রামধন
বাবু সামান্য গৃহস্থ। আজ কাল যে বাজার, তাহাতে কত শত বি-এ,
এমা্-এই জীবিকা নির্ব্বাহে অসমর্থ, তায় রামধন বাবুত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছায়া স্পর্শ করেন নাই। বাল্যকালে গৌরমোহন আঢ্যের স্কুলে চতুর্থ
শ্রেণী পর্য্যন্ত পড়িয়াছিলেন। নয়টা বাজিবার পূর্ব্বেই পিতার
রক্ত জল করিয়া সমাহৃত অন্ন ধ্বংস করিয়া বিদ্যালয়ে যাইতেন।
মধ্যাহ্ণে দু পয়সার জলখাবারও খাইতেন, ৪টার পর বাটীও ফিরিয়া
আসিতেন, কিন্তু পড়াশুনা কতদূর হইত, তাহা ঠিক জানা যাইত না।
ইতিপূর্ব্বেই রামধন বাবুর পিতা পিতৃকার্য্য করিয়া দিয়াছেন।
ছেলেকে লেখা পড়া শেখান ততটা আবশ্যক কিনা জানিনা, বিবাহটা দেওয়া
অবশ্য অবশ্য কর্ত্তব্য-"পিণ্ড লোপ হয়! কি কথা!!"
ক্রমে পিতৃদেবের পিণ্ডের প্রত্যাশাও হইল, কিন্তু পুত্র না
হইয়া একটী কন্যা হইল। তাহার তিন বত্সর পরে পিতৃদেবের আশাও
ফলবতী হইল। পৌত্র মহাশয় ক্রমে দিগম্বর মূর্ত্তি ধারণ করিয়া
ধূলিধূসরিত কলেবরে রাজপথ সুশোভিত করিতে লাগিলেন। রামধন আর
বাবাজীবনের "বার্ডসা্ আই" ক্রয় করিবার পয়সা যোগাইয়া
উঠিতে পারেন না। আজ গুণধর পুত্র ঘোষেদের ননীর লাঠিম কাড়িয়া
লইয়াছে, কাল বোসেদের শ্যামের ঘুড়ি ছিঁড়িয়া দিয়াছে,-নানা প্রকার
আর্জ্জি দাখিল হইতে লাগিল। সে সকলের খেসারতও রামধনকে দিতে
হইতে লাগিল। শিষ্টস্বভাব পুত্ররত্ন প্রাণান্তে ও অত্যাচারের
কথা স্বীকার করেন না, প্রত্যর্পণ দূরের কথা। মধ্যে মধ্যে "বক""বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ"
প্রভৃতি অঙ্গভঙ্গীসহ অমৃতায়মান বালকণ্ঠবিনিঃসৃত বচনপরম্পরা
শ্রবণ করিয়া তাঁহার শ্রবণ-বিবর পরিতৃপ্ত হইতে লাগিল।
ইতিপূর্ব্বেই
পিতৃদেব পৌত্রমুখ দর্শন করিয়া পিণ্ডলাভ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত
হইয়া পিণ্ড-প্রত্যাশায় অনন্তধামে গমন করিয়াছেন। অগত্যা রামধনের
চাকরী না করিলে আর দক্ষিণ হস্ত চালান সুকঠিন হইয়া উঠিল। যাহা
যত্কিঞ্চিত্ পৈতৃক সঞ্চিত অর্থ ছিল, পূর্ব্বপুরুষের পিণ্ডপ্রদাতা
শ্রীমানা্ বংশধর বাবাজীবনের আমোদ প্রমোদে ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে।
বহুকষ্টে আফিসে ৩০ ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরী হইল। চাকরী হইল,
পৈতৃক ঢিলে পায়জামা, ও চাপকান বাহির হইল, ৯টার পূর্ব্বে ভাতের
জন্য গৃহিণীর রাত্রে নিদ্রা বন্ধ হইল। মাসের পর মাস যাইতে
লাগিল, কিন্তু মাহিয়ানার টাকা কৈ? উকীল-বাটী নাকি মাসে মাসে
কেরাণীরা বেতন পায় না। এদিকে ধোপার পয়সা, ট্রামের পয়সার জন্য
বিব্রত হইতে হইল। রামধন বাবুর সৌভাগ্য, ছেলের লেখা পড়ার খরচ
নাই; বংশধর স্কুলে যান না। সে বড় কম খরচা নয়, বৃষোত্সর্গ
ব্যাপার। বত্সর বত্সর নূতন ধরণের কেতাব; অঙ্কের কেতাবও
বত্সর বত্সর, কোন বত্সরে বা দুই দফা নূতন নূতন চাই।
তার পর পাখার পয়সা, প্রশ্ন ছাপানর পয়সা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা
রকম ব্যয়। ভগবানের কৃপায় এবং শ্রীমানা্ বংশধরের কল্যাণে সে
সকল কোন কষ্টই কোন উত্পীড়নই রামধন বাবুকে সহ্য করিতে হইল
না। কিন্তু বার্ডসা্ আই, কামিজের হাতার ষ্ট্রাপ, হাফা্মোজার
টানা ইত্যাদির খরচা প্রায় স্কুলের খরচার সমান হইতে লাগিল।
অগত্যা, রামধন বাবু ঠিকা কাজ লইয়া সমস্ত রাত্রি লিখিয়া মধ্যে
মধ্যে দুই চারি টাকা উপার্জ্জন করিয়া অবশ্যকর্ত্তব্য পূর্ব্বোক্ত
ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন।
সুখে দুঃখে অনশনে অর্দ্ধাশনে, কোনরূপে দিন কাটিতেছিল, কিন্তু
আবার এক নূতন দায় উপস্থিত। কন্যাটীর বয়ঃক্রম দ্বাদশ উত্তীর্ণ
হইতে যায়। রামধন বাবুর পিতা সংকল্প করিয়াছেলেন পৌত্রীকে অষ্টম
বর্ষে পাত্রসাত্করণ জনিত গৌরীদানের ফল লাভ করিয়া বংশে অক্ষয়
কীর্ত্তিস্তম্ভ স্থাপন করিয়া যাইবেন। কিন্তু কালের কুটিল গতি
হঠাত্ দেহের নশ্বরতা প্রতিপাদিত করিয়া তাঁহার সে সাধে বাদ
সাধিয়াছে। রামধন বাবু নানা স্থানে পাত্র অপাত্র চেষ্টা করিয়াও
কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। যেখানে যান, পাত্র লেখা পড়ায়
ধনুর্ধর হউক আর নাই হউক, বিষয় আশয় থাকুক আর নাই থাকুক, এত
বেশী খাঁই করিয়া উঠে যে রামধন বাবু তত টাকা কখন একত্রে দেখেন
নাই অথবা কন্যার বিবাহে এত টাকা যে ব্যয় হয়, তাহাও তিনি বুঝিয়া
উঠিতে পারিলেন না। শেষে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া জাতিপাতের ভয়ে,
আত্মীয়বর্গের তাড়নায়, গৃহিণীর গঞ্জনায়, সমাজের শাসনে, মুন্সীগঞ্জের
হীরালাল দত্ত মহাশয়ের পুত্রের সহিত সম্বন্ধ স্থির করিলেন।
পাত্রটী রূপে শৈলসুতাসুতের ন্যায়। সকলেই রূপের কথা উঠিলে শৈলসুতাসুতের
সহিত উপমা দেয়। আমরাও চির প্রচলিত প্রথা পরিত্যাগ করিতে পারিলাম
না। তবে রামধন বাবুর ভাবী জামাতা, রামধন বাবুর পিতৃদেবের সংকল্পিত
গৌরীদানের গৌরীর গৌর কনিষ্ঠ না হইয়া জ্যেষ্ঠ শৈলসুতাসুত সদৃশ;-আর
কোন অঙ্গে তাদৃশ সৌসাদৃশ্য থাকুক আর নাই থাকুক উদর দেশটীতে
সম্পূর্ণ আছে। অলঙ্কার শাস্ত্রে বলে যাহার সহিত উপমা দেওয়া
যায়, বস্তুতঃ তাহা গুণে কিছু ন্যূন হয়। কিন্তু আমাদের এ উপমায়
অলঙ্কার শাস্ত্র পরাস্ত। যেহেতু জামাতার উদর শৈলসুতাসুত অপেক্ষা
কোন অংশেই ন্যূন নহে। বাবাজীবনের প্লীহা এত বৃদ্ধি পাইয়াছে
যে চিত্ হইয়া শয়ন করিতেও কষ্ট হয়। সর্ব্বঙ্গের মাংসগুলি
বোধ হয় একত্রিত হইয়া উদরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। বিদ্যার কথা আর
কি বলিব? মাতৃভাষায় নাম লিখিতেও লজ্জা বোধ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরীক্ষা দিয়া বি এ, এমা্ এ, উপাধি ত আজকাল হাড়ী, মুচি পাইতেছে;
সুতরাং এরূপ জঘন্য কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা অপমানের কথা। বয়ঃক্রম
৩৬ বত্সর ৫ মাস। বাবাজীর এটী তৃতীয় সংস্করণ, প্রথম দুইটী
সংস্করণই নিজ ভাগ্যবলে বিবাহের অব্যবহিত পরেই ভবলীলা সাঙ্গ
করিয়া চলিয়া গিয়াছে। রামধন বাবুর কন্যার বড়ই জোর কপাল, তাই
এহেন পাত্রের যোগাযোগ ঘটিয়া উঠিয়াছে।
দেনা পাওনা স্থির, বিবাহের দিন স্থির, সমস্তই স্থির। কিন্তু
বিধিলিপি খণ্ডন করে কার সাধ্য? শুভ গাত্রহরিদ্রার পূর্ব্ব
রাত্রে হীরালাল বাবুর পুত্রের জ্বর হইল। জ্বর পূর্ব্ব হইতেই
একটু একটু হইত কিন্তু তাহাতে স্নানাহার সহ্য হইত। বঙ্গদেশের
পল্লীগ্রামে স্নানাহার সহ্য হওয়ার কথাটা প্রায় শুনিতে পাওয়া
যায়। উত্থানশক্তি রহিত বা চৈতন্য রহিত না হইলে আর তাঁহাদের
মতে স্নানাহার অসহ্য হয় না। হীরালাল বাবুর পুত্রের সেই স্নানাহারসহিষ্ণু
জ্বর হইল। অগত্যা গাত্র হরিদ্রা বন্ধ হইল, এত ধূমধাম, এত আয়োজন
আপাততঃ বন্ধ হইল। তৃতীয় দিন মধ্যাহ্ণকালে রামধন বাবুর ভাবী
জামাতা পিতামাতার স্নেহবন্ধন ছিন্ন করিয়া ভাবিনী প্রণয়িনীর
আশা ভরসা অতলজলে ভাসাইয়া লীলা সম্বরণ করিলেন। হীরালাল বাবুর
বংশ লোপ হইল, পিণ্ড লোপ হইল। পিণ্ডের সম্ভাবনা কস্মিনা্ কালেই
ছিল না। তবে হীরালল বাবুর মনে আশা ছিল বটে; সে আশাটুকুও গেল।
এদিকে রামধন বাবুর মাথায়ও আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। বহুকষ্টে সন্ধান
করিয়া কন্যার বিবাহের পাত্র স্থির করিলেন। অদৃষ্ট দোষে বা
গুণে তাহাও ঘটিয়া উঠিল না। আবার গণ্ডূষ করিতে হইল। আবার স্থানে
স্থানে চেষ্টা হইতে লাগিল, কিন্তু সেই কথা।-রূপার ঘড়াসুটে
বাসন, চুড়িসুট ডায়মনকাটা সোণার গহনা ইত্যাদি ইত্যাদি। রামধন
বাবু উপায়ান্তর না দেখিয়া হাটখোলার রামসেবক মিত্রের পুত্রের
সহিত সম্বন্ধ স্থির করিলেন। রামসেবক বাবু চাকরি বাকরি করেন
না, আবশ্যকও নাই। পৈতৃক সম্পত্তি যথেষ্ট। দোল, দুর্গোত্সব
প্রভৃতি বার মাসে তের পার্ব্বণ সমস্তই করিয়া থাকেন। পুত্রটীও
রত্ন বিশেষ। কলিকাতার কোন বিখ্যাত কালেজে বি এ, পড়েন; সুবোধ,
শিষ্ট, সচ্চরিত্র, সুরূপ, সকলই "সু", এই "সু"ই
"কু"র কারণ হইয়া উঠিয়াছে। রামসেবক বাবুর গৃহিণী
রূপার ঘড়া না পাইলে কন্যাকে দুধে আলা্তার পাথরে দাঁড়াইতে
দিবেন না। অগত্যা রামধন বাবু সম্মত হইলেন। রামসেবক বর্ত্তমান
প্রথা মতে নগদ টাকা লইতে একেবারেই নারাজ। পাঁটা পাঁটি বিক্রয়ের
মত টাকা লওয়া কি? তবে ফুলশয্যা দিতে হইলে বৈবাহিক মহাশয়ের
বিস্তর ব্যয় হইবে। রামধন বাবু ছা-পোষা, বিশেষ কুটুম্ব হইতে
চলিলেন, তাঁহার স্বাশ্রয় করাও কর্ত্তব্য। আর এপক্ষেও ফুল শয্যার
তত্ত্ব লইয়া যে সকল লোক আসিবে, তাহাদের বিদায় এবং ভোজনা-দিতে
তাঁহারও বিস্তর ব্যয় হইবে। অথচ জিনিষ গুলি ত আর সম্ভ্রমের
দায়ে বাজারে বিক্রয় করিতে পারিবেন না-হতভাগা প্রতিবাসিবর্গকে
বণ্টন করিয়া দিতে হইবে। এরূপ কার্য্যে কোন পক্ষেই লাভ নাই।
অতএব ও সম্বন্ধে নগদ ৪০০ দেওয়াই স্থির হইল। সে টাকা ফুলশয্যার
দিনে দিতে হইবে। রামসেবক বাবু পূর্ব্বে লইবেন না। তাহা হইলে
যে শুক্রবিক্রয়ী হইয়া ধর্ম্মে পতিত হইতে হইবে? আহা কি ধার্ম্মিক!
এরূপ ধর্ম্মজ্ঞানসম্পন্ন ২।১ টা লোক আছে বলিয়াই এঘোর কলিযুগে
আজিও সোমবারের পর মঙ্গলবার হইতেছে, বৈশাখ মাসের পর জ্যৈষ্ঠ
মাস আসিতেছে, সূর্য্যের পর চন্দ্র উঠিতেছে।
যাহা হউক বিবাহের দিন স্থির হইল। ক্রমে দিন আসিল, বরপাত্র
সভায় বসিলেন। ৩।৪ শত বরযাত্রও আসিয়াছেন। ক্রমে সম্প্রদানের
সময় উপস্থিত হইল। রামধন বাবু গরদের জোড় পরিয়া সভাস্থ ব্রাহ্মণবর্গের
অনুমতি লইয়া কন্যা পাত্রস্থ করিলেন। বরকন্যা অন্তঃপুরে পাঠাইয়া
সভা মধ্যে গললগ্নীকৃতবাসে দাঁড়াইয়া কহিতে লাগিলেন, -"মহোদয়গণ,
আমার একটা দুঃখের কথা শুনুন। আমি অতি দরিদ্র। দুবেলা আহার
হয় না, অতি কষ্টে দিন পাত করি, তাহার উপর কন্যাদায়। হাতে পায়ে
ধরিতে ত্রুটি করি নাই। কিন্তু কাহারও দয়া হইল না। বুঝিলাম
এসংসার গরিবের নহে। এদিকে জাতিপাত হয়। অগত্যা রামসেবক বাবুর
পুত্রের সহিত বিবাহের স্থির করিলাম। এই যে রূপার ঘড়া গাড়ু
দেখিতেছেন, এগুলি ভাড়া করা। ঐ যে লোকটী দাঁড়ইয়া আছে দেখিতেছেন,
এদ্রব্য গুলি উহারই। এখনি এগুলি উঠাইয়া লইয়া যাইবে। খাট বিছানাও
তাই। কন্যার গাত্রে যে অলঙ্কার গুলি দেখিলেন, ওগুলি আমার প্রতিবাসিবর্গের।
কল্য প্রাতেই যাহার যে গহনা ফিরাইয়া লইবে। ইহাতে রামসেবক বাবু
অবশ্য আমার প্রতি একটু অসন্তুষ্ট হইবেন, হয়ত আমার কন্যা আর
আমার বাটী পাঠাইবেন না। তাহাতে আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নহি।
যেহেতু আমার বাটী থাকিলে ত মাসের অর্দ্ধেক দিন উপবাস করিতে
হইবে। তবে আমার একমাত্র দুঃখ ক্ষোভ কষ্ট অপমানের বিষয় এই যে
এতগুলি ভদ্রলোক অনুগ্রহ করিয়া আমার বাটী পদধূলি দিয়াছেন, আর
আমি এমনি হতভাগ্য যে ইঁহাদিগকে একটু মিষ্টমুখ করাইতে পারিলাম
না। হা আমার অদৃষ্ট! যাহা হউক সমস্ত দিন উপবাসে ও এই বৃহত্
কার্য্যের আয়োজনে আমার শরীর আজ বড়ই ক্লান্ত। এমন অনুমতি হয়
ত বাটীর মধ্যে যাই, জল খাইগে।"
রামধন বাবুর কথা শুনিয়া সকলেই নির্ব্বাকা্, নিষ্পন্দ! রামসেবক
বাবু চৈতন্যহীন!
নৃত্যগোপাল
কবিরত্ন
(
'দাসী' পত্রিকা জুলাই, ১৯৮৫ )