প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
বাপ
ও ছেলে
[ লেখক পরিচিতি : সতীশচন্দ্রের জন্ম ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দের
৪ঠা মে । ইংরাজীতে এম.এ. পাশ করার পরে আইন নিয়ে পড়াশোনা
করে বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন । পেশায় আইন ব্যবসায়ী হলেও সাহিত্য
ছিল তার প্রিয় বিষয় । কবিতা ও গল্প ছাড়া তিনি নাটকও রচনা
করেছেন । ব্যঙ্গাত্মক লেখক হিসাবেই তিনি বিশেষ পরিচিত ।
রবীন্দ্রনাথের 'দুই পাখি' কবিতার
'খাঁচার
পাখী ছিল
সোনার খাঁচাটিতে
বনের
পাখী ছিল বনে
একদা কী করিয়া
মিলন হল দোঁহে
কি ছিল
বিধাতার মনে ।' ইত্যাদি রূপান্তরিত হয়ে হয়েছে -
'খাঁচার
লাউ ছিল
বাঁশের মাচাটিতে
বনের
লাউ ছিল বনে
একদা কি করিয়া
মিলন হল দোঁহে
কি ছিল
রাঁধুনির মনে ।' ইত্যাদি
অথবা
'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ... ' গানটির প্যারোডি হয়েছে
'আমি
চিনি গো চিনি তোমারে ওগো মাড়োয়ারী
তুমি আছ বিশ্ব জুড়ে ওগো মাড়োয়ারী
তোমায় দেখেছি সাগরপারে
তোমায় দেখেছি ঘর কিনারে
তোমায় দেখেছি বড় বাজারে ওগো মাড়োয়ারী...' ইত্যাদি ।
সতীশচন্দ্রের
রচিত কবিতাগ্রন্থ : 'ঝলক' (১৯২৩) ; 'লতিকাগুচ্ছ' (১৯৩০)
। গল্প-গ্রন্থ : 'সতীর জেদ' (১৯২৪) ; 'দুই চিঠি' (১৯২৮)
। নাটক : 'নাটিকাগুচ্ছ' (৫ খণ্ড, ১৯২৯) ; 'হাটে হাঁড়ি' (১৯২৯)
; 'অগ্নিশিখা' (১৯৩০) ।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন তার মৃত্যু ঘটে ।
]
...
দীপক সেনগুপ্ত।
-"বাবা!
বাবা! একটা গল্প বল ।"
-"কিসের গল্প বাবা?"
-"এই-এই-এক্তা-এক্তা-বাগেল-এত্তবল-বাঘেল-না, না, সেই কুমিলেল-সেই
যে হাঁ ক'লে খেতে আসে ।"
-"না-না, গত্তেল মধ্যে নয়, তুমি জান না, জলেল মধ্যে । তালপল
বলবো? শুন্বে? তালপল-তালপল-একদিন-এই যে-সে-এই যে-একদিন-গত্তেল
থেকে বেলিয়ে-সে-তালপল কি বাবা?"
-"তারপর সে দেখ্লে, একটা গরু-"
-"না-না, তুমি বলচো কেন? আমি বলবো । তালপল সে দেখ্লে-দেখলে-গলু-এক্তা
গলু জল খাবো-না বাবা?"
-"হাঁ, হাঁ, লক্ষ্মী-কেমন গল্প শিখেচে আমার বাবা ।"
স্নেহকাতর পিতা শিশুর কচি গাল দুটিতে বারবার চুম্বন করতে লাগলেন
। পিতার এই অসাময়িক অর্থহীন দৌরাত্ম্য থেকে নিজেকে মুক্ত করে
শিশু দ্বিগুণ উৎসাহের সঙ্গে বল্তে লাগলো!
-"তালপল-শোন না বাবা-না, তুমি শোন-তালপল, কুমীল আত্তে আত্তে-এম্নি
ক'লে-আত্তে আত্তে না গিয়ে-আঁ-ক্ ।"
শিশু নিজেকে কুমীর এবং বাবাকে গরু করে পিতার হাত ধরে টান্তে
লাগ্লো । পিতাকেও সহাস্যমুখে কুম্ভীর কবল গ্রস্ত গরুর মত ছট্ফট্
করতে হল কিন্তু ছেলে তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে অভিমানের সুরে বল্লে-"তুমি
কাঁদ বাবা কাঁদ-আঁ-আঁ-আঁ ।"
-"গরু কি কাঁদতে পারে বাবা ।"
-"হাঁ, পালে-কাঁদে ।"
-"আচ্ছা, কাঁদচি-হাম্মা-"
-"গলু হাম্-মা বলে কাঁদে? গলুল মা কোথায় বাবা? হাসপাতালে?
আবাল আস্বে?-আবাল গলুকে কোলে নিয়ে-হাম্-?"
মুখ ফিরিয়ে চোখ মুখে নিয়ে তাড়াতাড়ি পিতাকে বলতে হল ।
-"বাবা, কেমন ছবির বই!-কেমন ভাল ভাল ছবি!"
-"কৈ বাবা? কৈ? দেখবো ।"
"এই যে, এই দেখ-এই অজগর সাপ-এই ঈগল পাখী-"
-"এই উত্ ।"
-"হাঁ হাঁ-এই উট আর এই এক্কা গাড়ী ।"
-এক্কা গালী খুব ছুটেছে ।"
-"লক্ষ্মী, লক্ষ্মী-সব জানে বাবা আমার-এই গুল-এই-"
পিতা তাড়াতাড়ি পাতা উল্টে গিয়ে বল্লেন-"এই ক'য় কুকুর"
-"না কুকুল না-ঐ যে তুমি দেখালে না-ঐ যে ওলেল পল-"
-"ও কিছু না ।"
অভিমানী ছেলে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে বাপের দিকে একটি ছোট মুঠো তুলে
বল্লে-"মাল্বো ।"
বিপদ্গ্রস্ত পিতা বলে উঠ্লেন-"বাবা, এই দেখ-উঃ কত বড় সিংহ-কত
বড় কেশর ।"
"-না ছিংহ না" মাটিতে শুয়ে পড়ে নির্মমভাবে বইখানার
উপর লাথি ছুড়্তে ছুড়্তে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বাপের কোলে মুখ
লুকালো ।
মা ছেলেকে অসুধ খাওয়াচ্চে এ ছবি কি সে না দেখে থাকতে পারে? যে
তার মা-ই তাকে কতবার দেখিয়েছে - সে জানে ও তার মায়েরই ছবি -
অমন লম্বা চুল, অমন গয়না কাপড় - আর কোন্ স্ত্রীলোকের আছে! তার
মা-ই যে তাকে কতবার পাছ্ড়ে কোলে ফেলে কালমেঘের রস খাইয়েছে ।
বইখানাকে টেনে নিয়ে এসে পিতা বল্লেন-"আচ্ছা কেঁদো না বাবা,
দেখাচ্ছি" শিশু লাফিয়ে কোলের উপর উঠে বসলো । একটুখানি দেখিয়েই
তিনি আবার পাতা ওল্টাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু শিশু তার গোল গোল কচি
হাত পাতার উপর চাপা দিয়ে বল্লে-
-"না, দেখি বাবা-মাকে ভাল কলে দেখি-"
সে আজ কতকাল মাকে দেখে নি-কতদিন-কতমাস ।
টস্ করে এক ফোঁটা গরম জল পিতার চোখ থেকে বইয়ের উপর পড়লো, তাড়াতাড়ি
সেটাকে মুছে নিয়ে, ছেলেকে আরো ভাল করে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে
বল্লেন-
-"হয়েচে ত বাবা ছবি দেখা? এইবার বন্ধ করে রাখি-কেমন?"
ছেলে কোন উত্তর দিলে না-বিষাদ গম্ভীর মুখে শুধু বল্লে-
-"বাবা, আমি ঘুমুবো-তোমার কোলে শুয়ে ।"
তার শরীর ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে ।
কোলে শুইয়ে তাকে নাচাতে নাচাতে পিতা বল্লেন-"তুমি চোখ বোজ
বাবা, আমি ঘুমপাড়ানো গান গাই-ঘুমপাড়ানী মাসী পিসি আমাদের বাড়ি
এসো-খাট নেই, চৌকি নেই-"
"না বাবা, সেইটে-এ ধন যাল ঘলে নেই তাল"-
-"ধন, ধন, ধন-আমার বাড়িতে ফুলের বন-এ ধন যার ঘরে নেই তার
বৃথাই জীবন-তারা কিসের গরব করে-তারা-"
আর গাইতে হল না-পিতা দেখ্লেন-শিশুর নিশ্বাস স্থিরভাবে পড়্চে-সে
ঘুমিয়েচে । একদৃষ্টে তার চাঁদমুখখানির দিকে চেয়ে তিনি কার সাদৃশ্য
তাতে দেখছিলেন কে জানে? কতক্ষণ নিশ্চলভাবে পাষাণে-গড়া মূর্তির
মত বসেছিলেন-সহসা চম্কে উঠে শুনলেন, শিশু ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে জড়িয়ে
বলছে-
-"আমি আলো অসুদ খাবো-আমি আল কাঁদব না ।"
সতীশচন্দ্র
ঘটক
( ‘সবুজপত্র’
পত্রিকা, ১৩২৬ ফাল্গুন সংখ্যা )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|