পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
তিব্বত্দেশীয়
মনুষ্যদিগের আচার ব্যবহার
[
লেখকের নাম পাওয়া যায় নি| মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে|
বর্তমান প্রবন্ধে ব্যবহৃত ভাষা বিশেষত অপেক্ষাকৃত তরুণ পাঠকদের
স্বাচ্ছন্দ বোধের অভাব ঘটাতে পারে| তবে দেড়শ বছর আগে ব্যবহৃত
ভাষা ও রচনা শৈলী বা বিষয় বস্তু নির্বাচন বর্তমানের প্রেক্ষিতে
অন্যরকম হবে সেটাই স্বাভাবিক| তবু যারা ভাষার বিবর্তনের স্বাদ
পেতে চান তাদের এ ধরণের রচনা ভাল লাগবে বলে মনে হয়| ]
দীপক
সেনগুপ্ত |
পূর্ব্বে
বিবিধার্থে তিব্বতদেশ-নিবাসিনী স্ত্রীদিগের মুখবিন্যাসের প্রথা
বর্ণন করা গিয়াছে, অধুনা উক্ত দেশীয় পুরুষদিগের আচার-ব্যবহার-বিষয়ক
কিঞ্চিৎ প্রকাশিতব্য|
হিমালয়ের উত্তর-পার্শ্বস্থ এক অধিত্যকার নাম তিব্বত্দেশ| ঐ দেশ
সর্ব্বদা অত্যন্ত শীতল থাকে; এই প্রযুক্ত তদ্দেশীয় ধনী দরিদ্র
সকলকেই আপাদ মস্তক সর্ব্বাঙ্গ লোমজ অনেক বস্ত্রদ্বারা আবৃত করিয়া
রাখিতে হয়| ধনী ব্যক্তিদিগের পক্ষে পসম দেওয়া সাটান বস্ত্রই
শীত-নিবারণের প্রধান উপায়, তদ্ভিন্ন-ব্যক্তির উর্ণা বস্ত্র ও
লোমবিশিষ্ট মেষচর্ম্ম ব্যতিরেক আর গতি নাই, এবং গৃহহইতে বহির্দ্দেশে
যাইতে হইলেই অন্য উপানহ্ ব্যবহার না করিয়া "বুট" অবলম্বন
করিতে হয়|
শীতের সময়ে তাহাদের মধ্যে প্রায় কেহই গাত্র-মুখাদি-প্রক্ষালন
করে না; ইহাতে তাহারা এই কারণ দর্শায়, যে ঐ কালে দৈবাৎ মুখ-কপোলাদির
কোন স্থানে জল স্পৃষ্ট হইলে তৎক্ষণাৎ ক্ষত হইবার সম্ভাবনা|
ইহা অনায়াসেই অনুভূত হইতে পারে, যে দেশের লোকেরা সমস্ত শীতকালে
স্নান করে না, এবং মুখধুইতেও অনিচ্ছুক তাহারা বস্ত্রাদির প্রক্ষালনে
তাদৃশ যত্নবান্ হইবেক না; ফলতঃ তাহাদিগের দেহাচ্ছাদন বস্ত্রাদি
অত্যন্ত মলিন| অপর, দেশব্যবহারবশতঃ তদ্দেশীয় লোকেরা শুষ্ক মাংস,
চা ও তদুপযোগি পাত্রাদি, ছুরী, কাঁটা, লবণ, গেঁজে প্রভৃতি যে
কোন দ্রব্য সঙ্গে লইয়া যাইবার আবশ্যক হয়, তৎসমুদায় স্ব স্ব বক্ষোদেশে
ঐ আবরণ-বস্ত্রের মধ্যে রাখে; সুতরাং ঐ মলিনতা ঘটিবার সম্পূর্ণ
কারণ বর্ত্তমান আছে| তিব্বত্দেশীয়েরা বক্ষোদেশে এত দ্রব্যাদি
রাখে, যে ঐ স্থান তাহাদিগের ভাণ্ডার বলিলে বলা যায়|
যে দেশে বর্ষের ছয় মাস মুখ প্রক্ষালন করিবার রীতি নাই, এবং সলোম
মেষচর্ম্মই প্রধান পরিধেয়, তথায় সাবান বহুমূল্যে বিক্রীত হইবে,
ইহা আশ্চর্য্য নহে; পরন্তু তদ্দেশে যে সকল চীনের লোক বসতি করে,
তাহাদিগের ব্যবহারার্থে কাশ্মীর ও নেপালহইতেই সাবান্ উক্ত দেশে
প্রেরিত হয়| সিকিমদেশহইতে যাহা যায় তাহা অত্যল্প| প্রস্তাবিত
দেশে বস্ত্রাদি পরিষ্কারার্থে সাবানের বড় অপেক্ষা রাখে না; তথায়
এক রকম ঘাস জন্মিয়া থাকে, তদ্দ্বারাই উক্ত কর্ম্ম নিষ্পন্ন হয়|
তিব্বত্দেশীয়দিগের বাহন চামরী গোই প্রসিদ্ধ| কি স্ত্রী কি পুরুষ
সকলে অশ্বারোহণের ন্যায় তদুপরি আরোহণ করে, এবং তৎকালে তাহাদের
বেশভূষা ও চড়িবার রীতি দেখিয়া কেহই স্ত্রীপুরুষের কিঞ্চিত্মাত্র
ভেদ অনুমাণ করিতে পারে না|
উক্ত হইয়াছে, যে তিব্বত্ দেশের মনুষ্যেরা অত্যন্ত অপরিষ্কৃত,
কিন্তু তথাকার স্থান তেমত নহে, তত্রত্য কি সহর, কি পল্লীগ্রাম,
সকল স্থান অতিসাবধানে পরিষ্কৃত রাখা হয়, কুত্রাপি কিঞ্চিৎ মাত্র
মলা থাকিবার সম্ভাবনা নাই| নগরস্থ মল সঞ্চয় করিয়া রাখিবার নিমিত্ত
প্রত্যেক লোকের বাটীতে এক এক পায়খানা আছে, এবং লোকে তথাকার মল
অতিপ্রযত্নে রাখিয়া থাকে| কেহ কেহবা চৌয্যের ভয়ে প্রহরিদ্বারা
তাহা রক্ষা করিয়া থাকে| তদ্দেশে শীতের প্রাধান্যতাপ্রযুক্ত অতি
অল্প বৃক্ষাদি জন্মে, সুতরাং রন্ধনের নিমিত্ত সকলকেই ঘুঁটিয়ার
অবলম্বন করিতে হয়; দেশের সমস্ত পশুর মল জ্বালাইবার নিমিত্তই
ব্যবহৃত হয়; সার প্রস্তুত করিতে কিছুই পাওয়া যায় না; তদর্থে
মনুষ্যের মল একমাত্র উপায়| অপর কোন কোন স্থানে ঐ মলে শোরা ও
প্রস্তুত হইয়া থাকে| এই প্রয়োজনানুরোপে তদ্দেশীয় লোকে মলকে প্রায়ঃ
মলজ্ঞান করে না| মলপরিষ্কারকেরা কুদ্দালাদি অস্ত্রের অবলম্বন
না করিয়া হস্তদ্বারাই উক্ত মল উত্তোলন করে, এবং পায়খানা পরিষ্কার
করিতে করিতে অনায়াসে সেই অধৌত হস্তে চা মাংসাদি পান ভক্ষণ করে|
অপর, চাল ডাল প্রভৃতি বাণিজ্য দ্রব্যের ন্যায় তত্রত্য সকলেই
ঐ মল বিক্রীত করিয়া অর্থোপার্জ্জন করিয়া থাকে; দেশের রাজাও সময়ে
সময়ে মল বিক্রয়দ্বারা ধন সঞ্চয় করেন| অধিকন্তু অন্যান্য বাণিজ্য
দ্রব্যের গুণভেদে যে প্রকার মূল্যের তারতম্য হয়, মল-বিক্রয়ে
ও তদ্রুপ নিয়ম আছে| তদনুসারে ইতর দীনব্যক্তির মলাপেক্ষায় ধনবান্
মান্য ব্যক্তির মল অধিক মূল্যে বিক্রীত হইয়া থাকে| মনুষ্যের
মূত্রও উত্তম-সারের মধ্যে গণ্য, সুতরাং তিব্বত দেশে তাহার ও
গ্রাহক অনেক আছে|
তিব্বত্ দেশীয় মনুষ্যেরা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী, এবং সেই ধর্ম্মের
প্রধান কর্ত্তব্য আমিষ-ত্যাগ; অথচ তিব্বতীয়েরা অত্যন্ত মাংসাশী|
লামা নামক ধর্ম্মযাজক ভিন্ন সকলেই মেষাদির মাংস ভক্ষণ করিয়া
থাকে, এবং অনেকে আনমাংস রৌদ্রে শুষ্ক করিয়া ভক্ষণ করে| দরিদ্র-লোক-মাত্রেই
কিয়ৎ-পরিমিত শুষ্ক আনমাংস আপন আপন বক্ষোদেশে রাখিয়া থাকে, এবং
আবশ্যক মতে ঐ সাধারণ ভাণ্ডারহইতে বাহির করিয়া লবণাদির নিরবলম্বনে
ভক্ষণ করে| অন্নের পরিবর্ত্তে শক্তুই তথাকার প্রধান খাদ্য; তাহা
"সাম্পা" নামে প্রসিদ্ধ, এবং দেশের অর্দ্ধেক লোক ঐ
সাম্পার অবলম্বনে দেহ-রক্ষা করে| কখন কেহ তণ্ডুল পাইলে তাহার
পিষ্টক বানাইয়া খায়; অন্ন পাক করিয়া খাইবার কুত্রাপি প্রথা নাই|
পানীয় দ্রব্যের মধ্যে চা এবং আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই প্রত্যস্থ
৪-৫ বার করিয়া তাহা পান করিয়া থাকে|
উক্ত দেশে শবসংস্কারের প্রথা অতি আশ্চর্য্য| তথায় সমাধি বা দাহ
করিবার রীতি নাই; তৎপরিবর্ত্তে কোন ব্যক্তি মৃত হইলে তাহাকে
পর্ব্বতাদি সদৃশ উচ্চ স্থানে রাখিয়া দেয়, যাহাতে নির্ব্বিঘ্নে
শকুণি প্রভৃতি পক্ষিগণ তাহার মাংস ভক্ষণ করিতে পারে, এই রীতি
পারসি-দিগের শব সংস্কারের নিয়মের সহিত তুল্য হয়| তাহারা প্রাচীর
বেষ্টিত সমাধি-স্থানে শব ফেলিয়া রাখে, এবং কালক্রমে মাংসাদি
পশু পক্ষিদ্বারা ভুক্ত ও গলিত হইলে অস্থিগুলি এক কুপ মধ্যে নিক্ষেপ
করে| যে ব্যক্তিরা তিব্বত-দেশীয় শব লইয়া পর্ব্বতাদি উচ্চ স্থানে
রাখে, তাহাদিগের দেশ-প্রসিদ্ধ নাম "রাগাতংদেন্"; তাহারা
স্বতন্ত্র দলে বিভক্ত| স্বপ্রিয় ব্যক্তিদিগের শবকে ভক্ষণ করাইবার
নিমিত্তে ঐ শ্মশানবাসিরা কতকগুলি কুক্কুর প্রতিপালন করিয়া থাকে|
ভিক্ষাই তাহাদিগের প্রধান উপজীবিকা| যখন তাহারা কোন ধনী ব্যক্তির
নিকট যাচিত বস্তু প্রাপ্ত না হয়, তখন ক্রোধপূর্ব্বক কহে, "আচ্ছা
এখন আমাদিগকে কিছু না দেও; কখন না কখন আমাদের হাতে পড়িতে হইবে;
তখন তোমার পায়ে দড়ি বান্ধিয়া পথে পথে টানিয়া বেড়াইব, এবং তোমার
শরীর কুক্কুরদিগকে খাওয়াইয়া দিব"| বস্তুত দীন ব্যক্তির
মৃতদেহের সর্ব্বদা ঐ রূপ গতি হইয়া থাকে| ধনবান্ ব্যক্তি মৃত
হইলে তাহার দেহকে উক্ত শব-বাহকেরা পর্ব্বতের উপরে লইয়া গিয়া
তাহার অস্থি ও মাংস পৃথক্ করিয়া অস্থি-সকল চূর্ণ এবং মাংস খণ্ড
খণ্ড করিয়া সমস্ত একত্র করত তন্নিকটে কিঞ্চিৎ পত্র জ্বালাইয়া
দেয়, তাহার ধুম দৃষ্টে বহু সঙ্খ্যক শকুণী-জাতীয় পক্ষিরা আসিয়া
চূর্ণ অস্থি ও মাংস সমস্ত ভক্ষণ করে|
[ 'বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ' , ১৭৭৬ শকাব্দ (১৮৫৪/৫৫
খ্রীষ্টাব্দ), ফাল্গুন সংখ্যা ] |
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)