প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

গৌরীদানের ফল

[ লেখক পরিচিতি : সুরেশচন্দ্র হুগলীর চন্দননগরে ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । গদ্য ও পদ্য রচনায় তিনি সমান কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন । ‘সবুজপত্র’ পত্রিকাতে তার একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে । গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রমথ চৌধুরীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন । প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও নতুন চিন্তার ছাপ রেখেছেন । তার প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘নবযুগের কথা’ (১৯১৯) ; ‘সবুজ কথা’ (১৯২১) ; ‘উড়ো চিঠি’ (১৯২২) । রূপকথা ধর্মী গল্প : ‘নূতন রূপকথা ও একটি রূপক গল্প’ (১৯২০) ; ‘ইরানী উপকথা’ (১৯২০) ; ‘ইন্দ্রজালিক’ (১৯২৬) । কাব্য গ্রন্থ : ‘সাকী’ (১৯২৬) ; ‘ইন্দ্রধনু' (১৯২৮) ; ‘সন্ধ্যালোকে' (১৯৩৫) প্রভৃতি । 'সবুজপত্রে'র ১৯৩২-এর মাঘ সংখ্যায় দিলীপকুমার রায় সুরেশচন্দ্রের ‘ইন্দ্রজালিক’ কাব্যগ্রন্থের একটি মনোরম আলোচনা প্রকাশ করেছেন । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে সুরেশচন্দ্রের মৃত্যু হয় । ].... দীপক সেনগুপ্ত।

সনাতন চাটুয্যে অতি তুখোড় লোক, এমন পলিসিবাজ আর দুনিয়ায় দুটো হয় না । তবে সাধারণত দেখা যায় লোকে পলিসি খাটায় ইহলৌকিক ব্যাপারে, কিন্তু সনাতন খাটাতেন পারলৌকিক ব্যাপার সম্বন্ধে । বলা বাহুল্য, বোধ হয় এই পারলৌকিক ব্যাপার সব পরার্থে উদ্দীপনাজনিত নয়, নিজস্বার্থে উৎসাহজনিত । সনাতনের জ্ঞান হওয়া থেকে বরাবর দৃষ্টি ছিল যে স্বর্গটা কিছুতেই যেন হাতচাড়া হ'য়ে না যায় । তাই স্বর্গে যাবার কত রকম কায়দা সংস্কৃতে লেখা আছে তা ছিল সনাতনের কণ্ঠাগ্রে ও নখাগ্রে । গয়া গঙ্গা গদাধর কারোই, রঘুনন্দন চাটুয্যের পৌত্র ও পরাশর চাটুয্যের প্রপৌত্র শ্রীযুক্ত সনাতন চাটুয্যের বিরুদ্ধে কোনই অভিযোগ বা অনুযোগ করবার কিছুই ছিল না । আর সেইজন্যে সনাতন ভাবতেন যে আর সবাইকে যদি বৈতরণী পার হতে হয় সাঁতরে, তবে তাঁর জন্যে তৈরী হয়ে থাকবে অন্তত পক্ষে একটি ময়ূরপঙ্খী, খুব কম করে হলেও এক শ' দাঁড়ের । সনাতনের মনে যে অধিকতর দ্রুতগামী ষ্টীমলঞ্চ বা মোটর লঞ্চের কথা উঠত না, তা নয় । তবে একালের ম্লেচ্ছের অবিষ্কারগুলো সেকালের ব্রাহ্মণ ইঞ্জিনিয়ারের আবিষ্কৃত বৈতরিণীর বুকে চলবে কি না সে-বিষয়ে তাঁর সন্দেহের বিরাম ছিল না ।
সনাতনের বনে যাবার বয়েস ধর ধর, এমন সময় একদিন তাঁর মনে হল যে, স্বর্গে যাবার সব রকম পুণ্যের টিকিটই তাঁর সংগ্রহ করা হ'য়ে গেছে, শুধু গৌরীদানের পুণ্যের টিকেটখানিই কেনা হয়নি । সেই বয়েসে এই কথাটা সনাতনের মনে হওয়ার একটা কারণও ছিল । সেটা হচ্ছে এই যে, সেই সময়ে তাঁর সবার ছোট মেয়েটি সাত পেরিয়ে ঠিক আটে পা দিয়েছে । সনাতনের বয়েসটাও ধাঁ ধাঁ করে' এগিয়ে যাচ্ছে । তাই সনাতন মনে মনে বললেন- না, গৌরীদানের পুণ্যটা বাকি রাখা কোন কাজের কথা নয় ।
সনাতনের যে কথা সেই কাজ । বছর ফিরতে না ফিরতে বিধবা তারাসুন্দরীর একমাত্র পুত্র রমেনের সঙ্গে তাঁর ছোট মেয়ে লতিকার শুভ বিবাহটা সুসম্পন্ন ক'রে স্বর্গে যাবার সনন্দখানি একেবারে মনের পকেটে পুরে রাখলেন ।

(২)

রমেন ছিল বিধবা তারাসুন্দরীর একমাত্র ছেলে । তেইশ বছর বয়সে দু'দু'বার বি,এ, ফেল করে বাড়িতেই বসে ছিল । সুতরাং এই সুযোগে মা ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু ঘরে আনলেন ।
বিবাহ ইত্যাদির সম্বন্ধে রমেনের যে মতামত কি ছিল তা কেউ জানত না, তবে কিছুদিন থেকে যে সে অত্যন্ত অন্যমনষ্ক ভাবে গুণ্ গুণ্ করে' রবি বাবুর বাছা বাছা প্রেম সঙ্গীত-গুলোর মক্স করত, সেটার সম্বন্ধে কেউ কেউ সাক্ষী দিতে পারত । তা ছাড়া বার্ণস্ ও ব্রাউনিং-এর কোন কোন লাইন যে তার হৃদয়টা দুলিয়ে যেত না সেটাও কেউ নিশ্চয় করে' বলতে পারে না ।
সুতরাং এ-হেন রমেনের শয্যাপ্রান্তে যেদিন তার অষ্টম বর্ষীয়া বধূটি এসে একটি কাপড়ের পুঁটুলির মত হ'য়ে স্থান গ্রহণ করল সেদিন রমেনের হৃদয়টা তোলপাড় করে' উঠল অনেকখানি । তারপর তার হৃদয়ের রক্ত তার মাথার দিকে এবং মাথার রক্ত তার হৃদয়ের দিকে অনেকবার যাতায়াত করার পর যখন সে সাহস সঞ্চয় করে' নববধূর একটি হাত নিজের হাতে টেনে অবেগকম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেসে করল-"লতি, আমায় ভালবাসবে?" তখন সে আবিষ্কার করল যে লতি অবগুণ্ঠনের নীচে কাঁদছে, সে প্রশ্নে লতির কান্না দ্বিগুণ বেড়ে গেল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে লতি উত্তর দিলে, "মা ছড়া আর আমি কাউকে ভালবাসব না ।" রবীন্দ্রনাথ, বার্ণস, ব্রাউনিং সব জড়িয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে রমেনের বুকের মধ্যে এমনি একটা জমাট আঁধার বেঁধে উঠল যে, তার মধ্যে রমেনের নিজের মন বুদ্ধি চিত্তও একেবারে লয় পেয়ে গেল, রইল যা তা কেবল ফিউচারিষ্টদের একখানা জোরাল ছবি ।

(৩)

তার পর দিন রমেনের হঠাৎ সুবুদ্ধির উদয় হ'ল । রমেন মাকে বললে-"মা আজকাল যে রকম দিন পড়েছে তাতে আর যেটুকু জমিজমা আছে তাতে চলবে না । সুতরাং চাকরি-বাকরির চেষ্টায় বেরিয়ে পড়া সমীচীন ।" মায়ের অনেক অনুযোগ অভিযোগ ও অশ্রুজল হেলায় জয় করে' রমেন অতি দূরদেশ বীরভূমে তার এক দূর সম্পর্কিত চাকুরে-কাকার কাছে চলে' গেল ।
কাকা মহাশয় রমেনের এই রকম হঠাৎ চাকরি করবার মত মতি দেখে যুগপৎ পুলকিত ও আনন্দিত হয়ে উঠলেন । কাকা মহাশয়ের সাহেবসুবোর কাছে একটু প্রতিপত্তি যে না ছিল তা নয় । সুতরাং কিছুদিনের মধ্যেই রমেনের চল্লিশ টাকা মাইনের এক কেরানীগিরি জুটে গেল ।
চাকরী পেয়ে রমেন মাকে জানাল । মা লিখলেন, "বৌকে নিয়ে যা ।" রমেন উত্তরে লিখল, "মাইনে একটু বাড়ুক ।" মা লিখলেন, "পূজোর বন্ধে বাড়ি আসিস ।" রমেন লিখলেন, "এত দূরদেশ থেকে বাড়ি যেতে আসতে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ টাকা খরচ । ঐ বাজে খরচটা এখন না করে' টাকাটা জমিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে কাজ দেবে ।" এতে মায়ের যে কত দিন কতখানি অশ্রু ঝরল তা রমেনের অজ্ঞাত রয়ে গেল ।
দেশে অনেকগুলো কল আছে । যেমন ট্যাকশাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ওকালতি, কেরানীগিরি । এই সব কল থেকে এক একটা টাইপ তৈরী হয় । ট্যাকশালে যেমন যে-ধাতুই গলিয়ে দেওয়া যাক্ না কেন, তার একদিকে রাজার মুখের ছাপ আর একদিকে সন তারিখ নিয়ে চেপ্টা হ'য়ে বেরিয়ে আসে, কেবল তাদের বাজারে একটু মূল্যের বেশ কম নিয়ে, তেমনি কেরানীগিরি কলে যত রকম ধাতুর মানুষই ঠেলে দেওয়া যাক না কেন কিছু দিন পরে' তাদের হাব ভাব ভ্রুভঙ্গী কটাক্ষ মন দেহ প্রায় এক রকমই দাঁড়িয়ে যায়; তবে বাজারদরে প্রভেদ থেকে যায় ।
আটটি বছরে রমেন পাকা কেরানী হ'য়ে উঠেছে । সে যে একদিন প্রেমসঙ্গীত গুণ্ গুণ্ করে' গান করত তা আজকাল তাকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না । বার্ণাস-এর নাম শুনলে আজ তার মনে হয় ও-পদার্থটা স্কট্ল্যাণ্ডের পাহাড় কি অন্তরীপ কি অমনি একটা কিছু হবে । আট বছরের প্রতিদিন, ঘন্টা আষ্টেক করে কলম পিষে তার দু চোয়াল জেগে উঠেছে, চক্ষু দুটো ভিতরে নেমে গেছে, একত্রিশ বছর বয়সে এমন কি তার বাঁ কানের পাশ দিয়ে দুটি পাকা চুল পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে । কিন্তু রমেন বেশ আছে, চল্লিশ থেকে তার মাইনে ষাটে উঠেছে ।
এমন সময় এক দিন বিধবা তারাসুন্দরী লতিকাকে সঙ্গে নিয়ে রাইচরণ খুড়োর সাথে রমেনের কর্মস্থলে এসে উপস্থিত । রমেন মনে ভাবলে মন্দ কি, এইবার খাওয়া দাওয়ার একটু সুরাহা হ'তে পারে ।
রমেন প্রায়ই আপিসের খাতাপত্র নিয়ে এসে বাসায় কাজ করত । সেদিনও রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষ করে' এসে নিজের শোবার ঘরের টেবিলের উপরকায় বাতিটা উজ্জ্বল করে' দিয়ে চেয়ারে বসে রাশি রাশি টাকা আনা পাইয়ের হিসেব একমনে দেখে যাচ্ছিল, এমন সময় খাওয়া শেষ করে' তার ষোড়শী স্ত্রী লতিকা ঘরে প্রবেশ করল । লতিকার বয়েসে যত বাড়ছিল ততই তার স্বামীর আট বছর আগের একমাত্র প্রশ্নটি তার হৃদয়ের অন্তস্থলে একটি তীক্ষ্ণ বিষাক্ত তীরফলকের মত স্থূল থেকে স্থূলতর হ'য়ে উঠছিল । আজ সে এসেছিল তার সমস্ত মন প্রাণ নিয়ে একটি জীবনকে নিঃশেষে উজাড় করে ঢেলে দেবার জন্যে । আজ লতিকার মনের সুষমা তার সমস্ত দেহে ছড়িয়ে গেছে, তার প্রাণের পুলক-স্পন্দন সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে চারিয়ে গেছে । ষোড়শী স্ত্রী এসে রমেনের চেয়ারের একটি হাতল ধরে' রমেনের পাশে দাঁড়াল, রাজ্যের রক্তিমাভা তার কপোলে জড়িয়ে । টানা-আনা-পাই-এ ব্যস্ত একবার খালি মুখ তুলে চাইল, তরপর তার বাঁ কানের পাশে যেখানে দুটো পাকা চুল এসে ঝুলে পড়েছিল সেইখানে চুলের মধ্যে অন্যমনস্কভাবে তার বাঁ হাতের পাঁচ আঙুল চালাতে চালাতে বললে, "আমাকে এখন আর disturb করো না, এ-কাগজ আমাকে কালই দাখিল করতে হবে ।" লতিকার কপোলের রক্তিনাভা একমুহূর্তে একেবারে পাঁশুটে হয়ে গেল, লতিকা ধীরে সরে গেল । তার বুকের মধ্যে নেমে এল একটা জমাট বাঁধা আঁধার আর তার চোখের সামনে বিছিয়ে গেল একটা সীমাহীন শেষহীন নিষ্ঠুর মরুভূমি-যেখানে চারিদিকে কেবল বিরতিহীন মৃগতৃষ্ণিকা ।
সেই সময়টাতে প্রায় ষাট বছরের এক বৃদ্ধ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে শুনছিলেন বৈতরণীর বুকে ময়ুরপঙ্খীর একশ' দাঁড়ের ঝুপ্ ঝুপ্ শব্দ ।


সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী


(‘সবুজপত্র’ , পৌষ সংখ্যা, ১৩২৭)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।