চার বছরের বিয়ে-করা স্ত্রী রেবামিনি যখন আঠার বছর বয়েসে সন্ন্যাস
রোগে হঠাৎ মারা গেল, তখন আমার মনে হ'ল যেন আমার হৃদয়-বীণায়
যে-কটা তার ছিল, সে-কটা একেবারে পট্ পট্ করে' ছিঁড়ে গেল ।
দুঃখ অনুভব করবার সুখটাও আমার রইল না ।
সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় শ্মশান থেকে ফিরে এলুম । মনে হ'ল কে
আমার হৃদয়-বীণায় তারগুলো আবার চড়িয়ে দিয়েছে । আর সেখানে কে
যেন সবগুলো তারে পূরবীর সুর বসিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে
বিশাল ক্রন্দনে সকল বিশ্ব সকল চরাচর ডুবিয়ে দিচ্ছে । সন্ধ্যার
পাতলা আঁধার বিষাদ মেখে যেন বাদুড়ের পাখার মতো হ'য়ে উঠেছে
। বাতাসে বাতাসে একটা ক্রন্দনের রোল ঘুরে ঘুরে আশ্রয়ের নিষ্ফল
সন্ধানে ফিরছে । এ জগতে তার কেউ নেই, কিছু নেই-আছে যেন একটা
স্বপ্নের স্মৃতি; কিন্তু সে স্বপ্ন যেন আজ উধাও হ'য়ে চলে গেছে-সৃষ্টির
একান্ত বাইরে ।
শোবার ঘরে ঢুকে' দরজা বন্ধ করে' দিলুম । এই সেই শোবার ঘর-এ
আজ কত মিথ্যা । কিম্বা মিথ্যাও ত নয়, মিথ্যা হ'লেও ত বেঁচে
যেতুম । এ যে সত্য মিথ্যার সেই মাঝখানটাতে যেখানে সত্য আপনার
অধিকার ছাড়তে চায় নি-আবার মিথ্যাও আপনার পূর্ণ দখল খুঁজে পায়
নি ।
টেবিলের উপরে আলো জ্বলছিল । আল্নাতে নিত্য ব্যবহারের কোঁচান
দুখানা শাড়ি শুঁড়ে শুঁড়ে জড়িয়ে ঝুলছে । টেবিলের উপরে "নৌকাডুবি"
বইখানা যতদূর পড়া হয়েছে সেইখানটা একটা চুলের কাঁটা দিয়ে চিহ্ণিত
হ'য়ে নিতান্ত পরিত্যক্ত ভাবে পড়ে' আছে । জড়বস্তুরও কি অনুভব
করবার ক্ষমতা আছে? আমার ত সেদিন ঠিক সেই রকমই মনে হ'ল । সিঁদূরের
কৌটাটি অর্ধেক খোলা অবস্থায় একটা ব্র্যাকেটের উপরে পড়ে রয়েছে
। আমার অন্তর থেকে কণ্ঠের মধ্যে কি যেন একটা বড় ড্যালা ঠিকরে
ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে । আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে' বিছানায়
মুখ লুকিয়ে চার বছরের শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলুম ।
কিন্তু আপনারা সবাই জানেন যে, যে-ক্ষতি পূরণ হবার কোন দিনই
সম্ভাবনা নেই, সে ক্ষতিকে ধরে' মানুষ চিরকাল থাকে না । সে
ক্ষতির যে দুঃখ সে-দুঃখের বিরুদ্ধে মানুষের অন্তর থেকে একটা
সংগ্রাম আপনা হ'তেই আরম্ভ হ'য়ে যায় । তাই আমারও অন্তরে যে
দুঃখ একদিন অতি স্পষ্ট ছিল অতি সত্য ছিল, তা কালের অব্যর্থ
প্রলেপে ধীরে ধীরে আব্ছা হ'য়ে উঠতে লাগল । তারপর এমন একদিন
এলো যখন দেখলুম যে রেবামিনির স্মৃতি আছে কিন্তু তার জন্য দুঃখ
নেই । আসলে যা রইল তা হচ্ছে অতীতকে নিয়ে একটা সেন্টিমেন্টালিজম্
।
আপনারা হয়ত বলবেন, যে-দুঃখ যে-ক্ষতি জীবনে এমন স্পষ্টতম ছিল,
সে ক্ষতি সে দুঃখের এমন পরিণাম মানুষের পক্ষে লজ্জাজনক । কিন্তু
মনে রাখবেন আমি আপনাদের উপন্যাস বলতে বসি নি-যা সত্যিই ঘটেছে
তাই বলছি ।
সে যা হোক্, রেবামিনি মারা যাওয়ার মাস আষ্টেক পর যখন মা
আমায় আবার বিয়ে করবার জন্যে ধরে' বসলেন, সে সময়ে আমার অন্তরে
বিয়ে করা সম্বন্ধে এমন একটা জোরের "না" ছিল না,
যা সে-অনুরোধের বিরুদ্ধে খাড়া হ'য়ে দাঁড়াতে পারে । অবশ্য আমার
বিয়ে করবার আগ্রহ যে একটুও ছিল, তা নয় । তবে আমি বিয়ে করলে
মা যে সুখী হবেন এটা জানতুম । সুতরাং যেটার সম্বন্ধে আমার
নিজের মনে একটা প্রবল "না" ছিল না, অথচ যেটা করলে
মা সুখী হবেন-মার সে অনুরোধে আমি "হাঁ" "না"
কিছুই করলুম না । মা-ও 'মৌনং সম্মতি লক্ষণং" ধরে নিয়ে
আমার দ্বিতীয় গৃহিণীর সন্ধানে লাগলেন । বাঙলা দেশে আর যারই
অভাব হোক্ না কেন, আঠার থেকে আশী বছর পর্য্যন্ত যে-কেউ বিয়ে
করতে চাক্ না কেন, কারোরই মেয়ের অভাব হয় না । আর বিশেষত আমার
বয়েস ত তখন সবে আটাশ । ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চঞ্চলার সঙ্গে
আমার দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়ে গেল ।
বাঙালীর সমাজে পুরুষ নারীর মধ্যে এমন একটা কঠিন যবনিকার
ব্যবধান আছে, যাতে করে' বাঙালী তরুণ-তরুণী পরস্পরের কাছে যেমন
রহস্যময় ও রহস্যময়ী, পৃথিবীর আর কোন দেশে তেমন নয় । বাঙলার
নব-দম্পতীর মধ্যে এই যবনিকাটি কতকটা অপসারিত হয়-শুভদৃষ্টির
সময়ে নয়, বাসর ঘরে নয়, বিয়ের সময়কার শত কোলাহলের মধ্যে নয়-সেটা
হয় তাদের প্রথম রজনীর নিরালা মিলনে-প্রথম রজনীর সম্ভাষণে ।
সেদিন দূর কাছে আসে, রহস্য উন্মুক্ত হ'য়ে দৃষ্টির অতি নিকটে
আসে-যা এতদিন চোখে পর্যন্ত দেখা যায় নি, তা একেবারে স্পর্শের
সীমায় এসে পড়ে । সেই জন্যে এই রজনীটি বাঙালী তরুণ-তরুণীর পক্ষে
আশায় আকাঙ্ক্ষায় কৌতূহলে একেবারে পরিপূর্ণ ।
আমার পুরুষের প্রাণ নারীর জন্যে অবশ্য তেমন সজাগ ছিল না ।
কেননা সে প্রাণের তন্ত্রী নারীর স্পর্শে একবার বেজে উঠেছিল,
সেখানে আর সেই একই কারণে নতুন উন্মাদনা সৃষ্টির সম্ভব ছিল
না । কারণ, মানুষের জীবনে একই বিষয়ের অনুভব দ্বিতীয়বার তেমন
তীব্র ও তেমন তীক্ষ্ণ হয় না । অজ্ঞাত যা, অপূর্ব যা, তার সম্মোহন
যতটা, জ্ঞাত যা দখলে এসেছে, একবার যা জেনেছি, তার মাদকতা,
ততটা নয় ।
কিন্তু তাই বলে' ঐ যে একটি জীব যার সঙ্গে আমার চিরজীবনের সম্বন্ধ,
তার সম্বন্ধে যে আমার কোনই কৌতূহল ছিল না, এটা যদি আপনারা
মনে করেন, তবে আপনাদের পক্ষে মানুষের চিরন্তন প্রকৃতিকেই অস্বীকার
করা হবে । তাই সেদিন যখন রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে' পান চিবুতে
চিবুতে শোবার ঘরে একখানা ঈজিচেয়ারে হেলান দিয়ে একখানা বাঙলা
মাসিকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তার গালাগালির বহরটা একবার নির্ণয়
করতে ব্যাপৃত ছিলুম, তখন যখন বাহিরের বারান্দা থেকে মলের একটা
সলজ্জ টিনি টিনি শব্দ আমার কানে এসে বাজল, তখন আমার মনটা "মোহমুদ্গরের"
শ্লোক আওড়াবার জন্যে মোটেই ব্যস্ত হ'য়ে উঠল না । এমনি সময়ে
এমনি অবস্থায় ওমনি মলের শব্দ আরও একদিন আমার শোবার ঘরের সামনে
অমনি সলজ্জ হ'য়েই বেজেছিল; কিন্তু সেদিন ঐ শব্দ শুনে আমার
বুকের বাঁ পাশটা একেবারে অচেতন ছিল না, সেদিন ঐ মলের শব্দের
সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে একটা নূতন জগতের রুদ্ধ কবাট অর্গলমুক্ত
হবার আয়োজন করছিল । কিন্তু আজ আমার ও-জগতের সকল গানই শোনা
হয়ে গেছে, আজ আবার নূতন একজন, যিনি গীত বহন করে' আমার হৃদয়ের
দ্বারে আসছেন, জানি তাঁর সে গীতের সঙ্গে আমার সে শোনা গানের
কোনই প্রভেদ থাকবে না-শব্দেরও নয়, অর্থেরও নয়, সুরেরও নয়-যদি
কিছু প্রভেদ থাকে ত, সে একমাত্র তানের ।
মলের শব্দ ধীরে ধীরে আমার শয়ন-কক্ষের দরজার পাশে এসে থামল,
সঙ্গে সঙ্গে একটা সুগন্ধি কেশ-তৈলের মৃদু স্নিগ্ধ ও মিষ্ট
গন্ধ আমার ঘরটার ভিতরে চারিয়ে গেল, আমার নির্জীব ঘরটা যেন
জেগে উঠল, আমিও সজাগ হয়ে ঈজি চেয়ারের উপরে উঠে বসলুম ।
ঘরের দরজার পাশে মলের শব্দ থামার সঙ্গে সঙ্গে চুপি চুপি
কি কথা আরম্ভ হয়ে গেল । বুঝলুম যে নববধূ একা আসেন নি । পরক্ষণে
চঞ্চলাকে আমার ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে আমার ছোট বোন স্বর্ণ দুষ্টোমির
হাসি হেসে বললে-"দাদা, এই রইল তোমার বউ, বুঝে পড়ে' নাও,
যে লজ্জা মা গো মা ।" সঙ্গে সঙ্গে আমার দরজাটাও বাহির
থেকে সশব্দে বন্ধ হ'য়ে গেল ।
চঞ্চলার প্রতি আমার দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ হবামাত্র আমার
বুকের মধ্যে সজোরে কি একটা টক্ করে' উঠল । একটা আনকোরা স্প্রিংকে
দাবিয়ে রেখে চট্ করে' ছেড়ে দিলে সেটা যেমন লাফিয়ে ওঠে তেমনি
করে' আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলুম । কে ও? কে ও? চঞ্চলা? না-না-ও
তো রেবামিনি । এমনি প্রায় পাঁচ বছর আগে অমনি একখানি গোলাপী
রঙের শাড়ি পরে' অমনি অবগুণ্ঠন টেনে অমনি ভঙ্গীতে অমনি করে'
আমার শোবার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল । চঞ্চলা? না-না-ও
যে একেবারে হুবহু রেবামিনি- আমারই মিনি । আমি দৌড়ে গিয়ে মিনিকে
বুকে তুলে নিলুম, তাকে বুকে করে' আলোর কাছে নিয়ে এলুম, একটানে
মাথার ঘোমটা ফেলে দিলুম, তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলুম,
না না, এ মিনি নয়, এ আর কেউ, আমি পাগলের মতো তৎক্ষণাৎ তাকে
আলিঙ্গন- মুক্ত করে দিলুম, এমনি করে' তাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে
দিলুম যে, চঞ্চলা তাল সামলাতে না পেরে একেবারে সজোরে টেবিলের
উপরে পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আলোটা উল্টে পড়ে' দপ্ করে' নিভে
গেল-আমি বাগানের দিককার দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে বাগানের একটা
পাথরের বেঞ্চির উপরে বসে' পড়লুম । আমার ভিতরে এখন আগুন ছুটছে,
শরীরের উপরে ঘাম ছুটছে । আমি তখন কে? শ্রীরামপুরের নবীন জমিদার
শ্রীবিভূতিরঞ্জন রায়? না-আমি তখন একজন বদ্ধ পাগল, আমার আসল
জায়গা হচ্ছে পাগলা-গারদে ।
কেমন করে' কোথায় দিয়ে রাত কেটে গেল । য্খন বাহ্য প্রকৃতির
জ্ঞান ফিরে এলো, তখন দেখলুম যে আমি তেমনি বেঞ্চির উপরে বসে'
আছি, আর পূব আকাশে অন্ধকারের বুক চিরে আলো ফুটেছে । ভোরের
হাওয়া বইতে শুরু করল, তার স্পর্শে আমার মাতাল মন কতকটা তাজা
হ'য়ে উঠল । পূর্বাকাশ ধীরে ধীরে লাল হ'য়ে উঠল । দিনের স্পষ্টতার
মধ্যে রাত্রির ঘটনাটাকে একটা অতিদূর দুঃস্বপ্নের মতো প্রতীয়মান
হ'তে লাগল, যেন সেটা আরব্য-উপন্যাসের একটা ছেঁড়া পাতা কোনক্রমে
উড়ে এসে আমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করেছিল ।
কিন্তু আরব্য-উপন্যাসের ছেঁড়া পাতাই হোক্ আর দুঃস্বপ্নই
হোক্, সে রাত্রির কোন ঘটনা যে আমার মনের উপরে কোনই ছাপ রেখে
গেল না তা নয় । আমি সেদিন স্পষ্ট বুঝলুম যে, মানুষের প্রতিমুহূর্তে
যা তার স্পষ্ট, সেইটেই তার মিথ্যা । মানুষের মগ্ন-চৈতন্যের
যে সত্য সে সত্য তার প্রবুদ্ধ চৈতন্যের সহস্র চাঞ্চল্যের কাছে
প্রতি নিমেষেই হার মানছে । কিন্তু যখন একটা কিছু ইঙ্গিতে একটা
কিছু ইসারায় একটা কিছুকে নিমিত্ত করে' সেই মগ্ন-চৈতন্যের সত্য
বাইরের মনে বেরিয়ে আসে তখন প্রবুদ্ধ চৈতন্যের হাজার চাঞ্চল্য
পালাবার পথ পায় না । আমার সেদিন মনের পাতায় যে-একটা গভীর দাগ
পড়েছিল এ দাগ আগে থাকলে মা আমার কিছুতেই দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে
পারতেন না-এটা ঠিক অনুভব করলুম ।
তার পরদিন রাত্রে চঞ্চলাকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্ণ এসে আমার ঘরের
সামনে দাঁড়াল তখন দেখলুম স্বর্ণর মুখ চোখ থেকে সে দুষ্টোমির
হাসি কোথায় চলে' গেছে, তার ঠোঁটদুটো কি যেন একটা অভিমানের
আঘাতে কঠিন হ'য়ে উঠেছে, তার চোখ দুটো থেকে কি যেন একটা প্রশ্ন
তীক্ষ্ণশরের মতো আমার পানে বেরিয়ে আসছে । স্বর্ণ বললে-"দাদা,
তুমি আর যাকেই ফাঁকি দাও না কেন, আমার নতুন কাণ নতুন চোখ,
নতুন মনকে ফাঁকি দিতে পারবে না । তোমার বাগানের দিককার দরজায়
আজ আমি বাহিরে থেকে শিকল এঁটে দিয়েছি-আর এ দরজারও তাই করব
। যদ্দিন তুমি শিষ্ট হ'য়ে না ওঠো, তদ্দিন তুমি এমনি বন্দী
অবস্থাতেই রাত কাটাবে ।" স্বর্ণ চঞ্চলাকে ঘরের মধ্যে
রেখে কবাট টেনে দিয়ে বাহিরের শিকলটা কড়ায় লগিয়ে দিয়ে চলে'
গেল ।
অভাব্য যা, কল্পনারও অতীত যা, তাই যখন অপ্রত্যাশিতভাবে দৃষ্টির
আগে আসে তখন অসতর্ক মনে এমন একটা ওলোটপালোট হয়ে যায় যে মানুষ
তখন স্বভাবতই সংযম হারিয়ে বসে; কিন্তু যে কল্পনাতীতের জন্যে
মনকে প্রস্তুত করে বসে আছে তার কোন রকম অপ্রকৃতিস্থ হবার কারণ
ঘটে না । আমি সেদিন চঞ্চলাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলুম । দেখলুম
চঞ্চলার সঙ্গে রেবামিনির সাদৃশ্য আমার উন্মাদ দৃষ্টির ভ্রান্তি
একটুও নয় । সেই একই দাঁড়াবার ভঙ্গী, একই দেহের গঠন, একই উচ্চতা-সেই
সবই এক । সেদিন চঞ্চলা একখানা হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিল
। বুঝলুম চঞ্চলার রেবামিনির সাদৃশ্যের কারণ আর যাই হোক্ না
কেন তা শাড়ির রঙের সাদৃশ্য নয় । এ সাদৃশ্য হয় চঞ্চলার দেহে,
নয় আমার মনে ।
চঞ্চলা দাঁড়িয়েই রইল । আমি ভীষণ অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলুম
। আমি যে কি করব, আমার যে কি করা উচিত, সেটা আমি কিছুতেই খুঁজে
পাচ্ছিলুম না । আমি যে অপরাধী, এ সত্য আমার মনের কাছে অতি
স্পষ্ট হ'য়ে উঠেছিল । গত রজনীর ঘটনার যে কোন কৈফিয়ত নেই কিম্বা
থাকলেও সে কৈফিয়তটা যে আর যাকেই হোক্ চঞ্চলাকে দেবার মতো নয়,
সেটা আমি জানতুম । যা হোক্ ও রকম অবস্থাটা যখন বেজায় অসহ্য
হ'য়ে উঠল, তখন আমি নিতান্তই খাপছাড়া ভাবে বললুম-"চঞ্চলা
এসো" ।
চঞ্চলা অগ্রসর হ'ল, ধীরে ধীরে সঙ্কোচের সঙ্গে দ্বিধাজড়িত পদে
। এ দ্বিধা নব-বধূর প্রথম সম্ভাষণের লজ্জা-প্রসূত নয়, এ দ্বিধা
উদ্ভূত হয়েছিল তরুণ মনে আশাভঙ্গের যে নিষ্ঠুর আঘাত, সেই আঘাত
থেকে ।
আমি কিন্তু চঞ্চলার চলনটাই দেখতে লাগলুম । মেয়েলী একেবারে
হুবহু রেবামিনির চলনের মতো । রেবামিনি মৃত, একথা আমি যদি না
জানতুম তবে আমি হলফ করে' বলতে পারতুম যে, এ মিনি-মিনি-মিনি
ছাড়া আর কেউ নয় ।
চঞ্চলা আমার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি তার মাথার অবগুণ্ঠন ফেলে
দিলুম । না, সকল সাদৃশ্য সত্ত্বেও এ রেবামিনি নয় । চঞ্চলা
আমার দিকে তাকিয়ে দেখল, আমিও তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলুম,
বড় বড় কালো কালো চোখ দুটি থেকে-উঃ সে কি দৃষ্টি! আমার মনে
হ'ল কে যেন আমার হৃদ্পিণ্ডের দলদলে তাজা রক্তমাংসের উপরে শঙ্কর
মাছের লেজের চাবুক শপাং করে' বসিয়ে দিলে ।
চঞ্চলার সে দৃষ্টি-সে দৃষ্টিতে ভাষা ছিল, মিনতি ছিল, ছিল একটা
জীবনের প্রাণপণে দাবিয়ে-রাখা ক্রন্দন-যে জীবনের সুখের একই
মাত্র আশালতা, যে আশালতা ছিঁড়লে জীবনে আর কিছু ধরবার থাকে
না । আমি অনুভব করলুম জল্লাদের সঙ্গে আমার কোনই প্রভেদ নেই
। আমার ত কোন কৈফিয়ত নেই । আমি চঞ্চলাকে পাশে বসিয়ে আদর করতে
লাগলুম । চঞ্চলার চোখ দু'টো ছল ছল করে' উঠল ।
চঞ্চলার যে হাতখানি নিয়ে আমি আদর করছিলুম সেই হাতখানার প্রতি
আমার দৃষ্টি পড়ল-আমি চমকে উঠলুম । রেবামিনির হাতের প্রত্যেক
রেখাটি আমার চেনা । দেখলুম এ হাত ঠিক রেবার হাত । হাতের গড়ন,
আঙুলের গড়ন, নখ সব অবিকল রেবামিনির হাতের মতো । চঞ্চলার বাঁ-হাতখানি
নিয়ে তা উল্টিয়ে দেখলুম তার পিঠে অনামিকা আঙুলের উপরে তিলটি
পর্যন্ত স্বস্থান ভ্রষ্ট নয় । আমি বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে হাত
দু'খানির দিকে চেয়ে রইলুম । চঞ্চলা অতি মৃদু কণ্ঠে সঙ্কোচের
সঙ্গে বললে-"কি দেখছ?" চঞ্চলাকে আমি উত্তরে ফাঁকি
দিলুম । আমি বললুম-"আমার স্বভাব এমনি যে, আমার মানুষের
হাতের সঙ্গে ভালবাসা আগে হয় । তোমার হাত দুখানি অতি সুন্দর
।" চঞ্চলার চোখ দুটো উজ্জ্বল হ'য়ে উঠল, তার ঠোঁট দু'খানিতে
একটু মৃদু হাসির রেখা অঙ্কিত হতে চেয়ে চেয়ে মিলিয়ে গেল; কারণ
তার প্রাণ থেকে শঙ্কা বুঝি তখনও একেবারে অন্তর্হিত হয় নি ।
কিন্তু সে দিন সে রাত্রে আমার অন্তরে সব চাইতে যেটা গভীর দাগ
কেটেছিল সেটা হচ্ছে আমার পানে চঞ্চলার প্রথম দৃষ্টিটি । আমি
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, আমার অন্তরে যাই হোক্ না কেন চঞ্চলার
যেন দুঃখের কারণ আমি না হই । চঞ্চলাকে সুখী করবার জন্যে আমি
প্রাণপণে চেষ্টা করব ।
স্বর্ণ তার শ্বশুর বাড়ি চলে' গেল, আমরা স্বামী স্ত্রীতে
যেমন সবাই দিন কাটায় তেমনি দিন কাটাতে লাগলুম । কিন্তু যতই
দিন যেতে লাগল ততই আমার মনে একটা ভাব স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর
হ'য়ে উঠতে লাগল । সে ভাবকে আমি যতই ছাড়াতে চাই সে ভাব আমাকে
ততই জড়িয়ে ধরতে লাগল । আমার সুখ সোয়াস্তি কোথায় উড়ে গেল ।
আমার ভিতর ও বাহির একটা বিরাট মিথ্যা সম্বন্ধের উপরে প্রতিষ্ঠিত
হ'ল । এ মিথ্যা আমার চাইতে শক্তিমান । এ মিথ্যার হাত থেকে
হায় আমার উদ্ধারের আর বুঝি উপায় নেই ।
পলে পলে তিলে তিলে আমার মনে প্রাণে যেন আমার প্রত্যেক স্নায়ুতে
স্নায়ুতে অতীতের একটি রহস্যময় অতি সূক্ষ্ম প্রভাব বিছিয়ে পড়তে
লাগল যে প্রভাবের সামনে চঞ্চলার অস্তিত্ব, চঞ্চলার স্বাতন্ত্র্য,
আমার কাছে প্রতিদিনে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল
। ঐ প্রভাবের মধ্যে আমার সুখ ছিল, বেদনা ছিল, আমার বিদ্রোহ
ছিল আবার আনন্দও ছিল । অতীতের অস্পষ্টতার কাছেই বর্তমানের
স্পষ্টতা প্রতি নিমেষে হার মানতে লাগল ।
আমি আদর করতুম-কাকে? চঞ্চলাকে? না-সে আদর যেন কোন অদৃশ্য লোকের
কোন অদৃশ্য-শরীরী জীব এসে দাবী করে' কুড়িয়ে নিয়ে যেত, সে আদর
চঞ্চলার শরীরের উপরেই থেকে যেত-তার অন্তরে ত পৌঁছিত না, সে
আদর করবার সময় ত আমার চঞ্চলাকে মোটেই মনে পড়ত না-মনে পড়ত রেবামিনিকে,
তার প্রতিদিনের কথাগুলিকে, তার বিশেষ বিশেষ দিনের অভিমানগুলিকে;
তার সোহাগ আদর হাস্য পরিহাস, এই সব একত্র হ'য়ে দল বেঁধে এসে
আমার মনের উপরে পড়ে' সেখান থেকে অতি স্পষ্ট অতি বর্তমান চঞ্চলাকে
কোথায় নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখত-ঠিক আমি চঞ্চলাকে নিয়ে আদর করতে
বসতুম । হায়! এর বিরুদ্ধে আমি কেমন করে' লড়াই করব ।
কিন্তু আর যাকেই হোক্ না কেন বাইরের মিথ্যা আচরণ দিয়ে আপনার
জনকে চিরকাল ফাঁকি দেওয়া যায় না । যে দুটি মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা
এক বাড়িতে রয়েছে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কুড়ি ঘণ্টাই হয়ত যাদের
বাক্য দৃষ্টি স্পর্শ পরস্পরের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে, বিশেষত
যে দুজনের অন্তত একজনও আর একজনের অতি আপনার অতি অন্তরতম হবার
জন্যে ব্যগ্র-এমন যে দুটি মানুষ-এদের পরস্পরের মনের সঙ্গে
এমনি একটা সম্বন্ধ স্থাপিত হ'য়ে যায় যাতে করে' সে দুটো মন
বাইরের মিথ্যা আচরণে কিছুতেই প্রতারিত হয় না । বাইরের সকল
অনুষ্ঠানকে কাটিয়ে এদের এক জনের মনে প্রতিফলিত হয়ে যায় ।
তাই চঞ্চলা এটা স্পষ্ট করে' না জানলেও এ অনুভবটা বোধ করতে
তার বিশেষ বিলম্ব হল' না যে, আমার অন্তরাত্মা তার অন্তরাত্মাকে
মোটেই বরণ করে নিতে পারে নি, একান্ত সামীপ্য সত্ত্বেও আমাদের
দু'জনের মধ্যে এমন একটা বাধা এমন একটা ব্যবধান আছে যা কি করলে
ভাঙ্গে কি করলে ঘোচে তা তারও জানা ছিল না-আমারও জানা ছিল না,
আর তা ভাঙ্গবার আমার ইচ্ছা ছিল না-শক্তি ছিল না ।
ধীরে ধীরে চঞ্চলা সম্বন্ধে আমার মনে দুটো ভাব বাসা বাঁধল,
দুটো পরস্পরের ঘোর বিরোধী । একটা তার প্রতি প্রবল আকর্ষণ,
আর একটা তার বিরুদ্ধে ঠিক তেমনি প্রবল বিদ্রোহ । চঞ্চলার যেটুকু
মিনির মতো, তার দেহের ভঙ্গিটি, তার হাত দুখানি-তাই ছিল আমার
প্রতিদিনের সম্বল । তার দুখানি হাত আমি যখন ধরে' থাকতুম, তখন
কি একটা মাদকতায় আমার চিত্ত মন ভরে' উঠত, কি একটা স্বপ্নে
আমার সমস্ত বর্তমান মুছে যেত, রেবামিনির চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে
যেন তার একটা সূক্ষ্ম সান্নিধ্য আমি বোধ করতুম-আর সেই সময়
একটা গভীর শান্তিময় তৃপ্তিতে আমার অন্তরাত্মা পূর্ণ হ'য়ে উঠত,
যেন এ জগতে আর আমার কিছুই করবার বাকি নেই, ভগবানের দেওয়া এই
জীবনের সকল ঋণই যেন আমার শোধ হ'য়ে গেছে, জীবনের শেষ কথাটি
যেন আমার বলা হ'য়ে গেছে । কিন্তু যখন চঞ্চলার মুখের দিকে আমার
নজর পড়ত, তখন আমার সে স্বপ্নের জগত মুহূর্তে কোথায় মিলিয়ে
গিয়ে তার বিরাট অমৃতত্ব আমায় দেখিয়ে দিত । ঐ মুখখানাই ত যত
নষ্টের মূল । হায় । ঐ মুখখানা যদি মিনির হত । ধীরে ধীরে চঞ্চলার
মুখের প্রতি একটা অতি রুদ্র অবজ্ঞা আমার মনকে প্রাণকে চিত্তকে
বিষময় করে তুলল । চঞ্চলাকে আমি ছাড়তে পারতুম না-কিন্তু সে
ত চঞ্চলার জন্যে নয় ।
কিন্তু আমার ঐ মনের ভাব চঞ্চলার মনে গিয়ে আঘাত করতে কিছুমাত্র
দেরী করল না । চঞ্চলা আর আমার কাছে অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতে
চাইত না । আমিও তা কোনদিন খুলতে বলতুম না বা খুলতুম না । কোন
অধিকারে?-এমনি করে' দিনের পর রাত, রাতের পর দিন কেটে যেতে
লাগল, সদা-অবগুণ্ঠনবতী চঞ্চলাকে দেখে আমার বুকের মধ্যে মাঝে
মাঝে একটা বিদ্যুতের ঝলক উঠত-এ চঞ্চলা? না রেবামিনি?-
আপনাদের মনে কোনদিন বিদ্রোহের ভাব জেগেছে? বিদ্রোহ - সংসারের
উপরে সৃষ্টির উপরে ভগবানের উপরে । যেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে
কিছুই ঠিক চলছে না-এর আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সব উল্টো, এর
সুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল একটা বিশৃঙ্খলার জটলা । এখানে
কারো বুদ্ধি নেই, বিবেচনা নেই, হৃদয় নেই, দয়া নেই, করুণা নেই,
কিছুই নেই-আছে কেবল নিষ্ঠুর মরুভূমির ধূ ধূ ধূসর তপ্ত বালির
চোখজ্বালা-করা শুভ্রতা । কিন্তু কেন? কারণ ঐ যে প্রশ্ন-এ চঞ্চলা,
না রেবামিনি? এর উত্তর একটা বিরাট মিথ্যা ।
আমার প্রতিদিনের নিষ্ঠুর অত্যাচার তার অন্তরাত্মার বিরাট
অপমান সম্বল করে' চঞ্চলা শুকিয়ে উঠতে লাগল । এ থেকে বুঝি তার
মুক্তি নেই, সে মন্ত্রমুগ্ধ বিহঙ্গিনীর মতো ধীরে ধীরে বুঝি
মরণের দিকে অগ্রসর হয়ে চলল, আর সেই সঙ্গে মিনির জন্যে আমার
রাক্ষসী আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠতে লাগল । এই রাক্ষসী আকাঙ্ক্ষার
কতকটা তৃপ্তির জন্য আমার ছিল দরকার চঞ্চলাকে । ক্রমে ক্রমে
আমার মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব সব ঘুচে গেল, চঞ্চলা যে একটি জীব,
তার যে একটা পৃথক জীবন আছে, যে জীবনে সুখ দুঃখ বোধ আছে, আশা
আকাঙ্ক্ষা আছে, তা আমি ভুলে গেলুম । চঞ্চলার দিনগুলো একটা
অন্তহীন দুঃখের ভিতর দিয়ে ব'য়ে যেতে লাগল । হায়! এর থেকে তার
মুক্তি কিসে হবে? কবে হবে?-
এমনি করেই দিন কাটতে লাগল । একদিন রাত্রে মিনিকে ভাবতে ভাবতে
কখন ঘুমিয়ে পড়লুম । ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলুম যে, মিনি
আমার বিছানার পাশে এসে হেসে কুটি-কুটি হ'য়ে আমায় বলছে-"এই
দেখ আমি আবার এসেছি, তুমি কি ঘুমিয়েই থাকবে?" আমার ঘুম
তখনই ভেঙ্গে গেল । দেখলুম কেবল অন্ধকার, আর আমার পাশে একটা
অতি মৃদু কান্নার শব্দ । চঞ্চলা কাঁদছিল ।
হায়! আমি চঞ্চলাকে কি বলে' সান্ত্বনা দেব । সে যে হবে ঘোর
মিথ্যা । আমার মুখের কথা কি তার প্রাণে লাগবে । আমার অন্তরাত্মায়
যার চিহ্ণমাত্র নেই, তারি ফাঁকা মুখের কথায় কি তার অন্তরাত্মায়
শান্তি ঢেলে দেবে? আমি জানতুম তা দেবে না । তাই আমি কিছুই
বলতে পারলুম না । কি জানি কত রাত চঞ্চলা এই রকম কেঁদে কাটিয়েছে!
এমন সময় মা আমার কবাটে আঘাত করে' ডাকলেন । আমি জেগেই ছিলুম
। উত্তর দিলে মা বললেন-"দেখত কার মোটর এসে আমাদের বাড়ির
গেটের কাছে এসে লাগল ।"
মোটরের শব্দটা আমারও কানে এসে লেগেছিল । কিন্তু সেদিকে তত
মনোযোগ দিই নি । যখন মা বললেন যে, সেটা আমাদেরই বাড়ির গেটের
কাছে এসে লেগেছে তখন আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে
পড়লুম ।
বাইরে গিয়ে দেখলুম আমার শ্বশুর বাড়ির - চঞ্চলার বাপের বাড়ির-মোটর,
সোফরের হাতে এক চিঠি । চিঠি পড়ে জানলুম যে চঞ্চলার বাবা অত্যন্ত
পীড়িত, এখন যায় যায় অবস্থা, ডাক্তারের মতে আজ রাত কাটে কি
না সন্দেহ, চঞ্চলাকে দেখবার জন্যে তিনি ব্যাকুল, কেবলই চঞ্চলাকে
ডাকছেন, চঞ্চলাকে ফিরতি মোটরে পাঠাবার ব্যবস্থা করবার জরুরি
অনুরোধ ।
আমি তাড়াতাড়ি মা'কে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে, চঞ্চলার
গায়ে একটা শাল জড়িয়ে দিয়ে দু'জনে গিয়ে মোটরে চড়লুম । মোটর
ঝড়ের বেগে ছুটে চলল ।
ভোর হয় হয় - হ্যারিসন রোদের গ্যাসের বাতিগুলো কেবল নিভিয়ে
দেওয়া হয়েছে । আমাদের মোটর আমহার্ষ্ট্র ষ্ট্রীটে চঞ্চলার বাপের
বাড়ির সামনে গিয়ে লাগল । মোটর থামার সঙ্গে সঙ্গে আমার শ্যালক
অমূল্য এসে চঞ্চলাকে নিয়ে গেল, আমি বৈঠকখানায় অপেক্ষা করতে
লাগলুম ।
পাঁচ মিনিটও হয় নি, তখন উপরে বাড়ির ভিতরে একটা চাঞ্চল্যের
আভাস পেলুম । সঙ্গে সঙ্গে অমূল্যের উত্তেজিত কণ্ঠ আমাকে ডাকলে-"বিভূতি
বাবু, বিভূতি বাবু, একবার উপরে আসুন ।" আমি তাড়াতাড়ি
উপরে উঠে গেলুম ।
যে ঘরে রোগী ছিল সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলুম, দেখলুম চঞ্চলা
অবগুণ্ঠন-হীনা রোগীর শয্যার পাশে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে । রোগী
বিছানার উপরে উঠে বসেছে । তার শীর্ণ মুখমণ্ডলে কোটরগত চোখ-দুটো
কেবল যেন কোন অদৃশ্যলোকের তীব্র ও তীক্ষ্ণ আলোকের সম্পাতে
জ্বল্ জ্বল্ করছে । আমি ঢুকতেই রোগী কণ্ঠে বললেন, "এ
কাকে নিয়ে এলে বাবা, এ ত আমার চঞ্চলা নয় ।"
আমি আমার স্ত্রী দিকে তাকিয়ে দেখলুম-ওঃ কি দেখলুম!!!
মুহূর্তে-বোধ হয় এক সেকেণ্ডের সহস্রাংশের এক অংশ সময়ের জন্যে
আমার ধমনীতে ধমনীতে সমস্ত রক্ত চলাচল বন্ধ হ'য়ে গেল, তার পর-মুহূর্তে
সেই রক্ত-প্রবাহ আবার আমার সর্বাঙ্গে ছেয়ে গিয়ে আমাকে উন্মাদের
মতো করে' তুলল, ক্ষুধার্ত শার্দূলের মতো আমি চক্ষের পলকে গিয়ে
আমার স্ত্রীকে আমার বুকের উপরে চেপে ধরলুম । কি একটা বিজয়-গর্বে
আমার সমস্ত অন্তর উথলে-ওঠা সাগর-বারির মতো স্ফীত হয়ে উঠল,
আমি রোগীর দিকে চেয়ে এক হাত তুলে আমার সম্মুখীন মৃত্যুর অসীম
শক্তিকে লক্ষ্য করে' চ্যালেঞ্জের স্বরে চেঁচিয়ে বলে' উঠলুম-"না
এ আপনার মেয়ে চঞ্চলা নয়-এ আমার স্ত্রী রেবামিনি ।"
মরণাহত রোগী বিছানার উপরে ঢলে পড়ল । আমি সে দিন আমার দ্বিতীয়
পক্ষের স্ত্রীকে প্রথম চুম্বন করলুম ।