পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
তপোবন
গিরি
( দেওঘর )
[
লেখক পরিচিতি : সুরমাসুন্দরী ১২৮১ বঙ্গাব্দের ৪ঠা ভাদ্র ঢাকা জেলার
মালখাঁনগর গ্রামে কায়স্থ কুলীন বসুঠাকুর বংশে জন্মগ্রহণ করেন|
পিতা উমেশচন্দ্র বসু ছিলেন উকিল| গ্রামের বাড়ীতেই ছিল এক বিদ্যালয়,
সেখান থেকেই ১৩ বছর বয়সে সুরমাসুন্দরী প্রাইমারী পরীক্ষায় বৃত্তি
পেয়ে উত্তীর্ণ হন| এরপর তিনি কিছুদিন ঢাকার ইডেন বালিকা বিদ্যালয়ে
পড়াশোনা করেছিলেন|
১২৯৩ সালের ১৯শে অগ্রহায়ণ বিক্রমপুরের
বজ্রযোগিনী গ্রামের উকিল চন্দ্রকান্ত ঘোষের বড় ছেলে অধ্যাপক নিশিকান্ত
ঘোষের সঙ্গে সুরমাসুন্দরীর বিয়ে হয়| পরে অবশ্য নিশিকান্ত অধ্যাপনা
ছেড়ে ওকালতি শুরু করেন|
ছেলেবেলা থেকেই কবিতা লেখার চেষ্টা ছিল সুরমাসুন্দরীর| বিয়ের পর
উচ্চশিক্ষিত স্বামী তাকে লিখতে উৎসাহিত করেছেন| স্বামীও ছিলেন
সাহিত্যানুরাগী| ১২৯৬ বঙ্গাব্দে তিনি 'অশ্রু' নামক একটি ছোট কবিতার
বই প্রকাশ করেন; বইটিতে সুরমাসুন্দরীর কয়েকটি কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল||
স্বামীর আগ্রহে তিনি ঐপূর্ব্ববঙ্গ স্ত্রীশিক্ষা কমিটি' আয়োজিত
বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ পরীক্ষায় সর্ব্বোচ্চ স্থান অধিকার করে
স্বর্ণপদক লাভ করেন| তিনি 'প্রদীপ', 'উৎসাহ' (বোয়ালিয়া রাজসাহী
থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা), 'প্রভাত' (স্বল্পস্থায়ী সাপ্তহিক
পত্রিকা) ইত্যাদি পত্রে অনেক গীতি কবিতা প্রকাশ করেছেন| কুন্তলীন
থেকে প্রকাশিত তার রচিত কাব্যগ্রন্থ 'সঙ্গিনী' (১৩০৮) ও 'রঞ্জিনী'
(১৩০৯) পাঠক সমাজের অত্যন্ত সমাদর লাভ করেছিল| অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত
লেখক ও সংবাদপত্রও এ দুটি গ্রন্থের সুখ্যাতি করেছেন|
সে
যুগে খুব কম লেখকই রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত ছিলেন| সুরমার ক্ষেত্রেও
তার ব্যতিক্রম হয় নি কিন্তু তবু তিনি তার স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে
পেরেছেন| তার 'নির্ব্বাসিতা সীতা' কবিতাটি অনেকেরই প্রশংসা পেয়েছে|
রামচন্দ্রের কঠোর আজ্ঞা লক্ষ্মণের কাছে শুনে সীতা ভেঙে পড়লেন না;
কিন্তু তার ক্ষোভ ও অভিমান তিনি ব্যক্ত করেছেন| তিনি লক্ষ্মণকে
বললেন -
"আপনার
মন্দ ভাগ্য, জেনে নাহি গণে
নির্ব্বাসিতা
সীতা ভাবিতেছে শুধু মনে, -
ধর্ম্ম
কি সহিবে হায়, আজি অকারণে
রাজহস্তে অপমান?"
এখানে সীতা রামচন্দ্রকে 'রাজা’ বলে
উল্লেখ করেছেন| কিন্তু পরক্ষণেই সীতা আত্মস্থ হয়ে বললেন -
"বলো
আর্য্যপুত্র পদে দীনা জানকীর
এই নিবেদন,
রাজা তিনি, তিনি স্বামী;
তার কিছু
নাহি দোষ, অভাগিনী আমি!
শুনেছি
অনলে স্বর্ণ ধরে উজ্জ্বলতা;
স্বর্ণ
নই - ঘুচিল না নিন্দা-মলিনতা;
কিন্তু
না হইল ছাই! তাহার সন্তান
ধরেছি
যে গর্ভে আমি, যদি থাকে প্রাণ,
পিতৃগুণে
বিমণ্ডিয়া তুলিব বাছারে|
আর এক
কথা আছে বলিও তাঁহায়
সাধিব
দুশ্চর তপ লয়ে মনস্কাম
জন্মে
জন্মে পতি যেন হয় মোর রাম|"
সেকালে কেউ কেউ নিজের রচিত কোন কাব্য বা রচনার নামে নিজের পরিচয়
ব্যক্ত করতেন| 'তপোবন গিরি' কবিতাটির শেষে নিজের নামের পরিবর্তে
সুরমাসুন্দরী আত্মপরিচয় দিযেছেন 'শ্রীসঙ্গিনী রচয়িত্রী' এই নামের
মাধ্যমে|
১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে সুরমাসুন্দরী পরলোক
গমন করেন|]
দীপক
সেনগুপ্ত
নিবিড় অরণ্য মাঝে শৈল তপোবন,
আম্র, শাল, নানাজাতি বন্য তরুগণ
পাদমূলে দাঁড়াইয়ে প্রহরীর মত
পাহারা দিতেছে জেন সভয়ে নিয়ত
সন্ন্যাস আশ্রম| গিরিকক্ষে স্তরে স্তরে
রচিত তাপস-গৃহ ইষ্টক প্রস্তরে
পাহাড়ের সানুদেশে দাঁড়ায়ে ক্ষণিক
দেখিনু, প্রভাতসূর্য্য করি ঝিকমিক
পাহাড়ের গায়ে, বৃক্ষ অন্তরাল কোণে
উঁকি ঝঁকি চেয়ে ধীরে উঠিচে গগনে|
হেরি সে তরুণ কান্তি নবীন প্রভাতে,
দ্রুতপদে উঠিলাম হরষিত চিতে -
বন্য হরিণীর মত, তপোবন শিরে
জনহীন শান্ত স্তব্ধ নির্ম্মল সমীরে
শৃঙ্খল বন্ধন মুক্ত পক্ষিণীর মত
লভিনু বিমল সুখ| মনে হল কত
পৌরাণিক স্মৃতি| কোথা সেই তপোবন
নির্ব্বাসিত করেছিল যেখানে লক্ষণ
জনকনন্দিনী সীতা? কোথা মহামুনি
বাল্মীকির পবিত্র আশ্রম! নাহি শুনি
ঋষিকুমারের সুমধুর কণ্ঠ ভরে
সামবেদগান. মির্ভীক পুলক স্বরে
বিহগেরা পুণ্যগীতি গাহে সেই সনে
বহে যায় শান্তি; বনে সুস্নিগ্ধ পবনে
ঢাকি ক্ষীণ তনুলতা বাকল বসনে
পুষ্পাধার লয়ে করে কুসুম চয়নে
করুণ সরলা মূর্ত্তি ঋষির কুমারী
মন্থর গমনে চলে| কমণ্ডুল ধরি
তরু-আলবালে কেহ সিঞ্চিছে সলিল|
রজতধারার মত শুভ্র অনাবিল
অদূরে বহিয়া যায় তমসা তটিনী
পুর্ণ কুম্ভ কক্ষে লয়ে তাপসরমণী
আর্দ্রবাসে গৃহে আসে| মুনি ঋষিগণ
উদার গম্ভীর মূর্ত্তি ধ্যানে নিমগন
যাগ জজ্ঞ আয়োজন করিতেছে কেহ
বিভূতি ভূষিত করি স্নাত শুদ্ধ দেহ
অতীতের পুণ্য ময় স্মরণীয় দিন
কোন মহাকালগর্ভে হয়ে গেছে লীন,
লুকাযেছে কোথা সেই অতুল বিভব
ভারতের? এবে সেই লীলা ভূমি সব
দৈত্য দানবের অতীতের পুণ্যফল
স্মরিয়া| ঝরিছে শুধু তপ্ত আঁখিজল|
সুরমাসুন্দরী
দেবী
( ‘আরতি’ মাসিক পত্রিকা, ভাদ্র-আশ্বিন ১৩০৮ )|
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।