প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

দাঁড়কাক

[ লেখক পরিচিতি : সতীশচন্দ্রের জন্ম ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা মে । ইংরাজীতে এম.এ. পাশ করেন । পরে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন । পেশায় আইন ব্যবসায়ী হলেও সাহিত্য ছিল তার প্রিয় বিষয় । কবিতা ও গল্প ছাড়া তিনি নাটকও রচনা করেছেন । ব্যঙ্গাত্মক লেখক হিসাবেই তিনি বিশেষ পরিচিত । রবীন্দ্রনাথের 'দুই পাখি' কবিতার

'খাঁচার পাখী ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখী ছিল বনে
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে
কি ছিল বিধাতার মনে ।' ইত্যাদি রূপান্তরিত হয়ে হয়েছে -

'খাঁচার লাউ ছিল বাঁশের মাচাটিতে
বনের লাউ ছিল বনে
একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে
কি ছিল রাঁধুনির মনে ।' ইত্যাদি

অথবা 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ... ' গানটির প্যারোডি হয়েছে

'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো মাড়োয়ারী
তুমি আছ বিশ্ব জুড়ে ওগো মাড়োয়ারী
তোমায় দেখেছি সাগরপারে
তোমায় দেখেছি ঘর কিনারে
তোমায় দেখেছি বড় বাজারে ওগো মাড়োয়ারী...' ইত্যাদি ।

সতীশচন্দ্রের রচিত কবিতাগ্রন্থ : 'ঝলক' (১৯২৩) ; 'লতিকাগুচ্ছ' (১৯৩০) । গল্প-গ্রন্থ : 'সতীর জেদ' (১৯২৪) ; 'দুই চিঠি' (১৯২৮) । নাটক : 'নাটিকাগুচ্ছ' (৫ খণ্ড, ১৯২৯) ; 'হাটে হাঁড়ি' (১৯২৯) ; 'অগ্নিশিখা' (১৯৩০) । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন তার মৃত্যু ঘটে । ] .. দীপক সেনগুপ্ত।



'কা-কা-কা' ;-একটা দাঁড়কাক নিমগাছের ডাল থেকে ডেকে উঠ্লো । অমনি গিন্নি বলে উঠ্লেন 'দূর দূর'! ঝি শশব্যস্তে কোটা মাছ ঢাকা দিলে এবং ছেলেরা গুলতি নিয়ে বের হলো ।
বেচারা দাঁড়কাক বুঝলে বেগতিক!-সে নিমগাছ থেকে জামগাছে এবং জামগাছ থেকে তেঁতুলগাছে উড়ে গিয়ে আবার ডাকলে 'কা-কা' অর্থাৎ কা বার্তা-ব্যপার কি?
যদি এ ঘটনা খুব প্রত্যূষে হতো, তাহলে না হয় কবির ব্যাখ্যায় সায় দিয়ে ব’লতে পারতুম-ও অভিসারিকাদের ব’লছে ঘরে ফিরে যেতে, কিম্বা সূর্য্যদেবকে সতর্ক করে দিচ্ছে যাতে তিনি ওকে টুকরো জমাট অন্ধকার না মনে করেন;-কিন্তু তখন বেলা প্রায় ন'টা ।
বধূ ছাদের উপর বড়ি দিচ্ছিলেন-তাঁর কোলের ভিতর মাথা রেখে স্তন্যপান কচ্ছিল একটী শিশু । তিনি দেখলেন দাঁড়কাকটা তাঁরই দিকে চেয়ে আছে, সুতরাং দু'একবার অস্ফুটস্বরে 'হুস্--হুস্' শব্দ কল্লেন,-কিন্তু দাঁড়কাক আর নড়লো না ।
বধূ হাত গুটিয়ে দাঁড়কাকের কথাই ভাবতে লাগলেন-বোধহয় সে তাঁকে mesmerise করে থাকবে ।
খানিক পরে দাঁড়কাকটা আবার 'কা' বলে ডেকে নিমগাছ ছেড়ে উড়লো, এবং ছাদের গায়ে লাগানো যে একটা ডালিমগাছ ছিল, তারই ডালের উপর এসে ব'সলো ।
বধূ মনে ভাবলেন-দেখি আমি নিজে একটা শকুন-শাস্ত্র রচনা করতে পারি কি না; দাঁড়কাক যখন "কা" বলে আমার কাছে উড়ে এসেছে, তখন ধরে নেওয়া যাক্ ওর অর্থ হ্চ্ছে "কাস্ত্বম্" অর্থাৎ "কে তুমি?"
নিজের ব্যাখ্যায় নিজে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি হেসে উত্তর দিলেন-"সে খোঁজে তোর দরকার কি রে পোড়ারমুখো?"
দাঁড়কাক তাঁর দিকে দু'একবার কট্মট্ করে চেয়ে ঘাড় বাঁকালে এবং নিতান্ত অনুনয়ের সুরে উচ্চারণ করলে একটি ছোট্ট মোলায়েম 'কা' ।
"কা ক্ষতি?-কেমন?" বলেই বধূ একটু চমকে উঠলেন; তাঁর পিছন থেকে কে তাঁকে ডেকে বল্লে-"কার সঙ্গে কথা বল্ছো বৌদি? বড়ির সঙ্গে, না দাঁড়কাকের সঙ্গে?"
"কে? ঠাকুর-পো! কেন, ঐ দাঁড়কাকটার সঙ্গে - তাতে কোন দোষ আছে নাকি?
আলসের উপর থেকে একখানা কচুপাত টেনে নিয়ে, তার উপর বসতে বসতে সুশীল বল্লে-"আছে বৈকি, জানত 'বহুকা ভালা চুপ' ।"
"তাহলে বোবা মেয়ে বিয়ে করতে চাওনা কেন?"
"সে যে দরকার হলেও-"
"তাই বল-কিন্তু সে দরকারটি কি কেবল তোমাদেরি? আমাদের যতই দরকার হোক্ না, বাইরে একটা কথা বলবার জো নেই-কাজেই ঘরের ভিতর এত দরকার হয় যে, তোমরা বিরক্ত হয়ে ওঠ । জানত ভাই, কথা মন থেকে কেবলি ঠেলে উঠতে চায়-তাকে জিভ দিয়ে চেপে রাখলে সে এক সময় না এক সময় এমন জোরের সঙ্গে তেজের সঙ্গে-"
"এবং গোলমালের সঙ্গে বের হয, যে তার সঙ্গে পেরে ওঠা দায়!-তা ঠিক, কিন্তু আমরাই যখন পারি না, তখন দাঁড়কাকটা কি পারবে? ওকে ভালোয় ভালোয় বিদায় দিলে হয় না?"
"না-না, থাক, তাড়িও না; তুমি কি ওদের ভয় কর নাকি?"
সুশীল একটু হাসতে হাসতে উত্তর করলে-"তা করি বৈকি-ওদের রং যে কালো ।"
"তা ত ফিঙেরও ।"
"আর ওদের কদাচিৎ দেখা যায় ।"
"সহরেই দেখা যায় না-নৈলে পাড়াগেঁয়ে ওরা যথেষ্ট ।"
"তা হ'লেও বৈদি, ওরা যেন কেমন এক রকমের-ওরা যে কোত্থেকে আসে আর কোথায় যায়-"
"তার সঠিক্ খবর নিতে হলে সঙ্গে সঙ্গে উড়তে হয়! তবে ওরা যে যমপুরী থেকে আসে, এ বিশ্বাস বোধহয় তোমার নেই?
সুশীল খুব গাম্ভীর্য্যের সঙ্গে বল্লে-
-"তা বলা যায় না; লোকে ত বলে ওরা যমরজের গুপ্তচর ।"
"গুপ্তচর হ'লে ওরা কোনদিনই প্রকাশ্যে কাছে আসতো না ।"
"আচ্ছা, না হয় দূতই হলো ।"
"তাহ'লে ত ধর-পাকড় করতো ।"
"কি আপদ! ধরনা ওরা যম-রাজের পেয়াদা-নোটিস জারী ক'রে বেড়ায় ।"
"আর নিরীহ গেরস্তের কাছ থেকে বারবরদারী আদায় করে?"
বধূ এই বলে সুশীলের অলক্ষিতে একটা বড়ি কাকের দিকে ছুঁড়ে দিলেন ।
"পেয়াদাটাই ঠিক-অন্তত শাস্ত্রে তাই বলে; কিন্তু ওর সঙ্গে তোমার কি কথা হচ্ছিল শুনি?"
"সে অনেক কথা,-ওর সুখদুঃখের কথা ।"
"বটে! দাঁড়কাকের আবার সুখদুঃখ!"
"তা নেই? পাখীরা উড়ে বেড়ায় বলে কি আর ঘরসংসার করে না?"
এমন সময় দাঁড়কাক ডালের গায়ে ঠোঁটের দুপাশ ভাল করে ঘসে নিয়ে ডাকলে -"কং কঃ ।"
সুশীল কৌতূহলী ছাত্রের মত জিজ্ঞাসা করলে-"বৌদি, এবার?"
"এবার ও বলছে যে, এ কথা কে কাকে বোঝায় ।"
"বটে! তাহলে তুমি সত্যি সত্যিই ওর আত্মজীবনী শুনেছ দেখছি-আচ্ছা, বল দেখি ওর জীবনের বৃত্তান্তটি কি?"
"নাঃ-সে আর তোমার কাছে বলবো না-ও আমাকে বিশ্বাস করে'-"
দাঁড়কাক অমনি তার পুচ্ছাগ্র বিস্ফারিত করে ডাক্লে "ক্যও-ক্যও"
সুশীল অম্নি বলে' উঠলো-"বৌদি! বল, অনুমতি দিয়েছে ।"
বৌদিদিকে অগত্যা কাকের জীবনচরিত প্রকাশ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে হ'ল; তিনি ছেলেটীকে সুশীলের কোলে দিতে দিতে বললেন-
"তাহ'লে একে ধর, আমি বড়ি দিই আর গল্প করি-অর্থাৎ কি না ইতিহাস বলি ।"
"তুমি ইতিহাসকে ঠাট্টা ক'রোনা বৌদি-ওটা আমার ভারি প্রিয় জিনিস; কিন্তু দেখ, তোমার নতুন বন্ধু কেমন একদৃষ্টে বড়ির দিকে চেয়ে আছে, আর ওর বাঁ চোখটা কেমন ছল্ ছল্ করছে ।"
"ওটা হচ্ছে শূন্যদৃষ্টি; আর ঐ যে চোখ ছল্ ছল্ করছে ওটা হচ্ছে কৃতজ্ঞতার চিহ্ণ ।"
"তুমি ওকে দু'একটা বড়ি দিয়েছ বুঝি?"
"না, তা কেন? ওর নামে তুমি যে সব অপবাদ দিচ্ছিলে, তা কাটিয়ে দিয়েছি ।-যাক্, এখন তাহলে শোন; কিন্তু ও যেরকম ভাবে বলেছিল, ঠিক তেমনি ভাবেই বলবো:-
প্রথম যেদিন আমি ডিম থেকে ফুটে বের হলুম, চেয়ে দেখি আমার কাছে আর কেউ নেই-কেবল আমারি মত একজন । তার চোখ দুটী একটু লাল আর ঠোঁটটি একটু ছোট । সে আমার দাদা, কি ছোট ভাই-এই কথা মনে মনে ভাবছি, এমন সময় মুখে কি নিয়ে মা উড়ে এল । আমরা দুজনেই হাঁ করলুম, কিন্তু মা "আধার" আমার মুখে দিলে-তার মুখে দিলে না; অথচ তারই মাথায় ঠোকর মারতে আরম্ভ করলে । সে 'কু-কু- করে কেঁদে উঠলো,-সে কান্না কি মিষ্টি! দেখাদেখি আমারও কান্না পেলে, কিন্তু আমার গলা দিয়ে বের হলো একটা মোটা বিশ্রী সুর,-যা আমারই ভাল লাগলো না । কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার ডাকলুম,-কিন্তু সেই এক সুর । 'কা' আর কিছুতে 'কু' হল না । ওদিকে ঠোকর খেতে খেতে সে অতিকষ্টে বাসা ছেড়ে উড়লো । তারপর কোথায় যে চলে গেল-কে জানে । তার পিছনে পিছনে মাও উড়ে চললো, আরো যেন কে কে ।"
দেখা গেল দাঁড়কাকটা নীচের ডাল থেকে লাফিয়ে একটি উপরের ডালে গিয়ে বসলো, এবং অসীম আকাশের দিকে হতাশ নয়নে চেয়ে ডাকলে-"ক-ক্ক ।"
"বৌদি?-"
"ও বলছে 'ক্ক গতা', অর্থাৎ কোথায় গেল সেদিন, সেই মায়ের আদর?"
এমন সময় একটী পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে এক-থালা মাখা-ভাত হাতে করে ছাদের উপর উঠে এল' বধূ তাকে দেখেই বল্লেন-
"অপু, মা, ওইখানে ব'স, রোদপিঠ করে'-হাঁ, হাঁ-লক্ষ্মী মেয়ে-খাইয়ে দিতে হবেনা ত?"
বালিকা "আমি খাবো" বলে' পা ছড়িয়ে বসলো, এবং থালাটাকে পায়ের মধ্যে রেখে প্রমাণ করবার চেষ্টা করলে যে সে নিজেই খেতে শিখেছে ।
সুশীল তার ভাবভঙ্গী দেখে খুব এক চোট্ হেসে বললে-"তা ত বটেই-তুই মা'র হাতে খাবি কেন? তোর মা'র হাত যে নোঙরা"-তারপর বৌদিদির দিকে ফিরে বললে-"তার পর?"
"তারপর আমি বড় হ'য়ে তাকে অনেক খুঁজলুম, কিন্তু কোথাও আর দেখাতে পাই না; শেষে একদিন দেখি কি, সে একটা আমগাছে বসে আম খাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে মুখ নীচু করে ডাক্ছে, আর এক দল ছেলেমেয়ে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে উঁচু দিকে চেয়ে আছে ।
আমি গাছে গিয়ে ব'সতেই, সে খাওয়া বন্ধ করলে । আমি ভাবলুম বুঝি সে আমাকে চিনতে পেরেছে, কিন্তু তার সঙ্গে একটা কথা বলতে না বলতেই সে এক রাশ 'কু-কু-কু-কু' শব্দ করে, নক্ষত্রবেগে কোথায় উড়ে গেল । আমি কি করি, ছেলেরা পাছে মনঃক্ষুণ্ণ হয়, তাই তার জায়গায় বসে তারই মতন করে ফলে মুখ দিতে যাচ্ছি-এমন কি একটা আমার কাণের পাশ দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল । চমকে উঠে নীচের দিকে চেয়ে দেখি, ছেলেরা ঢিল কুড়াচ্ছে আর বলাবলি করছে, "ভারি পাজী-কোকিলটাকে উড়িয়ে দিলে-আচ্ছা ওকে দেখে নিচ্ছি-দেখিস্ যেন ফলে না ঠোকর দেয়-ওর ঠোক্রানো ফল খেতে নেই ।" আর শোনবার কি দেখবার প্রবৃত্তি রইল না; আমি যেদিক হয় একদিকে উড়ে গেলুম । কিন্তু ছেলেদের উপর তত রাগ হল না-যত হিংসে হল ঐ কোকিলটার উপর । আমার মনের ভিতর থেকেও কে যেন বলে দিতে লাগলো "ওকে হিংসে করাই তোর উচিত ।"
তারপর তার খোঁজ আর করলুম না, কিন্তু এটা বেশ দেখতে পেলুম যে, ভাল ফলের গাছে বসতে গেলেই লোকে আমাকে তাড়ায়-তারা আমার জন্যেই ক্ষেতের মধ্যে চুনমাখা হাঁড়ি, আর গাছের ডালে পাতিকাকের ডানা টাঙিয়ে রাখে । তা দেখে আমার মনে আতঙ্ক হয় । ক্রমে এমন হলো যে, ভাল করে না দেখেশুনে, কি চারপাশে না ঘুরে এসে আমি কোন গাছেরই ডালে বসতে সাহস করতুম না । ভয় হল হয়ত চিরজীবন আমাকে ডানাতে ভর দিয়েই থাকতে হবে । কিন্তু শেষে জানতে পারলুম যে, কেবল দুটো গাছ আছে, যার ফল খেয়ে কেউ আমাকে কিছু বলে না ।"
সুশীল বাধা দিয়ে বল্লে-"সে কি, বৌদি?"
"এই বট আর জগ্ডুমুর ।"
"অর্থাৎ যে ফল মানুষে ছোঁয় না ।-আচ্ছা, তারপর?"
"তারপর আর কি-আমি গভীর বনের মধ্যে ঢুকে এক দেবদারু গাছের উপর একটা পাকারকমের বাসা তৈরী করলুম ।"
"তখন তোমার বিয়ে হয়েছে?"
"এইবার ঠেকিয়েছ-দাঁড়াও মনে করি ।"
"এই শুন্লে, আর এই ভুলে গেছ? যাক্, বুঝেছি-তাহলে এইখানেই ইতিহাস শেষ, কেমন?"
বৌদিদি কি বল্তে যাবেন, এমন সময় দাঁড়কাকটা আল্সের একধারে এসে উড়ে বসে 'খা-খা' শব্দ করতে লাগলো ।
"না-এবার বড় খারাপ রকম ডাকছে-ওকে উড়িয়ে দিই" বলে এক টুকরো শক্ত বালি হাতে করলে ।
বৌদিদি বল্লেন "না, না, উড়িও না-ও ভাল কথাই বলছে; দেখছ না অপি কেমন ভাত ছড়াচ্ছে-বুক বেয়ে ভাতের স্রোত বইছে-এটা ওর সহ্য হচ্ছে না- ও জানে ভাতের দাম কি-তাই বলছে "খা, খা, কুড়িয়ে খা ।"
"তোমার জন্যে বৌদি, পাখী ত পাখী, পিঁপড়েটারও আস্পর্ধা বেড়ে যায়-ঐ শোন, মা সুদো বুদোকে ডেকে বলছেন অলক্ষুণে কাকটাকে তাড়িয়ে দিতে । আর ঐ দেখ, ও অপুর বুকের উপর থেকে এক ডেলা ভাত মুখে করে ডালের উপর গিয়ে বস্লো-আহা দেখ, বেচারীর মুখখানা! ভয়েতে কাঁদ কাঁদ হয়েছে ।"
বৌদিদি মেয়ের দিকে চেয়ে বল্লেন-"কাক বড় দুষ্টু-না? ওকে মারবো'খন-তুমি কেঁদনা-আরে কাগ!"
অপুর আলোড়িত মুখমণ্ডল আবার শান্তভাব ধারন করলে; সে পুনর্বার আহারে মনঃসংযোগ করতেই, তিনি ঠাকুর-পোর দিকে ফিরে বল্লেন-'যা খেয়ে গিয়েছে ঠাকুর-পো, তার ত আর চারা নেই-এখন থেকে দেখো যেন পাতের দিকে না যায় ।"
তা দেখবো'খন'; কিন্তু দেখেছ বৌদি, ওর নাকের উপর কেমন একটা ছেঁদা?"
"হাঁ, ওটার কথাই ত বলতে যাচ্ছিলুম-তা ত শুন্লে না ।"
"না, বল ।"
"আমি একদিন উড়তে উড়তে একটা মস্ত বাড়ির রেলিং-এর উপর গিয়ে বসি; সেখানে দেখি কি যে, বারান্দায় খাঁচায় সেই কোকিল । সে তখন খাচ্ছিল পাকা কলা আর তেলাকুচো । যথার্থ বলতে কি, আমার লোভ হল-ও সব ত আমি খেতে পাই না । শুধু বেল পাকলে কেন, অনেক ফল পাকলেই আমার স্বার্থ নেই ।
আমি ভাবতে লাগলুম, আমাকে কেন লোকে খাঁচায় ধরে রাখে না? আমি কি ওর চেয়ে দেখতে মন্দ? অবশ্যই নই, যদি স্বাস্থ্য ও বল দুয়ে মিলে সৌন্দর্য্য হয় ।

তবে সুর?-তা কি সকলের গলায় থাকে? হীরেমন চন্দনা কাকাতুয়ার আছে?-তবে একটা কথা এই, তারা ধরা দেয়, আমি ধরা দিই না । সেটা আমার বোকামি । এই যেমন মনে হওয়া, অমনি আমি আর নড়লুম না-ছেলেরা এসে আমাকে ধর্লে কিন্তু যদিও পাশে একখানা খালি-খাঁচা ছিল, তবু আমাকে তার মধ্যে পুরলে না-কেবল নাকে একটা কড়ি পরিয়ে হাততালি দিতে দিতে উড়িয়ে দিলে । কি করি, আমি আর একটা বাড়িতে উড়ে পড়লুম । সেখানে তোমারি মত কে একজন বেড়াচ্ছিল, তার নাকে তোমারি মত একটা কি? ভাবলুম আমারও নাকে যখন একটা কিছু রয়েছে, তখন আমাকে নিশ্চয়ই আপনার লোক বলে আদর করবে; কিন্তু সে আমাকে দেখে হাস্তে হাস্তে আর দশজনকে ডেকে দেখাতে লাগলো-শেষে আমি যাই না দেখে একটা ধনুক নিয়ে তাড়া করলে । রাগে এবং দুঃখে আমি নিজের দলে উড়ে গেলুম ।"
দাঁড়কাকটা আবার আল্সের উপর নেবে 'কা-কা' করে ডেকে উঠলো ।
সুশীল বল্লে-"ঐ বৌদি, আবার যাচ্ছে ।"
বৌদিদি বল্লেন "নজর রেখো, কিন্তু ও ডাকের মনে হচ্ছে "কা গতিঃ" অর্থাৎ 'উপায় কি?' বাস্তবিকই তখন ও ছাড়া আর আমার উপায় কি ছিল-কিন্তু তারা আমাকে খাতির করা দূরে থাক্, বরং ঠোকরাতে এলো; এমন কি, যার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছিল, সেই দাঁড়কাকীটাও আমাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল ।
মনের দুঃখে, দল ছেড়ে নিজের বাসায় উড়ে গেলুম । সেখানে গিয়ে দেখি, ঝড়ে আর বৃষ্টিতে বাসাটা একটু আলগা হয়ে গিয়েছে । ঠোঁট দিয়ে সেটাকে মেরামত করতে গিয়ে, নাকের কড়িটা পড়ে গেল । কিন্তু তাহলেও আর নিজের দলে গেলুম না ।"
"পাতি কাকের দলে?"
"তারা হচ্ছে ছোট জাত-তাদের গাম্ভীর্য্যও নেই ।-কাজেই শেষে ঠিক করলুম নিজের বাসাতেই নির্জন-বাসে থাক্বো, আর নেহাৎ বেড়াতে ইচ্ছে হ'লে লোকালয়ের কাছ দিয়ে ঘুরে আসবো । তারা তাড়াক আর যাই করুক-সেখানে কিছু পাওয়া যায় ।"
"পাওয়া যায়-কিন্তু সে চুরি করে ।"
"সে পেটের দায়ে ।"
"বৌদি, ঐ দেখ! কেমন আস্তে আস্তে এক পা এক-পা করে এগচ্ছে, আবার অপুর হাত তোলা দেখে, পা না হটিয়ে গা টাকে হটিয়ে দিচ্ছে ।"
"আচ্ছা, এই বড়িটা ছুঁড়ে দাও তো-দেখি এদিকে আসে কি না!"
বৌদিদির কথামত সুশীল বড়ি ছুঁড়ে দিলে, এবং তার এই ফল হল যে, কাকটা দু একবার বক্রদৃষ্টিতে বড়ির দিকেও চাইতে লাগলো; কিন্তু বড়লোকের দেওয়া জিনিস বড় হলেও নিতে ভয় হয় - তাই সে একবার একটু এগিয়ে, যথাক্রমে সুশীল আর তার বৌদিদির দিকে স্থির দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে, এবং কোনরকম একটু অঙ্গসঞ্চালন দেখলেই তিন পা পিছিয়ে যায়, - এই রকম কিছুক্ষণ ধরে অভিনয় করতে লাগলো । তারপর হঠাৎ একটা প্রবল সাহসে ভর করে, বড়িটার কাছেই উড়ে বসলো এবং আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে, গলা ও ঠোঁট যথাসম্ভব লম্বা করে দিয়ে বড়িটাকে মুখে তুলে নিয়েই ডালিম গাছের সর্বোচ্চ ডালে উড়ে বসলো ।
এমন সময় নীচে শব্দ শোনা গেল “উইরে ঐ - দে গুলতী দে ।“
বৌদিদি খুব হেসে বল্লেন-“দেখলে ত ঠাকুরপো ওর সাহস-ও যমের পেয়াদা হওয়া দূরে থাক, আদালতের পেয়াদা হতে পারে কি ?”
এমন সময় কাকটা ঝট্পট্ করতে করতে ডালিম গাছ থেকে ছাদের পড়ে লুটিয়ে পড়লো ।
সুশীল চেঁচিয়ে বলে উঠলো –“ঠিক বলেছ বৌদি - পেয়াদা নয় আসামী । ঐ দেখ যমরাজ ওকে তলব করেছেন ।“
বৌদিদি বড়ির উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে গিয়ে দাঁড়কাকটাকে বুকের মধ্যে তুলে নিলেন এবং চেঁচিয়ে বল্লেন –“ঠাকুর-পো - জল, - শীগ্গির !”
সুশীল ছেলেকে ছদের উপর নামিয়ে রেখে দ্রুতবেগে নীচে ছুটলো ।
বৌদিদি কাকটার চোখে মুখে বার বার ফুঁ দিতে লাগলেন; সে একবাত তার ওল্টানো চোখ মেললে, কিন্তু আবার তা উল্টে গেল । বৌদিদির এক ফোঁটা চোখের জল তার চোখের মধ্যে নিয়ে সে তার লটকানো ঘাড়টাকে তাঁর হাতের উপর ঝুলিয়ে দিলে ।

সতীশচন্দ্র ঘটক

( ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা ১৩২৩ মাঘ সংখ্যা )

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।