প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

         
 অরবিন্দ-প্রসঙ্গ
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

        [ লেখক পরিচিতি : উপেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জুন ফরাসী অধিকৃত চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায়| চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করে মেডিকেল কলেজে চিকিৎষাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে প্রবেশ করেন কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য পাঠ শেষ করতে পারেন নি| পরে কলকাতার ডাফ কলেজে বি.এ. পাঠরত অবস্থাতেই হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তিনি বিপ্লবী দলে যোগ দিতে মনস্থ করেন| ভদ্রেশ্বরে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন| ১৯০৫-০৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগে তিনি 'যুগান্তর' ও 'বন্দে মাতরম' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন| পরে বিপ্লবী বারীন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে 'যুগান্তর' পত্রিকার সম্পাদনার কাজও করেছেন| এর পরই তিনি বিপ্লবী দলে যোগদান করেন| ১৯০৮-এর ৩০শে এপ্রিল প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম দাস মজফ্রপুরের জজ কিংস্ফোর্ডকে হত্য করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন| এর দু'দিন পরে ২রা মে পুলিশ ৩২ মুরারিপুকুর রোডস্থ বারীন্দ্রনাথের মানিকতলার বাগানবাড়ী থেকে উপেন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করে| অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উল্লসকর দত্ত, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কানাইলাল দত্ত, দেবব্রত বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল প্রভৃতি| ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই মে বিচারে উপেন্দ্রনাথের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয় এবং তিনি আন্দামানে নির্বাসিত হন| ১২ বছর পর মুক্তিলাভ করে, বিপ্লবীদের কারাবাস থেকে মুক্তির দাবীতে তিনি 'বিজলী' পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করেন| এই সময় তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সংস্পর্শে আসেন এবং তার 'নারায়ণ' পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন| ইতিমধ্যে অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তার অজ্ঞাতবাস থেকে আত্মপ্রকাশ করেন এবং তারই উদ্যোগ ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে সাপ্তাহিক 'আত্মশক্তি' পত্রিকা প্রকাশিতে হয় এবং উপেন্দ্রনাথ তার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন| রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্য এই সময়ে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সংস্পর্শেও আসেন| বহুবাজারের চেরী প্রেস থেকে তখন 'আত্মশক্তি' প্রকাশিত হত; সেখান থেকেই স্বরাজ দলের মুখপত্র বাংলা দৈনিক 'স্বদেশ' প্রকাশিত হতে থাকে (১৯২৩-এর ৯ই সেপ্টেম্বর)| 'স্বদেশ' প্রকাশনার কাজে উপেন্দ্রনাথ যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন| কিন্তু ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে সেপ্টেম্বর বৃটিশ সরকার আবার তাকে ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩ ধারায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে| ১৯২৬-এ মুক্ত হয়ে তিনি সাংবাদিকতার কাজে যোগ দেন| 'ফরোয়ার্ড', 'লিবার্টি', 'অমৃতবাজার পত্রিকা' প্রভৃতির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন| ১৯৪৫-এর এপ্রিল মাস থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি 'দৈনিক বসুমতী' সম্পাদনা করেছেন| শেষ জীবনে হিন্দু মহাসভার আদর্শের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন| ১৯৪৯-এর অগাষ্ট থেকে ১৯৫০-এর মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সভাপতির পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন|
          উপেন্দ্রনাথের প্রকাশিত গ্রন্থ : 'নির্বাসিতের আত্মকথা' (১৯২১) ; ঊনপঞ্চাশী' (১৯২২) ; 'পথের সন্ধান' (১৯২৮) ; 'বর্তমান সমস্যা' (১৩২৮) ; 'স্বাধীন মানুষ' ; 'জাতের বিড়ম্বনা' (১৩২৮) ; 'ধর্ম ও কর্ম' (১৩২৯) ; 'অনন্তানন্দের পত্র' ; 'বর্তমান জগত' ; 'Memoirs of a Revolutionary ইত্যাদি| 'অনন্তানন্দ ব্রহ্মচারী' ও 'পঞ্চানন্দ' ছদ্মনামেও তিনি লিখতেন| হাস্যরসসিক্ত ও সরস রচনা পরিবেশনে তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন| ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল তিনি পরলোক গমন করেন| ]
                                                                         দীপক সেনগুপ্ত|

( ১ )

         ১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে যখন প্রথম 'বন্দে-মাতরম্' কার্য্যালয়ে আসি তখন অরবিন্দ বাবু ম্যালেরিয়ার জ্বালায় দেওঘরে পলাতক| তাঁহার সম্বন্ধে বন্ধু বান্ধবদের নিকট হইতে অনেক গল্পই শুনিয়াছিলাম| বরোদায় ৮০০ টাকা বেতনের চাকরী ছাড়িয়া তিনি ১৫০ টাকা বেতনে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যাপক হইয়া আসিয়াছেন শুনিয়া আমি বিস্ময়ে একটা এ-ত বড় হাঁ করিয়া ফেলিয়াছিলাম| ঐ টাকায় তাঁহার সংসার খরচ কি করিয়া চলিবে জিজ্ঞাসা করায় তিনি হিসাব করিয়া দেখাইয়া দিয়াছিলেন যে মা, বোন, ভাই প্রভৃতি সকলকে মাসিক খরচ দিয়াও তাঁহার নিজের জন্য ১০ টাকা বাকি থাকে| বস্ আবার কি চাই?

         তাঁহার পাণ্ডিত্য ও ত্যাগের কথা শুনিয়া ত আগে হইতেই মুগ্ধ হইয়াছিলাম; তাহার পর তাঁহার লেখা পড়িয়া একেবারে কাৎ হইয়া পড়িলাম| উঃ, সে কি ভাষা! - যেন আরবী ঘোড়ার জুড়ী একেবারে বুকের উপর দিয়া বগ্ বগ্ করিয়া ছুটিয়াছে! পড়িতে পড়িতে মনে একটা অদ্ভুত রকমের নেশা জমিয়া উঠিত| তাঁহাকে দেখিবার জন্য ভারি কৌতূহল হইত| দেশ বিদেশের জানা অজানা সমস্ত বড়লোকের ছবি মিলাইয়া মনে মনে তাঁহার একটা ছবিও আঁকাইয়া রাখিয়াছিলাম|

          ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে একদিন অফিসে গিয়া শুনিলাম কংগ্রেস উপলক্ষে অরবিন্দ বাবু কলিকাতায় আসিয়াছেন; আর শুধু তাই নয়-পাশের ঘরে তিনি সশরীরে বর্ত্তমান! বুকটা ধড়াশ করিয়া উঠিল| আস্তে আস্তে গিয়া দরজার কাছে উঁকি মারিয়া দেখিলাম-কৈ, কোথায় অরবিন্দ? আমার একজন সহকর্মী কোণের এক চেয়ারে উপবিষ্ট কাঠের মত আড়ষ্ট একটি মূর্ত্তির দিকে দেখাইয়া দিলেন|

          ব্যোম ভোলানাথ! এই অরবিন্দ! মা ধরিত্রি, দ্বিধা হও, মা| ঐ রোগা, কালো, সিড়িঙ্গে ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট প্রাণী-ঐ অরবিন্দ? ঐ আমাদের Chief? তার চেয়ে শ্যামসুন্দর বাবু ত ছিলেন ভাল| তিনি বেঁটে বটেন, তবু তাঁহার বেশ প্রমাণসই দাড়ী আছে| হেমেন্দ্র বাবুরও বেশ গোলগাল নধর ভদ্রলোকের মত চেহারা| কিন্তু এ কি!
মনটা প্রায় দমিয়া গিয়াছিল, এমন সময় সেই কাষ্ঠমূর্ত্তি ঘুরিয়া আমার দিকে চাহিলেন| সে চাহনির যে কি বিশেষণ দিব তাহা খুঁজিয়া পাইতেছি না| কালোতারার আশেপাশে একটা কৌতুকপ্রিয় তরলতা মাখান ছিল, কিন্তু ঐ তারার মাঝখানে এমন একটা কি অতলস্পর্শ ভাব ছিল যাহা আজও বিশ্লেষণ করিয়া উঠিতে পারি নাই|

         বছর কতক আগে আমরা কয়জন বন্ধু মিলিয়া একবার বালিগঞ্জে শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের কাছে মাথা দেখাইতে গিয়াছিলাম| জ্যোতিরিন্দ্র বাবু আমার মাথার গঠন দেখিয়া বলিয়াছিলেন যে লোকের মুখ দেখিয়া তাহাদের চরিত্র অনুমান করিবার ক্ষমতা আমার অসাধারণ| সেই অবধি আমার মনে মনে বেশ একটু গুমর ছিল যে লোক দেখিয়া চিনিয়া লইবার আমি একজন ওস্তাদ| কিন্তু আজ অরবিন্দ বাবুর কাছে আমার সে ওস্তাদি ব্যর্থ হইল|
কাহারও কাহারও ভিতরের কথা যেন মুখের উপর লেখা থাকে| ১৮৯৮ সালে বেলুড়মঠে একবার স্বামী বিবেকানন্দকে দেখিয়াছিলাম| তখন আমি বঙ্গবাসী দলের খাঁটী গোঁড়া ব্রাহ্মণ| স্বামীজীর অসাধারণ বাগ্মিতার কথা কাগজে পড়িয়াছিলাম; আমেরিকায় তাঁহার দিগ্বিজয়ের কথা ভাবিয়া যথেষ্ট গর্ব্ব ও অনুভব করিতাম| কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি যখন কলিকাতার বক্তৃতায় বাংলার ব্রাহ্মণদের উপর আক্রমণ করিয়াছিলেন, তখন মনে মনে তাঁহার উপর বেশ একটু চটিয়াছিলাম| বেলুড় মঠে যখন তাঁহাকে প্রথমে দেখিলাম, তখন তাঁহার পায়ে মোজা ও জুতা ও হাতে থেলো হুঁকা| একে সন্ন্যাসী জাতিতে কায়স্থ, আবার তাহার উপর এই অশাস্ত্রীয় পোষাক| কাজেই ব্রাহ্মণ-সুলভ রাগে আমার টিকিটা বিদ্রোহের মত খাড়া হইয়া উঠিয়াছিল| কিন্তু আমার ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার ভেদ করিয়া এ জ্ঞানও সঙ্গে সঙ্গে ফুটিয়া উঠিয়াছিল যে ভগবানের স্বহস্তপ্রদত্ত রাজটীকা ইহার ললাটে দেদীপ্যমান| দিব্য প্রতিভা ইঁহার মুখে, চোখে, কথায় বার্ত্তায়, ভাবে ভঙ্গীতে যেন ফুটিয়া উঠিতেছে|
অরবিন্দের মুখে তেমন রাজশ্রী তখনও ফুটিয়া উঠে নাই| অরবিন্দ বর্ণচোরা আম; বাহির দেখিয়া তাঁহার ভিতর বুঝিবার জো নাই|

( ২ )

           ১৯০৭ সালের বসন্তকালে তিনি দেওঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া পাকাপাকিভাবে 'বন্দে মাতরমের' ভার লইলেন| আলাদা বাসা আর করা হইল না; তিনি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে সুবোধ বাবুর বাড়ীতে বাস করিতে লাগিলেন| ঘর সংসার করা আর তাঁহার অদৃষ্টে জুটিল না|

         আগে 'বন্দেমাতরম্' অফিসের কেহ কেহ নিয়ম বা শৃঙ্খলার বড় একটা ধার ধারিতেন না| সম্পাদকীয় প্রবন্ধ শ্যামসুন্দর বাবু লিখিতেন; কিন্তু প্রবন্ধ লিখিবার inspiration তাঁহার উপর কখন যে ভর করিবে তাহার কিছুই স্থিরতা ছিল না| একদিন হয়ত এক কাপ চা খাইতে না খাইতেই inspiration আসিয়া গেল; আর কোন কোন দিন বা চায়ের উপর তিন চার ছিলিম তামাক পোড়াইয়াও inspiration আসিল না| কাজে কাজেই প্রিণ্টার বেচারার সময় মত কাগজ বাহির করা কঠিন হইয়া পড়িত| অরবিন্দ বাবু আসিবার পর সে দুঃখ ঘুচিল| তিনি সুবোধ বাবুর বাড়ী হইতেই প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাইয়া দিতেন| অফিসে বড় একটা আসিতেন না, আর আসিলেও কাহারও সহিত বেশী কথাবার্ত্তা কহিতেন না| একে তিনি অত্যন্ত অল্পভাষী লোক; তাহার উপর বাংলা-চল্তি ভাষার উপর খুব বেশী দখল ছিল না বলিয়া বোধ হয় সকলের সহিত কথাবার্ত্তা কহিবার সুবিধাও তাঁহার হইত না| তাঁহার বাংলা উচ্চারণ অনেকটা সাহেবী ধরণের ছিল বলিয়া আমরা তাঁহার আড়ালে খুব হাসাহাসি করিতাম| কিন্তু চল্তি ভাষার উপর দখল না থাকিলেও তিনি সাধুভাষা বেশ লিখিতে পারিতেন|

         তাঁহার মত এমন অসাধারণ একাগ্রচিত্ত লোক আর দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না| সুবোধ বাবুর বাড়ীতে লোক জনের ভিড় প্রায়ই লাগিয়া থাকিত| কেহ গল্প জুড়িয়া দিয়াছে, কেহ অট্টহাস্য করিতেছে, কেহ বা তর্ক লাগাইয়াছে; আর তাহাদের মাঝখানে বসিয়া তিনি নির্ব্বিকার ভাবে লিখিতেছেন বা পড়িতেছেন| কোন দিকে ভ্রুক্ষেপও নাই|

         রাশভারি লোক বলিয়া তাঁহার সহ-কর্ম্মীরা তাঁহাকে ভয়ও করিত, ভক্তিও করিত| তাঁহার কথার কোনরূপ প্রতিবাদ তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না| কাজকর্ম্মের কোনরূপ গোলমাল দেখিলে বিরক্ত হইয়া চুপ করিয়া থাকিতেন; আর যখন খুব বেশী রাগিয়া যাইতেন, তখন তাঁহার ঠোঁট একটু কাঁপিত| তাঁহার আশপাশের লোকেরা সেই সময় প্রমোদ গণিত|

         বিনয় বাবু নামে আমাদের একজন সহকারী সম্পাদক ছিলেন| একাধারে এত গুণ এই কলিযুগে খুব কম লোকেরই দেখিতে পাওয়া যায়| সুবোধ বাবুর স্ত্রী যখন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন, তখন এই বিনয় বাবুটী তাঁহার চিকিৎসা করিতে আসিয়াছিলেন| একে যক্ষ্মারোগ, তাহার উপর বিনয় বাবুর চিকিৎসা, সুতরাং রোগী অল্প দিনের মধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করিয়া রোগ ও চিকিৎসার দায় এড়াইলেন| কিন্তু ইতিমধ্যে বিনয় বাবু কথকতা করিয়া, আ্যাকটিং শুনাইয়া ও সং দেখাইয়া বাড়ীর বৃদ্ধামহলে এমনি পশার জমাইয়া লইয়াছিলেন যে তাঁহাকে একটা কোন কাজকর্ম্ম দিয়া আটকাইয়া রাখিবার জন্য নানাস্থান হইতে সুপারিশ আসিতে লাগিল| কাজেই তিনি 'বন্দে মাতরম্' আফিসের একজন Maid-of-all-work হইয়া দাঁড়াইলেন| রাত্রে প্রুফ দেখিবার ভার একদিন তাঁহার উপর পড়িল| অরবিন্দ বাবুর প্রবন্ধের মধ্যে একটা কথা ছিল-churchianity| বিনয় বাবু বেচারা churchianity-র ধার ধারেন না; কাজেই তিনি নিঃসংশয়চিত্তে ঐ লম্বা চৌড়া কথাটাকে কাটিয়া শুদ্ধ করিয়া লিখিয়া দিলেন - christianity, সকাল বেলা কাগজ পড়িয়াই অরবিন্দ বাবু দেখিলেন কোন্ পণ্ডিত তাঁহার লেখার উপর কলম চালাইয়াছে| খোঁজ করিয়া দেখা গেল যে ঐ সংশোধন কার্য্যটা শ্রীমান বিনয় বাবুর কৃত| অরবিন্দ বাবুর এজলাসে তাঁহার ডাক পড়িল| বিনয় বাবু হাত জোড় করিয়া বলিলেন-"কি করবো, মশাই! দোষ আমার নয়; দোষ ইউনিভার্সিটির| আমি এক গাদা বই পড়ে বি, এ পাশ করেছি, কিন্তু কোথাও churchianity কথাটার দেখা পাই নি"|-বক্তৃতাটা আরও কতক্ষণ চলিত বলা যায় না| হঠাৎ অরবিন্দ বাবুর ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিল| বিনয় বাবু বেগতিক দেখিয়া প্রাণ লইয়া সেখান হইতে চোঁচা দৌড় দিলেন|

( ৩ )

        কথাবার্ত্তায় ও মেজাজে অনেকটা সাহেবী ধরণের হইলেও পোষাক-পরিচ্ছেদে ও আচার-ব্যবহারে অরবিন্দ একেবারে খাঁটি বাঙ্গালীর মত| ধুতি চাদর ও চটিজুতাই তাঁহার সম্বল ছিল| ঘরের আসবাবের মধ্যে শুইবার একখানি খাট ও টেবিলের উপর ছড়ান একগাদা বই| কোনরূপ বাবুয়ানি তাঁহার ভিতর দেখি নাই| পয়সা কড়ির দিকে নজর কস্মিন্ কালেও ছিল না| বরোদায় থাকিবার সময় একবার হঠাৎ বাক্স খুলিয়া দেখিলেন যে প্রায় দুই হাজার টাকা জমিয়া গিয়াছে| যতক্ষণ পর্য্যন্ত না সে টাকাটা খরচ হইয়া গেল ততক্ষণ পর্য্যন্ত তিনি স্বস্তি বোধ করেন নাই|
পূর্ব্ব জন্মের সংস্কার কিনা জানি না, কিন্তু সাহেবিয়ানার মধ্যে লালিত পালিত হওয়া সত্ত্বেও হিঁদুয়ানীর উপর তাহার খুব একটা শ্রদ্ধা ছিল| বরোদায় থাকিবার সময় কে একজন সাধু তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে তাঁহার উপর রাজকোপ হইবে; এবং তাহা খণ্ডনের জন্য তাঁহাকে সোণার বগলামূর্ত্তি গড়াইয়া পূজা করিতে বলিয়াছিলেন| অরবিন্দ বাবু সেই অবধি বহুদিন পর্য্যন্ত এক পায়ে দাঁড়াইয়া বগলামন্ত্র জপ করিতেন| টেবিলের প্রেত নামান, প্ল্যানচেট্ ধরা ও Automatic writing করার বাতিকও অরবিন্দ বাবুর খুব প্রবল ছিল| ধর্ম্ম-বিষয়ে তাঁহার মতামত শুনিয়া অনেক সময় তাঁহাকে শিশুর মত সরলবিশ্বাসী বলিয়া মনে হইত|

        ১৯০৭ সালের সুরাট কংগ্রেস হইতে ফিরিবার পথে বিষ্ণু ভাস্কর লেলে নামক একজন মহারাষ্ট্রীয় সাধকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়, ও তাঁহার নিকট হইতে অরবিন্দ বাবু দীক্ষা গ্রহণ করেন| সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি সুবোধ বাবুর বাড়ী ছাড়িয়া আলাদা বাসায় বাস করিতে লাগিলেন| ধর্ম্ম সাধনায় তাঁহার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হইতে লাগিল| অফিসে তাঁহার সহকারীদের উপর হুকম দিলেন-'কাগজে কাহাকেও গালি দিতে পারিবে না| হেমেন্দ্র বাবু ত হুকুম শুনিয়া গালে হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন| খবরের কাগজ হইতে যদি গালাগালিটুকুই বাদ গেল তাহা হইলে আর বাকি রহিল কি?

        সাধনের জন্য এই সময় অরবিন্দ বাবু আহারাদি বিষয়ে কঠির সংযম অভ্যাস করিতেন| নুন, লঙ্কা ত নিষিদ্ধই ছিল; ভাতের সঙ্গে ডাল বা তরকারী পর্য্যন্ত খাইতেন না| ভাত, দুধ ও ফলমূল খাইবার ব্যব্স্থা ছিল; তবে অধিকাংশ দিনই দুধ জুটিত না| দেশে একটা প্রবল ধর্ম্মভাব না জাগিলে যে রাজনৈতিক বিপ্লব সফল হইবে না, এই মতবাদ তিনি এই সময় হইতে প্রচার করিতে আরম্ভ করেন| এই সময়ের কথা উল্লেখ করিয়া অরবিন্দ বাবু জেলে একদিন বলিয়াছিলেন-"ভগবান আমায় জেলে নিয়ে এসে বাঁচিয়ে দিয়েছেন| চারদিকের টানাটানিতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলুম| বাইরে একদিকে টানছিল ন্যাশনাল কলেজ, আর একদিকে টানছিল 'বন্দে মাতরম', আর ভিতরে একদিকে টানছিল বারীন, আর একদিকে টানছিল বৌ| জেলে এসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি|"

         তাঁহার জীবনের গতি এই সময় হইতে নূতন দিকে ফিরিল|

( ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকা শ্রাবণ, ১৩২৯ )

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।