প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

মুখরক্ষা

[ লেখক পরিচিতি : সতীশচন্দ্রের জন্ম ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা মে । ইংরাজীতে এম.এ. পাশ করেন । পরে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন । পেশায় আইন ব্যবসায়ী হলেও সাহিত্য ছিল তার প্রিয় বিষয় । কবিতা ও গল্প ছাড়া তিনি নাটকও রচনা করেছেন । ব্যঙ্গাত্মক লেখক হিসাবেই তিনি বিশেষ পরিচিত । রবীন্দ্রনাথের 'দুই পাখি' কবিতার

'খাঁচার পাখী ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখী ছিল বনে
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে
কি ছিল বিধাতার মনে ।' ইত্যাদি রূপান্তরিত হয়ে হয়েছে -

'খাঁচার লাউ ছিল বাঁশের মাচাটিতে
বনের লাউ ছিল বনে
একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে
কি ছিল রাঁধুনির মনে ।' ইত্যাদি

অথবা 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ... ' গানটির প্যারোডি হয়েছে

'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো মাড়োয়ারী
তুমি আছ বিশ্ব জুড়ে ওগো মাড়োয়ারী
তোমায় দেখেছি সাগরপারে
তোমায় দেখেছি ঘর কিনারে
তোমায় দেখেছি বড় বাজারে ওগো মাড়োয়ারী...' ইত্যাদি ।

সতীশচন্দ্রের রচিত কবিতাগ্রন্থ : 'ঝলক' (১৯২৩) ; 'লতিকাগুচ্ছ' (১৯৩০) । গল্প-গ্রন্থ : 'সতীর জেদ' (১৯২৪) ; 'দুই চিঠি' (১৯২৮) । নাটক : 'নাটিকাগুচ্ছ' (৫ খণ্ড, ১৯২৯) ; 'হাটে হাঁড়ি' (১৯২৯) ; 'অগ্নিশিখা' (১৯৩০) । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন তার মৃত্যু ঘটে । ] .. দীপক সেনগুপ্ত।



   ভয়ঙ্কর গোলমাল! সন্ধ্যের পর থেকেই সদর দরজার উপর থেকে সানাইয়ের চীৎকার এবং এঁটোপাতা নিয়ে কুকুরদের মধ্যে ঝগড়া সুরু হয়েছে| চণ্ডীমণ্ডপে গুটিকয়েক ভট্চাজ্জি নস্যি নাকে টিপে শাস্ত্রের কচকচানি পুড়ে দিয়েছেন, এবং বাড়ির মধ্যে মেয়েরা কুট্নো কোটা এবং ছেলেদের দুটো খাইয়ে দেবার তালে হুলুস্থূল বাধিয়ে দিয়েছেন|

   বাড়ির পাশের পোড়ো জমির মেরাপের নীচে একদল বরযাত্রী এসে জড় হয়েছেন যাঁদের তুমুল আনন্দের স্রোত থেকে থেকে অন্য সব শব্দকেই ভাসিয়ে কিম্বা ডুবিয়ে দিচ্ছে|

   পাড়ার ভদ্রলোকদের মধ্যে আর বড় কেউ ব্রজেনবাবুর বাড়িতে আসেন নি, কেবল এসেছেন মুখুজ্জে ও গাঙ্গুলি যাঁরা দুজনেই নিঃসন্তান এবং এই কাজের এবং পাড়ার সকল কাজেরই প্রধান উদ্যোগী| আর এসে জুটেছেন সেই ঘটকচূড়ামণি, যিনি এই সংঘটনের কর্তা এবং সেই পরামাণিক যে ব্রজেন্দ্র বাবুর বদান্যতার গুণে সব পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত| বলা বাহুল্য ভটচাজ্জিরা কেউই স্থানীয় নন, সুতরাং বিদায়ের পরিবর্তে অন্য কোন দায়ের আশঙ্কা তাঁদের ছিল না|

    স্ত্রীলোকদের মধ্যে অনেকেই গ্রামস্থ, কিন্তু তাঁদের আসাযাওয়া নাকি সামাজিক হিসাবে ততটা ধর্তব্য নয়, এবং তাঁরা "আসেন নি" একথা বল্লে পুরুষদের সেটা প্রমাণ করা বড়ই কঠিন, তাই তাঁদের সংখ্যা সম্ভাবনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল| মোটের উপর গোলমাল ও সংঘর্ষ যদি উৎসবের মানদণ্ড হয় তাহলে এ বিবাহে উৎসবের মাত্রা কিছুই কম হয় নি|

    দেখতে দেখতে গ্রামের কতকগুলো ইয়ার ছোক্রা এসে বরযাত্রীদের ছেঁকে বেঁকে ধরলে, এবং অবিলম্বেই ঘোরতর বাক্বিতণ্ডা ও শান্তিভঙ্গের সূত্রপাত হলো; কিন্তু কে কার খোঁজ রাখে|

    একা ব্রজেন বাবু নিজের সাধ্যমত চারপাশে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন, কাউকে মিষ্টি কথায় শান্ত করে, কাউকে ভদ্র কথায় আপ্যায়িত করে, কারুর কাছে বা নির্বাক হয়ে হাত জোড় করে|

    বরপাত্র তখনো এসে উপস্থিত হন নি, তাঁর নিহাৎ অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে তিনি এখনি আস্বেন এই রকম সকলের মুখেই দুই তিন ঘণ্টা ধরে শোনা যাচ্ছে| কিন্তু এগারোটার লগ্ন ত প্রায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়|

     তখন আকাশে মেঘ বেশ ঘনিয়ে এসেছে| ঠাণ্ডা বাতাসের দুই একটা দম্কা কখনো বা দুই একটা ঝাড়ের আলো নিবিয়ে দিচ্ছে, কখনো বা আঁস্তাকুড়ের জঞ্জালগুলোকে তুলে নিয়ে ঘুরোতে ঘুরোতে বিয়ের আসরে এনে উপস্থিত কচ্ছে, আর একটা হাড়ীর মেয়ের প্রাণান্ত হয়ে যাচ্ছে বকুনি খেয়ে ও সেইগুলোকে পরিষ্কার করে'|
ব্রজেন বাবুর মনটা যেন ক্রমেই কেমন একটু চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠ্ছে| একে দেখবার লোকের অভাব, তাতে আকাশের বেগতিক, তাতে পাত্রের অনুপস্থিতি, এই তিন কারণে এবং সম্ভবতঃ আরো অনেক কারণে, যা আমরা জানি না, তাঁর মনের ভিতরকার সমস্ত আয়োজন ও বন্দোবস্তও কে যেন গুলিয়ে দিচ্ছিল| তিনি বাইরে ছুটে গিয়ে একবার ঘড়ির দিকে ভ্রুকটির সঙ্গে চেয়ে বল্লেন "তাই ত|" তারপর গাঙ্গুলির কাঁধে হাত দিয়ে তাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গেলেন| গাঙ্গুলির কানে কানে কি যেন ফিস্ ফিস্ করে বলবার পর গাঙ্গুলির একটু বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো, "অত অধৈর্য হলে চলবে কেন|"

     গাঙ্গুলির কথা শুনে মুখুজ্জে একটা ডাবা হুঁকো টান্তে টান্তে তাঁদের কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং ব্রজেন বাবুকে সহসা গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে বল্লেন, "তুমি কিচ্ছু ভেব না ব্রজেন, আমরা যখন রইছি তখন কারুর সাধ্যি নেই যে তোমার কোন রকম অসুবিধে করে-আজই কি, দুদিন পরেই কি|"

     আসল কথা, মুখুজ্জে এবং গাঙ্গুলির যে উৎসাহ সে কেবল কর্মের উৎসাহ, তার ফল সম্বন্ধে তাঁদের মত গীতার সঙ্গে যতটা মেলে ব্রজেনের সঙ্গে ততটা নয়|

     ঘটক পীতাম্বর তখন তর্কবাগীশের সঙ্গে স্মৃতিতীর্থের রাক্ষস ও গান্ধর্ব বিবাহ নিয়ে যে তর্ক হচ্ছিল-তাও হাঁ করে' গিলে ফেলবার চেষ্টা করছিলেন, এমন সময় তাঁর কানে খট্ করে বাজলো মুখুজ্জের শেষ কথা| পাছে এই শেষ মুহূর্তেও সব কেঁচে যায় এই আশঙ্কায় তিনি তাড়াতাড়ি খড়ম পায়ে দিয়ে এবং কাছাটীকে ধুলোয় লুটোতে লুটোতে একেবারে ব্রজেন বাবুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং ঢোক দিলতে ভাঙ্গা গলায় বল্লেন-"কেন, কিছু গোলযোগ হচ্ছে নাকি?"

     ব্রজেন বাবু ধীর ভাবে "না" এই উত্তর দিয়ে নিকটস্থ সম্প্রদানস্থলে উপস্থিত হলেন|
পুরোহিত রামধন ভট্টাচার্য তখন কুশাসনের উপর দুই হাত দিয়ে দুই জানুকে বেষ্টন করে অনেকটা ক্যাঙ্গারুর মত উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাম্রকুণ্ডের উপরস্থ এমন কোন জিনিসের উপর বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন যা ফুল চন্দন নয়|

     ব্রজেন বাবুকে দেখেই তিনি দু'তিনটি তুড়ীর সাহায্যে নিজের আলস্য প্রকাশ কল্লেন এবং তাঁর দীর্ঘ চিক্কণ টিকিটিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জণীর মধ্যে পাকাতে পাকাতে বল্লেন, "কদ্দূর ব্রজেন বাবু? এদিকে আমার ত সব প্রস্তুত|"
     "দেখা যাক" বলে ব্রজেন বাবু আকাশের দিকে চাইলেন| একটা বিদ্যুৎ বড় মাছের মত আকাশের গায়ে 'কড়াত' করে একটা ঘাই দিয়ে মেঘের রং আরো ঘুলিয়ে দিয়ে গেল|

     গাঙ্গুলি, মুখুজ্জে ও ঘটক আস্তে আস্তে ব্রজেন বাবুর কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং অধ্যাপকের দল সভাস্থ হলেন| স্মৃতিতীর্থ একটা কোন কথা-প্রসঙ্গ তোলবার ইচ্ছায় বললেন-"এ মেঘে বৃষ্টি হবে না-যদিও আড়ম্বর নিতান্ত কম নয়|"

     শিরোমণি তাতে সায় দিয়ে বল্লেন-"শরৎকালে সবই বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া"-ব্রজেন বাবু চমকিত হয়ে শিরোমণির মুখের দিকে চাইলেন|

      তর্কবাগীশ শিরোমণিকে তিরস্কারচ্ছলে বল্লেন-"ও কথা এখন অপ্রাসঙ্গিক, সম্প্রতি লক্ষ্য করা উচিত যাতে লগ্ন ভ্রষ্ট না হয়|"

      পুরোহিত শশব্যস্তে উত্তর কল্লেন, "সে বিষয়ে আমি সতর্ক আছি; এখনো রাত্রি দ্বাদশ দণ্ডের অধিক হয় নি-সুতরাং অনুমান আরো অর্ধঘণ্টা সময় আছে|"

     "তা হলে আর ত দেরী করা যায় না" বলে' ব্রজেন বাবু নবীন ও বাঞ্ছাকে ডেকে বল্লেন "ওরে! লণ্ঠন নিয়ে মাঠের মধ্যে এগিয়ে দে, তাঁরা আস্ছেন কি না|"

     মুখুজ্জে গাঙ্গুলির দিকে চেয়ে বল্লেন "এ উত্তম প্রস্তাবই করেছেন-দেখা দরকার|"

     গাঙ্গুলির একটু ব্যস্ত-সমস্ত ভাব দেখিয়ে নবীনকে ডেকে বল্লেন-"আর তাঁদের দেখা পেলে বাঞ্ছাকে বলিস তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতে, আর তুই দৌড়ে এসে আমাদের খবর দিবি|

     স্মৃতিতীর্থ হেসে বল্লেন "এটা খুব প্রবীণ কথা, কারণ তাহলে সংবাদ পাবামাত্রই কার্য্যারম্ভ করা যাবে|" বেশ বোঝা যাচ্ছে এই অনুষ্ঠানে যে কয়জনে যোগ দিয়েছেন, সখের যাত্রার দর্শকদের মত অভিনয় ব্যাপারে তাঁদের মন নির্লিপ্ত,-আর কিছু না হোক তাঁরা আশা করছেন যথেষ্ট| সঙ বাহির হবে| এমন সময় বাইরের থেকে শব্দ উঠলো "ওহে ছোকরা, দেখ না আমাদের দক্ষিণ হস্তের কোন ব্যবস্থা হচ্ছে কি না-ক্ষিদে মাত্ হয়ে যে চোঁয়া ধোঁ ছাড়তে আরম্ভ কল্লে|"

     ব্রজেন বাবু উৎকণ্ঠিত হয়ে গাঙ্গুলির দিকে চাইলেন| গাঙ্গুলি মুখুজ্জের দিকে অঙ্গুলি-সংকেত করে বল্লেন-"যাও না হে, একটু থামিয়ে রাখ না-আমি যে এখান ছেড়ে যেতে পাচ্ছি নি|"

     একজন রসুইকর ব্রাহ্মণ ছুটে এসে পীতাম্বর ঘ্টকের কানে কানে বল্লে "বাবু লুচি কি এখন ভাজা বন্ধ থাক্বে?"

     গাঙ্গুলি ঘটককে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় নিজে দাঁড়িয়ে বল্লেন-"কি? হয়েছে কি?"
ব্রজেন বাবু সব শুনতে পেয়েছিলেন, তিনি বল্লেন, "দু'চার খানা করে ভাজগে"-
গাঙ্গুলি তাড়াতাড়ি বল্লেন-"না,-এক খানাও না-সকলে এসে গেলে, একেবারে পাতে বসিয়ে গরম গরম লুচি পাতে দেবো|"

     এদিকে বাড়ির ভিতর থেকে কে একটা ছেলে উচ্চৈঃস্বরে ককিয়ে কেঁদে উঠলো "মা খাঁদী আমার কাপড়ে পান্তোয়ার রস দিলে|" সঙ্গে সঙ্গে তীব্র-মধুর কণ্ঠে আওয়াজ হলো-"লক্ষীছাড়া মেয়েটাকে ঘরে চাবি দিয়ে রেখে এলে হতো-যা, দূর হ" -অমনি শোনা গেল একটা প্রকাণ্ড চপেটাঘাতের শব্দ, এবং দেখা গেল একটা ছোট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এবং জামা ছিঁড়্তে ছিঁড়্তে বাইরে ছুটে বেরিয়ে এল এবং উঠোনের মাঝখানে চিৎপাত হয়ে শুয়ে অনন্ত আকাশের বুকে সজোরে লাথি ছুঁড়তে লাগলো|

     ব্রজেন বাবু তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঠাণ্ডা করে বড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দিলেন এবং গাঙ্গুলির দিকে চেয়ে বল্লেন, "দাদা একবার ভাঁড়ারে না গেলে ত হয় না,- সেখানে নাকি সব লুট হয়ে গেল|"
গাঙ্গুলি খুব মুরুব্বিয়ানা ভাবে বল্লেন "আচ্ছা সে আমি দেখ্ছি, তুমি কিছু ভেবো না-আর একলা আমি ক'দিকেই বা যাই|"

     গাঙ্গুলি বাড়ির ভিতর যেতে যেতে একটা চাকরকে দেখতে পেয়ে তর্জন করে বলে উঠলেন "এই বেটা-কোথায় থাকিস্-এক কল্কে তামাক দে"-এই বলে রোয়াকের উপর বসে পড়্লেন|

     তর্কবাগীশ ব্রজেন বাবুর সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ খুঁজছিলেন-তিনি আবার কথা পাড়্লেন-঒যাই বল শিরোমণি ব্রজেন বাবুর এ কাজ সকলে হয়ত সমর্থন না করতে পারেন, কিন্তু ওঁর সৎসাহসকে প্রশংসা না করবেন এমন কেউই নেই|"

     ব্রজেন বাবু তর্কবাগীশের দিকে একটু প্রখরভাবে দৃষ্টিপাত কল্লেন| শিরোমণি বল্লেন, "আর এ কাজ ত শাস্ত্রসম্মত -শাস্ত্রে এরও ত একটা ব্যবস্থা আছে"|

     পুরোহিত মহাশয় স্মৃতিতীর্থের কাছ থেকে একটু নস্যি নিয়ে ছিলেন-তার ফলে তিনি হাঁচতে হাঁচতে এবং গামছা দিয়ে নাক রগ্ড়াতে রগ্ড়াতে বল্লেন-"আঁছে না? নৈলে বিদ্যাসাগর মশায় ত একটা মূর্খ ছিলেন না|"
ক্রমে স্মৃতিতীর্থ এ তর্কে যোগদান কল্লেন এবং পারাশর বড় কি মনু বড়, যুগধর্ম মেনে চলা উচিত কি না, এবং 'নষ্টে মৃতে঑-প্রভৃতি নানাবিধ শব্দ ও বচনের প্রয়োগে সে স্থান একটা টোলের মতই প্রতীয়মান হতে লাগ্লো|

     পীতাম্বর বাঁকা হাসিতে শাণ দিয়ে কেবল এইমাত্র বলে নিরস্ত হলেন "বিশেষতঃ এমন সুপাত্র পেলে সকল বয়সের বিধবাই দারপরিগ্রহ করতে পারেন|"

     ব্রজেন বাবু ঘটকের দিকে ভরৎসনাপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বল্লেন-"শুনে যাও|"
ঘটক চুপ করতে গিয়েও তার মুখ দিয়ে কেবল এই কথাটী বেরিয়ে গেল-"একেবারে কার্তিক-কোন দোষ নেই|"

     ব্রজেন বাবু আর সেখানে বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পাল্লেন না; একজন সানাইওয়ালা এসে বল্লে-"বাবু আমাদের কিছু খাবার মিলবে না?"

     ব্রজেন বাবু "ওরে-ও-হাঁ-চল-আমিই দিচ্ছি" বলে ভাঁড়ারের দিকে ছুটলেন|
কিছুক্ষণ পরে পুরোহিত হেঁকে বল্লেন-"কিন্তু আর ত দেরী করা যায় না-লগ্ন ত এসে গিয়েছে বটেই, বোধ হয় আর কিছুক্ষণ পরেই উত্তীর্ণ হয়ে যাবে|"

     ব্রজেন বাবু ভাঁড়ার থেকে সেই কথা শুন্তে পেয়ে ছুটে বাইরে এসে বল্লেন-"ঘড়িতে এখন ত বারটা বাজে-তিন মিনিট আছে|"
স্মৃতিতীর্থ তাড়াতাড়ি পাঁজি টেনে নিয়ে মুখের ভঙ্গীতে নানাবিধ তর্ক ও গণনার চিহ্ণ প্রকাশ করে বল্লেন "তাহলে আর ঠিক ১৭ মিনিট আছে, এদিকে তিন ওদিকে চোদ্দ|"

     ব্রজেন বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন-"ওরে নব্নে, ওরে বাঞ্ছা"-তার পর মুখুজ্জেকে আসতে দেখে বল্লেন "মুখুজ্জে পাত্র এসে গিয়েছে ত?"
মুখুজ্জে কি বল্বেন বুঝতে না পেরে বল্লেন-"হাঁ, বোধ হয় এসে গিয়েছে-আমার যেন দূর থেকে সেই রকম মনে হলো|"

     "আহা, দেখেই এস না" এই কথা ব্রজেন বাবু বল্তেই মুখুজ্জে বল্লেন, "দেখে আর আসব কি-বাবাজীকে তুলেই নিয়ে আসছি"-তারপর তিনি বাইরের দিকে চলে গেলেন|
রামধন ব্রজেন বাবুর দিকে চেয়ে বল্লেন-"ব্রজেন বাবু-শুন্ছেন-মশায়-এই দিকে আসুন-বসে যান-আপনার কাপড় ত ছাড়াই আছে-আর আপনিই ত সম্প্রদান করবেন?"
ব্রজেন বাবু "এ্যাঁ, আমি বসব?-তা-আচ্ছা-দাঁড়ান-একটু আস্ছি"-বলে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর ছুটলেন|

     "এখন আবার চল্লেন - শীগ্গীর আসবেন কিন্তু" বলে পুরোহিত ফুলটুল সাজিয়ে নিয়ে আচমন করে বস্লেন|

     ব্রজেন বাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির ভিতর ছুটে গিয়ে ডেকে বেড়াতে লাগলেন-"গিন্নী-কোথায় গো-গিন্নী|ও কিন্তু গিন্নী তখন নিকটে ছিলেন না| ব্রজেন বাবু খুঁজতে গিয়ে বারবার অপরিচিত স্ত্রীলোকদের সুমুখে পড়ে গিয়ে নিজেকে লজ্জিত এবং বিপন্ন বোধ করতে লাগলেন|

     আসল কথা, গিন্নী সেদিন তাঁর শোবার ঘরেই চুপ করে বসে ছিলেন| আজ ক'দিন ধরে' চোখের জল পড়ে পড়ে তাঁর চোখদুটো শুকনো কাগজের মত করকরে হয়ে গিয়েছে-কিন্তু তাহলেও তাঁর মুখখানা বড়ই ভার-হাসির লেশমাত্র নেই| তবু পাছে এক ফোঁটা জল কোন ভুলে; কোন সময় চোখ ফেটে বেরিয়ে পড়ে তাই তিনি কোন আমোদ প্রমোদে, কোন আদর সম্ভাষণে যোগদান করেন নি-কেন না কর্তার কড়া হুকুম ছিল-"আগে যা করেছ করেছ, আজকের দিনে চোখের জল ফেলে অমঙ্গল করতে পারবে না|" পাড়ার দু'একজন বর্ষীয়সী মহিলা এসে তাঁকে প্রফুল্ল করে নিজেদের মধ্যে নিয়ে যাবার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি| পাড়ার কর্ত্রী বিশ্বেশ্বরী এসে কি তাঁর হাতে ধরে বলেছিলেন "সুবদনীর আবার সীঁথেয় সিঁদূর, হাতে লোহা উঠবে-আর তুমি মা হয়ে তা দেখবে না|"

     জয়ন্তী কিন্তু কেবল এই উত্তর দিয়েছিলেন "তোমরাও ত ওর মার মত-তোমরা গেলেই হবে-যেদিন ওর সিঁদূর পুঁছে-নোয়া ভেঙ্গে-ওকে থান কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলুম আমার চোখে আজও ঠিক্ তেমনি একটা দিন|"

     ব্রজেন বাবু গিন্নীকে খুঁজছিলেন মেয়ে কোথায় তাই জানবার জন্যে-কিন্তু তিনি হঠাৎ নিজেই সেই ঘরে ঢুকে পড়লেন! তখন তরুণীরা সকলে মিলে সুবদনীকে সাজাচ্ছিল-
তিনি ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে পড়তেই সকলে "ওমা কে ও!" বলে ঘোম্টা টেনে এক কোণে সরে দাঁড়াল তারপর চিনতে পেরে ভাবলে তিনি এখনই চলে যাবেন| কিন্তু ব্রজেন বাবু নিশ্চল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন যেন সে গ্রীক্-পুরাণের সেই একটা পরী যার দিকে চাইলেই লোকে পাথর হয়ে যেত|

     তখন মেয়ের পায়ে আলতা পরিয়ে, চুল বেঁধে তাকে রাঙ্গা সাড়ী পরিয়ে দেওয়া হয়েছে-কেবল কপালে চন্দনের ফুল কিছু বাকি আছে|"
মেয়ে বাপের দিকে একবার চেয়ে ঘাড় নীচু কল্লে-আর তোলবার শক্তি রইলো না-ব্রজেন বাবু দেখতে পেলেন না-সে চোখে তখন বিদ্যুৎ কি বৃষ্টি-কুয়াসা কি ঝড়|
অন্যান্য রমণীরা পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন|

     ব্রজেন বাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল কি জন্যে তিনি এসেছেন-কিন্তু কথা কোথায়! ভাষা কোথায়! তিনি কি সব ভুলে গিয়েছেন? তাঁর মাথায় কি আর মস্তিষ্ক এক বিন্দুও নেই? তাঁর বুকের ভিতর কি আর বায়ু চলাচল করছে না? না তাঁর জিভ্ শুকিয়ে তালুর সঙ্গে এঁটে গিয়েছে? কিন্তু কথা বল্ছিল তাঁর চোখ-সেই চোখ বারবার মনকে জিজ্ঞাসা করছিল-"কেমন, এই ভাল, না সেই ভাল? কোন্টা ভাল দেখাচ্ছে? কোন্টা দেখে তুমি চিরদিন সুখী থাকবে?"

     ব্রজেন বাবু তখন দাঁড়িয়ে রইলেন দেখে সুবদনী আস্তে আস্তে ডাকলে-"বাবা|"
ব্রজেন বাবুর মুখের ভিতর থেকে কি যেন একটা মস্ত পাথর সরে গেল-তিনি কাঁপানো গলায় জিজ্ঞাসা কর্লেন-"মা, সব ঠিক - এইবার, এখনো বল, ফিরব না এগোব-একটু পরে আর হাত থাক্বে না|"
মেয়ে সে সময় আর কি বল্বে-সে জানে তার মায়ের কি স্নেহ-বাপের কি মঙ্গল কামনা| সে জানে তাঁদের একজনের কি ইচ্ছা-আর একজনের কি সংকল্প| এর মধ্যে তার নিজের ক্ষুদ্র সত্তাটুকু কোথায়? তাকে ছিঁড়ে ভাগ করে দিতে পারলে সে হয়ত দুজনকেই সন্তুষ্ট কর্তে পারত, কিন্তু তা সে পার্লে কৈ? তার নিজের মনকে যাচাই করে, বুদ্ধিকে স্থিরভাবে প্রশ্ন করে-তার স্বাভাবিক সংস্কারের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া করিয়ে দেবার সময় পেলে কৈ? সে কেবল দুই ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজে বিক্ষুব্ধ হয়ে চিন্তিত হয়ে, চূর্ণ হয়ে, মাটির মধ্যে মিশে গিয়েছে-স্বাধীনতার উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবার অবসর পায় নি| সে অনেক ভেবে শেষে এই কথাটি বল্লে, "বাবা, ভেব না-ভগবান সকলের মুখরক্ষা কর্বেন|"

     ব্রজেন বাবু কি বুঝলেন জানি না-দ্রুতবেগে বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং একেবারে সম্প্রদাতার আসনের উপর বসে বল্লেন-"কৈ মুখুজ্জে কোথায়? পাত্রকে এখনো নিয়ে এল না?"
কিন্তু কোথায় মুখুজ্জে? নবীন বাঞ্ছারও কোন সংবাদ নেই|

     এমন সময় মুষুলধারে বৃষ্টি নেবে এল-বরযাত্রীরা মেরাপের নীচে থেকে একেবারে হুড়্মুড়্ করে বেরিয়ে এবং অনেক জিনিষপত্র লণ্ডভণ্ড করে পূজার দালানে অর্থাৎ সম্প্রদানের স্থানে গিয়ে হাজির হল|
তাদের জিজ্ঞাসা করাতে তারা বল্লে "কৈ, না-স্বরূপচন্দ্র ত এখনো এসে পৌঁছয় নি-সে নৌকায় চড়বে দেখে আমরা চলে এলুম|"

     "বল কি!" বলে ব্রজেন বাবু লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন|
     "ব্যস্ত হয়ো না" বলে গাঙ্গুলি তাকে টেনে ধরে বসালেন|
     "কিন্তু আর যে লগ্ন নেই" বলে ব্রজেন বাবু গাঙ্গুলির দিকে ঘৃণাপূর্ণ কাতর কটাক্ষে চাইলেন-সে কটাক্ষে সম্মনের চিহ্ণ ত ছিলই না বরং বিদ্রোহের ভাব ছিল|
অল্পভাষী, দ্বিধাপূর্ণ ব্রজেন্দ্রের ভিতর যে এতটা শক্তি ও তেজ প্রচ্ছন্ন ছিল-যাতে সে তাঁর সঙ্গেও কড়া ভাবে কথা বলতে পারে-এটা গাঙ্গুলি আজ নূতন দেখলেন|
তিনি পূর্বের মত একটা যা তা উত্তর দিতে আর সাহস কল্লেন না-"তাহলে যা ভাল হয় তাই কর" বলে দূরে সরে গেলেন|

     ঠিক সেই সময় সেখানে উপস্থিত হল একটা বিকট বীভৎস মূর্তি-অনেকটা প্রেতের মত; সর্বাঙ্গে কাদামাখা-চক্ষু রক্তবর্ণ-লম্বা চুল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াচ্ছে|

     ব্রজেন বাবু তার দিকে চেয়েই বল্লেন-"এ কে? কে তুমি?"
সে প্রথমটা চুপ করেই রইল-কোন উত্তর দিতে পাল্লে না-কিন্তু তার চোখ যেন কাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল|
এমন সময় পরামাণিকচন্দ্র এসে তার মাথায় টোপর পরিয়ে দিলে এবং ঘটকরাজও ছুটে এসে বল্লেন, "তাই ত এমন অবস্থা|" তারপর অন্দরের দিকে মুখ করে উঁচু গলায় বল্লেন, "হুলু দাও-শাঁখ বাজাও|"
অমনি হুলুধ্বনি ও শঙ্খ বেজে উঠল| কিন্তু ব্রজেন বাবু আস্তে আস্তে উঠে ঘটককে জিজ্ঞাসা কল্লেন-"এই কি আমাদের জামাই?"

     ঘটক দ্বিধাপূর্ণ ভাবে বল্লেন, "তাই বলেই ত মনে হচ্ছে-তবে মুখে টুখে কাদা রয়েছে বলে-"
"কিন্তু আমার ত মনে বলছে না, এই আমার সুবদনীর বর" বলে ব্রজেন বাবু অন্যদিকে মুখ ফেরালেন|
"সে সন্দেহ আমারই যখন ভাল করে যায় নি, তখন আপনার ত হতেই পারে-তবে কাদাটাদাগুলো ধুয়ে ফেললেই বুঝতে পারবেন" এই বলে ঘটক চাকরদের ডেকে বল্লেন, "ওরে জল নিয়ে আয়"-তারপর আগন্তুকের হাত ধরে তাকে বল্লেন, " বাবাজি এইদিকে এস- কাদার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলে বুঝি? তা পথ যে পিছল-"

     এইবার আগন্তুকের মুখে কথা ফুটলো| সে সকলের মুখের দিকে সন্দিগ্ধভাবে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞাসা কল্লে, "বর এয়েছে? হাঁ মশায় বর এয়েছে?"
ঘটক বল্লেন, "সে কি কথা বাবাজি, বর ত তুমিই!" সে জড়িতকণ্ঠে বল্লে, "সেই কথাই ত জিজ্ঞাসা করছি| এখনো কি তবে ডুবে মরে নি? ঝড়ে নৌকাটা গেল উল্টে, বরের গলার মালাটা গেল ভেসে, আর ঐ আবাগের বেটা বরটাই বাঁচল না কি?"

     ঘটক বরের এই প্রলাপ-উক্তি চাপা দিয়ে বলে উঠ্লেন-"তাহলে কাজ আরম্ভ করা যাক্, সময় বয়ে যায়|"

      পীতাম্বরের মুখ কৌতুকহাস্যে কুঞ্চিত হয়ে উঠল| ব্রজেন এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে চৌকির উপরে হাত দিয়ে বসে ছিলেন, হঠাৎ লাফিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠ্লেন, "মরেছে, মরেছে, বর মরেছে-চুকে গেছে!"
ঘটক বল্লেন, "কি বলছেন ব্রজেন বাবু; আপনার হল কি?" ব্রজেন বল্লেন, "আমার মুখরক্ষা হল, আমার মেয়ের কথাই খাট্ল| এই যদি আমার সুবদনীর বর হয় তা হলে বর মরেছে|"
বাড়ির ভিতর একটা কান্নার রোল উঠে পড়ল| মুখুজ্জে বেগতিক বুঝে কি একটা হাঁড়ি নিয়ে খিড়কীর দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এবং স্মৃতিতীর্থ, তর্কবাগীশের কানে কানে বল্লেন-"ছানার পায়েস জিনিসটা শোনাই গিয়েছিল, দেখা আর হল না|"

     পুরোহিত মহাশয় ব্রজেন বাবুর নিকটে এসে বল্লেন "তা হলে আজ আমি আসি-আপনি দুঃখিত হবেন না-সমস্তই দৈবাধীন কার্য্য-"শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি"-তবে আপনি বুদ্ধিমান, বিবেচক লোক-আপনাকে আর বেশী কি বলব-আমার আজকের পারিশ্রমিকটা-"

     ওদিকে গাঙ্গুলি ও ঘটক দু'পাশ থেকে দু'জনে এসে ব্রজেন বাবুর পাশে দাঁড়ালেন|
গাঙ্গুলি তাঁর মুখখানাকে যথাসম্ভব লম্বা ও বিমর্ষ করে বল্লেন-"ভেবে অবিশ্যি কোন ফল নেই ব্রজেন-তবে ঈশ্বর যা করেন তা ভালর জন্যেই-আমার সন্ধানে খুব ভাল একটী পাত্র আছে এবং খুব সম্ভবতঃ সে রাজী হবে-আমি কালই গিয়ে-"

     ব্রজেন বাবু বাধা দিয়ে বল্লেন-"আচ্ছা, সে পরে হবে|"
"না-না-সে পরে কেন-আমি কালই গিয়ে প্রস্তাব তুলব-তুমি কোন দুঃখ করো না-এ পাত্রের সঙ্গে তার আকাশ পাতাল তফাৎ-তার কোন রকম নেশা কি বদ্খেয়াল নেই|"

     "তা হলে এর ছিল?" বলে ব্রজেন বাবু একটা ছোট হাসি হাস্লেন যা শুনতে খুব বিকট এবং দেখ্তে অনেকটা মেঘলা দিনের রোদের মত|

      ঘটক তাড়াতাড়ি বলে উঠ্লেন-"না, না সে রকম কিছু নয়-তবে একটু আধটু-আচ্ছা তা গাঙ্গুলি যার কথা বল্লেন তাকেই না হয় কাল গিয়ে দেখে আসা যাবে-ভালর চেয়েও ত ভাল থেকে থাকে|"

      ব্রজেন বাবু ঘটকের দিকে চেয়ে আর একবার হেসে বল্লেন-"বটে! তা হলে ঈশ্বর না করুন এ পাত্রেরও যদি কিছু হয় তা হলে এর চেয়েও একটা ভাল পাওয়া যাবে?"
ব্রজেন বাবুর কথার ভাবে গাঙ্গুলি ঘটক সকলেই চুপ করলেন| বরযাত্রীরা এক এক করে সরে পড়্বার উপক্রম কর্তে লাগল|

     ওদিকে এক এক করে কে যেন সব আলো নিবিয়ে দিয়েছে-আর সানাইয়ের সুরও কোন্ সময় বন্ধ হয়ে গেছে-দেখ্তে দেখ্তে সমস্ত বাড়ি নীরব নিঝুম হয়ে পড়লো|
ব্রজেন বাবু অনেকক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে উঠলেন-"ওরে কে আছিস সব আলো জ্বেলে দে-আর সানাইওয়ালাদের বল্ খুব কসে বাজাতে"|

     পুরোহিত আশ্চর্য্য হয়ে উঠলেন-"সে কি!-"
ব্রজেন বাবু হাসতে হাসতে বরযাত্রী পুরোহিত এবং অন্যান্য ভদ্রলোকদের দিকে চেয়ে বল্লেন,"আপনারা কেউ যাবেন না-খেতে বসুন-আমি নিজে পরিবেশন কচ্ছি|"

      পুরোহিত আশ্চর্য্য হয়ে বল্লেন,-"সে কি ব্রজেন বাবু, লগ্ন ত আজ গেছে|"
ব্রজেন উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, "গেছে, গেছে, চিরদিনের মত গেছে, আর ভাবনা নেই|"

সতীশচন্দ্র ঘটক

( 'সবুজপত্র' পত্রিকা ১৩২৪ আষাঢ় সংখ্যা )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।