পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
[
লেখক পরিচিতি : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৬ষ্ঠ সন্তান ও
জ্যেষ্ঠ্যা কন্যা সৌদামিনী দেবী ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ
করেন। তার স্বামীর নাম ছিল সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। ১৮৫১
সালে ⤗হিন্দু ফিমেল স্কুল⤘-এ ভর্তি হন। তাকে দেখে অনেক বাঙালী
মেয়ে স্কুলে পড়তে আসে। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। সৌদামিনীর
ধবধবে ফর্সা গায়ের রং দেখে পুলিশ এসে ধরেছিল চুরি করে নিয়ে
আসা ইংরেজ মেয়ে ভেবে। তাদের পুত্র সত্যপ্রসাদ ও কন্যা ইরাবতী।
দেবেন্দ্রনাথের অনুজ গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া দেবীর
সঙ্গে সৌদামিনীর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্য। একটি পারিবারিক
কারণে যোগমায়া পৃথক স্থানে বাস করতে শুরু করলে কাকীমার অভাবে
সৌদামিনী মনে খুব দুঃখ পান। তিনিই ছিলেন তার সুখ দুঃখের সঙ্গী।
স্ত্রী শিক্ষাপ্রসারের জন্যও সৌদামিনী অনেক কাজ করেছেন। প্রথাগত
শিক্ষা তার খুব বেশী দূর হয় নি। আদর্শ গৃহিনী হিসাবেই তাকে
স্বামী পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে কাটাতে হয়। সৌদামিনীর ছোট বোনদের
মধ্যে সুকুমারী অল্প বয়সেই লোকান্তরিত হন। সৌদামিনী-সুকুমারীর
বোন স্বর্ণকুমারী একজন সার্থক লেখিকা। এই ⤗পিতৃস্মৃতি⤘ই সৌদামিনীর
একমাত্র রচনা ; তিনি দুই একটি ব্রহ্মসঙ্গীতও রচনা করেছিলেন।
অবশ্য বর্তমান নিবন্ধটির অনুলিখনের কাজ করেছেন রমা দেবী। সুযোগ
পেলে সৌদামিনী হয় ত আরাও অনেক কিছু করে যেতে পারতেন। ১৯২০
খ্রীষ্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন। ]দীপক
সেনগুপ্ত।
পিতা শিলাইদহ জমিদারিতে
পদ্মানদীতে তাঁহার তিন চারিটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে গেলেন।
সেখানে থাকিতেই তিনি সঙ্কল্প করিলেন , দূরে কোথাও নির্জ্জনে
গিয়া ঈশ্বর সাধন করিবেন। সেখান হইতেই ছেলেদের বাড়ি পাঠাইয়া
তিনি সিমলায় চলিয়া গেলেন। ইহাদিগকে বাড়ি পাঠাইবার সময় তাঁহার
চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তখনো সোম, রবি ও তাঁহার কণিষ্ঠা
কন্যা জন্মগ্রহণ করে নাই। পিতা মনে করিয়াছিলেন, হয় ত তাঁহার
বাড়ি ফেরা আর ঘটিয়া উঠিবে না।
তিনি সিমলায়
যাইবার দিনকয়েক পরেই সিপাই বিদ্রোহ আরম্ভ হইল। অনেকদিন তাঁহার
চিঠিপত্র পাওয়া গেল না। একটা গুজব উঠিল সিপাহীরা তাঁহাকে হত্যা
করিয়াছে। একে অনেকদিন চিঠিপত্র লেখেন নাই, তাহার উপর এই গুজব,
- বাড়ির সকলে ভাবনায় অভিভূত হইল। মা ত আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া
কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন। সে এক ভয়ানক দিন গিয়াছে।
কিছুদিন
পরে তাঁহার চিঠি পাওয়া গেল, তখন সকলে সুস্থ হইলেন। এদিকে তাঁহার
সিমলা থাকার সময়েই পুণ্যেন্দ্র বলিয়া আমার একটি ভাইয়ের মৃত্যু
হইল। পিতার কাছে শুনিয়াছি, পুণ্যেন্দ্র মারা যাইবার সংবাদ তিনি
পান নাই কিন্তু একদিন সেই প্রবাসেই তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন
পুণ্যেন্দ্র কোন কথা না কহিয়া তাঁহার কাছে আসিয়া দঁড়াইল। তাহা
রাত্রি স্বপ্ন নহে; দিনের বেলা জাগ্রত্ অবস্থায় তিনি তাহাকে
দেখিয়াছিলেন। তিনি সেই সিমলাতে থাকিতেই ছোট কাকার মৃত্যু হইয়াছিল
- তখনো তিনি তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিলেন, সে কথা তাঁহার মুখে শুনিয়াছি।
রবির জন্মের
পর হইতে আমাদের পরিবারে জাতকর্ম্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সকল অনুষ্ঠান
অপৌত্তলিক প্রণালীতে সম্পন্ন হইয়াছে। পূর্বে যে সকল ভট্টাচার্য্যেরা
পৌরাহিত্য প্রভৃতি কার্য্যে নিযুক্ত ছিল রবির জাতকর্ম্ম উপলক্ষ্যে
তাহাদের সহিত পিতার অনেক তর্কবিতর্ক হইয়াছিল, আমার অল্প অল্প
মনে পড়ে। রবির অন্নপ্রাশনের যে পিঁড়ার উপরে আলপনার সঙ্গে তাহার
নাম লেখা হইয়াছিল সেই পিঁড়ির চারিধারে পিতার আদেশে ছোট ছোট গর্ত্ত
করানো হয়। সেই গর্ত্তের মধ্যে সারি সারি মোমবাতি বসাইয়া তিনি
আমাদের তাহা জ্বালিয়া দিতে বলিলেন। নামকরণের দিন তাহার নামের
চারিদিকে বাতি জ্বলিতে লাগিল - রবির নামের উপর মহাত্মার আশীর্ব্বাদ
এইরূপেই ব্যক্ত হইয়াছিল।
মা আমার
সতীসাধ্বী পতিপরায়ণা ছিলেন। পিতা সর্ব্বদাই বিদেশে কাটাইতেন
এই কারণে সর্ব্বদাই তিনি চিন্তিত হইয়া থাকিতেন। পূজার সময় কোনোমতেই
পিতা বাড়িতে থাকিতেন না - এই জন্য পূজার উত্সবে যাত্রা গান
আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন - কিন্তু মা
তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না। তখন নির্জ্জন ঘরে তিনি
একলা বসিয়া থাকিতেন। কাকীমারা আসিয়া তাঁহাকে কত সাধ্য সাধনা
করিতেন তিনি বাহির হইতেন না। গ্রহাচার্য্যেরা স্বস্ত্যয়নাদির
দ্বারা পিতার সর্ব্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার
কাছ হইতে যে কত অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।
যে ব্রাহ্মমুহূর্তে
মাতার মৃত্যু হইয়াছিল পিতা তাহার পূর্বদিন সন্ধ্যার সময় হিমালয়
হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। তাহার পূর্ব্বে মা ক্ষণে ক্ষণে
চেতনা হারাইতেছিলেন। পিতা আসিয়াছেন শুনিয়া বলিলেন, "বসা্তে
চৌকি দাও।" পিতা সম্মুখে আসিয়া বসিলেন। মা বলিলেন, "আমি
তবে চল্লেম।" আর কিছুই বলিতে পারিলেন না। আমাদের মনে হইল,
স্বামীর নিকট হইতে বিদায় লইবার জন্য এপর্য্যন্ত তিনি আপনাকে
বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন। মার মৃত্যুর পর মৃতদেহ শ্মশানে লইয়া যাইবার
সময় পিতা দাঁড়াইয়া থাকিয়া ফুল চন্দন অভ্র দিয়া শয্যা সাজাইয়া
দিয়া বলিলেন "ছয় বত্সরের সময় এনেছিলেম, আজ বিদায় দিলেম।"
আমার ছেলেবেলায়
আমাদের বাড়িতে যে পূজার উত্সব ছিল তাহার মধ্যে সাত্ত্বিকভাব
কিছুই দেখা যাইত না। এই পূজা-অনুষ্ঠান আমোদ উন্মত্ত হইবার একটা
উপলক্ষ্যমাত্র ছিল। আমরা ছোটবেলায় শিব পূজা ইতু পূজা প্রভৃতি
যাহা দেখিতাম তাহারই অনুকরণ করিতাম। দুর্গোত্সবের সময় প্রতিমার
নিকট অঞ্জলি দিয়া তবে জলগ্রহণ করিতে পাইতাম। আমার ঘরে কৃষ্ণের
ছবি ছিল আমি গোপনে ফুল জল লইয়া ভক্তির সহিত সেই ছবির পূজা করিতাম।
একবার
পিতা যখন সিমলা পাহাড় হইতে হঠাত্ বাড়ি ফিরিলেন, তখন বাড়িতে
জগদ্ধাত্রী পূজা। সেদিন বিসর্জ্জন। তিনি বাড়িতে প্রবেশ না করিয়া
ব্রাহ্মসমাজে গিয়া বসিয়া রহিলেন - বাড়ির সকলেই ব্যস্ত হইযা উঠিলেন;
কোনোপ্রকারে ঠাকুর বিসর্জ্জন দেওয়া হইলে তিনি ঘরে আসিলেন। তাহার
পর হইতে আমাদের বাড়িতে প্রতিমা পূজা উঠিয়া যাইতে লাগিল। একদিন
প্রাতঃকালে সত্যকে কোলে করিয়া লইয়া বসিয়া আছি; - এমন সময় সেজদাদা
একটি ছোট ছাপানো কাগজ আমার হাতে দিয়া বলিলেন, এই কবিতাটি মুখস্থ
করিয়া লইয়া ঈশ্বরকে স্মরণ করিবে। সে কবিতাটি বোধ করি সকলেই জানেন
-
একে একে দিবারাত করিতেছে গতায়াত
তাঁহার শাসনে চলে সকল সংসার হে।
সেজদাদা, মেজকাকীমা ও তাঁর মেয়েদের ব্রাহ্মধর্ম্ম সম্বন্ধে বুঝাইয়া
বলিতেন। মেজকাকীমা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনিতেন কিন্তু তাঁহার
মেয়েরা তাহাতে কান দিতেন না। অবশেষে তাঁহার শালগ্রাম শিলাটিকে
লইয়া আমাদের সম্মুখের বাড়িতে উঠিয়া গেলেন - আমরা একলা পড়িলাম।
আমার মা বহুসন্তানবতী ছিলেন এই জন্য তিনি আমাদের সকলকে তেমন
করিয়া দেখিতে পারিতেন না - মেজকাকীমার ঘরেই আমাদের সকলের আশ্রয়
ছিল। তিনি আমাদের বড় ভালবাসিতেন, তাঁহার পরেই আমাদের যত আবদার
ছিল। তিনি যেদিন ভোরের বেলা গঙ্গাস্নান করিতে যাইতেন আমাকে তাঁহার
সঙ্গে লইতেন। তিনি অল্প কালের জন্যও দূরে গেলে আমাদের বড় কষ্ট
বোধ হইত।
এক সময়
ছিল যখন আমাদের বাড়ি আত্মীয়স্বজনে পূর্ণ ছিল। অবশেষে একদিন দেখিলাম
প্রায় সকল আত্মীয়ই আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া গেলেন। পিতামহ তাঁহার
উইলে যাঁহাদিগকে কিছু কিছু দান করিয়া গিয়াছিলেন দেখিলাম তাঁহারা
আদালতে মোকদ্দমা করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ফেল
করাতে আমাদের বৈষয়িক দুর্গতির দিন উপস্থিত হইয়াছিল - তথাপি উইল
অনুসারে যাহার যাহা প্রাপ্য ছিল তাহা পরিশোধ করিয়া দিয়া পিতৃদেব
নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। তাঁহার উপর এত যে অত্যাচার গিয়াছে তিনি
ধীরভাবে সমস্ত বহন করিয়াছেন, কখনও ন্যায়পথ হইতে ভ্রষ্ট হন নাই।
যাহারা তাঁহার প্রতি অত্যন্ত অনাত্মীয় ব্যবহার করিয়াছে দৈন্যদশায়
পড়িয়া যখনি তাহারা তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছে তখনি তিনি তাহাদের
চির জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন।
আমাদের
বাল্যকালে মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চ্চা বড় একটা ছিল না। বৈষ্ণব
মেয়েরা কেহ কেহ বাংলা, এমন কি, সংস্কৃত শিক্ষা করিত - তাহাদেরই
নিকট অল্প একটু শিখিয়া রামায়ণ মহাভারত এবং সেকেলে দুই একখানা
গল্পের বই পড়িতে পারিলেই তখন যথেষ্ট মনে করা হইত। আমাদের মা
কাকীমারাও সেইরূপ শিক্ষাই পাইয়াছিলেন।
আমাদেরও
প্রথম শিক্ষা একজন বৈষ্ণবীর নিকট হইতে। তাহার কাছে শিশুপাঠ পড়িতাম,
এবং কলাপাতে চিঠি লেখা অভ্যাস করিতাম। ক্রমে তাহার কাছে রামায়ণ
পড়া পর্যন্ত আমাদের অগ্রসর হইয়াছিল। এমন সময় পিতৃদেব সিমলাপাহাড়
হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমাদের শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে মন দিলেন।
কেশববাবুদের অন্তঃপুরে মিশনরি মেয়েরা পড়াইতে আসিত। আমাদের শিক্ষার
জন্য পিতা তাহাদিগকে নিযুক্ত করিলেন। বাঙালী খৃষ্টান শিক্ষয়িত্রী
প্রতিদিন আমাদিগকে পড়াইতেন এবং হপ্তায় একদিন মেম আসিয়া আমাদিগকে
বাইবল পড়াইয়া যাইতেন। মাস কয়েক এইভাবে চলিয়াছিল। অবশেষে একবার
পিতৃদেব, আমাদের পড়া শুনা কেমনতর চলিতেছে দেখিতে আসিলেন। একখানা
স্লেটে শিক্ষয়িত্রী আমাদের পাঠ লিখিয়া দিয়া গিয়াছিলেন - তাহারই
অনুসরণ করিয়া কপি করিবার জন্য আমাদের প্রতি ভার ছিল। স্লেটে
লিখিত সেই পাঠের বানান ও ভাষা দেখিয়া পিতা আমাদের এই নিয়মের
শিক্ষা বন্ধ করিয়া দিলেন।
কলিকাতায়
মেয়েদের জন্য যখন বেথুন স্কুল প্রথম স্থাপিত হয় তখন ছাত্রী পাওয়া
কঠিন হইল। তখন পিতৃদেব আমাকে এবং আমার খুড়তুত ভগিনীকে সেখানে
পাঠাইয়া দেন। এইরূপে অতি অল্প কয়েকটি মাত্র ছাত্রী লইয়া বেথুন
স্কুলের কাজ আরম্ভ হয়।
মেয়েদের
কেবল লেখাপড়া শেখানো নয় শিল্প শেখানোর প্রতিও তাঁহার বিশেষ অনুরাগ
ছিল। আমাদের পরিবারে যখন বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠান হইতে পৌত্তোলিক
অংশ উঠিয়া গেল তখনো জামাইবরণ স্ত্রীআচার প্রভৃতি বিবাহের আনুষঙ্গিক
প্রথাগুলিকে পিতা রক্ষা করিয়াছিলেন। সেই সকল উপলক্ষ্যে পিঁড়াতে
আলা্পনা দিবার ভার আমাদের উপর ছিল ভাল করিয়া ফুল কাটিয়া আলা্পনা
দিতে না পারিলে তিনি কিছুতেই পছন্দ করিতেন না। কোথাও নিমন্ত্রণে
যাইতে হইলে আমার ছোট বোনদের চুল বাঁধার ভার আমার উপর ছিল। কেমন
চুল বাঁধা হইল এক একদিন তিনি তাহা নিজে দেখিতেন। তাঁহার পছন্দমত
না হইলে পুনর্ব্বার খুলিয়া ভাল করিয়া বাঁধিতে হইত।
মানসিক
বিষয়ে পিতৃদেবের যেমন একটি সূক্ষতা ছিল ইন্দ্রিয়বোধ সম্বন্ধেও
সেইরূপ দেখা যাইত। কোনো প্রকার শ্রীহীনতা তিনি সহ্য করিতে পারিতেন
না। সঙ্গীত বিশেষরূপ ভাল না হইলে তিনি শুনিতে ভাল বাসিতেন না।
প্রতিভার পিয়ানো বাজান এবং রবির গান শুনিতে তিনি ভাল বাসিতেন।
বলিতেন রবি আমাদের বাঙ্গালা দেশের বুলা্বুল্। মন্দগন্ধ তাঁহার
কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল - সুগন্ধ দ্রব্য সর্ব্বদা তাঁহার
কাছে থাকিত। ফুল তিনি বড় ভাল বাসিতেন। পার্কষ্ট্রীটে যখন তাঁহার
কাছে ছিলাম তখন প্রত্যহ তাঁহাকে একটি তোড়া বাঁধিয়া দিতাম। মাঝে
মাঝে তাহাই ঘ্রাণ করিতে করিতে তিনি হাফেজের কবিতা আবৃত্তি করিতেন,
বলিতেন, ফুলের গন্ধে আমি তাঁহারি গন্ধ পাই। একদিন এইরূপে যখন
হাফেজের কাব্যরসে তিনি মগ্ন ছিলেন আমাকে বলিলেন কাগজ পেন্সিল
লইয়া এস। আমি তাহা লইয়া গেলে তিনি হাফেজের কবিতা তর্জ্জমা করিয়া
বলিতে লাগিলেন আমি তাহা লিখিয়া লইলাম। সেগুলি তত্ত্ববোধিনীতে
ছাপা হইয়াছিল। সুন্দর পরিপাটি করিয়া কোন কাজ নিষ্পন্ন না হইলে
তিনি কোনোদিন খুশি হইতেন না। আমাদের রন্ধন শিক্ষার জন্য তিনি
নিয়ম করিয়া দিয়াছিলেন, প্রতিদিন একটি করিয়া তরকারি রাঁধিতে হইবে।
রোজ একটা করিয়া টাকা পাইতাম, সেই টাকায় মাছ তরকারী কিনিয়া আমাদিগক্কে
রাঁধিতে হইত। আমাদের কোনো এক সম্পর্কের দিদিমা ভাল রাঁধিতে পারিতেন,
তিনিই আমাদের শিক্ষক ছিলেন।
বাড়ির
মধ্যে আমাদের প্রাত্যহিক উপাসনার একটি ঘর ছিল। পিতার আদেশ অনুসারে
আমরা সাফ কাপড় পরিয়া সেই ঘর প্রতিদিন ঝাড়িয়া মুছিয়া পরিষ্কার
করিতাম। মহোত্সবের দিন সেই ঘর ফুল পাতা দিয়া সাজাইতে হইত।
আমরা পরামানন্দে সমস্ত রাত জাগিয়া ঘর সাজাইতাম। পিতা সকালে আসিয়া
প্রথমে আমাদিগকে লইয়া সেই ঘরে উপাসনা করিয়া পরে ব্রাহ্মসমাজে
যাইতেন। সেই উপাসনার ঘরে তিনি প্রতিদিন উপাসনা করিয়া আমাদিগকে
ব্রাহ্মধর্ম্ম পড়াইতেন; - কোনো কোনো দিন আমাদিগকে লইয়া গ্রহ-নক্ষত্রের
বিষয় আলোচনা করিতেন। এইরূপে যে সকল উপদেশ দিতেন আমাদিগকে তাহা
লিখিতে হইত। লেখা ভাল হইলে তাহার পাশে তিনি উত্সাহবাক্য লিখিয়া
দিতেন। তাঁহার শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে বলপ্রয়োগের কোনো স্থান ছিল
না; তিনি যাহা আদেশ করিতেন আমরা তাহাই সন্তুষ্টচিত্তে পালন করিতাম
- তাঁহার আদেশ আমাদের পক্ষে দেববাক্য ছিল।
বাহিরের
দালানে যেদিন লোকসমাগম হইত, উপাসনাসভা বসিত, মেজদাদা নিজে গান
রচনা করিয়া একটি ছোট হার্ম্মোনিয়ম লইয়া মনের সঙ্গে যখন সেই গান
গাহিতেন তখন সকলেই মুগ্ধ হইত, এবং আমাদের যে কি ভাল লাগিত তাহা
বলিতে পারি না। ধর্ম্মের উত্সাহে মেজদাদা প্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন।
স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধেও তাঁহার বিশেষ আগ্রহ ছিল। স্ত্রীস্বাধীনতা
বলিয়া একটি চটি বই তাঁহর অল্প বয়সেই তিনি লিখিয়াছিলেন। তখন মেয়েদের
বাহিরে কোথাও যাইতে হইলে ঢাকা দেওয়া পাল্কীতে যাওয়াই রীতি ছিল
- মেয়েদের পক্ষে গাড়ি চড়া বিশেষ লজ্জার কথা বলিয়াই গণ্য হইত।
একখানি পাতলা শাড়ি মাত্রই তখন মেয়েদের পরিধেয় ছিল। আমাদের বাড়িতে
মেজদাদাই এ সমস্ত উল্টাইয়া দিলেন। আমরা যখন শেমিজ জামা জুতা
মোজা পরিয়া গাড়ি চড়িয়া বাহির হইতে লাগিলাম তখন চারিদিক হইতে
যে কিরূপ ধিক্কার উঠিয়াছিল তাহা এখনকার দিনে কল্পনা করা সহজ
নহে। পিতৃদেব নিষেধ করিলে তাহা লঙ্ঘন করা আমাদের অসাধ্য হইত,
কিন্তু তিনি ইহাতে কোনো বাধা দেন নাই। তিনি যখন দেখিতেন ছেলেমেয়েরা
কোনো মন্দের দিকে যাইতেছে না তখন কোনো আচারের পরিবর্ত্তন সম্বন্ধে
তিনি নিষেধ করিতেন না।
আমার পিতার
পিসা্ততভাই চন্দ্রবাবু আমাদের সম্মুখের বাড়িতেই বাস করিতেন।
একদিন তিনি আসিয়া পিতাকে বলিলেন, - " দেখ, দেবেন্দ্র, তোমার
বাড়ির মেয়েরা বাহিরের খোলা ছাদে বেড়ায়, আমরা দেখিতে পাই; আমাদের
লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দেও না কেন ?" পিতা বলিলেন,
' কালের পরিবর্ত্তন হইয়াছে। নবাবের আমলে যে নিয়ম খাটিত এখন আর
সে নিয়ম খাটিবে না। আমি আর কিসের বাধা দিব, যাঁহার রাজ্য তিনিই
সমস্ত ঠিক করিয়া লইবেন।' ছোট মেয়েরা ভাল করিয়া কাপড় সামলাইতে
পারিত না তাই তাহাদের শাড়ি পরা তিনি পছন্দ করিতেন না। বাড়িতে
দর্জ্জি ছিল - পিতা নিজের কল্পনা হইতে নানা প্রকার পোষাক তৈরি
করিবার চেষ্টা করিতেন। অবশেষে আমাদের পোষাক অনেকটা পেষোয়াজের
ধরণের হইয়া উঠিয়াছিল। আমার সেজ এবং ন বোন অধিক বয়স পর্য্যন্ত
অবিবাহিত ছিল বলিয়া আত্মীয়েরা চারিদিক হইতেই মাকে এবং পিতাকে
তাড়না করিতেন। মা বিচলিত হইয়া উঠিতেন কিন্তু পিতা কাহারও কোনো
কথা কানেই লইতেন না। ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণে একত্রে আহারের প্রথা
পিতার সম্মতিতে আমাদের বাড়িতেই আরম্ভ হয় কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ
সম্বন্ধে শেষ পর্যন্তই তাঁহার আপত্তি দূর হয় নাই। ব্রাহ্মণদের
ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিবাহে তাঁহার উত্সাহ ছিল।
একদিকে
প্রাচীন প্রথার সংস্কার ও আর একদিকে তাহার রক্ষণ এই দুই তাঁহার
চরিত্রে দৃঢ় ছিল। এইজন্য সমাজের আচার সম্বন্ধে তিনি যে কোনো
পরিবর্ত্তন তাঁহার পরিবারে প্রবর্ত্তিত করিয়াছেন সমাজের প্রতি
নির্ম্মমতাবশতঃ তাহা করেন নাই। দেশের সমাজকে তিনি আপনার জিনিস
বলিয়াই জানিতেন। সামাজিক প্রথার মধ্যে যেখানে যতটুকু সৌন্দর্য্য
আছে তাহার প্রতি তাঁহার মমতা ছিল। এইজন্য জামাই-ষষ্ঠী ভাই-ফোঁটা
প্রভৃতি লৌকিক প্রথা আমাদের বাড়িতে বরাবর চলিয়া আসিয়াছে। অনেকে
এ সম্বন্ধে আপত্তি করিয়াছিলেন, তিনি শোনেন নাই। আমি যখন তাঁহাকে
খবর দিতাম, আজ ভাই-ফোঁটা, তিনি শুনিয়া হাসিতেন, বলিতেন, "
তুমি ফোঁটা দিয়াছ - আমরা যমরাজার দুয়ারে কাঁটা দিতে যাই না,
যিনি যমরাজের রাজা তাঁহার কাছে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করি। "
একটি কথা
আমাদের মনে রাখিতে হইবে; - এখনকার দিন অত্যন্ত দুর্ব্বল লোকও
যে পথে অনয়াসে চলিতে পারে তখনকার কালের বিশেষ শক্তিমান লোকের
পক্ষেও তাহা দুর্গম ছিল। তা ছাড়া এ কথাও মনে রাখা চাই একবার
পথ বাহির হইলে সে পথে চলা তেমন কঠিন নহে কিন্তু পথ দেখানই শক্ত।
সামাজিক উন্নতির পথে এখনকার কালের দ্রুতগামীরা পিতৃদেবের মৃদুগতিকে
মনে মনে নিন্দা করিয়া থাকেন। তাঁহার ভুলিয়া যান তখন যে রাস্তা
ছিল তাহা পায়ে হাঁটার মত, প্রত্যেক পদক্ষেপেই নিজের শক্তির প্রয়োগ
করিতে হইত, এখন সেখানেই অবাধে গাড়ি চলিতেছে, তাই বলিয়া রথারোহীরা
যে পদাতিকের চেয়ে অধিক শক্তিশালী এমন কথা যেন তাঁহারা কল্পনা
না করেন - এবং এ কথাও বোধ হয় চিন্তা করিবার যোগ্য যে তখনকার
রাস্তায় অন্ধবেগে গাড়ি হাঁকাইলে আরোহীদের পক্ষে তাহা কল্যাণকর
না হইতে পারিত।
একদিন
কেশববাবু যখন ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া পিতার সঙ্গে যোগদান
করিলেন তখন চারিদিকে ধর্ম্মোত্সাহ যে কিরূপ জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছিল
তাহা মনে পড়ে। পিতা তাঁহাকে ব্রহ্মানন্দজী বলিয়া ডাকিতেন এবং
পুত্রের অধিক স্নেহ করিতেন। বুধবারে সমাজের উপাসনার পর ফিরিয়া
আসিয়া আমাদের বাড়ির দালানে যখন সকলে মিলিয়া গান ধরিতেন
" সবে মিলে মিলে গাওরে -
তাঁর পবিত্র নাম লয়ে জীবন কর সফল,
কেহ থেকোনা নীরব " -
তখন কি উত্সাহের আনন্দে আমাদের মন উদ্বোধিত হইয়া উঠিত। সমাজবাড়ি
মেরামত হওয়ার উপলক্ষ্যে আমাদের বাড়ির দালানে রাত্রিতে উপাসনাসভা
বসিত - তখন আমরা ছেলেমানুষ - কিন্তু উপদেশে গানে বক্তৃতায় ঈশ্বরের
প্রেমরসে মানুষের মন যে কেমন করিয়া অভিষিক্ত হইত তাহা আজও ভুলিতে
পারি নাই।
একবার
মাঘোত্সবের আগের দিনে মামা আসিয়া আমাকে বলিয়া গেলেন - "
কর্ত্তা বলিয়া দিলেন, কাল কেশববাবুর স্ত্রী ও আর দুই জন মেয়ে
আসিবেন - তোমরা তাঁহাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া খাওয়ানো ও দেখাশোনা
করিবে - কোনো ত্রুটি না হয়।" তাহার পরদিন কেশববাবু প্রতাপবাবু
ও অক্ষয় মজুমদার মহাশয়ের স্ত্রী আমাদের বাড়িতে আসিলেন।
কেশববাবুর
স্ত্রী তিন চার মাস আমাদের কাছে ছিলেন। তখন আত্মীয় স্বজনেরা
আমাদিগকে ত্যাগ করিয়াছেন, কেহ আমাদের বাড়িতে আসিতেন না। সেই
সময়ে কেশববাবুর স্ত্রীকে আমাদের আত্মীয়রূপে পাইয়া আমরা বড় আনন্দে
ছিলাম। প্রথমটা তাঁহার মন বিমর্ষ ছিল - বিশেষত তাঁর একটি ছোট
ভাইয়ের জন্য তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হইত। সেই সময়ে সোম, রবি ও সত্য
শিশু ছিল - তাহাদিগকেই তিনি সর্ব্বদা কোলে করিয়া থাকিতেন - বলিতেন,
রবিকে তাঁহার সেই ছোট ভাইটির মত মনে হয়। সত্য তাঁহাকে মাসী বলিতে
পারিত না, "মাচি" বলিত, তাহাতে তিনি আমোদ বোধ করিতেন।
তাঁহাকে আমাদের ভগিনীর মতই মনে হইত; তিনি যাইবার সময় আমরা বড়ই
বেদনা পাইয়াছিলাম।
আমরা যখন কিছুদিন নৈনানের বাগানে ছিলাম তখন সেখানে কেশববাবুর
বড়ছেলে করুণার অন্নপ্রাশন হইয়াছিল। তখনকার সমস্ত ব্রাহ্মণদিগকে
নিমন্ত্রণ করিয়া বিশেষ সমারোহে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। দশ পনেরো
দিন আগে হইতে আমরা পিঁড়িতে আলপনা দিতে নিযুক্ত ছিলাম। এই কাজে
আমরা প্রশংসা পাইয়াছিলাম।
চুঁচুড়ার
বাড়িতে পিতার যখন কঠিন পীড়া হয় তখন আমি আর আমার ন বোন স্বর্ণ
তাঁহার সেবার জন্য গিয়াছিলাম। কিন্তু পাছে আমাদের কোনো অসুবিধা
হয়, সেজন্য তিনি অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন। সেই অবস্থাতেই
আমাদের শোবার খাবার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া তবে তিনি নিশ্চিন্ত
হইলেন। তাঁহার কাছে থাকিয়া কেহ কোনো অসুবিধা ভোগ করিবে ইহা তিনি
সহ্য করিতে পারিতেন না, - এমন কিন ভৃত্যদেরও কোনো অসুবিধা তাঁহার
ভাল লাগিত না।
চুঁচুড়ায়
থাকিতে একদিন তাঁহার জ্বর প্রবল হইয়া উঠিল, বিকাল হইতে জ্ঞানশূণ্য
হইয়া রহিলেন। ইংরাজ ডাক্তার আসিয়া বলিল, এই জ্বর ত্যাগের সময়
বিপদের আশঙ্কা আছে, সেই সময়েই নাড়ি ছাড়িয়া যাইতে পারে - অতএব
সাবধান থাকা আবশ্যক। রাজনারায়ণবাবু সেইরাত্রে আসিয়াছিলেন। ডাক্তার
বেদানার রসে আর্সেনিক মিশাইয়া দিয়াছিলেন; আমি তাহাই কাপড়ে ভিজাইয়া
তাঁহার জিবে দিতেছিলাম এবং ডাক্তার কেবলই নাড়ি পরীক্ষা করিতেছিলেন।
নাড়ি দুর্ব্বল; ভোরের বেলাটাতে ভয়ের কথা। কিন্তু সকালবেলা জ্ঞান
হইবামাত্রই তিনি উঠিয়া বসিয়া শাস্ত্রীকে বলিলেন, রাজনারায়ণবাবু
আসিয়াছেন, তাঁহাকে ডাক। শাস্ত্রী ভয় পাইলেন পাছে এই অবস্থায়
কথা কহিবার চেষ্টা করিয়া দুর্ব্বলতা বাড়িয়া যায়। রাজনারায়ণবাবু
কাছে আসিয়া বসিলেন। পিতা বলিলেন, " দেখ, আমি ঈশ্বরের আদেশ
পাইলাম যে, এ যাত্রায় তুমি রক্ষা পাইলে; তোমার এখনো কাজ বাকি
আছে; আমার দিকে আরো তুমি অগ্রসর হও।"
সকল কর্ম্মই
তিনি ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া এবং ন্যায় পথে থাকিয়া নির্বাহ
করিয়াছেন। যখন পার্কষ্ট্রীটে তাঁহার কাছে ছিলাম, দেখিলাম সকাল
হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি একই চৌকিতে সমানভাবে বসিয়া ঈশ্বরচিন্তায়
দিন কাটাইয়াছেন - স্নানাহার ছাড়া আর সমস্ত ক্ষণই তাঁহার মন ঈশ্বরে
নিবিষ্ট থাকিত। কোনো দিন যখন কোনো প্রয়োজনীয় কথা বলিতে যাইতাম
তিনি বলিতেন আমি কোথায় ছিলাম, আমাকে কোথায় আনিলে - তখন মনে অনুতাপ
হইত।
বয়সের
শেষভাগে যখন পিতৃদেব পার্কষ্ট্রীট ও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়াছিলেন
তখনি তাঁহার কাছে থাকিয়া তাঁহার সেবা করিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম।
ইহার পূর্ব্বে প্রায়ই তিনি বিদেশে নির্জ্জনাবাসে দিন যাপন করিয়াছেন।
যখন চিঠিতে তাঁহার বাড়ি আসিবার খবর আসিত তখন আমাদের এত আনন্দ
হইত যে, যে লোক সংবাদ দিত তাহাকে পুরস্কার দিতাম। সকাল তিনি
আমাদের সকলকে একত্র করিয়া দালানে উপাসনা করিতেন। উপসনা হইতে
ফিরিয়া আসিবার পূর্বে তিনি একবার আমাদের দেখিয়া লইতেন। বাহিরে
গিয়া মামাকে জিজ্ঞাসা করিতেন অমুককে আজ ভাল দেখিলাম না কেন,
অমুককে যেন বিমর্ষ বোধ হইল। ক্ষণকালের দৃষ্টিতে তিনি আমাদের
মনের অবস্থা বুঝিয়া লইতেন। তাঁহার মতের বিরুদ্ধে কত কাজ করিয়াছি
কিন্তু কখনো তিনি আমাদের কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন নাই। তিনি
যখন মিষ্টস্বরে মা বলিয়া ডাকিতেন তখন সে যে কি মধুর লাগিত তাহা
জীবনে কখনো ভুলিতে পারিব না। তেমন মধুর বাণী আর কাহারো মুখে
ত শুনিতে পাই না। এত বড় বৃহত্ পরিবারকে তিনি তাঁহার স্নেহপূর্ণ
মঙ্গল কামনায় আবৃত রাখিয়াছিলেন, এবং সকল প্রকার সাংসারিক সুখদুঃখ
ও বিরোধ বিপ্লবের মধ্যে অবিচলিত থাকিয়া নীরবে নিয়ত সকলের কল্যাণ
বিধান করিয়াছেন।
(২)
পিতৃদেবের স্মরণশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ছিল। একবার তাঁহার কাছে
শুনিয়াছিলাম শিশু অবস্থায় মা কোলে শুইয়া তিনি ঝিনুকে করিয়া দুধ
খাইতেছেন সে কথাও তাঁর অল্প অল্প মনে পড়ে তাঁহার বাল্যকালের
একটি ঘটনা একদিন তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, - ' তখন আমার বয়স পাঁচ
কি ছয় বত্সর হইবে। ঠাকুরঘরে গিয়া দেখি ঘরে কেহই নাই, সিংহাসনের
উপর শালগ্রাম ঠাকুর। আমি সেই শিলাটিকে আস্তে আস্তে তুলিয়া লইয়া
বাহিরে আসিয়া মাটিতে গড়াইয়া মনের আনন্দে খেলা করিতেছি - ওদিকে
পূজারী ব্রাহ্মণ আসিয়া দেখে যে, সিংহাসনে ঠাকুর নাই। ঠাকুর কে
লইল বলিয়া মহা হুলস্থূল বাধিয়া গেছে; চারিদিকে খোঁজ খোঁজ করিতে
করিতে একজন আসিয়া দেখে যে আমি তাহা লইয়া নিশ্চিন্ত মনে খেলা
করিতেছি। বাড়ির মেয়েরা সব ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, দেবেন্দ্র এ
কি সর্ব্বনাশ - ঠাকুরকে লইয়া খেলা ! কি মহা বিপদই না জানি ঘটিবে
! পুনর্ব্বার অভিষেক করিয়া ঠাকুরকে সিংহাসনে স্থাপিত করা হইল।
তাহার পরে আমার যাহাতে কোনো অনিষ্ট না হয় সেজন্য শান্তিস্বস্ত্যয়নের
ধুম পড়িয়া গেল।"
অল্পবয়সে
পিতা একবার সরস্বতী পূজা করিয়াছিলেন। কি কারণে পিতামহ তখন বাড়িতে
উপস্থিত ছিলেন না। সেই পূজায় পিতা এত প্রচুর অর্থব্যয় করিয়া
সমারোহ করিয়াছিলেন যে সেই পার্ব্বণে শহরের গাঁদাফুল ও সন্দেশ
দুর্লভ হইয়া উঠিয়াছিল। প্রতিমাও এত প্রকাণ্ড হইয়াছিল যে বিসর্জ্জনের
সময় নানা কৌশলে তাহা বাড়ি হইতে বাহির করিতে হয়। শুনিয়াছি পূজার
এরূপ অতিরিক্ত ব্যয় পিতামহের সন্তোষজনক হয় নাই।
পিতামহের
আমলে দুর্গোত্সব যেমন আমাদের বাড়ির সামাজিক আনন্দোত্সব ছিল
এবং এই উত্সব যেমন মহাসমারোহে সম্পন্ন হইত, পিতার ইচ্ছা ছিল
মাঘোত্সবকে তিনি সেইরূপ আমাদের বাড়ির অবারিত আনন্দ সম্মিলনের
মত করিয়া তুলিবেন। যখন তাঁহার হাতে এই উত্সবের ভার ছিল তখন
মাঘমাসের প্রথম দিন হইতেই কাজকর্ম্ম আরম্ভ হইত; - ভৃত্যেরা কাপড়
পাইত পরিবারস্থ আত্মীয়-স্বজনদিগকে কাপড় দেওয়া হইত, কাঙ্গালীবিদায়েরও
বিশেষ আয়োজন হইত। পূর্ব্বে পূজার সময়ে যেরূপ বৃহদাকার মেঠাই
তৈরি হইত এগারই মাঘেরও সেইরূপ মেঠাইয়ের ব্যবস্থা ছিল। সেই বড়
বড় মেঠাইয়ের স্তূপ সকালবেলা হইতে বাহিরের ঘরে টেবিলের উপর সাজানো
থাকিত; যাঁহার যখন ইচ্ছা খাইতেন - কোনো বাধা ছিল না। একবার উত্সবের
দিন ব্রাহ্মসমাজগৃহে প্রাতঃকালের উপাসনা শেষ করিয়া আসিয়া তাঁহার
এক জামাতা এই মিষ্টান্নারাশির সম্মুখে দাঁড়াইয়া ' বাঃ কেয়াবাত্হ্যায়⤘
বলিয়া মনের উচ্ছ্বাস যেমনি প্রবল কণ্ঠে ব্যক্ত করিয়াছেন, অমনি
দেখিলেন সম্মুখে পিতা আসিয়া তাঁহার সেই আনন্দ-আবেগে হাস্য করিতেছেন।
তিনি ত লজ্জায় মাটি হইয়া গেলেন। উত্সবের রাত্রিতেও আহারের
আয়োজন অবারিত ছিল - যে যখনই আসিত আহার করিতে বসিয়া যাইত।
পয়লা বৈশাখে
বর্ষারম্ভের উপাসনার পর আমরা তাঁহাকে প্রণাম করিলে তিনি আমাদের
প্রত্যেককে একটি করিয়া গিনি দিয়া আশীর্ব্বাদ করিতেন। সেদিন দুপুরবেলায়া
বাদামের কুলপির বরফ তৈরি করাইয়া আমাদের জন্য পাঠাইয়া দিতেন,
আমরা তাহা সকলে আনন্দে ভাগ করিয়া খাইতাম। ১লা বৈশাখে প্রথম অরুণোদয়ে
প্রত্যুষের নির্ম্মল স্নিগ্ধতার মধ্যে মধুর গানে ও পিতৃদেবের
হৃদয়গ্রাহী উপদেশে আমাদের সকলের মন আরাধনার ভক্তিরসে একেবারে
পরিপূর্ণ হইয়া উঠিত - আজ মনে হয় যেন সেই এক পবিত্র সত্যযুগ চলিয়া
গিয়াছে।
যখন পিতা
বক্রোটায় ছিলেন, তখন মনে আছে তিনি মাকে একখানি চিঠিতে লিখিয়াছিলেন
- দেখ, ছোটকাকা আমাকে পত্র দিয়াছেন তুমি আর দেশ ছাড়িয়া কতদিন
পাহাড়ে পর্ব্বতে ঘুরিয়া বেড়াইবে - বাড়িতে আসিয়া বড়লোকের ছেলেদের
মত দশ পাঁচটি মোসাহেব রাখিয়া পাঁচজনকে লইয়া আমোদ আল্হাদে দিন
যাপন কর - আত্মীয় বন্ধু ছাড়িয়া তুমি একলাটি কি করিয়া জীবন কাটাইতেছ।
- তাঁহার ছোটকাকা মনেও করিতে পারিতেন না, নিজের মন ভোলাইবার
ও দিন কাটাইবার জন্য তাঁহাকে একমুহূর্তকাল পাঁচজনের মুখাপেক্ষা
করিতে হইত না।
পীড়ার
সময় যখন তাঁহাকে ডাক্তার দেখিতে আসিয়াছিল তখন একদিন তিনি আমাকে
বলিয়াছিলেন, " এ ডাক্তার আমার কি করিবে, আমার যিনি ডাক্তার
তিনি সর্ব্বদা আমার কাছেই থাকেন। আমি যখন একবার কাশীরে পাহাড়-ভ্রমণ
করিতে বাহির হইয়াছিলাম তখন আমার শরীর ভাল ছিল না। আমার প্রবাসের
বন্ধুরা আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়া বলিয়া গেলেন, এখন আপনার
বাহির হওয়া উচিত হইবে না - আগে শরীর সুস্থ হউক তাহার পরে যেমন
ইচ্ছা করিবেন। আমি তাঁহাদের কাহারও বারণ শুনিলাম না। ঝাঁপানে
করিয়া পাহাড়ে উঠিতেছি, কোথায় যাইব এবং কোথায় থাকিব তাহার কোনো
ঠিকানা নাই। চাকরদের বলিয়া দিলাম, তোরা যেখানে পাস একটা কোনো
আশ্রয় ঠিক করিয়া রাখ। তাহারা একটা ভাঙাবাড়ি খালি পাইয়াছিল। সেখানে
একটা খাটিয়া পড়িয়া ছিল তাহারই উপরে তাহারা আমার বিছানা করিয়া
রাখিয়াছিল। সেখানে গিয়া আমি ত শুইয়া পড়িলাম। একে শরীর অসুস্থ,
পথে কিছুই আহার করি নাই, তাহার পরে ঝাঁকানি; ক্লান্তি ও দুর্ব্বলতা
আমাকে যেন একেবারে আবিষ্ট করিয়া ফেলিল। আমি খাটিয়া শুইয়া চোখ
বুজিলাম। আমার মনে হইতে লাগিল আমি যেন কাহার কোলের উপর শুইয়া
আছি - আমার বড়ই আরাম। সকালে উঠিয়া চাকরদের বলিলাম, চেষ্টা করিয়া
দেখা্ যদি কোথাও একটু দুধ পাওয়া যায়। তাহারা দুইজনে ঘটি লইয়া
দুধের সন্ধানে বাহির হইল। কিছুদূর যাইতেই দেখে একটা গাভী আসিতেছে।
সেই গাভীটাকে একজন ধরিল ও আর একজন তাহার দুধ দুইয়া লইল। সেই
দুধটুকু খাইয়া মনে হইল যেন আমার জীবন ফিরিয়া আসিল। তাহার পর
ধীরে ধীরে আমি সারিয়া উঠিলাম এবং শরীরে বল পাইলাম। নিজের ঘরে
গরু পুষিলাম - সেই গরু রোজ দশ সের দুধ দিত। সেই দুধ ও তাহার
ঘি মাখন খাইয়া এবং খুব করিয়া বেড়াইয়া আমি একেবারে সুস্থ হইয়া
উঠিলাম। সেখানে আমার ডাক্তার কবিরাজ কে ছিল। কেবা আমার এই দুধের
পথ্য জোগাইয়া দিল।
পার্কষ্ট্রীটে যেদিন
আমরা সকল ভাইবোনে মিলিয়া পিতার জন্মোত্সব করিতাম সেদিন আমাদের
বড়ই আনন্দের দিন ছিল। সেদিন পরিবারের সকলেই একত্রিত হইতেন।
তিনি মাঝখানে চৌকিতে বসিতেন আমরা সকলে তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া
ঈশ্বরের উপাসনা করিতাম - বড়দাদা সময়োচিত কিছু একটা লিখিয়া
পাঠ করিতেন, রবি গান করিত। তিনি ফুল বড় ভালবাসিতেন বলিয়া সকলেই
তাঁহাকে ফুলের তোড়া ফুলের সাজি আনিয়া উপহার দিত - আমরা ফুল
দিয়া তাঁহার সমস্ত ঘরটি সাজাইয়া দিতাম। ছেলেমেয়ে জামাতা বধূ
দৌহিত্র পৌত্র সকলে মিলিয়া তাঁহার কল্যাণ কামনা করিতেছে এত
বড় মঙ্গলের সাজিভরা আনন্দ-উপহার সুদীর্ঘজীবনের সন্ধ্যাকালে
কয়জন লোকের ভাগ্যে ঘটে। আমাদের সেই আনন্দের দিন আর ফিরিয়া
আসিবে না, সেই পবিত্র সৌম্য মূর্তি আর দেখিতে পাইব না।
সৌদামিনী
দেবী
(
প্রথম ভাগটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ⤗প্রবাসে⤘ পত্রিকার ফাল্গুন
সংখ্যায় এবং দ্বিতীয় ভাগটি চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত )।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।