প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
অবেক্ষণশক্তি
[
লেখক পরিচিতি : লেখকের নাম পাওয়া যায় নি| তখনকার দিনে অনেক
সময়েই লেখক নিজের নাম প্রকাশ করতেন না| সাধারণ ভাবে প্রচার
বিমুখতার মানসিকতাই এর কারণ ছিল কি না বলা শক্ত| বর্তমান
লেখাটিতে লেখক নিজের নাম দিয়েছেন শ্রীজ-| মূল বানান অপরিবর্তিত
রাখা হয়েছে| ]
দীপক সেনগুপ্ত |
পাঠক, বড় বিপদে পড়িয়াছি| নানা কারণে
কিছু দিন বান্ধবসম্পাদকের কিছু মাত্র অবকাশ ছিল না; এই হেতু
কএক সংখ্যা বান্ধব প্রকাশে বিলম্ব হয়| আপনারাও 'অনবকাশের'
ওজর গ্রাহ্য করিবেন না; সুতরাং সম্পাদক লেখকদিগের নিকট প্রবন্ধ
চান| করি কি লেখনী হস্তে কাগজ সম্মুখে লইয়া ভাবিতে ভাবিতে
একটি বিষয় নির্ণয় করিলাম; কিন্তু কি নামে বিষয়টির নামকরণ করি,
তাই ভাবিয়াই অস্থির| 'দৃশ্', 'লুচ্' ও 'ঈক্ষ্' তিনটি ধাতু
লইয়া একে একে উপসর্গ গুলি যোগ করিয়া দেখিলাম, কিছুতেই ইংরেজী
শব্দটির প্রতিশব্দ পাইলাম না| অবশেষে যেটি নির্ব্বাচন পূর্বক
উপরে স্থাপিত করিয়াছি, তাহাও মনোমত হয় নাই| তবে ইংরেজী উপসর্গের
সহিত বাঙ্গলা উপসর্গটির মিল আছে, এইমাত্র| এস্থলে একটি গল্প
মনে পড়িল| গত দুর্ভিক্ষ হইতে গবর্ণমেন্ট ষ্টাটিষ্টিক্ সংগ্রহ
করিতে আরম্ভ করিয়াছেন| কোন স্থানের কালেক্টর একজন বাঙ্গলানবিশ
ডেপুটীকালেক্টরের প্রতি উহা সংগ্রহ করিতে আদেশ করিবেন, মনে
করিয়া, পাছে উক্ত কর্ম্মচারী ঐ শব্দের অর্থ না বুঝেন, এই সন্দেহ
করিয়া, সেরেস্তাদারকে কহিলেন, উহা বাঙ্গালায় অনুবাদ করিয়া
দেও| সেরেস্তাদারের মহা বিপদ, দিশাহারা হইয়া তিনি উচ্চারণ
সাদৃশ্যের উপর নির্ভর করিয়া লিখিলেন 'স্থিতি স্থাপক|' সাহেব
সন্তুষ্ট হইলেন, ভাবিলেন সেরেস্তাদার বেশ বাঙ্গলা জানেন| কিন্তু
পাঠক আমার অনুবাদটি কি আপনাদের নিকট তদ্রুপ 'পাশ' হইবে? যাহউক,
সংপ্রতি মূল প্রস্তাব আরম্ভ করা যাক|
শ্রীমতী মিস্ নাইটিংগেলের নাম অনেকেই অবগত আছেন| তিনি
কহিয়াছেন, 'চিকিৎসালয়ে যে সকল ধাত্রী আছে, তাহাদের অন্যান্য
গুণ সত্বেও একটি প্রধান দোষের জন্য রোগীদিগের তত সুবিধা হয়
না| সে দোষটি অবেক্ষণের অভাব, এ দোষটি শুদ্ধ ধাত্রীদিগের নহে;
প্রায় লোক মাত্রেরই| যদি লোক মাত্রেই এই শক্তিসম্পন্ন হইত,
তবে পৃথিবীতে উন্নতি বিষয়ে এতদিন যুগান্তর উপস্থিত হইত| কেহ
বলেন, অভিজ্ঞতাদ্বারা লোকে জ্ঞানী হয়, অর্থাৎ কেহ দেখিয়া শিখে,
কেহ ঠেকিয়া শিখে, আবার কেহ বা ঠকিয়া শিখে| কিন্তু আমরা বলি
এ মত নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমশূন্য নহে| কারণ, 'দেখা' 'ঠেকা' দূরে
থাকুক, অনেকে পদে পদে 'ঠকিয়াও' যে অজ্ঞ সেই অজ্ঞই থাকে| যাহাদের
চরিত্রে স্বাভাবিক দোষ থাকে, কোনরূপ অভিজ্ঞতাই তাহাদিগকে জ্ঞানী
করিতে পারে না| যদি তাহা হইত, তবে প্রথম চার্লস ভূপতি রাজ্যচ্যুত
ও ছিন্নশির হইতেন না| বোর্বন পরিবার কোন কালে জ্ঞানী হইল না;
তাহা হইলে আজিও ফরাসের সিংহাসনে তাহারা বিরাজ করিত| কূলাঙ্গার
জয়চন্দ্র ধোরিয়ান মহম্মদকে বৈরনির্য্যাতন মানসে আহ্বান করাতে
ভারতরাজ্য ম্লেচ্ছকবলিত হইল; তাহাতে যদি হিন্দুদিগের জ্ঞানোদয়
হইত তবে কি পলাসীর অভিনয় হইত? ঐতিহাসিক প্রমাণেরই বা প্রয়োজন
কি? আমরা সর্ব্বাদাই দেখিতে পাই অনেক লোক চিরকালই নির্ব্বুদ্ধিতা
প্রদর্শন করেন| অনেকে বাল্যকালে বরং একটুকু জ্ঞানের স্ফূর্তি
দেখান, যত বড় হন্ নির্ব্বুদ্ধিতা তত বর্দ্ধিত হইতে থাকে| অবেক্ষণশক্তিসম্পন্ন
লোকই স্বতন্ত্র-বাল্য ও বার্দ্ধক্যের সহিত উক্ত শক্তির কোন
সম্পর্ক নাই| নেপোলিয়ন বোনাপার্টি যখন প্রথম কন্সল হন, তখন
তাঁহার বয়ঃক্রম কত? কিন্তু তখন তিনি অস্ট্রিয়ার অনেক বৃদ্ধ
ও সমরাভিজ্ঞ সৈন্যাধ্যক্ষকে পরাভব করিতে পারিয়াছিলেন| সেনানী
উল্ফ্ কেমন বিক্রম প্রকাশ করিয়া সমরক্ষেত্রে শায়িত হইয়াছিলেন!
অথচ মৃত্যু সময়ে তদীয় বয়ঃক্রম এত অল্প ছিল যে, তাঁহাকে বালক-সেনানী
বলিলেও হয়; কিন্তু তদানীস্তন বয়োবৃদ্ধ সেনানীরাও তাঁহার নিকট
মস্তক অবনত করিতেন| ইংলণ্ডের প্রধান মন্ত্রী উলিয়ম পিট অপরিণত
বয়সে পার্লিয়ামেন্ট সভাতে তদীয় বিদ্রুপকারিদিগকে কেমন প্রবীণোচিত
উত্তর দিয়াছিলেন! বালক-ফার্গুসন এক গাছি সূত্র লইয়া খেলাইতে
খেলাইতে নিশ্চল-নক্ষত্রপটলের পরস্পর ব্যবধান পরিমাণ করিয়াছিলেন
এবং বায়ুর অবস্থা-নির্ণয় করিয়া কতই প্রাজ্ঞতা দেখাইয়াছিলেন|
এই মহাত্মারা সকলেই অবেক্ষণগুণে অপরাপর লোকদিগের অপেক্ষা এত
শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিয়াছিলেন| ফলতঃ অবেক্ষণ-বিশিষ্ট বালক
অনেক বয়োবৃদ্ধ অপেক্ষা যে প্রবীণ তাহার আর ভুল নাই|
জ্ঞানকে ঈশ্বরদত্ত গুণ বলিলে অসঙ্গত হয় না| অবেক্ষণই
জ্ঞানের প্রসূতি ও ধাত্রী| এই অবেক্ষণশক্তি অন্যান্য শক্তির
ন্যায় অভ্যাসে পরিবর্দ্ধিত হয়| মিস্ নাইটিংগেল যাদুকর বরার্ট
হুডিনের নাম উল্লেখ করিয়া কহেন যে 'সে অকিঞ্চিৎকর বিষয়ের জন্য
বিখ্যাত হইলেও, অবেক্ষণশক্তির পরিচালনার নিমিত্ত স্বীয় পুত্রকে
যে পদ্ধতির অনুসরণ করিতে পরামর্শ দিয়াছিল, তাহা অত্যন্ত প্রাজ্ঞোচিত|'
সে পদ্ধতিটি এই; - হুডিন স্বীয় পুত্র সমভিব্যাহারে দ্রুতবেগে
কোন বিপনীর নিকট দিয়া চলিয়া যাইতে যাইতে তাহাকে তন্মধ্যস্থ
দ্রব্য সকলের প্রতি মনোযোগ পূর্ব্বক দৃষ্টি করিতে বলিত| পরে
পিতাপুত্রে সেই দৃষ্ট বস্তু গুলির একটি তালিকা লিখিত| এইরূপে
উক্ত বালকের অবেক্ষণশক্তি এত উন্নতি লাভ করিয়াছিল যে, সে একবার
কোন দোকানের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে, তন্মধ্যস্থ ৬০| ৭০টি বস্তুর
আকৃতিস্থিতি প্রভৃতির যথাযথ বর্ণন করিতে পারিত| ইহারা 'দিব্যচক্ষু'
বলিয়া লোকসমাজে পরিচয় দিয়া অর্থোপার্জ্জন করিত| বালক হুডিন
এরূপ আশ্চর্য্য শক্তি লাভ করিয়া ছিল যে, কোন গৃহে প্রবেশ করিবা
মাত্র তাহার চক্ষুর্দ্বয় সম্পূর্ণরূপে বন্ধন করিয়া ফেলিলেও,
সে, গৃহস্থিত সমুদয় ব্যক্তি ও সকল সামগ্রীর সূক্ষ্ম বর্ণন
করিয়া দর্শকদিগকে চমৎকৃত করিতে পারিত| লোকে জিজ্ঞাসা করিলে
বলিত যে, সে শিরা ও ধমনী সংযোগে সমুদয় বস্তু দেখিতে পায়|
পাঠক মহাশয়দিগকে হুডিন দ্বয়ের ন্যায় যাদুকর হইবার জন্য
আমরা পরামর্শ দেই না; কিন্তু অবেক্ষণশক্তির পরিচালনা বিষয়ে
তাহারা নিশ্চয়ই অনুকরণীয়| এই শক্তির কত যে মহৎফল তাহা বলা
যায় না| প্রাত্যহিক ব্যাপারে ইহার অভাবজনিত কুফল সর্ব্বদাই
পরিলক্ষিত হইয়া থাকে| প্রভু অবেক্ষণশক্তি বিরহিত হইলে ভৃত্যের
দ্বারা আশানুরূপ কার্য্য পান না; কোন বিষয়ে মধ্যস্থতা করিতে
গেলে ভ্রমে পতিত হইতে হয়; একটি সামান্য উদাহরণ প্রদর্শন করিলেই
পাঠক বুঝিতে পারিবেন| কিছুদিন হইল কোন বিদ্যালয়ের, একটি বালক
সমপাঠীর একখান পুস্তক অপহরণ করিয়াছিল; উক্ত পুস্তকের যে যে
স্থানে অধিকারির নাম লেখা ছিল, তাহা তুলিয়া ছিল, পুস্তকের
মলাট পর্য্যন্ত পরিবর্ত্তন করিয়া ছিল, কিন্তু অধিকারী পত্রসমষ্টির
গাত্রে পেন্সিল দিয়া যে স্বীয় নাম লিখিয়া রাখিয়াছিল, অবেক্ষণাভাব
বশতঃ তাহা দেখিতে পায় নাই; সুতরাং চুরির কএক দিন পরে বিদ্যালয়ে
পুস্তক খানি লইয়া আসামাত্র ধরা পড়িল| পাঠক অনেক সময় শুনিয়া
থাকিবেন, হতব্যক্তির কোন বস্তু পরিধান পূর্ব্বক পুলিস কর্ত্তৃক
হত্যাকারী ধৃত হইয়াছে|
ইতিহাস মন্থন করিলে এই অবেক্ষণশক্তির এত
ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যায় যে, তৎসমুদয় উল্লেখ করিতে গেলে এই
একই প্রবন্ধে অনেক সংখ্যা বান্ধবের কলেবর পূর্ণ হইতে পারে| বালক
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি উড়াইতে উড়াইতে তাড়িতাকর্ষণ আবিষ্কার
করিয়াছিলেন; নিউটন আতা ফলের পতন অবলোকনে মাধ্যাকর্ষণ ও শিশুদিগকে
সাবানবুদ্বুদ্ লইয়া ক্রীড়া করিতে দেখিয়া বর্ণবিজ্ঞানের আবিষ্কার
করিয়াছিলেন| ভারতচন্দ্র যখন লিখিয়াছিলেন-
'কাঞ্চীপুর
বর্দ্ধমান ছয় মাসের পথ|
ছয় দিনে উত্তরিল অশ্ব মনোরথ ||'
অথবা ভারতবর্ষে
রেলওয়ের কথা হইলে একজন আধুনিক কবিওয়ালা যখন গাইয়াছিল-
'লোকে একদিনে
কলকাতা হ'তে সদ্য
যাবে কাশী|'
তখন লোকে উহা কবিকল্পনা বলিয়া ভাবিয়াছিল মাত্র; কিন্তু
রেলওয়ে তাহা সত্য ঘটনা বলিয়া প্রমাণ করিয়াছে| অবেক্ষণপ্রভাবে
একটি সামান্য ঘটনা দেখিয়া জেমস্ ওয়াট এই বৃহৎ কাণ্ডের আবিষ্কার
করেন| কেৎলিতে চা সিদ্ধ হইতেছিল, তখন পাত্রমধ্যস্থ রুদ্ধবাষ্পপ্রভাবে
আবরণটি উত্থিত হইতেছে দেখিয়া ওয়াটের অন্তঃকরণে বাষ্পের শক্তির
ভাব প্রথম উদিত হয়, এবং তাহারই ফল বাষ্পীয় পোত, বাষ্পীয় শকট
প্রভৃতি| এই যে ঘটিকাযন্ত্রটিতে টক্ টক্ করিয়া দোলকটি ইতস্ততঃ
নড়িতেছে, ইহাও অবেক্ষণের ফল| পাইসা নগরীর একটি গির্জাতে একজন
ফরাশ সন্ধ্যা সময়ে ঝাড় লণ্ঠন জ্বালিয়া দিতেছিল, একটি শিকে
হস্ত লাগিয়া ইতস্ততঃ দুলিতে লাগিল; তাহা দেখিয়া গালিলিওর মনে
হইল, যদি কোন ক্রমে এরূপ ভাবে একটি বস্তু দোলাইয়া দেওয়া যায়
যে, তাহা বাধা না পাইলে চির দিন দুলিতে পারে তবেই তদ্দ্বারা
সময় নিরূপণ করা যায়| এই সিদ্ধান্ত হইতেই ঘটিকাযন্ত্রের সৃষ্টি|
সামুদ্রিক মানচিত্র ও সামুদ্রিক স্রোত অবেক্ষণ করিয়া কলম্বস
নূতন মহাদ্বীপের সত্ত্বা উপলব্ধি করিয়াছিলেন| পুনশ্চ যখন কলম্বসের
সঙ্গিগণ ত্যক্ত ও ক্ষিপ্ত প্রায় হইয়া হতাশচিত্তে তদীয় প্রাণ
সংহার করিতে কৃতসংঙ্কল্প হইয়াছিল, তখনও তিনি এই শক্তির প্রভাবে
একটি সামুদ্রিক তৃণ ও কএকটি পক্ষী দেখাইয়া কহিয়াছিলেন ভূমি
অধিক দূর নহে| কলম্বসের নামের উল্লেখ করাতে একটি গল্প মনে
পড়িল, তাহা সংক্ষেপে বর্ণন না করিয়া ক্ষান্ত হইতে পারি না|
কলম্বসের বিদ্বেষিরা বলিয়া ফিরিতেন, আমেরিকা আবিষ্কারের তাঁহার
অধিক গুণপনা কি প্রকাশ পাইয়াছে? উহা অনেকেই পারিত, অথচ পূর্ব্বে
অনেকেই কলম্বসের কথাকে উন্মাদের প্রলাপ বলিয়া অগ্রাহ্য করিযাছিলেন|
একদা কোন স্থানে কলম্বসের কএক জন দ্বেষ্টা একত্রিত হইয়া ঐরূপ
বিদ্রুপ করিতেছেন, তখন কলম্বস একটি অণ্ড সোজাভাবে বসাইয়া তাঁহাদিগকে
কহিলেন 'আপনারা এক আঘাতে এটি ভগ্ন করুন' সকলেই অকৃতকার্য্য
হইলেন; তখন কলম্বস অণ্ডটিকে ঈষৎ হেলাইয়া বসাইয়া অল্প আঘাতেই
ভগ্ন করিলেন| তখন সকলেই হাসিয়া করতালি দিয়া উঠিলেন 'ওরূপ করিলে
আমরাও পারিতাম' তখন কলম্বস গর্ব্বিতভাবে উত্তর করিলেন 'মহাশয়গণ,
হাসা ও করতালি প্রদান করা সহজ বটে; কিন্তু এই বুদ্ধিটুকু পূর্ব্বে
আপনাদের কাহারও ঘটে আসে নাই'| তখন সকলেই লজ্জায় মস্তক অবনত
করিলেন| আবিসিনিয়ার যুবরাজ স্বাধীন পশু পক্ষীর সহিত স্বীয়
অবস্থার তুলনা করিয়া দুঃখিত হৃদয়ে বসিয়া আছেন| 'সুখনিকেতন'
হইতে প্রস্থান করিতে এতদিন কোন যত্নই করেন নাই, এই ভাবিয়া
আপনাকে ধিক্কার দিতেছেন; এমন সময়ে একটি দাসী একটা কাচপাত্র
ভাঙ্গিয়া দুঃখ করিতেছিল, সহসা বলিয়া উঠিল, 'যাহা গিয়াছে তাহা
যখন আর পাওয়া যাইবে না, তখন গতানুশোচনায় ফল কি?' যুবরাজ চমকিয়া
উঠিয়া কহিলেন, 'আমি কি অন্ধ! এই সহজ সত্যটুকু আমি অগ্রে বুঝিতে
পারি নাই!' আর একটি গল্প আছে| কোন সময়ে এক জন প্রবলপ্রতাপ
নৃপতি কোন দূর দেশ জয় করিবার জন্য সমরসজ্জ্বা করিতেছিলেন,
তদ্দৃষ্টে তদীয় একজন বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন 'এদেশ জয় হইলে
কি করিবেন?' রাজা বলিলেন 'আর এক দেশ জয় করিব|' বন্ধু 'সেটি
অধিকৃত হইলে?' রাজা 'অপর একদেশ|' বন্ধু 'তার পর ?' রাজা 'এইরূপে
ভূমণ্ডল অধিকার করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে জীবন অতিবাহিত করিব|'
বন্ধু কহিলেন 'এখনই যদি ভাবেন যে, ভূমণ্ডল অধিকৃত হইয়াছে,
তবে ত অর্থনাশ, শারীরিক কষ্ট, মানসিক ক্লেশ ও অনিশ্চিত জয়পরাজয়ের
চিন্তা ভোগিতে হয় না| সুতরাং সুখে কাল কাটাইতে পারেন|' রাজা
চমৎকৃত হইয়া কহিলেন, 'এই সূক্ষ্ম দর্শনটি আমার এত দিন হয় নাই|
আমি যথার্থই অন্ধ|' ফলতঃ রাসেলাস ও এই নৃপতির ন্যায় আমরা সকলেই
অন্ধ! অবেক্ষণশক্তির অপরিচালনাই এই অন্ধতার মূল|
কতিপয় বৎসর অতীত হইল জেনার নামে একজন অতি
সামান্য ডাক্তার সাড্বারি নামক স্থানে চিকিৎসা করিতেন| উদ্ভিদ্বিদ্যা
বিষয়ে বহু গবেষণাদ্বারা ত্দীয় অবেক্ষণশক্তি ইতিপূর্ব্বেই বিলক্ষণ
উন্নত হইয়াছিল| তখন ইংলণ্ডে বসন্ত রোগের এমন প্রাদুর্ভাব হইয়া
উঠিয়াছিল যে, প্রতি দিন বহুলোক এই রোগে আক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ
করিত| এমন কি অনেক পরিবার সমূলে ধ্বংশ প্রাপ্ত হইয়াছিল| একদা
ডর্সেটসায়র-বাসিনী এক জন গোপিনী জেনারের নিকট কোন রোগ দেখাইতে
আসিলে, জেনার তাহাকে বলিলেন সাবধান বসন্ত রোগে যেন আক্রান্ত
না হও| তাহাতে উক্ত গোপিনী কহিল, কিছু দিন হইল আমার 'গোবসন্ত'
হইয়া গিয়াছে, সুতরাং বসন্তে আমার ভয় নাই| এরূপ কথা অনেক চিকিৎসকই
ইত্যগ্রে শুনিয়াছিলেন, কিন্তু কেহই গ্রাহ্য করেন নাই| জেনার
গোপিনী প্রমুখাৎ এই কথা শুনিবামাত্র স্মরণ-পুস্তকে লিখিয়া লইলেন,
এবং ক্রমাগত অনুসন্ধান করিয়া ণির্ণয় করিলেন যে, গোবীজ শরীরে
প্রবিষ্ট হইলে বসন্ত রোগের প্রায়ই ভয় থাকে না| সেই হইতে গোমসূর্য্যাধানের
প্রচলন হইয়া কত লোকেরই প্রাণরক্ষা হইয়াছে| এবং অবেক্ষণ গুণে
জেনারের নামও লোকহিতৈষি বলিয়া চিরস্মরণীয় থাকিবে| আর প্রস্তাব
দীর্ঘ করিবার প্রয়োজন নাই| উপসংহার কালে এইমাত্র বলিলেই পর্য্যাপ্ত
হইবে যে, পণ্ডিত ও মূর্খে যে প্রভেদ, তাহার কারণ একজন অবেক্ষণবিশিষ্ট,
অপর জন তাহা নহে|
শ্রীজ-
( 'বান্ধব' পত্রিকা, ফাল্গুন-চৈত্র,
১২৮৩ বঙ্গাব্দ )|
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|