুনিয়াছিলেন|
আরও শুনিয়াছিলেন যে, অতিরিক্ত বিশ হাজার টাকার যোগাড় আজ না হইলে
বিষয় লাটে উঠিবে| মহাল হইতে যে টাকা আসিয়াছে, তাহাতে খাজানার অর্দ্ধেকও
কুলাইবে না| এ সংবাদে তাঁহার মনে যে উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কার সঞ্চার
হইয়াছিল, তাহার ফলে আজ তিনি সর্ব্বান্তঃকরণে ইষ্টদেবতার চরণে অর্ঘ্য
দিতে পারেন নাই|
জামাতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলিলেন, "তা' ত জানি বাবা|"
অধীরভাবে বিধুভূষণ বলিল, "কিন্তু টাকার উপায় কি? এত টাকা
এখন কোথায় পাওয়া যায়?"
বসিবার জন্য জামাতাকে আসন পাতিয়া দিয়া পূর্ব্ববৎ মৃদুস্বরে বিধবা
বলিলেন, "সবই তো তোমার উপর ভার বাবা| যা'তে ভাল হয়, তাই কর|
আমি আর কি বল্বো? বিষয়টা তো রক্ষা করা চাই|"
বিধুভূষণ আসনগ্রহণ করিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, "দুই চারি হাজার
করিয়া আমি তো এ যাবৎ দশ হাজার টাকা আপনার ষ্টেটে ধার দিয়েছি, তা
তো আপনি জানেন| সে জন্য কোন দলিল পর্য্যন্ত এখনও হয়নি| শুধু হাতে
আমি আর কত দিতে পারি, বলুন?"
আজ প্রাতে সদরের কর্ম্মচারীরা মনিব ঠাকুরাণীকে ইঙ্গিতে জানাইয়াছিল
যে, জামাইবাবু ছাড়া এ বিপদের সময় এখন এত টাকা আর কেহ দিতে পারিবে
না|
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া কর্ত্রীঠাকুরাণী বলিলেন, "এ সময়
তুমি সাহায্য না করিলে চলিবে কেন? সবই তো তোমার উপর নির্ভর| যেমন
করিয়াই হউক না কেন, লাটের খাজনা দিতেই হইবে|"
বিধুভূষণ কিছুকাল চিন্তা করিয়া বলিল, "আমার কাছে অবশ্য আরও
বিশ হাজার টাকা আছে; কিন্তু শুধু হাতে আমার যথাসর্ব্বস্ব তো দিতে
পারি না| পরিণামে কোন গোলযোগ ঘটিলে, আমি গরীব মানুষ, মারা যাইব|
সুতরাং যদি * * * পরগণাটা বন্ধক রাখেন, তবেই আমি টাকাটা যোগাড়
করিয়া দিতে পারি|"
বিধবা শিহরিয়া উঠিলেন| স্বামীর কাছে তিনি শুনিয়াছিলেন, * * * পরগণা
তাঁহাদের যাবতীয় সম্পত্তির মধ্যে লাভবান্ ও উৎকৃষ্ট| সেই সম্পত্তি
সর্ব্বাগ্রেই বন্ধক দিতে হইবে? উপায় কি? শিরে সংক্রান্তি| বিষয়-রক্ষা
করিতেই হইবে; সুতরাং গত্যন্তর নাই| প্রাচীরগাত্রে পরলোকগত স্বামীর
তৈলচিত্র দুলিতেছিল; বিধবা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাহার দিকে চাহিলেন|
এমন সময় একাদশ বর্ষের নাবালক পুত্র রমেশ, মাষ্টারের কবল হইতে সে
বেলার মত মুক্তিলাভ করিয়া নাচিতে নাচিতে মাতার কাছে ছুটিয়া আসিল|
অপাঙ্গে ভগিনীপতির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া সে বলিল, "মা, আমায়
একটা কলের গান কিনে দিতে হবে|"
অলক্ষ্যে নয়নাশ্রু মার্জ্জন করিয়া জননী সস্নেহে পুত্রকে বুকে টানিয়া
লইলেন| কষ্টে কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া বলিলে, "আচ্ছা, বাবা!"
বিধুভূষণ নীরসকণ্ঠে বলিল, "এই সকল বাজে খরচ বন্ধ না করায়
আজ এমন অবস্থা হয়েছে| আপনি তো মোটে বোঝেন না|"
বিধবা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন| সত্যই কি তাঁহারই অপব্যয়ে
আজ স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তির এই দুর্দ্দশা?
বিধুভূষণ অধীরভাবে বলিল, "আর সময় নেই| কি করিতে চান, বলুন|
বন্ধক দিতে যদি আপত্তি-"
রমেশজননী ব্যগ্রকণ্ঠে বলিলেন, "না বাবা, তুমি যা ব্যবস্থা
ক'রে দেবে, তাই হবে| আমার বল, বুদ্ধি ও ভরসা সবই তুমি|"
বিধুভূষণ দ্রুত চঞ্চলচরণে নীচে নামিয়া গেল|
অষ্টম রক্ষা হইল| সে যাত্রা বিষয় লাটে উঠিল না| রাধামাধব বাবুর
পত্নী নাবালক পুত্রের অভিভাবিকা এবং সমগ্র সম্পত্তির অছি ছিলেন|
সেই অধিকারে তিনি ত্রিশ হাজার টাকায় * * * পরগণা জামাতার নিকট
বন্ধক রাখিলেন| যথারীতি দলিলাদি সম্পাদিত হইল|
[ ৬ ]
নিজমুখে কিছু প্রকাশ না করিলেও বিধুভূষণের অনুগ্রহভাজনেরা চারিদিকে
তাহার এই মহত্ত্বের কথা প্রচার করিয়া দিল| বিংশ শতাব্দীতে কে
এমন আছে যে, শ্যালকের বিষয়-রক্ষার জন্য ত্রিশ হাজার টাকা দিয়া
থাকে? কিন্তু বাঙ্গালী জাতি, বিশেষতঃ বিধুভূষণের আত্মীয়-স্বজন
তাহার এই উদারতা, মহিমা উপলব্ধি করিতে পারিল না| বরং এই ব্যাপারে
তাহার স্বার্থপরতা ও কৃতঘ্নতা আত্মপ্রকাশ করিয়াছে বলিয়া তাহার
শ্বশুরালয়ের সংশ্লিষ্ট আত্মীয়স্বজন মত প্রকাশ করিতে লাগিলেন|
রাধামাধব
বাবুর পত্নীর বিষয়বুদ্ধি কোনও কালে তেমন তীক্ষ্ণ ছিল না| তিনি
অত্যন্ত সরলা ও সহজ-বিশ্বাসী ছিলেন| সংসারের কুটিলতা, স্বার্থপরতা
কোনও দিন তাঁহার পবিত্র চরিত্রকে কলঙ্কমলিন করিতে পারে নাই| কৃতবিদ্য
জামাতার উপর তাহার অগাধ বিশ্বাস ছিল| ইচ্ছাপূর্ব্বক সে যে কোনও
দিন তাহার নাবালক পুত্রের অনিষ্ট করিবে, এ আশঙ্কা কোনও দিন তাহার
মনে উদিত হয় নাই| স্বামীর আমলের স্বর্ণপ্রসূ সম্পত্তি ক্রমশঃ ঋণজালে
জড়িত হইয়া পড়িতেছে, এ চিন্তা তাঁহার চিত্তকে ব্যথিত ও শঙ্কিত করিয়া
তুলিয়াছিল সত্য; কিন্তু তজ্জন্য তিনি বিধুভূষণকে আপরাধী মনে করিতে
পারেন নাই| রাধামাধবের শ্রাদ্ধোপলক্ষে অজস্র অর্থ ব্যয়িত হইয়াছিল,
তাহা তিনি জানিতেন| সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ তাহাতে অনেকটা হ্রাস
পাইয়াছিল| তারপর উপর্য্যুপরি বিষয়সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুতর মোকদ্দমায়
জলের মত টাকা ব্যায় হইবার সংবাদও তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না| মহালে
অজন্মা ও প্রজাবিদ্রোহ ঘটিতেছে, এ সম্বন্ধে বহু কাহিনী তাঁহার
কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল| সুতরাং এ সকলের জন্য বিধুভূষণকে নিমিত্তভাগী
না করিয়া তিনি নিজের ভাগ্যেরই দোষ দিতেন|
কিন্তু যে দিন ত্রিশ হাজার টাকায় সর্ব্বাপেক্ষা মূল্যবান্ ও উৎকৃষ্ট
বিষয়টি বিধুভূষণ বন্ধক রাখিয়া অষ্টমের কার্য্য নির্ব্বাহ করিল,
সে দিন বিধবার হৃদয়ে বিষম আঘাত লাগিল| তাঁহারই অন্নে পুষ্ট, অর্থে
প্রতিপালিত, সুশিক্ষিত জামাতা বিষয়-রক্ষার জন্য শ্রেষ্ঠ তালুকটি
বন্ধক রাখিয়া টাকা দিল, এই চিন্তা তাঁহার স্নেহ-পরায়ণ মাতৃহৃদয়কে
অত্যন্ত ব্যথিত করিল| মনকে তিনি আর কোনও মতেই প্রবোধ দিতে পারিলেন
না| জামাতার প্রতি তাঁহার একান্ত নির্ভরতা, অটল বিশ্বাস বিষম ধাক্কা
খাইয়া চঞ্চল ও অধীর হইয়া উঠিল| সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের
তীব্র সমালোচনা ও মন্তব্য শুনিতে শুনিতে তাঁহার বিশ্বাস ও ধৈর্য্যের
বাঁধ ভগ্ন হইবার উপক্রম করিল| নাবালক পুত্রের ভবিষৎ ভাবিয়া বিধবা
মাতা অত্যন্ত শঙ্কিত হইলেন| যে রক্ষক, সেই ভক্ষকের বৃত্তি অবলম্বন
করিয়াছে, তখন আর মুক্তির সম্ভাবনা কোথায়?
কয়েকটি বিশিষ্ট আত্মীয়ের পরামর্শে অবশেষে শঙ্কিতা নারী গোপনে স্বামীর
কোনও বিচক্ষণ বন্ধুর হস্তে সম্পত্তি-রক্ষার সম্পূর্ণ ভার অর্পণ
করিলেন|
বিধুভূষণ যখন এ সংবাদ পাইল, তখন ক্রোধে, ক্ষোভে ও আক্রোশে তাহার
চিত্ত পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল| শ্বশুর-কূলের উদ্দেশে তখন সে যে অভিসম্পাত
করিল, তাহা শুনিয়া স্বয়ং অন্তর্যামী বোধ হয়, শিহরিয়া উঠিয়া থাকিবেন|
[ ৭ ]
প্রৌঢ় চট্টোপাধ্যায় মহাশয় পর্দ্দার বাহিরে দণ্ডায়মানা দাসীকে বলিলেন,
"কর্ত্রীঠাকুরাণীকে জিজ্ঞাসা কর, জামাই বাবুর হিসাবপত্রের
কি করা যাইবে?"
দাসী মনিব ঠকুরাণীর শিক্ষামত উত্তরে বলিল, " মা বল্ছেন,
আপনার কথা তিনি বুঝ্তে পাচ্ছেন না|"
প্রৌঢ়
ম্যানেজার তখন কণ্ঠস্বর আরও পরিষ্কার করিয়া বলিলেন যে, বিধুভূষণের
সময়ের হিসাবপত্র দেখিয়া বুঝা যাইতেছে যে, হিসাব-নিকাশ করিলে বিধুভূষণের
নিকট লক্ষাধিক টাকা পাওনা হইবে| এতগুলি টাকার ব্যবস্থা করা তো
চাই ! তিনি জামাতা বাবাজীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করিয়া বুঝিয়াছেন
যে, যদিও এই টাকা হিসাব-নিকাশে বাহির হয়, তজ্জন্য তিনি দায়ী নহেন
এবং এক কপর্দ্দকও তিনি দিতে বাধ্য নহেন| বিধুভূষণ অত্যন্ত বিরক্ত
হইয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, তিনি নিজে যে টাকা ধার দিয়াছেন, তাহা
শীঘ্র সুদসমেত শোধ না করিতে পারিলে তিনি উপায়ান্তর অবলম্বন করিবেন|
কিন্তু ষ্টেটের এতগুলি টাকার কি হইবে
বিধবা, দাসীর দ্বারা বলাইলেন, "তা সে যদি না মানে, তা হ'লে
আর উপায় কি?"
চট্টোপাধ্যায় বলিলেন, "উপায় আছে
বৈ কি? হিসাব-নিকাশের দাবী দিয়া নালিশ করিলেই টাকা আদায় হইতে পারে|
উকীলেরাও সেই পরামর্শ দিতেছেন|"
যবনিকার অন্তরালে বিধবা শিহরিয়া উঠিলেন| জামাতা-যাহাকে পেটের সন্তানের
ন্যায় এতকাল মানুষ করিয়াছেন, তাহার নামে নালিশ! দাসীকে দিয়া তিনি
বলাইলেন যে, এমন কাজ তাঁহার দ্বারা হইবে না| যদি সে টাকা ভাঙ্গিয়াই
থাকে, কোন উপায় নাই| ইহার জন্য তিনি আদালতে যাইতে পারিবেন না|
কখনই না|
ম্যানেজার অনেক প্রকার যুক্তি-তর্কের অবতারণা করিলেন, কিন্তু তিনি
কোন কথায় কর্ণপাত করিলেন না| অবশেষে চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বলিলেন,
"এতগুলি টাকা ছাড়িয়া দিবেন কেন? তিনি তো আপনাকে রেহাই দিতেছেন
না? আমি সংবাদ পাইয়াছি, বিধুবাবু তাঁর প্রাপ্য গণ্ডা আদায় করিবার
জন্য ইতিমধ্যেই আদালতের আশ্রয় লইয়াছেন| আমরা আরও কিছু দিন অপেক্ষা
করিতে বলিয়াছিলাম, কিন্তু দেখিতেছি, তিনি তাহা শুনেন নাই|"
যবনিকা একবার দুলিয়া উঠিল| ম্যানেজারের কর্ণে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের
শব্দ প্রবেশ করিল| দাসী মনিবের শিক্ষামত বলিল, "মা বল্ছেন,
তার ধর্ম্ম তাকে যেমন বলেছে, সে তাই করছে| কিন্তু আমি তার নামে
নলিশ কর্তে পার্ব না| অদৃষ্টে যা আছে, তাই হবে|"
ক্ষুণ্ণ-মনে ম্যানেজার বিদায় লইলেন|
[ ৮ ]
সাবালক হইয়া রমেশ যে দিন জমিদারীর কাজকর্ম্ম দেখিতে আরম্ভ করিল,
তাহার মাসখানেক পরে একদিন সহসা বিধুভূষণ শ্বশুরালয়ে পদধূলি দিল|
দুই চারিটি কথার পর সে শ্যালককে নিভৃতে জানাইল যে, পঞ্চাশ হাজার
টাকার যে ডিক্রি সে পাইয়াছে, তাহা তামাদি হইতে আর বেশী বিলম্ব
নাই| নাবালকের সম্পত্তি বলিয়া এতদিন সে চুপ-চাপ বসিয়াছিল-ডিক্রি
জারী করে নাই| কিন্তু এখন সে টাকা যদি রমেশ এক সপ্তাহের মধ্যে
শোধ না করে, তাহা হইলে বাধ্য হইয়া তাহাকে ডিক্রী-জারি করিতে
হইবে|
রমেশ দশদিক্ অন্ধকার দেখিল| সে ভাবিয়াছিল, হাজার হউক, বিধুবাবু
তাহার ভগিনীপতি, নানা উপায়ে ক্রমশঃ তাঁহার টাকাটা শোধ দিলেই চলিবে|
বিশেষতঃ সুদটা হয় তো তিনি ছাড়িয়াও দিতে পারেন| বাস্তবিক কি তাহার
নিকট হইতে তিনি সুদ লইবেন, না, আরও কিছুকাল অপেক্ষা করিবেন না?
কিন্তু মানুষের কুটুম্বিতা বা আত্মীয়তার সঙ্গে অর্থের কিরূপ সম্বন্ধ,
সে সম্বন্ধে প্রাপ্তমাত্রযৌবন রমেশের প্রকৃত অভিজ্ঞতা তখনও হয়
নাই|
সামান্য আলোচনার পরই রমেশ বুঝিতে পারিল, বিধুভূষণ আর দুই সপ্তাহ-মাত্র
অপেক্ষা করিবে| এই সময়ের মধ্যে প্রাপ্য টাকা দিতে না পারিলে বিষয়
নীলামে চড়িবে| ঘৃণায়, অভিমানে রমেশ আর কোন কথা বলিল না|
মাত্র দুই সপ্তাহ সময়! এই অত্যল্পসময়ের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকার
সংস্থান করা সম্পূর্ণই অসম্ভব| পৃথিবীব্যাপী ইউরোপীয় সমরানলে দেশের
লোক বিব্রত| কোন উত্তমর্ণই এ সময়ে সঞ্চিত অর্থ হাত-ছাড়া করিতে
চাহিল না| রমেশের মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল| পিতৃবন্ধু চট্টোপাধ্যায়
মহাশয় একবৎসর হইল, লোকান্তরে গমন করিয়াছেন| নূতন ম্যানেজার কবুল
জবাব দিলেন যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে বিষয়-সম্পত্তি বন্ধক রাখিয়া
অন্য স্থান হইতে অর্থ সংগ্রহ করা অসম্ভব| তিনি প্রাণপণ চেষ্টা
করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই| সমগ্র সম্পত্তি উচ্চহারে বন্ধক
রাখিলে টাকা পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু তাহাতে অন্ততঃ দুই মাস সময়
লাগিবে|
ম্যানেজারকে সঙ্গে লইয়া রমেশ বিধুভূষণের সহিত সাক্ষাৎ করিল; সমস্ত
কথা বুঝাইয়া বলিল| অর্থ-সংগ্রহের কোন উপায় নাই| বিধুভূষণ তখন প্রস্তাব
করিল যে, পঞ্চাশ হাজার টাকায় সে * * * পরগণা ডাকিয়া লইবে| তারপর
রমেশকে ঐ সম্পত্তি পুনরায় ইজারা দিবে| শ্যালকের সম্পত্তি গ্রাস
করিবার তাহার অভিপ্রায় নাই| ক্রমে ক্রমে যদি রমেশ তাহার সমস্ত
টাকা শোধ করিয়া দিতে পারে, তখন ঐ সম্পত্তি সে পুনরায় ফিরাইয়া পাইবে|
রমেশ সানন্দে এ প্রস্তাবের অনুমোদন করিল| হাজার হউক, বিধুভূষণ
তাহার ভগিনীপতি, সত্যই কি সে তাহাকে ভাসাইয়া দিতে পারে? অনেকটা
নিশ্চিন্তমনে সে গৃহে ফিরিয়া আসিল|
[ ৯ ]
নীলাম-ঘরের মধ্য হইতে ঘর্ম্মাক্তকলেবরে বাহির হইয়া বিধুভূষণ
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল| তখন যদি কেহ তাহাকে নিরীক্ষণ
করিত তাহা হইলে তাহার নয়নের জয়োল্লাসজনিত উৎকট দীপ্তি দেখিয়া
চমৎকৃত হইত| রুমালে মুখ মুছিয়া সে যেমন পশ্চাতে ফিরিবে, অমনই
প্রবীণ উকীল বিশ্বনাথের সহিত তাহার দৃষ্টি-বিনিময় ঘটিল| বিশ্বনাথ
বহুদিন হইতেই তাহার শ্বশুরের সম্পত্তির যাবতীয় মামলা-মোকদ্দমার
তদ্বির করিয়া আসিতেছেন| বিধুভূষণের ইতিহাস তিনি ভালরকমই জানিতেন|
বিধুভূষণ পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে, বিশ্বনাথ বলিলেন,
"কি বিধু বাবু, কেমন আছ, পালাচ্ছ কেন?"
রুমালে আবার মুখ মুছিয়া বিধুভূষণ বলিল, "অম্নি এক রকম আছি|
আপনার সব ভাল তো?-একটা বিশেষ কাজ আছে, আমি-"
বিশ্বনাথ বলিলেন, "তা জানি, আজ তোমার নিশ্বাস ফেলিবার সময়
নাই| কিন্তু কাজটা কি ভাল হ'ল?"
বিধুভূষণ থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, "কেন, মন্দ কাজটা কি হ'ল?"
শ্লেষভরে বিশ্বনাথ বলিলেন, "না-এ আর মন্দ কাজ কি? ত্রিশ হাজারে
* * * শ্বশুরের পরগণা নীলামে করাইয়া লইলে, বাকী বিশ হাজার টাকার
জন্য আবার অন্য সম্পত্তি ক্রোক দিবে, এটা আর মন্দ কাজ কি? কিন্তু
আমার অগোচরে কিছুই তো নাই| এত পাপ, এত অধর্ম্ম ভগবান্ সহিবেন
কি?"
বিরক্তিভরে বিধুভূষণ বলিল, "ভদ্রলোকের সঙ্গে কি ভাবে কথা
বলিতে হয়, আপনি ভুলিয়া গিয়াছেন দেখিতেছি| প্রাপ্য টাকা আদায় করা
কি অধর্ম্ম? আপনি কি মনে করেন, দানছত্র খুলিবার জন্য আমি টাকা
রোজগার করিয়াছি?"
বিধুভূষণের কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হইয়া আরও কতিপয় উকীল সেখানে আসিয়া
দাঁড়াইয়াছিলেন| বিশ্বনাথ আর আত্মসংবরণ করিতে না পারিয়া তীব্রস্বরে
বলিলেন, "দেখ বিধুবাবু, তোমার রোজগারের কথা আর গলাবাজি করিয়া
কাহারও কাছে বলিও না| অনাথা, বিধবা ও নাবালকের সর্ব্বনাশ করিয়া
যাহারা অর্থোপার্জ্জন করে, তাহাদের মুখদর্শন করাও পাপ| ভাবিয়াছিলাম,
তুমি উচ্চ-শিক্ষিত ভদ্র-সন্তান, অন্ততঃ সে জন্যও এতটুকু চক্ষুলজ্জা
তোমার থাকা উচিত ছিল| তোমার বই-বেচার ইতিহাসও আমি জানি| নাবালকের
সম্পত্তির কি দুর্দ্দশা করিয়াছ, তাহাও কাহারও জানিতে বাকী নাই|
তোমার সঙ্গে কথা কহিতেও ঘৃণা হইতেছে| তোমার কৃতঘ্নতা ও অধর্ম্মের
পুরষ্কার এই ঘোর কলিতেও তুমি এক দিন পাইবে, এ কথা আমি বলিয়া রাখিলাম|"
দারুণ ঘৃণাভরে মুখ ফিরাইয়া উকীলবাবু চলিয়া গেলেন| চারিদিক্
হইতে একটা বিদ্রূপ ও টিটকারীর অনুচ্চ ধ্বনি উঠিতেছে, ইহা শুনিতে
পাইয়া বিধুভূষণও দ্রুতপদে চলিয়া গেল|
বহুদিনের
ইপ্সিত ফললাভে আজ বিধুভূষণের আনন্দ ও উল্লাস রাখিবার স্থান ছিল
না| এত দিন সকলেই তাহাকে যাহারা অন্নদাস বলিয়া বিদ্রূপ করিয়া আসিয়াছে,
আজ সেই শ্বশুরের বংশধরের সম্পত্তির কিয়দংশের সে মালিক| প্রয়োজন
হইলে শ্যালক তাহার নিকট হইতে উক্ত সম্পত্তি ইজারা লইয়া তাহারই
প্রজা হইবে| অতএব, এত দিনে তাহার কতকটা সার্থক হইয়াছে| শ্বশুরবংশের
প্রতি তাহার যে বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল, এত দিনে তাহার কতকটা উপশম
হইল| কিন্তু বিশ্বনাথ উকীলের কথাগুলি থাকিয়া থাকিয়া তাহার বুকের
মধ্যে খোঁচা মারিতেছিল| মনটাকে প্রসন্ন করিবার অভিপ্রায়ে বিধুভূষণ
মোটর হাঁকাইয়া তাহার "চিত্ত-বিশ্রামে" চলিয়া গেল|
অপরাহ্ণের ছায়া যখন চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছিল, তখন বাড়ী ফিরিবার
কথা তাহার স্মরণ হইল| তাহার অনুগ্রহভাজন সহচরেরা আজিকার শুভসংবাদ
জানিবার জন্য তাহার গৃহে হয় তো এতক্ষণ সমবেত হইয়াছে, ব্যগ্রভাবে
তাহার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে| দুই এক দিনের মধ্যে একটা বৃহৎ ভোজেরও
যে আয়োজন করিতে হইবে, একথাটাও বিধুভূষণের মনে ক্ষণে ক্ষণে উদিত
হইতে লাগিল| সে আর কালবিলম্ব না করিয়া গৃহাভিমুখে ফিরিল|
মোটর যখন তাহার বাড়ীর ফটকের মধ্য দিয়া গাড়ী বারান্দায় নীচে আসিয়া
থামিল, তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিয়াছে| বৈঠকখানা-ঘরে আলো
জ্বলিতেছে, বহু লোক তাহার প্রতীক্ষা করিতেছে, তাহাও সে চকিতে দেখিতে
পাইল; কিন্তু অন্য দিনের মত আজ উচ্চ হাস্য-পরিহাসের শব্দ তাহার
কর্ণে প্রবেশ করিতেছে না কেন?
গাড়ী হইতে নামিবামাত্র বাড়ীর সরকার তাহার সম্মুখে পড়িল| তাহার
মুখে আশঙ্কা ও উদ্বেগের চিহ্ণ দেখিয়াই বিধুভূষণ থমকিয়া দাঁড়াইল-প্রশ্নবোধক
দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিল|
সরকার বলিল, "বাবু, আপনি কোথায় ছিলেন? আদালতে আপনাকে খুঁজিয়া
পাই নাই| ছোটবাবুর ভারী অসুখ-কলেরা-"
অকস্মাৎ বিধুভূষণের সমস্ত দেহ থর্-থর্ করিয়া কাঁপিয়া উঠিল| কলেরা?-তাহার
একমাত্র বংশধর, যাহার জন্য সে এত আয়োজন করিয়া রাখিতেছে, সে কি
তবে তাহাকে ফেলিয়া চলিবার উপক্রম করিয়াছে?
কোনও দিকে না চাহিয়া বিধুভূষণ লম্ফে লম্ফে সিঁড়ি
অতিক্রম করিয়া উপরে উঠিল| দাস-দাসীর শঙ্কামলিন-মুখে দূরে সরিয়া
দাঁড়াইল| বিধুভূষণ সম্মুখের কক্ষে উন্মাদের মত প্রবেশ করিল|
গৃহমধ্যে-ভূমিতলে তাহার বংশ-প্রদীপ, আদরের দুলাল, আঠারো বছরের
ফণিভূষণ শায়িত! গৃহমধ্যে আরও কয়েকটি মনুষ্য-মূর্ত্তি রহিয়াছে বটে;
কিন্তু বিধুভূষণের দৃষ্টি তখন এমন আচ্ছন্ন যে, সে কাহাকেও সে সময়
চিনিয়া উঠিতে পারিল না| ধপ্ করিয়া সে ভূমিতলে বসিয়া পড়িল| সেই
মুহূর্ত্তে এক ব্যক্তি নিঃশব্দ-দ্রুত চরণে তাহার পার্শ্বে আসিয়া
দাঁড়াইলেন|
গৃহ-চিকিৎসক তাহাকে বলিতেছিলেন, "অত ব্যস্ত হইবেন না| অবস্থা
গুরুতর" কিন্তু এখানে গোলযোগ করিলে বিপদ্ আরও বাড়িবে| ধৈর্য্য
ধরুন|"
তা কি পারা যায়? একমাত্র সন্তান, স্নেহের দুলাল মুমূর্ষু-পিতার
প্রাণ কি স্থির থাকিতে পারে? কিন্তু চিকিৎসকের প্রবোধবাক্যে অবশেষে
বিধুভূষণ অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইল|
পুত্রের শিয়রে বসিয়া শুভ্রবসনা কে ঐ বৃদ্ধা? হাঁ, তিনিই তো! তাহার
শ্বশ্রূঠাকুররাণীই তো বটেন! একমনে বৃদ্ধা দৌহিত্রের মস্তকে বরফ
দিতেছিলেন| পার্শ্বে অশ্রুনতনেত্রে তাহার পত্নী পাখা করিতেছেন|
আর পদতলে ও কে? মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়া
দৃঢ়-দেহ, সুস্থ, সবল ঐ যুবক তাহারই শ্যালক নহে কি? কয়েক ঘণ্টা
পূর্ব্বে ইহারই সম্পত্তি বিধুভূষণ জুয়াচুরি করিয়া নীলামে করিয়া
লইয়াছে না? এ কি পরিহাস? যাহাকে পরাজিত করিয়া আত্ম-প্রতিষ্ঠার
জন্য সে লালায়িত, যাহাকে খর্ব্ব করিয়া নিজের প্রাধান্য বাড়াইবার
জন্য সে অল্পক্ষণ পূর্ব্বে তাহার সম্পত্তি নীলাম করিয়া লইয়াছে,
সেই এখন তাহার পুত্রের প্রাণরক্ষার জন্য নির্ব্বিকারভাবে সেবা
করিতেছে!
** ** **
কঠোর সাধনা, অদম্য পুরষকার এবং ঐকান্তিক ঈশ্বরনিষ্ঠার
ফলে মৃত্যুদূত পরাজয়ের কলঙ্ককালিমা মাখিয়া ফিরিয়া গেল|
রাত্রিশেষে
বাড়ির ডাক্তার বলিলেন, "আর ভয় নাই, কিন্তু খুব সাবধানে শুশ্রূষা
করতে হইবে| রমেশ বাবু, এখন আপনাদের বিশ্রামের প্রয়োজন| আপনারা
যান| আমরা পালাক্রমে ভার লইতেছি|"
শুশ্রূষার জন্য নূতন দল আসিল| রমেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাতা ও ভগিনীকে
লইয়া বাহিরে গেল|
বাহিরের স্নিগ্ধ বাতাসে, বারান্দায়
রমেশ খানিক দাঁড়াইল| ভগিনী চারুবালা ভ্রাতার হাত ধরিয়া বলিলেন,
"রমু, ভাই আমার, অপরাধ ক্ষমা কর্| আমি সব জানি-আজ আমা হইতেই
তোকে প্রায় পথে দাঁড়াতে হয়েছে|
মেশ
বাধা দিয়া বলিল, দিদি, বিষয় থাকে আবার যায়| এতে আর দুঃখ কি?
আর ফণি যে আমার ভাগ্নে, সে কথা ভুলে যাচ্ছ কেন? আমার শরীরে
যে রক্ত-স্রোত বইছে, তাতেও কি তার কিছু নাই? আমি যদি বিয়ে না
করি, তা হ'লে সেই তো উত্তরাধিকারী| এর জন্য এত দুঃখ কেন দিদি?"
উন্মত্তের ন্যায় বাহিরে আসিয়া বিধুভূষণ বলিল, "রমেশ, তুমি
দেব্তা না মানুষ?" আচ্ছা, কাল সকালেই এর প্রায়শ্চিত্ত
কর্বো|"
রমেশ দুই হস্তে তাঁহাকে ধরিয়া বলিল, "থামুন বিধু বাবু,-ফণির
অবস্থা এখনও ভাল নয়| অত গোল করিবেন না|"
(
'নারায়ণ' পত্রিকা, কার্তিক, ১৩২৫ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।