প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

নতুন রূপকথা

[ লেখক পরিচিতি : সুরেশচন্দ্র হুগলীর চন্দননগরে ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । গদ্য ও পদ্য রচনায় তিনি সমান কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন । ‘সবুজপত্র’ পত্রিকাতে তার একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে । গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রমথ চৌধুরীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন । প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও নতুন চিন্তার ছাপ রেখেছেন । তার প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘নবযুগের কথা’ (১৯১৯) ; ‘সবুজ কথা’ (১৯২১) ; ‘উড়ো চিঠি’ (১৯২২) । রূপকথা ধর্মী গল্প : ‘নূতন রূপকথা ও একটি রূপক গল্প’ (১৯২০) ; ‘ইরানী উপকথা’ (১৯২০) ; ‘ইন্দ্রজালিক’ (১৯২৬) । কাব্য গ্রন্থ : ‘সাকী’ (১৯২৬) ; ‘ইন্দ্রধনু' (১৯২৮) ; ‘সন্ধ্যালোকে' (১৯৩৫) প্রভৃতি । 'সবুজপত্রে'র ১৯৩২-এর মাঘ সংখ্যায় দিলীপকুমার রায় সুরেশচন্দ্রের ‘ইন্দ্রজালিক’ কাব্যগ্রন্থের একটি মনোরম আলোচনা প্রকাশ করেছেন । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে সুরেশচন্দ্রের মৃত্যু হয় । ].... দীপক সেনগুপ্ত।

           এক যে ছিল রাজা| রাজার নাম জীবনগুপ্ত, রাজার রাজ্য শাকদ্বীপ, রাজার রাজধানীর নাম মনে নেই| রাজার ধনৈশ্বর্যের অন্ত নেই, লোকজনের ইয়ত্তা নেই| রাজার হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, দেউড়ীভরা দরোয়ান, বাগিচাভরা ফুল| রাজার সাত-মহলা পুরী পৃথিবীর বুক আঁকড়ে ধরে' আকাশ ফুঁড়ে একেবারে কোথায় উঁচু হ'য়ে উঠেছে-উপরে তাকিয়ে দেখলে দেখাই যায় না কোথায় তার চূড়া কোন্ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। সাতমহলা পুরী-তার মহলে মহলে দাস দাসী, মহলে মহলে চন্দনকাঠের দরজা, মেহগনি কাঠের জানালা, দুধের মত সাদা শ্বেত পাথরের থামের উপরে উপরে আবীরের মত লাল রক্তপাথরের গম্বুজ-একেবারে কতদূর থেকে দেখা যায় যেন পলাশবনে পলাশ ফুটে আছে| সেই সব থামে থামে আবার কত কারুকার্য, তার ইয়ত্তা নেই। কোথাও ময়ূর তার পেখম ফুলিয়ে রঙ্ বাহার খেলছে, কোথাও হাতী তার শুঁড় ঝুলিয়ে দিয়েছে, সিংহ তার প্রকাণ্ড থাবা পেতে বসে আছে, বাঘ রাগে বসে' গর্ গর্ করছে-এমনি সব কত কত শ্বেতপাথরের থামে থামে খোদাই করা। দেয়ালে দেয়ালে কত চিত্র। কোথাও সীতার বনবাস, কোথাও পঞ্চবটী, কোথাও মায়ামৃগ, কোথাও অশোকবন-এমনি সব কত চিত্র নিপুণ তুলিতে চিত্রিত হয়ে দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। গম্বুজের ছাদে ছাদে সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শতদল আাঁকা-তারই পাশে পাশে আবার কতরকমের পাখী লতা পাতা। সাত মহলে রাজার সাত রাণী। সাত রাণীর গলায় মুক্তোর মালা, নাকে হীরের ফুল, কানে পান্নার দুল; তাদের মাথাভরা চক্চকে মিশমিশে কালো রেশমী চুলে গজমোতির হার; হাতে সোনার কাঁকন রাণীদের গায়ের রঙের সঙ্গে একেবারে মিলিয়ে গেছে, আঙুলে আঙুলে লাল ডগ্ডগে চুণি-বসান আংটি; মাথা থেকে পা পর্যন্ত হীরে চুণি পান্না জহরতে সাত রাণীর রূপ একেবারে জ্বল্ জ্বল্ করছে। সাতমহলা পুরীতে সাত রাণীকে নিয়ে রাজা সুখে রাজ্য করেন।

           রাজা প্রতি বৎসর বসন্ত এলে বনোৎসব করেন| যখন প্রথম ফাল্গুনের হাওয়ার মাঝের মদের গন্ধ শীতবুড়ির নাকে ঢোকে, তখন শীতবুড়িটা যেন কিসের স্মৃতিতে শিউরে ওঠে, কিসের বেদনায় জেগে ওঠে। তার পরণের সাদা থানের কাপড়ে ধীরে ধীরে সবুজের আমেজ লাগে, মুখের বুকের হাতের ঢিলে চাম্ড়া সব নিটোল হয়ে আসে, চোখের শুক্নো চাউনি বিদ্যুৎভরা মেঘের মত হয়ে আসে-মাথায় কাশফুলের মত সাদা চুলের রাশ ভ্রমরের দলে ছেয়ে যায়-ফাটা পা দুটো কমলদলের মত হ’য়ে আসে, হাতের কাঠির মত আঙ্গুলগুলো চাঁপার কলি হ’য়ে জেগে ওঠে। তখন শীতবুড়িকে চেনে কার সাধ্য; তখন তার কালো চোখে বাঁকা চাউনি, পাকা ডালিমের কোয়ার মত লাল টুক্টুকে ঠোঁটের ফাঁকে যূথীর কলির মত দাঁত-দেখান হাল্কা হাসির রেখা, জরি-পেড়ে চূণি পান্নার বুটিদার গাঢ় সবুজ রঙের শাড়িতে আর তার শরীর যেন ধরেই না; সে সবুজ শাড়ির চাইতেও যে সে অনেকখানি বেশি-এই কথাটা সে ভরা-বুক নিয়ে যেন জানিয়ে দিতে চায়। প্রতি ফাল্গুনে এমনি করেই শীতবুড়ির নবজন্ম হয়,আর রাজাও তাঁর সাত রাণীকে নিয়ে এমনি সময়েই বসন্তোৎসব করতে রাজধানী ছেড়ে চলে যান।

            সেবার প্রথম ফাল্গুনের সঙ্গে সঙ্গে "ফাল্গুনী"র বাঁশী বেজে উঠল। বনে বনে গাছে গাছে পাতায় পাতায় পুলক লাগল। কোথা থেকে একটা ভূঁইচাঁপা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে তার কচি মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে আধ আধ কথায় গান শুরু করে'দিলে:-
               "বিদায় নিয়ে গিয়েছিলাম
                         বারে বারে।
                 ভেবেছিলেম ফিরব না রে"।

              কোথা থেকে একটা ছোট্ট চড়াই তার ছোট্ট বুক ফুলিয়ে গলায় গিটকিরি কেটে গান জুড়ে দিলে-
                 "আকাশ আমায় ভর্ল আলোয়।
                   আকাশ আমি ভর্ব গানে"।

           আমের মুকুলের গন্ধ ছোটার সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছি দলের ব্যস্ত ব্যাকুলতা জেগে উঠল, ঘন পাতার আড়াল থেকে স-তান কোকিল ডেকে উঠল, বুল্বুল্ লতার গায়ে দোল খেতে খেতে পিউ পিউ করে সাধতে লাগল, দোয়েল ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে নতুন গোঁফ-ওঠা ছোক্রার মত শিষ দিতে লাগল, শালিখেরা পর্যন্ত হলদে ঠোঁট দিয়ে তাদের গিরিমাটির গা ঠোক্রাতে ঠোক্রাতে মহা আনন্দে তাদের বেসুরো গলায় কিচিরমিচির করতে লাগল। বনে বনে লতা দুলল-পাতা কাঁপল-বাতাস ছুটল-চারদিকে মহাসাড়া পড়ে গেল| রাজা বললেন-"বসন্ত আগত, বনোৎসবের আয়োজন কর।"

            রাজা বসন্তোৎসবে যাবেন| সাতমহলা পুরীর সাত মহল ডাক হাঁকে ভরে' উঠল। রাজপুরীর চার তোরণের নহবতে সানাইয়ের বুক চিরে ভৈরবী সুর ফুটে বেরল| কাড়া নাকাড়া দামামা মৃদঙ্গ রবাব বেণু বীণা মূরজ মুরলী করতাল জয়ঢাক সব একসঙ্গে বেজে উঠল| ঘোড়াশালে লক্ষ ঘোড়া ঘাড় বাঁকিয়ে চিঁ হিঁ হিঁ করে' তাদের আনন্দ জানাল, হাতীশালে হাজার হাতী তাদের শুঁড় আকাশে তুলে বিশাল নাদ করে' জয়ধ্বনি করে' উঠল| রাজা দুধের মত সাদা একটা ঘোড়ার উপরে সোয়ার হলেন; সাত মহল থেকে সাত রাণী বেরিয়ে এসে সাত দোলায় উঠলেন| রাজপুরীর বিশাল সিংহদ্বার খুলে গেল। রাজা সাদা ঘোড়ার ঘোড়সোয়ার হয়ে সাত দোলায় সাত রাণীকে নিয়ে সিংহদ্বার পথে বেরলেন-এমন সময় সেই সিংহদ্বার দিয়ে এক পরম সুন্দর পুরুষ প্রবেশ করে' রাজাকে অভিবাদন করে দাঁড়াল।

          -ওরে থামা থামা কে কোথায় আছিস! থামা সব কোলাহল, সব গীতবাদ্য, সব ডাক হাঁক, সব হাসি গান! ইঙ্গিতে সব থেমে গেল-কাড়া নাকাড়া দামামা মৃদঙ্গ রবাব বেণু বীণা মূরজ মুরলী করতাল জয়ঢাক সব যেন যাদুমন্ত্রবলে নীরব হ'য়ে গেল। নহবতে নহবতে সানায়ের হৃদয়-গলান সুর কানে কানে রেশ রেখে মিশিয়ে গেল, তুরঙ্গ সব বাঁকান-ঘাড় সোজা করল, হাতীর দল শুঁড় আস্ফালন বন্ধ করল| বাহকেরা সাত রাণীর সাত দোলা কাঁধ থেকে মাটিতে নামাল, রাজা ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন| রাজার আর বনোৎসবে যাওয়া হ'ল না।

            রাজা দেখলেন পরম সুন্দর পুরুষ| দীর্ঘ শরীর, উন্নত শির, তেজভরা চোখ, স্বাস্থ্যভরা দেহ; গায়ের রঙ, সে যেন গলিত কাঞ্চন-গায়ের কোনখানে টিপি দিলে যেন আঙ্গুলের দু'পাশ দিয়ে রক্ত ছুটে বেরবে, এমন স্বাস্থ্য| মাথা মুখ মুণ্ডিত| মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোন আবরণ নেই, কেবলমাত্র একটুকু কৌপীন| রাজা বিস্মিত হ'য়ে কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলেন| তারপর জিজ্ঞেস করলেন-"মহাশয় আপনি কে?"
আগন্তুক উত্তর দিলেন-"মহারাজ! আমি সন্ন্যাসী।"

          রাজা বললেন-"মহাশয় অজ্ঞতা ক্ষমা করবেন। সন্ন্যাসী কি? সন্ন্যাসী কে?"

          সন্ন্যাসী উত্তর করলেন-"মহারাজ! সন্ন্যাসী সেই, যে সৎ অসৎ নাশ করে নির্বিকার হয়েছে| সেই পরম সত্য একই সত্য-সেই সত্য হচ্ছে ব্রহ্ম। এক ব্রহ্মই সত্য, আর সব মিথ্যা। মহারাজ, এই যে জগৎ দেখছেন, এ কেবল আমাদের মায়ার সৃষ্টি-আমাদের দৃষ্টির বিভ্রম।"

           রাজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-"মহাত্মন! এ জগৎ সব মিথ্যা? এই যে সংসার, ঐ যে আকাশ, এই যে ঘোড়া, ঐ যে হাতী-সব মিথ্যা?"

         -"স্বপ্ন, মহারাজ, স্বপ্ন, ছায়াবাজী। হাতী কি থেকে বলছেন? ঘোড়া কোন্টাকে দেখছেন? আপনার যদি দৃষ্টি থাকত তবে দেখতে পেতেন, ও হাতীও নয়, ঘোড়াও নয়,-খালি "ইলেকট্রনের" পুঞ্জীভুত সমষ্টি। সুন্দর ফুল, সুন্দরী নারী, সুস্বাদ সোম-কোথায় মহারাজ?- আমি দেখছি কেবল ঈশ্বর| এই মিথ্যাকে চরম করে' মেনে পরম সত্য থেকে আমরা দূরে রয়েছি।"

             রাজা এমন সব কথা কোনদিন শোনেননি। তাই এ সব কথা শুনে উতলা হলেন| তারপর কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন-"মহাত্মন, ক্ষমা করবেন-আমার এখন সময় নেই-বসন্তোৎসবে বনে যেতে হবে| এ রাজ্যের এই রাজবংশের কোটি বছরের উৎসব এ - যা কোটি বছরের প্রত্যেক বছরটিতে সম্পাদিত হ'য়ে এসেছে| আমার পূর্বে যিনি ছিলেন, আবার তাঁর পূর্বে যিনি ছিলেন-আবার তাঁর পূর্বে তাঁর পূর্বে তাঁর পূর্বে-এমনি লক্ষ রাজার উৎসবের স্মৃতি নিয়ে এই উৎসব গড়ে উঠেছে| এ উৎসব বন্ধ করবার ক্ষমতা আমার নেই। মহাত্মন, রাজপুরীতে অবস্থান করুন। এক মাস পরে উৎসব থেকে ফিরে এসে আপনার কথা শুনব| রাজপুরীতে যখন যা প্রয়োজন হবে অনুজ্ঞা করবেন-তৎক্ষণাৎ তা পালিত হবে।"

            সন্ন্যাসী উত্তর করলেন-"মহারাজ, আমি সন্ন্যাসী-আমার কিছুরই প্রয়োজন নেই| আপনি উৎসব থেকে ফিরে আসুন-আমি অপেক্ষা করব।"

           সন্ন্যাসী বিদায় নিলেন।

         -ওরে বাদ্যকরেরা থেমে রইলি কেন! তোরা সব বোকার মত সঙের মত দাঁড়িয়ে রইলি কেন! বাজা বাজা-ঐ যে রাজা ঘোড়ায় উঠছেন-ঐ যে সাত রাণীর সাত দোলা বাহকেরা কাঁধে তুলে নিল-বাজা বাজা। চোখের এক পলক ফেলতে সোনার জীবন কাঠির স্পর্শে যেন সব জেগে উঠল-কাড়া নাকাড়া কাঁসি দামামা রবাব বেণু বীণা মূরজ মুরলী মৃদঙ্গ করতাল জয়ঢাক-সব বেজে উঠল কাড়া নাকাড়া ক-র্র্র্ করে' উঠল, কাঁসি খন্ খন্ করে উঠল, দামামা ডিম্ ডিম্ করে' উঠল, মৃদঙ্গ দম্ দম্ করে' উঠল, করতাল ঝম্ ঝম্ করে' উঠল, বেণু বীণা রবাব নানা মূর্ছনা তুলল, জয়ঢাক ঢক্কা নিনাদ তুলল। লক্ষ ঘোড়া আবার ঘাড় বাঁকিয়ে মাটির গায়ে খুর ঠুকতে প্রাচির গায়ে লাগল, হাজার হাতী শুঁড় দুলিয়ে তাদের চাঞ্চল্য জানিয়ে দিল-রাজা সাদা ঘোড়ায় সোয়ার হ'য়ে সাত দোলাতে সাত রানীকে নিয়ে বনোৎসবে যাত্রা করলেন| রাজা সঙ্গীসহচর নিয়ে সিংহদরজা দিয়ে প্রশস্ত রাজপথে বেরিয়ে পড়লেন;-রাজপুরীর চার তোরণে নহবতে নহবতে সানাইয়ে সানাইয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে বসন্ত-বাহারে সুর উঠতে লাগল-
                 "গন্ধে উদাস হাওয়ার মত
                   উড়ে তোমার উত্তরী,
               কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।"

           রাজা বনে এলেন। রাজার পিছনে সাত দোলায় সাত রাণী, তার পিছনে লক্ষ ঘোড়া, তার পিছনে হাজার হাতী, তার পিছনে বাদ্যভাণ্ড দাসদাসী অনুচর নিয়ে রাজা বনে এলেন, বসন্তোৎসব করবার জন্যে।
বনের অপূর্ব শোভা। বনের বুক একেবারে পুরে উঠেছে-তালে তমালে শালে শিমুলে আমে জামে বকুলে পারুলে অশোকে অশ্বত্থে একেবারে ভরে' উঠেছে| লক্ষ রকমের লক্ষ গাছ তাদের ঘন পাতার চামর ঝুলিয়ে দিয়েছে; কেবল সবুজ আর সবুজ আর সবুজ-চোখ-জুড়োন সবুজে সবুজে একেবারে চারদিক জড়িয়ে গেছে, চারিয়ে গেছে-সেই সবুজের বুকে বুকে আবার রঙের ঢেউ। সাদা লাল হল্দে গোলাপী বেগুনে নীল জরদ-একেবারে রঙে রঙে রঙ্বাহার| তারই মাঝে আবার মত্ত বাতাসের মাতামাতি, বাতসে বনে নতুন করে পরিচয়, নতুন করে' চিরদিনের প্রশ্নোত্তর। বাতাস ছুটতে ছুটতে একখানে থমকে দাঁড়িয়ে যায়-ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্ন বর্ষণ করতে থাকে-
         কে গো তুমি? আমি বকুল।
         কে গো তুমি? আমি পারুল।
         তোমরা কেবা? আমরা আমের মুকুল গো-
         আবার সেখান থেকে ছুট্ দিয়ে আর একখানে থমকে দাঁড়িয়ে যায়-আবার জিজ্ঞেস করতে লেগে যায়-
         তুমি কে গো? আমি শিমুল!
         তুমি কে গো? কামিনী-ফুল!
         তোমরা কেবা? আমরা নবীন পাতা গো-
         আবার সেখান থেকে চট্ করে' ছুট্ দিয়ে কোন এক অশ্বত্থ গাছের আগডালে উঠে দোল খেতে খেতে গান ধরে' দেয়-
          "এই কথাটাই ছিলেম ভুলে
           মিলব্ আবার সবার সাথে
            ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে।"

                "অশোকবনে আমার হিয়া
            নূতন পাতায় উঠ্বে জিয়া,
            বুকের মাতন টুট্বে বাঁধন
            যৌবনেরি কূলে কূলে,
            ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে।"

         রাজা সন্ন্যাসীর কথা একেবারে ভুলে গেলেন। লক্ষ গাছের লক্ষ ডালে লক্ষ দোলনা চড়ল-মহানন্দে বনোৎসব আরম্ভ হল।
         বনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিচয় ত আজকার নয়, একদিনের নয়; ও পরিচয় সেই আদিম কালেরও আগে হতে-সেই কাল, যে-কালে বনের মানুষ ছিল বন-মানুষ। বনের সবুজকে যখন মানুষ হৃদয় দিয়ে আবিষ্কার করে, তখন তো বন কেবল বনই নয়-বনের চাইতেও সে অনেকখানি বেশী। মানুষের হৃদয়ের রঙ যে তখন বনের সবুজকে উজ্জ্বল করে' তোলে। সে তখন নির্জীব নয়, মূক নয়-তখন সে হাসে, খেলে, গান গায়। ঐ গানই ত চাঁদনী রাতে হালকা হাতে আকাশের গায়ে জ্যোৎস্নার আলপনা টানতে টানতে বিদ্যুৎবরণ পরীরা বেণু বনে বনে শুনতে পায়-
               "ওগো দখিণ হাওয়া, পথিক হাওয়া
                দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে!
                নূতন পাতার পুলক-ছাওয়া,
                পরশ-খানি দাও বুলিয়ে।

                        আমি পথের ধারের ব্যাকুল-বেণু
                 হঠাৎ তোমার সাড়া পেনু,"
               "আহা এস আমার শাখায় শাখায়
                 প্রাণের গানের ঢেউ তুলিয়ে।"

         ঐ গানই ত অপ্সরীরা তারা-জাগা উষায় তাদের সারা নিশার অভিসার থেকে ফিরবার পথে ঘুমন্ত চোখে ফুলন্ত গাছে গাছে শুনতে পায়-
                   "ওগো নদী আপন বেগে
                   পাগল পারা,
                   আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু
                   গন্ধভরে তন্দ্রাহারা।
                   আমি সদা অচল থাকি,
                   গভীর চলা গোপন রাখি,
                   আমার চলা নবীন পাতায়,
                   আমার চলা ফুলের ধারা।"

             ঐ গানের সঙ্গে যখন মানুষও গান গাইতে শেখে তখন ত সে মৃত্যুকেই বড় বলে মানতে চায় না| কিন্তু যাক সে কথা!

           এক মাস পরে রাজা বন থেকে বসন্তোৎসব শেষ করে' রাজধানীতে ফিরে এলেন| রাজপুরীতে এসেই মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন-"মন্ত্রী সন্ন্যাসী কোথায়? তাঁর কাছে আমায় নিয়ে চলুন।" মন্ত্রী রাজাকে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে গেলেন।

               রাজা সন্ন্যাসীকে দেখে একেবারে চম্কে উঠলেন! এই সেই সন্ন্যাসী যাঁকে তিনি মাত্র এক মাস আগে দেখেছিলেন। কোথায় সে নধর তনু-উন্নত শির তেজভরা চোখ, স্বাস্থ্যভরা দেহ, কাঞ্চনের মত বর্ণ? সে মুখে যেন কে কালি মেখে দিয়েছে-সে চোখে যেন কে কুজ্ঝটিকা ভরে' দিয়েছে-প্রশস্ত ললাটে চামড়া কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছে-সারা শরীরটা একেবারে ঝুনো নারকেলের মত চিম্সে হয়ে উঠেছে| রাজা বিস্ময় প্রকাশ করে' সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করলেন-"মহাত্মন, আপনার একি পরিবর্তন?"

            সন্ন্যাসী তাঁর অত্যন্ত শুষ্ক ঠোঁটে একটু হাসি এনে মৃদুকণ্ঠে উত্তর দিলেন-"মহারাজ, গত একমাস আমি অনাহারে আছি।"

           ক্রোধে রাজার চোখ দুটো জ্বলে উঠল-শরীর থর্ থর্ করে কেঁপে উঠল-বুকের উপর রত্নরাজি ঝক্ ঝক্ করে জেগে উঠল-কোষের অসি ঝন্ ঝন্ করে' বেজে উঠল-রাজা মন্ত্রীর দিকে চোখ ফিরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কঠোর কণ্ঠে বললেন-"এ কি ব্যাপার মন্ত্রী? আমার যে রাজ্যে কোনদিন সামান্য একটি পিঁপড়ে পর্যন্ত অভুক্ত থাকে না, সেই রাজ্যে রাজার অতিথি হয়ে রাজপুরীতে অবস্থান করে একমাস কাল অনাহারে!-মন্ত্রী এর অর্থ কি?" ক্রোধে রাজার বাক্ রুদ্ধ হয়ে এল, মুখে আর কথা সরল না।

           মন্ত্রী কৃতাঞ্জলিপুটে প্রশান্ত কণ্ঠে উত্তর করলেন-"মহারাজ এ দাসের অপরাধ মার্জনা করবেন। কিন্তু মহারাজ, বনোৎসবে যাবার সময় এ দাস সন্ন্যাসীর নিজ মুখ থেকেই শুনেছিল যে তাঁর কিছুরই প্রয়োজন নেই-তাই এ দাস তাঁর আহারের কোন আয়োজন করেনি। সন্ন্যাসীও কোন অনুজ্ঞা করেননি।"

           রাজা সন্ন্যাসীর দিকে ফিরে বললেন-"মহাত্মন, আপনার আহার্য্য কি?"

           সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন-"মহারাজ, আমি যখন কুরুবর্ষের রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছিলেম, তখন প্রতিদিন রাজভাণ্ডারী দশ সের করে' দুধ আমার আশ্রমে রেখে যেত।"

           রাজা মন্ত্রীকে সম্বোধন করে বললেন-"মন্ত্রী, রাজগোশালায় শ্রেষ্ঠ যে গাভী তিনটি রয়েছে সেই গাভী তিনটি সন্ন্যাসীর সেবায় নিযুক্ত হোক।"

        -"যে আজ্ঞা মহারাজ।"
       রাজা সন্তপ্ত ও ব্যথিত অন্তঃকরণে অন্তঃপুরে চলে গেলেন।

( ২ )

        প্রশস্ত রাজসভা। রাজা সভা করে বসে আছেন। রূপোর ঝালর লাগান চুনি পান্নার চুমকি বসান চন্দ্রাতপ-তারই নীচে সোনার ঝালর লাগান প্রশস্ত রাজছত্র-তারই নীচে সুবর্ণনির্মিত রত্নখচিত রাজসিংহাসন। রাজসিংহাসনে রাজা - মাথায় তাঁর রাজমুকুট, হাতে তাঁর রাজদণ্ড। রাজমুকুটে কত কত মণি মরকত প্রবাল-তাদের বুকে বুকে আলো প্রবেশ করে' আবার ছুঁচের মত সূক্ষ্ম আর বিদ্যুতের মত তীক্ষ্ণ হয়ে বেরিয়ে এসে চারদিকে ঠিক্রে ঠিক্রে পড়ছে। রাজাকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে কত কত পাত্র মিত্র অমাত্য সভাসদ্, কত কত বৈদেশিক রাজ-প্রতিনিধি। সভাসদ্দের উষ্ণীষের রত্নরাজিতে আলো প্রতিফলিত হয়ে সভামণ্ডপ চক্ চক্ ঝক্ ঝক্ করছে, দ্বারে দ্বারে সদ্যফোটা ফুলের মালা ঝোলানো, তারই মাঝে মাঝে আবার চোখ-জুড়োন আম্র-পল্লবের মঙ্গল ইঙ্গিত| রাজসভা স্তব্ধ নীরব-একটুকু কোনখানে নড়াচড়া নেই| এ যেন সত্যিকার রাজসভা নয়-এরা যেন সত্যিকারের মানুষ নয়। এ যেন একখানা নিপুণ তুলিতে পটে-আঁকা ছবি।

         ধীরে ধীরে সভামণ্ডপের বাইরে মন্দিরার ঠিনি ঠিনি মিষ্টি শব্দ উঠল-তারপর তারই সঙ্গে সঙ্গে বৈতালিক-কণ্ঠে রাজার মঙ্গলাচরণ গীত উঠল। একবার, দু'বার তিনবার ফিরে ফিরে বৈতালিকেরা রাজার গুনগান করে' রাজার জয়ধ্বনি করে' উঠল, এমন সময়ে সভামণ্ডপের বৃহৎ দ্বার দিয়ে ধীর পাদবিক্ষেপে উন্নত-শিরে সন্ন্যাসী রাজসভায় প্রবেশ করলেন।

         চকিতে রাজসভা চঞ্চল হয়ে উঠল। চক্ষের পলকে রাজা সিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন| রাজার পাশে রাজমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, অমাত্যরা উঠে দাঁড়াল, পাত্র মিত্ররা উঠে দাঁড়াল, সভাসদেরা উঠে দাঁড়াল, বৈদেশিক রাজ-প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়াল। সন্ন্যাসী তাঁর আজানুলম্বিত অনাবৃত বাহু উত্তোলন করে' সবার উদ্দেশে আশীর্বাদ বাণী উচ্চারণ করলেন| রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এগিয়ে এসে সন্ন্যাসীকে অভ্যর্থনা করলেন, তাঁকে নিয়ে গিয়ে আপনার সিংহাসনের দক্ষিণপার্শ্বের আসনে বসায়ে রাজা সিংহাসনে বসলেন, পাত্রমিত্র আমাত্য সবাই তখন নিজ আসন গ্রহণ করল।

          তারপর রাজা মন্ত্রীকে সম্বোধন করে' জিজ্ঞাসা করলেন-"মন্ত্রী রাজ্যের কুশল ত?"

        -"মহারাজ-"মন্ত্রীর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। মন্ত্রীর কথা কেড়ে নিয়ে সন্ন্যাসী উত্তর করলেন-"মহারাজ কুশল কোথায়? যেখানে রাতদিন ধরে মিথ্যার পূজো চলছে-আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত অনৃতের লীলা চলছে-সেইখানে কুশল? মরুভূমির তপ্ত বালি নিঙ্ড়িয়ে সলিল-বিন্দু মিলবে? বাসনার বহ্ণির মাঝে স্নিগ্ধতার আশা? বিষবৃক্ষ কি চন্দন তরু হয়? পঙ্কে ডুবে কি রত্ন আহরণ করা যায়? মহারাজ কুশল নেই-অনৃতের ধ্বংস না করতে পারলে কুশল নেই।"

           রাজসভা বিস্মিত হ'য়ে প্রায় রুদ্ধ-শ্বাসে সন্ন্যাসীর কথা শুনতে লাগল| কারো চোখে পলক পড়ল না| কে ইনি? মানুষ-না স্বয়ং ভগবান মনুষ্যদেহ ধারণ করে মর্তে এসেছেন।

           শুধু মন্ত্রী তাঁর মাথা-ভরা পাকা চুল হেলিয়ে স-সম্ভ্রমে সন্ন্যাসীকে সম্বোধন করে' বললেন -"মহাত্মন! আমি দার্শনিক নহি, সুতরাং যা আমি দর্শন করি তাকে অদৃশ্য বলে মানতে পারি নে| রাজকার্যে আমার চুল পেকে গেল, মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। মহাত্মন! সেই সাহসেই আজ আমি বলতে দ্বিধা করব না যে রাজ্যের কুশল"-তারপর রাজার দিকে ফিরে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন-"মহারাজ রাজ্যের সর্বত্র কুশল। রাজ্যে অপর্যাপ্ত শস্য উৎপন্ন হয়েছে, প্রজাদের ঘরে ঘরে প্রচুর অন্ন, রাজা জীবনগুপ্তের নামাঙ্কিত পতাকা উড়িয়ে বাণিজ্যতরণীর বহর পৃথিবীর সপ্ত-সমুদ্রের তরঙ্গমালার পরিচয় নিচ্ছে, শিল্পকলার নব নব সৃষ্টিতে সমাজের মনের সৌন্দর্যের ও প্রাণের সজীবতার চিহ্ণ ফুটে উঠেছে, সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞানের আলোচনায় সমাজ-জীবন সম্পদশালী উদার হ'য়ে উঠেছে| মাহারাজ! দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত আনন্দময়| নরনারীর প্রাণের আনন্দে রাজ্যের আকাশ বাতাস আকুলিত| সেই আনন্দই ত উন্নত সৌধ-ঘেরা নগরীতে নগরীতে, পাখী-ডাকা ছায়ায় ঢাকা পল্লীতে পল্লীতে পুলক ছড়িয়ে আনন্দ-আলয় গড়ে তুলেছে - সেই আনন্দের আলো লেগেই ত বৃক্ষবাটিকায় তরুশ্রেণী সতেজ হ'য়ে আকাশের পানে আপনাদের মাথা নির্ভয়ে তুলে দেয়, সেই আনন্দেই ত সহস্র কল্লোলিনী সহজ গতি-ভঙ্গিমায় পৃথিবীর বুক কেটে কেটে শ্যামল ক্ষেতে আপনার স্নেহরস অপর্যাপ্ত করে' বিলিয়ে সাগরাভিসারিকা। মহারাজ! রাজ্যের সর্বত্র কুশল। রাজরাজেশ্বর জীবনগুপ্তের রাজ্যে সারা বর্ষ ধরে বসন্তোৎসব চলছে।"

           সন্ন্যাসী ব্যথিত কণ্ঠে বললেন-"মহারাজ, মহারাজ! আমরা কেবলই জাল বুনছি-উর্ণনাভের মত আমাদের অন্তর থেকে আকাঙ্ক্ষার সূক্ষ্ম সুতো বের করে' কেবলই স্বপ্নের জাল বুনছি| তারই উপরে আবার অজ্ঞানের তুলি চালিয়ে হাওয়ার মত অদৃশ্য রঙ দিয়ে আকাশকুসুম আঁকছি-এর শেষ কোথায় মহারাজ? কিসে এর সমাপ্তি মহারাজ? এর শেষ অমৃতে নয়-বিষে, আনন্দে নয়-হতাশায়, হাসিতে নয়-অশ্রুতে; মহারাজ! এর শেষ সংবাদ মৃত্যু| মহারাজ, ইলেকট্রনের মায়া ধ্বংস করতে না পারলে অমৃতের সাক্ষাৎ মিলবে না।"

           মন্ত্রী বিনীত কণ্ঠে বললেন-"মহাত্মন! এর শেষ সংবাদ মৃত্যু হোক্, কিন্তু সেই মৃত্যুকেই বড় করে দেখব কেন? আমার বয়েস আশী পেরিয়ে গেছে, হয়ত কাল মৃত্যু হবে| মৃত্যুর পরপারে কি আছে?-হয় অনন্ত জীবন, নয় বিরাট শূন্য; কিন্তু আমার ঐ আশী বৎসরের জীবনকে ছোট করে' এক মুহূর্তের মৃত্যুকেই বড় করে' দেখব কেন? অনন্ত কালের কোলে আশী বছরও যে আমি ছিলেম এইটেই যে আমার গৌরব।"
সন্ন্যাসী মন্ত্রীর কথা শেষ হতে না হতেই বলে উঠলেন-"কে ছিল, কি ছিল মন্ত্রী?-ছিল শুধু স্বপ্নের বোনা সূক্ষ্ম জাল - ছিল শুধু আকাঙ্ক্ষার বোনা স্থূল জঞ্জাল - ছিল না, যা চরম ও পরম, যা অক্ষয় ও অব্যয়, যা অবিনশ্বর ও ঈশ্বর"-কথা বলতে বলতে সন্ন্যাসী আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন| তাঁর চোখ দু'টি উৎসাহে উদ্দীপিত হয়ে উঠল, তাঁর মুখমণ্ডল অনিন্দ সুন্দর জ্যোতিতে মণ্ডিত হ'য়ে গেল। আজানুলম্বিত দুই বাহু তুলে সমস্ত রাজসভার দিকে তাঁর মহত্তোজ্জ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে' উচ্চৈস্বরে বলে উঠলেন-"বল একবার ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা।" তাঁর সে কণ্ঠস্বরে সভামণ্ডপের বিরাট কক্ষ গুম্ গুম্ করে' উঠল, দ্বারে দ্বারে সদ্যফোটা ফুলের মালা সব কেঁপে উঠল, রাজছত্রের সোনার ঝালর নড়ে উঠল, চন্দ্রাতপের চুনি পান্নার চুম্কি সব ছল্ ছল্ করে' উঠল, আর রাজমুকুটের মধ্যমণি মহামরকতটা যেন নিঃশব্দে একটুকু হেসে উঠল, রাজসভার কেউ সন্ন্যাসীর জ্যোতির্মণ্ডিত মুখমণ্ডলের দিক থেকে আর চোখ ফিরাতে পারলে না-যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত সমস্ত রাজসভা সমস্বরে ধ্বনি করে' উঠল-"ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা"।

          সন্ন্যাসী রাজ-সিংহাসনের দিকে ফিরে রাজাকে সম্বোধন করে' বললেন-"মহারাজ! আমি আপনার রাজ্যে ধর্ম প্রচার করতে চাই, আপনার প্রজাবৃন্দকে সত্যের পথে অমৃতের পথে অমরত্বের পথে নিয়ে যেতে চাই-অনুমতি দিন।"

          রাজা মন্ত্রীকে সম্বোধন করে' বললেন-"মন্ত্রী, শিপ্রানদীর তীরে সন্ন্যাসীর জন্য বৃহৎ মঠ নির্মিত হোক্| আর রাজকোষ থেকে পঞ্চাশ সহস্র মুদ্রা সন্ন্যাসীকে দক্ষিণা দেওয়া হোক্।"
পক্ককেশাবৃত মস্তক অবনত করে মন্ত্রী বললেন-"যে আজ্ঞা মহারাজ।"

( ৩ )

          শিপ্রা অশ্রান্ত গতিতে ছুটে চলেছে। সারা দিনমানে তার অস্থির বুক রোদে চিক্মিক্-চাঁদনীরাতে তার তরল হৃদয় জ্যোছ্নায় ঝিক্ ঝিক্, দিন নেই, রাত নেই, শিপ্রা কলকল ছলছল করে' গান গেয়ে গেয়ে ব'য়ে চলেছে। স্তব্ধ দুপুর বেলা যখন তমালতালীর বনে বনে প্রাণ-উদাসকরা ঘুঘুর ডাক থেকে জেগে ওঠে, ত্খন সেই নিস্তব্ধতার মাঝে শিপ্রার দু'তীরের ঘন দেবদারু বনেরা মাথা হেলিয়ে শিপ্রাকে বুঝি জিজ্ঞেস করে-ওগো শিপ্রা, তুমি গান গেয়ে কোথায় চলেছ?-আর শিপ্রা তার উত্তর দেয়-

                  গান গাহিয়া চল্ছি আমি সেই দেশেতে যেথায় গো
             আকাশ গায়ে সাগর শুয়ে উর্মিমালায় খেলায় গো,
             অসীম নভে অগাধ জল
             করছে সদাই ছল ছল
             চলছি আমি সেই দেশেতে গান গেয়ে মোর বীণায় গো।

                   চলছি আমি সেই দেশেতে দুল্তে সুনীল দোলাতে
             আমি অন্তিমেতে পারব খেলায় ভুলাতে
             আমার গীতি আমার গান,
             স্নিগ্ধ করি হৃদয় প্রাণ
             গগন তলে সিন্ধুবুকে পারব কোথায় মিলাতে।

                   আমি সেই সুনীলে যেথায় সবই পুলক গো
             গভীর জলের শান্তশীতল অসীম নভের আলোক গো,
             আলোক যেথায় পুলক যেথায়
             শব্দ যত স্তব্ধ যেথায়
             লব্ধ যেথায় গল্প গীতে এই নিখিলের চালক গো।

                   গানটি আমায় শিখিয়েছে বিশ্বপতির করুণা
             এই গানেতেই ধরিত্রী ও রাত্রি দিবস মগনা
             সুরু গানে সাঙ্গ গানে
             সৃজন লীলার রঙ্গ গানে
             এই গানই গো সজ্জা মহীর নইলে মহী নগনা।

                   ওই গানেতে উঠ্বে জাগি আছিস্ যারা ঘুমায়ে
             মুক্তিবিহীন মর্মহীনের ধর্মখানি জড়ায়ে,
             বদ্ধ হয়ে রুদ্ধ ঘরে
             মলিন মুখে আঁখির 'পরে
             অবিশ্বাসীর হাস্যটুকু দিবস যামি ছড়ায়ে।

                    উঠ্রে জাগি আলোর মাঝে জীবন পথের আনন্দে,
             মর্মতলের দেবতা সেই মোহন মধু সু-ছন্দে,
             নৃত্যে তারি তালে তালে
             হাস্যে তারি ছল ছলে,
             উঠ্বে জাগি লাস্যে তারি বর্ণে গীতে গন্ধে।

                   উঠ্রে জাগি উষায় যখন রক্ত রবি কিরণে,
             পৃথ্বী তলের দূর্বারাশি জড়ায় হিরণ বরণে,
             উঠ্রে জাগি ক্লান্ত সাঁঝে
             দিনটি যখন রক্ত সাজে
             অন্ধকারে ধরে যখন লুটায় মহীর চরণে।

                  উঠ্রে জাগি জীবন পথে উঠ্রে জাগি মরণে,
              উঠ্রে জাগি মিলতে হবে বিশ্বপতির চরণে,
              উঠ্রে জাগি-ছুট্তে হবে
              উঠ্রে জাগি-লুটতে হবে
              শিপ্রা যেমন রঙ্গে নাচি' লুটায় সাগর-চরণে।

      এমনি করে' শিপ্রা ছুটে চলেছে-লক্ষ পল্লীকে ঘিরে ঘিরে, হাজার নগর নগরীকে বেড়ে বেড়ে নেচে নেচে দুলে দুলে ফুলে ফুলে ফেনা ছড়িয়ে ছড়িয়ে জঞ্জাল কুড়িয়ে কুড়িয়ে অক্লান্ত গতিতে ব'য়ে ব'য়ে চলেছে-আপন প্রাণের স্নিগ্ধতা কোমলতা শীতলতা অপর্যাপ্ত স্নেহরস ধরিত্রীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে এমনি করেই শিপ্রা সাগরাভিসারিকা| সেই শিপ্রারই তীরে এক বিরাট মঠ নির্মিত হল-রাজ-আজ্ঞায়-সন্ন্যাসীর জন্য।
বর্ষা শেষ হ'য়ে গেল।সস শরতের সোনার রঙ জগৎ ভরে' ফুটে উঠল| সন্ন্যাসী তাঁর মঠে যাবার জন্যে রাজপুরী ত্যাগ করে' রাজপথে বেরুলেন। রাজপথে অগণ্য লোকের সারি চলেছে-রাজপথের পাশে পাশে অসংখ্য দোকানে বেচা কেনা চলছে। সন্ন্যাসীকে যে দেখল সেই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। পথিক পথ ভুলে গেল-দোকানে ক্রেতা বিক্রেতারা বেচা কেনা ভুলল-নাগরিকদের গৃহে গৃহে বদ্ধ জানালা সব খুলে গেল-তা দিয়ে অসংখ্য কুলাঙ্গনারা পলকহীন চোখে সন্ন্যাসীকে দেখতে লাগল| কত কিশোরী তাঁকে মনে মনে পতিত্বে বরণ করল-কত প্রৌঢ়া বৃদ্ধা তাঁকে পুত্র বলে বাঞ্ছা করল-সন্ন্যাসীর কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই-তিনি সোজা চলেছেন আপনার গন্তব্য স্থানে| সবাই জিজ্ঞেস করে-কে ইনি? মানুষের মুখে মুখে কথার রঙ চড়ে| কেমন করে' রটে গেল যে কিছু দিন আগে স্বয়ং মহাদেব রাজাকে স্বপ্নে দেখা দেন-দেখা দিয়ে বলেন যে তিনি শীঘ্র মনুষ্য দেহ ধারণ করে' তার রাজ্যে উপস্থিত হবেন-এই সন্ন্যাসীই সেই মহাদেব। সন্ন্যাসী মঠে পৌঁছিতে না পৌঁছিতে মঠের চারদিক লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল-সেদিন দিন ফুরুতে না ফুরুতেই সন্ন্যাসী লক্ষ শিষ্য করলেন-মঠের চূড়া থেকে এক প্রকাণ্ড গৈরিক পতাকা উড়ল| বাতাসে সেই গৈরিক পতাকা সারা দিনমানে পত্ পত্ করে' উড়ে উড়ে যেন বলতে লাগল-"মি-ত্থ্যা"-"মি-তথ্যা"।

       সন্ন্যাসীর লক্ষ শিষ্য পঙ্গপালের মত সমস্ত শাকদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ল-ধর্ম প্রচারের জন্যে| ধনীর অট্টালিকায়, বণিকের বাণিজ্যালয়ে, গৃহস্তের গৃহে, দরিদ্রের কুটিরে ধ্বনিত হ'য়ে উঠল-"ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা।" নগর নগরীর কোলাহলের মাঝে, শান্ত পল্লীর নীরবতার মাঝে, সবুজ বনের শ্যামলতার মাঝে কেবল ঐ রব ধ্বনিত হতে লাগল-"ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা|" শাকদ্বীপের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত যেন গৈরিক হয়ে উঠল-রোদের রঙ যেন গৈরিক রেণুতে ভরে উঠল-বাতাস যেন গৈরিক গন্ধে পূর্ণ হ'য়ে গেল-নীল আকাশ যেন গৈরিক রাগিণীতে ধ্বনিত হয়ে উঠল-"ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা"। ওরে কি আছে?-কিছুই নেই, আমি নেই, তুমি নেই, জগৎ নেই-কিছুই নেই| ওরে এসব কিসের জন্যে-এই পরিশ্রম, এই কর্ম এই ভোগ? থামাও থামাও সব মূর্খের দল যদি মঙ্গল চাও। এমনি করেই দিন কাটতে লাগল| দিনে দিনে মাস কাটল-মাসে মাসে বছর কাটল-বছরে বছরে কত বছর কেটে গেল-ধীরে ধীরে নর নারীর প্রাণের অস্থি শিথিল হ'য়ে এল-ক্রমে ক্রমে জীবনের অমৃত স্বাদহীন হ'যে উঠল-এ সৃষ্টির শব্দ গন্ধ রূপ রস অর্থহীন বোঝা হ'য়ে পড়ল-ধনীর ভোগসামার্থ্য লয় পেয়ে গেল-মানুষের কর্মসামর্থ্যে বাজ পড়ল-বণিকের বাণিজ্যালয় বিশৃঙ্খলায় ভরে' উঠল-কৃষকের লাঙ্গলের মুঠো ঢিলে হ'য়ে পড়ল| সবার মুখেই ঐ এক বাণী-জগৎ মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা| কত কত ধনীর অট্টালিকায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হ'ল-কত কত বণিকের বাণিজ্য তরনী বিনা ঝড়ে মারা পড়ল-কত কত গৃহস্থের বাসস্থান অমনি অমনি জ্বলে উঠল-ক্ষেতে ক্ষেতে হালের বলদ অমনি অমনি মারা পড়ল| মানুষের অস্বীকারে সব অকৃতার্থ হ'য়ে উঠল| মন্ত্রী গিয়ে রাজসমীপে নিবেদন করলেন-"মহারাজ রাজ্যের ভীষণ অমঙ্গল উপস্থিত| দুর্ভিক্ষ আসন্ন।"

       "দুর্ভিক্ষ আসন্ন? সে কি মন্ত্রী! দুর্ভিক্ষ আসন্ন! আমার রাজ্যে-যে রাজ্যে প্রতি বৎসর তিন বৎসরের উপযুক্ত শষ্য উৎপন্ন হয়-সেই রাজ্যে দুর্ভিক্ষ! মন্ত্রী, আপনার ভুল হ'য়ে থাকবে-আপনার অবসর গ্রহণের কাল উপস্থিত বুঝি।"

       দুঃখের হাসি হেসে মন্ত্রী উত্তর দিলেন-"আমার ভুল হয়নি-আমি সত্য সংবাদই রাজ সমীপে নিবেদন করছি| রাজ্যে প্রকৃতই দুর্ভিক্ষ আসন্ন। দেশের নর নারীরা জীবনে আস্থা হারিয়েছে, জীবনের আনন্দকে তাড়িয়েছে| কৃষক আর তেমন উৎসাহে তেমন করে, লাঙ্গল ধরে না-তার লাঙ্গলের মুঠো শ্লথ হ'য়ে আসে,মাতা ধারিত্রীকে আর সে তেমন চোখে দেখে না, সে আজ তার কাছে প্রাণহীন অস্তিত্বহীন, এই অবজ্ঞার বিনিময়ে সে আগে যে শস্য পেত তার দশমাংশের এক অংশ পায়, বাণিজ্যের শিল্পের অবনতি ঘটেছে, বণিকের চোখে এ জগৎটা তার কারাগার, অসুখের জায়গা অমঙ্গলের স্থান, তার বাণিজ্য-তরণী আজ কেবল কাঠের ভেলা, তার মধ্যে মানুষের প্রাণ নেই মন নেই আনন্দ নেই| বণিকের প্রাণের পুলকে আজ সপ্তসিন্ধুর তরঙ্গমালা কল্ কল্ ছল্ ছল্ করে না, তাঁর জীবনের অবজ্ঞায় তার বিশাল বুক আজ ফুলে ফুলে উঠেছে, তার কল্ কল্ ছল্ ছল্ অট্টহাসিতে পরিণত হয়েছে, তাই তার বাণিজ্য-তরণী বিনা ঝড়ে মারা পড়ে| দার্শনিকেরা সূর্যের আলোকে নাকচ করে' দিয়ে অমাবস্যার অন্ধকারের বুক চিরে স্বর্গের জ্যোতি ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টায় ব্যস্ত| সাহিত্যে কেবল পরলোকে বাঁচবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, মহারাজ-"

         রাজা বিচলিত হলেন, মন্ত্রীর কথা শেষ না হতেই বললেন,"মন্ত্রী আমি পরিদর্শনে বের হব, প্রস্তুত হও।"
       রাজা ও মন্ত্রী দু'জনে ছদ্মবেশে রাজপুরীর গুপ্তদ্বার দিয়ে রাজপথে বেরিয়ে পড়লেন|
       রাজা ও মন্ত্রী রাজপথে ধরে' চলতে লাগলেন| রাজপথের দু'ধারে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তায় নরনারী চলছে| সব যেন লক্ষ্মীহীন শ্রীহীন। রাস্তার দু'ধারের সৌধমালার ভিতর থেকে যেন একটা নিঃশব্দ ক্রন্দনের রোল ঘুরে ঘুরে উঠে আকাশে মিশে যাচ্ছে, নর-নারীরা সব যেন অর্ধমৃত, তাদের সে উৎসাহদীপ্ত আনন নেই, তড়িতোজ্জ্বল চোখ নেই, যেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে আপনাদের নিরেট দেহটাকে বোঝার মত ব'য়ে নিয়ে চলেছে আর ভাবছে কবে এর হাত থেকে উদ্ধার পাবে| দোকানে দোকানে বেচা কেনা চলছে, যেন কলের দোকানে কলের মানুষেরা কলের সাহায্যে হাত পা নাড়ছে, চারদিক মৃত্যুর ছায়াতে সব কদর্য হ'য়ে উঠেছে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অট্টালিকা-যেন তার মধ্যে বাস করছে সব “মম্নি"রা, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাণিজ্যালয়-যেন সেখানে বসে' রয়েছে সব প্রেতাত্মারা, বাহির থেকে সেই সবই আছে, নেই কেবল সেই ভিতরের প্রাণের তড়িৎ-যে তড়িতের স্পর্শে সব সুন্দর হ'য়ে উঠবে সার্থক হ'য়ে উঠবে, অর্থপূর্ণ হ'য়ে উঠবে| রাজা সব দেখলেন, তাঁর চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হ'য়ে এল| রাজা রাজধানী ছাড়িয়ে জনপদ ছাড়িয়ে পল্লীতে প্রবেশ করলেন।

       রাজা দেখলেন পল্লীর সে চোখ-জুড়োন চেহারা আর নেই| পত্রবহুল বৃক্ষরাশি যেন সব কৃপণ হ'য়ে উঠেছে, যা নেহাৎ না হলে নয় সেই কটা পাতা গায়ে জড়িয়ে তারা কঙ্কালের মত ডাল মেলে দিয়ে জড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে, ক্ষেতে ক্ষেতে আর সে শ্যামল শোভা আপনার মায়া বিস্তার করে হাসে না| দীঘির জলে আর মরাল মরালীরা সে আনন্দে সাঁতার কাটে না, পল্লী-আকাশ আর তেমন শিশুদের হাস্য কলরবে মুখরতি হয়ে ওঠে না, স্তব্ধ দুপুরে ছায়ায় ঢাকা বটগাছের তলে আর রাখাল বালকের বাঁশীতে তেমন সুর ফোটে না-আর সে পল্লীদেবালয়ে সান্ধ্য আরতির কাঁশর বেজে ওঠে না| ভরা-জ্যোছনায় আর সে ঠাকুরমায়ের মুখে রূপকথার স্বপ্নের জাল বোনা নেই, সে সাধ আহ্লাদ সুখ সম্পদ যেন কোন্ এক যাদুকরের মায়া প্রভাবে কোথায় অদৃশ্য হ'য়ে গেছে| দূর্বাবিরল মাঠে মাঠে হাড় বের-করা গাভীর দল প্রাণপণে তাদের আহার্য আদায় করবার চেষ্টায় ধুঁকছে, পল্লীপাশ দিয়ে শীর্ণা নদী দীনা ভিখারিণীর মত থেমে থেমে জিরিয়ে জিরিয়ে আপনার প্রাণহীনতার পরিচয় দিয়ে দিয়ে অস্ফুট ক্রন্দনে চলছে| রাজা যেখানেই যান সেখানেই কেবল শোনেন-"ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। কি হবে রে ভাই মিথ্যার জঞ্জাল বাড়িয়ে কোনরকমে দুটো দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই ভাল।" রাজা সব দেখলেন, সব শুনলেন, তারপর মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন-"মন্ত্রী এ পরিবর্তনের কারণ কি?"

        মন্ত্রী উত্তর দিলেন-"মহারাজ! মানুষ ধরিত্রীকে অস্বীকার করেছে, নিজেও তাই নিরর্থক হয়ে উঠছে| মানুষের প্রাণহীনতায় তার চতুষ্পার্শ্বের প্রকৃতি নির্জীব আনন্দহীন হ'য়ে উঠেছে, মহারাজ! ।আপনার জীবনের প্রতি মানুষ প্রেম হারিয়েছে তার বিনিময়ে সে লাভ করেছে কেবল মৃত্যু। এরা আজ মনে করতে শিখেছে যে ইহলোকের দুঃখ পরলোকের সুখ হ'য়ে দেখা দেবে, ইহলোকের অক্ষমতা পরলোকে সামর্থ্য হ'য়ে ফুটে উঠবে, এদের ধারণা মহারাজ, ইহলোকে নরক ভোগ করাই পরলোকে স্বর্গ লাভের সহজ ও সত্য উপায়।"

         রাজা বিরাট দুঃখের ভার বুকে করে' রাজপুরীতে ফিরে এলেন।

        ধীরে ধীরে রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল| অন্ন বস্ত্র অগ্নিমূল্য হ'য়ে উঠল| যেখানে এক টাকায় আট মণ চাল মিলত সেখানে আট টাকায় এক মণ চাল মেলে না। যেখানে তাঁতির বাড়িতে চার আনা পয়সা ফেলে দিয়ে এলে এক জোড়া কাপড় মিলত সেখানে চার টাকায় একখানা কাপড় পাওয়া যায় না| চারিদিকে হতাশা নিরাশা, কেবল হাহাকার। দেশের কত লোক একবেলা খেয়ে থাকল, কত লোক আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতে লাগল। আর কত লোক মরে গেল। কিন্তু দেশের এ দুর্দশা প্রাণে প্রাণে অনুভব করবারও শক্তি নেই-এমনি তারা প্রাণহীন। সবাই মনে করতে লাগল যে এ পৃথিবীর বুঝি এই রকমই ধারা| তখন দ্বিগুণ জোরে নরনারী-কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হতে লাগল "ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা"| এই মিথ্যার কাছ থেকে যত শীঘ্র বিদায় নেওয়া যায় ততই ত সুবিধা| ঘরে ঘরে আরও পরিধেয় বস্ত্র গেরুয়া রঙে রঙিন হ'য়ে উঠল।

  ( ৪ )

        এই রকম যখন শাকদ্বীপের অবস্থা তখন এ সংবাদ গুপ্তচর-মুখে জম্বুদ্বীপের রাজা হুনেশ্বরের কাছে গিয়ে পৌঁছিল।
     রাজা হুনেশ্বর সিংহাসনে বসে ছিলেন, সংবাদ শুনে একেবারে সিংহাসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। "কি বললে, কি বললে গুপ্তচর ? এই রকম অবস্থা ? জম্বুদ্বীপের রাজা হুনেশ্বর তার পিতা মুঘলেশ্বর, তার পিতা বাণেশ্বর, তার পিতা চণ্ডেশ্বর এমনি সাত পুরুষ ধরে শাকদ্বীপ জয় করবার চেষ্টা করেছে, আর বার বার পরাভূত হয়ে ফিরে এসেছে| আজ শাকদ্বীপের এইরকম অবস্থা! সেনাপতি, সাজাও সাজাও, সৈন্য সাজাও।" রাজা হুনেশ্বর সেনাপতিকে যুদ্ধ যাত্রার জন্যে সৈন্য সাজাতে আদেশ করলেন। তুরী ভেরী বেজে উঠল, অসি ঝন্ঝনা জেগে উঠল, বর্শাফলক চিকমিক করে' উঠল। পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য, দশ হাজার হাতি, বিশ হাজার ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে রাজা হুনেশ্বর শাকদ্বীপের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন।

        রাজা জীবনগুপ্ত খবর পেলেন, হুনেশ্বর আসছে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য দশ সহস্র হাতি বিশ সহস্র ঘোড়া নিয়ে শাকদ্বীপ জয় করতে মন্ত্রীকে ডেকে বললেন-"মন্ত্রী রাজ্যের নগরে নগরে পল্লীতে পল্লীতে পরোয়ানা জারি কর যে স্বদেশরক্ষার্থে আবার আজ অস্ত্র ধারণ করতে হবে, শাকদ্বীপের চিরশত্রু জম্বুদ্বীপের রাজা আজ সসৈন্যে আবার সমাগত। দেশের সমস্ত সমর্থ লোক সমবেত হোক, জম্বুরাজ আবার পরাজয়-পুরস্কার নিয়ে ফিরে যায়।"

       রাজ অনুচর ছুটল দিকে দিকে পরোয়ানা নিয়ে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে, দেশের যুবক দলকে আহ্বান করতে| রাজ অনুচরেরা সমস্ত নগর নগরীতে প্রত্যেক পল্লীতে পল্লীতে রাজার পরোয়ানা জারি করলে, রাজ-আহ্বান জানিয়ে দিলে, তার পর তারা এমনি এমনি রাজপুরীতে ফিরে এল, তাদের সঙ্গে কেউ এলো না।
সেনাপতি নিজে বেরুলেন-সমস্ত দেশবাসীকে ডেকে ডেকে বললেন, "স্বাধীনতা হরণের জন্যে শত্রু আগত, ওঠো জাগো, যার বাহুতে কিছুমাত্র বল আছে, ধমনীতে বিন্দুমাত্র শোণিত আছে, দস্যুর হাত থেকে দেশ রক্ষার্থে, দাসত্বের কবল থেকে স্বাধীনতা রক্ষার্থে, বেরিয়ে এসো অগন্য পল্লীর অসংখ্য কুটীর থেকে, সংখ্যাহীন নগরীর উচ্চ সৌধমালার ভিতর থেকে, অগণিত মানুষের দল, অদম্য অপরাজেয় অরিন্দম। সেনাপতির বাণী কারো প্রাণে কোন ঢেউ তুললে না, সে বাণী আকাশে অমনি মিশিয়ে গেল। সেনাপতি একাকী রাজপুরীতে ফিরে এলেন, সঙ্গে কেউ এলো না|

        রাজা নিজে বেরুলেন। তাঁর প্রজাদের সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, "এসো শাকদ্বীপের বীরের দল, আমাদের পিতৃপিতামহরা যেমন করে' জম্বুরাজগণকে, তাদের বাহিনীকে বার বার পরাজিত করে' পৃষ্ট করে' নষ্ট করে শাকদ্বীপের প্রত্যন্ত দেশ থেকেই বিতাড়িত করেছিলেন, তেমনি করে আজ আমরা হুনেশ্বর আর তার বিশাল চমূকে বিধ্বস্ত করে' তাড়িয়ে দেব। পরধনলোলুপ হুনেশ্বরের দু'চোখ আজ শাকদ্বীপে নির্মিত বর্শাফলকের তীক্ষ্ণতা পরীক্ষা করুক, তার সৈন্যেরা আজ শাকদ্বীপের বীরবৃন্দের তরবারীর ধার অনুভব করুক, এস বীরের দল, আর সময় নেই, শত্রু দ্বারে সমাগত।" রাজার কথা সবার এক কান দিয়ে প্রবেশ করে আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল| রাজা ফিরে এলেন, কেউ এল না।

        রাজা হুনেশ্বরের জয়ধ্বনি নিকট থেকে নিকটতর হ'তে লাগল| শাকদ্বীপের চারিদিকে কোথাও মৃদুকণ্ঠে কোথাও মৃতের কণ্ঠে, কেবল রব উঠতে লাগল-ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা|"

        রাজা হুনেশ্বর দ্রুতবেগে শাকদ্বীপের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হলেন, স্বচ্ছন্দ গতিতে, কোনখানে কোন বাধা নেই, কোথাও একখানি তরবারী তাঁর পথ আগলে বসে নেই, কোনখান থেকে একখানি বর্শা তাঁর সৈন্যের আরে এসে পড়ল না। রাজা জীবনগুপ্ত মাথায় করাঘাত করে' সিংহাসনে বসে পড়লেন। "কি হবে মন্ত্রী, কি হবে! আপন স্বাধীনতা রক্ষার্থে একটি লোক অগ্রসর হোল না| দেশরক্ষা কে করবে? লোক নেই। রাজকোষে কুবেরের ধন সঞ্চিত, কি হবে? লোক নেই| অস্ত্রাগারে অপর্যাপ্ত অস্ত্র মজুত, কি হবে? লোক নেই-লক্ষ সৈন্যের বর্ষব্যাপী রসদ্ মজুত, কি হবে? লোক নেই|" নিরাশয় রাজার চোখ ফেটে জল পড়তে লাগল।

        রাজা হুনেশ্বর সন্ধ্যার প্রাক্কালে রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। গৃহে গৃহে সমস্ত দরজা জানালা রুদ্ধ, রাজপথে পথে আর সেদিন বাতি জ্বলল না, একটি লোক চলল না, চারদিক স্তব্ধ মৃত্যুর মত নীরব, যেন কোন এক প্রেতপুরী| ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার গভীর কালো হ'য়ে উঠল, হুনেশ্বর তাঁর পঞ্চাশ হাজার সৈন্য দশ হাজার হাতি বিশ হাজার ঘোড়া নিয়ে এসে রাজপুরীর উত্তর দ্বারে হানা দিলেন, সেই সময় সেই আঁধারে রাজা জীবনগুপ্ত তাঁর সাত রাণীর হাত ধরে' চোখের জল মুছতে মুছতে দক্ষিণ দ্বার দিয়ে রাজপুরী ত্যাগ করে' গেলেন।

( ৫ )

         রাজা জীবনগুপ্তের সিংহাসনে রাজা হুনেশ্বর বসে'| রাজা গুপ্তচরকে আহ্বান করে' জিজ্ঞেস করলেন-"গুপ্তচর, প্রবল প্রতাপান্বিত এই শকজাতি, যাদের কত শতাব্দী ধরে আমার পূর্বপুরুষেরা জয় করতে পারেনি, সেই শকজতির আজ এ দশা কেন?

        গুপ্তচর বললে-"মহারাজ! এই রাজ্যে দশ বৎসর পূর্বে এক সন্ন্যাসী আসেন, তিনি প্রচার করেন যে, তিনি অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এই আবিষ্কার করেছেন যে এই জগতের কোন অস্তিত্ব নেই। সেই শিক্ষাকে অবলম্বন করে' শকজাতি এ জগৎটাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়ে আপনাদের আনন্দহীন প্রাণহীন করে' তুলছিল, তারই প্রতিশোধ এই দুর্দশা।"

       রাজা হুনেশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন-"সে সন্ন্যাসী এখন কোথায়?"

       গুপ্তচর উত্তর দিলে-"তিনি এখন শিপ্রাতীরে তাঁর মঠে অবস্থান করছেন।"

       রাজা বললেন-"তাঁকে আমার সমীপে নিয়ে এস।"

       সন্ন্যাসী রাজা হুনেশ্বরের সমীপে নীত হ'ল| রাজা হুনেশ্বর আপনার গলা থেকে বহুমূল্য মণিহার খুলে নিজ হাতে সন্ন্য্যাসীর গলায় পরিয়ে দিলেন| বললেন-"মহাত্মন, আমার পিতৃপিতামহরা সাত পুরুষ ধরে' অস্ত্র দিয়ে যা করতে পারেননি, আপনি এক পুরুষে শাস্ত্র দিয়ে তাই করেছেন, সম্রাট হুনেশ্বরের ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা ও এই যৎকিঞ্চিত উপহার গ্রহণ করে তাকে কৃতার্থ করুন।"

        তারপর সম্রাট তাঁর সেনাপতির দিকে চেয়ে বললেন-"সেনাপতি, সন্ন্যাসীকে আমার সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে রেখে আসবার ব্যবস্থা অবিলম্বে করা হোক, তার জন্যে এক মাস সময় দিলেম, সন্ন্যাসীকে জানিয়ে দেওয়া হোক, ঐ এক মাস পর থেকে তাঁকে কোন দিন আমার সাম্রাজ্যের সীমানায় দেখতে পেলে তাঁর প্রাণদণ্ড হবে।"

        সেনাপতি তরবারি কোশমুক্ত করে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন-"যে আজ্ঞা মহারাজ।"

                                    

সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী


             (‘সবুজপত্র’,আশ্বিন,১৩২৬ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।