(
১ )
১৯০৬
সালের অক্টোবর মাসে যখন প্রথম 'বন্দে-মাতরম্' কার্য্যালয়ে
আসি তখন অরবিন্দ বাবু ম্যালেরিয়ার জ্বালায় দেওঘরে পলাতক|
তাঁহার সম্বন্ধে বন্ধু বান্ধবদের নিকট হইতে অনেক গল্পই
শুনিয়াছিলাম| বরোদায় ৮০০ টাকা বেতনের চাকরী ছাড়িয়া তিনি
১৫০ টাকা বেতনে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যাপক হইয়া আসিয়াছেন
শুনিয়া আমি বিস্ময়ে একটা এ-ত বড় হাঁ করিয়া ফেলিয়াছিলাম|
ঐ টাকায় তাঁহার সংসার খরচ কি করিয়া চলিবে জিজ্ঞাসা করায়
তিনি হিসাব করিয়া দেখাইয়া দিয়াছিলেন যে মা, বোন, ভাই প্রভৃতি
সকলকে মাসিক খরচ দিয়াও তাঁহার নিজের জন্য ১০ টাকা বাকি
থাকে| বস্ আবার কি চাই?
তাঁহার পাণ্ডিত্য ও ত্যাগের কথা শুনিয়া ত আগে হইতেই মুগ্ধ
হইয়াছিলাম; তাহার পর তাঁহার লেখা পড়িয়া একেবারে কাৎ হইয়া
পড়িলাম| উঃ, সে কি ভাষা! - যেন আরবী ঘোড়ার জুড়ী একেবারে
বুকের উপর দিয়া বগ্ বগ্ করিয়া ছুটিয়াছে! পড়িতে পড়িতে মনে
একটা অদ্ভুত রকমের নেশা জমিয়া উঠিত| তাঁহাকে দেখিবার জন্য
ভারি কৌতূহল হইত| দেশ বিদেশের জানা অজানা সমস্ত বড়লোকের
ছবি মিলাইয়া মনে মনে তাঁহার একটা ছবিও আঁকাইয়া রাখিয়াছিলাম|
১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে একদিন অফিসে গিয়া শুনিলাম কংগ্রেস
উপলক্ষে অরবিন্দ বাবু কলিকাতায় আসিয়াছেন; আর শুধু তাই
নয়-পাশের ঘরে তিনি সশরীরে বর্ত্তমান! বুকটা ধড়াশ করিয়া
উঠিল| আস্তে আস্তে গিয়া দরজার কাছে উঁকি মারিয়া দেখিলাম-কৈ,
কোথায় অরবিন্দ? আমার একজন সহকর্মী কোণের এক চেয়ারে উপবিষ্ট
কাঠের মত আড়ষ্ট একটি মূর্ত্তির দিকে দেখাইয়া দিলেন|
ব্যোম ভোলানাথ! এই অরবিন্দ! মা ধরিত্রি, দ্বিধা হও, মা|
ঐ রোগা, কালো, সিড়িঙ্গে ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট প্রাণী-ঐ অরবিন্দ?
ঐ আমাদের Chief? তার চেয়ে শ্যামসুন্দর বাবু ত ছিলেন ভাল|
তিনি বেঁটে বটেন, তবু তাঁহার বেশ প্রমাণসই দাড়ী আছে| হেমেন্দ্র
বাবুরও বেশ গোলগাল নধর ভদ্রলোকের মত চেহারা| কিন্তু এ
কি!
মনটা প্রায় দমিয়া গিয়াছিল, এমন সময় সেই কাষ্ঠমূর্ত্তি
ঘুরিয়া আমার দিকে চাহিলেন| সে চাহনির যে কি বিশেষণ দিব
তাহা খুঁজিয়া পাইতেছি না| কালোতারার আশেপাশে একটা কৌতুকপ্রিয়
তরলতা মাখান ছিল, কিন্তু ঐ তারার মাঝখানে এমন একটা কি
অতলস্পর্শ ভাব ছিল যাহা আজও বিশ্লেষণ করিয়া উঠিতে পারি
নাই|
বছর কতক আগে আমরা কয়জন বন্ধু মিলিয়া একবার বালিগঞ্জে শ্রীযুক্ত
জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের কাছে মাথা দেখাইতে গিয়াছিলাম| জ্যোতিরিন্দ্র
বাবু আমার মাথার গঠন দেখিয়া বলিয়াছিলেন যে লোকের মুখ দেখিয়া
তাহাদের চরিত্র অনুমান করিবার ক্ষমতা আমার অসাধারণ| সেই
অবধি আমার মনে মনে বেশ একটু গুমর ছিল যে লোক দেখিয়া চিনিয়া
লইবার আমি একজন ওস্তাদ| কিন্তু আজ অরবিন্দ বাবুর কাছে
আমার সে ওস্তাদি ব্যর্থ হইল|
কাহারও কাহারও ভিতরের কথা যেন মুখের উপর লেখা থাকে| ১৮৯৮
সালে বেলুড়মঠে একবার স্বামী বিবেকানন্দকে দেখিয়াছিলাম|
তখন আমি বঙ্গবাসী দলের খাঁটী গোঁড়া ব্রাহ্মণ| স্বামীজীর
অসাধারণ বাগ্মিতার কথা কাগজে পড়িয়াছিলাম; আমেরিকায় তাঁহার
দিগ্বিজয়ের কথা ভাবিয়া যথেষ্ট গর্ব্ব ও অনুভব করিতাম|
কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি যখন কলিকাতার বক্তৃতায় বাংলার
ব্রাহ্মণদের উপর আক্রমণ করিয়াছিলেন, তখন মনে মনে তাঁহার
উপর বেশ একটু চটিয়াছিলাম| বেলুড় মঠে যখন তাঁহাকে প্রথমে
দেখিলাম, তখন তাঁহার পায়ে মোজা ও জুতা ও হাতে থেলো হুঁকা|
একে সন্ন্যাসী জাতিতে কায়স্থ, আবার তাহার উপর এই অশাস্ত্রীয়
পোষাক| কাজেই ব্রাহ্মণ-সুলভ রাগে আমার টিকিটা বিদ্রোহের
মত খাড়া হইয়া উঠিয়াছিল| কিন্তু আমার ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার
ভেদ করিয়া এ জ্ঞানও সঙ্গে সঙ্গে ফুটিয়া উঠিয়াছিল যে ভগবানের
স্বহস্তপ্রদত্ত রাজটীকা ইহার ললাটে দেদীপ্যমান| দিব্য
প্রতিভা ইঁহার মুখে, চোখে, কথায় বার্ত্তায়, ভাবে ভঙ্গীতে
যেন ফুটিয়া উঠিতেছে|
অরবিন্দের মুখে তেমন রাজশ্রী তখনও ফুটিয়া উঠে নাই| অরবিন্দ
বর্ণচোরা আম; বাহির দেখিয়া তাঁহার ভিতর বুঝিবার জো নাই|
(
২ )
১৯০৭
সালের বসন্তকালে তিনি দেওঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া পাকাপাকিভাবে
'বন্দে মাতরমের' ভার লইলেন| আলাদা বাসা আর করা হইল না;
তিনি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে সুবোধ বাবুর বাড়ীতে বাস করিতে
লাগিলেন| ঘর সংসার করা আর তাঁহার অদৃষ্টে জুটিল না|
আগে 'বন্দেমাতরম্' অফিসের কেহ কেহ নিয়ম বা শৃঙ্খলার বড়
একটা ধার ধারিতেন না| সম্পাদকীয় প্রবন্ধ শ্যামসুন্দর বাবু
লিখিতেন; কিন্তু প্রবন্ধ লিখিবার inspiration তাঁহার উপর
কখন যে ভর করিবে তাহার কিছুই স্থিরতা ছিল না| একদিন হয়ত
এক কাপ চা খাইতে না খাইতেই inspiration আসিয়া গেল; আর
কোন কোন দিন বা চায়ের উপর তিন চার ছিলিম তামাক পোড়াইয়াও
inspiration আসিল না| কাজে কাজেই প্রিণ্টার বেচারার সময়
মত কাগজ বাহির করা কঠিন হইয়া পড়িত| অরবিন্দ বাবু আসিবার
পর সে দুঃখ ঘুচিল| তিনি সুবোধ বাবুর বাড়ী হইতেই প্রবন্ধ
লিখিয়া পাঠাইয়া দিতেন| অফিসে বড় একটা আসিতেন না, আর আসিলেও
কাহারও সহিত বেশী কথাবার্ত্তা কহিতেন না| একে তিনি অত্যন্ত
অল্পভাষী লোক; তাহার উপর বাংলা-চল্তি ভাষার উপর খুব বেশী
দখল ছিল না বলিয়া বোধ হয় সকলের সহিত কথাবার্ত্তা কহিবার
সুবিধাও তাঁহার হইত না| তাঁহার বাংলা উচ্চারণ অনেকটা সাহেবী
ধরণের ছিল বলিয়া আমরা তাঁহার আড়ালে খুব হাসাহাসি করিতাম|
কিন্তু চল্তি ভাষার উপর দখল না থাকিলেও তিনি সাধুভাষা
বেশ লিখিতে পারিতেন|
তাঁহার মত এমন অসাধারণ একাগ্রচিত্ত লোক আর দেখিয়াছি বলিয়া
মনে হয় না| সুবোধ বাবুর বাড়ীতে লোক জনের ভিড় প্রায়ই লাগিয়া
থাকিত| কেহ গল্প জুড়িয়া দিয়াছে, কেহ অট্টহাস্য করিতেছে,
কেহ বা তর্ক লাগাইয়াছে; আর তাহাদের মাঝখানে বসিয়া তিনি
নির্ব্বিকার ভাবে লিখিতেছেন বা পড়িতেছেন| কোন দিকে ভ্রুক্ষেপও
নাই|
রাশভারি লোক বলিয়া তাঁহার সহ-কর্ম্মীরা তাঁহাকে ভয়ও করিত,
ভক্তিও করিত| তাঁহার কথার কোনরূপ প্রতিবাদ তিনি সহ্য করিতে
পারিতেন না| কাজকর্ম্মের কোনরূপ গোলমাল দেখিলে বিরক্ত
হইয়া চুপ করিয়া থাকিতেন; আর যখন খুব বেশী রাগিয়া যাইতেন,
তখন তাঁহার ঠোঁট একটু কাঁপিত| তাঁহার আশপাশের লোকেরা সেই
সময় প্রমোদ গণিত|
বিনয় বাবু নামে আমাদের একজন সহকারী সম্পাদক ছিলেন| একাধারে
এত গুণ এই কলিযুগে খুব কম লোকেরই দেখিতে পাওয়া যায়| সুবোধ
বাবুর স্ত্রী যখন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন, তখন এই বিনয়
বাবুটী তাঁহার চিকিৎসা করিতে আসিয়াছিলেন| একে যক্ষ্মারোগ,
তাহার উপর বিনয় বাবুর চিকিৎসা, সুতরাং রোগী অল্প দিনের
মধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করিয়া রোগ ও চিকিৎসার দায় এড়াইলেন|
কিন্তু ইতিমধ্যে বিনয় বাবু কথকতা করিয়া, আ্যাকটিং শুনাইয়া
ও সং দেখাইয়া বাড়ীর বৃদ্ধামহলে এমনি পশার জমাইয়া লইয়াছিলেন
যে তাঁহাকে একটা কোন কাজকর্ম্ম দিয়া আটকাইয়া রাখিবার জন্য
নানাস্থান হইতে সুপারিশ আসিতে লাগিল| কাজেই তিনি 'বন্দে
মাতরম্' আফিসের একজন Maid-of-all-work হইয়া দাঁড়াইলেন|
রাত্রে প্রুফ দেখিবার ভার একদিন তাঁহার উপর পড়িল| অরবিন্দ
বাবুর প্রবন্ধের মধ্যে একটা কথা ছিল-churchianity| বিনয়
বাবু বেচারা churchianity-র ধার ধারেন না; কাজেই তিনি
নিঃসংশয়চিত্তে ঐ লম্বা চৌড়া কথাটাকে কাটিয়া শুদ্ধ করিয়া
লিখিয়া দিলেন - christianity, সকাল বেলা কাগজ পড়িয়াই অরবিন্দ
বাবু দেখিলেন কোন্ পণ্ডিত তাঁহার লেখার উপর কলম চালাইয়াছে|
খোঁজ করিয়া দেখা গেল যে ঐ সংশোধন কার্য্যটা শ্রীমান বিনয়
বাবুর কৃত| অরবিন্দ বাবুর এজলাসে তাঁহার ডাক পড়িল| বিনয়
বাবু হাত জোড় করিয়া বলিলেন-"কি করবো, মশাই! দোষ আমার
নয়; দোষ ইউনিভার্সিটির| আমি এক গাদা বই পড়ে বি, এ পাশ
করেছি, কিন্তু কোথাও churchianity কথাটার দেখা পাই নি"|-বক্তৃতাটা
আরও কতক্ষণ চলিত বলা যায় না| হঠাৎ অরবিন্দ বাবুর ঠোঁট
কাঁপিয়া উঠিল| বিনয় বাবু বেগতিক দেখিয়া প্রাণ লইয়া সেখান
হইতে চোঁচা দৌড় দিলেন|
( ৩ )
কথাবার্ত্তায়
ও মেজাজে অনেকটা সাহেবী ধরণের হইলেও পোষাক-পরিচ্ছেদে ও
আচার-ব্যবহারে অরবিন্দ একেবারে খাঁটি বাঙ্গালীর মত| ধুতি
চাদর ও চটিজুতাই তাঁহার সম্বল ছিল| ঘরের আসবাবের মধ্যে
শুইবার একখানি খাট ও টেবিলের উপর ছড়ান একগাদা বই| কোনরূপ
বাবুয়ানি তাঁহার ভিতর দেখি নাই| পয়সা কড়ির দিকে নজর কস্মিন্
কালেও ছিল না| বরোদায় থাকিবার সময় একবার হঠাৎ বাক্স খুলিয়া
দেখিলেন যে প্রায় দুই হাজার টাকা জমিয়া গিয়াছে| যতক্ষণ
পর্য্যন্ত না সে টাকাটা খরচ হইয়া গেল ততক্ষণ পর্য্যন্ত
তিনি স্বস্তি বোধ করেন নাই|
পূর্ব্ব জন্মের সংস্কার কিনা জানি না, কিন্তু সাহেবিয়ানার
মধ্যে লালিত পালিত হওয়া সত্ত্বেও হিঁদুয়ানীর উপর তাহার
খুব একটা শ্রদ্ধা ছিল| বরোদায় থাকিবার সময় কে একজন সাধু
তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে তাঁহার উপর রাজকোপ হইবে; এবং তাহা
খণ্ডনের জন্য তাঁহাকে সোণার বগলামূর্ত্তি গড়াইয়া পূজা
করিতে বলিয়াছিলেন| অরবিন্দ বাবু সেই অবধি বহুদিন পর্য্যন্ত
এক পায়ে দাঁড়াইয়া বগলামন্ত্র জপ করিতেন| টেবিলের প্রেত
নামান, প্ল্যানচেট্ ধরা ও Automatic writing করার বাতিকও
অরবিন্দ বাবুর খুব প্রবল ছিল| ধর্ম্ম-বিষয়ে তাঁহার মতামত
শুনিয়া অনেক সময় তাঁহাকে শিশুর মত সরলবিশ্বাসী বলিয়া মনে
হইত|
১৯০৭ সালের সুরাট কংগ্রেস হইতে ফিরিবার পথে বিষ্ণু ভাস্কর
লেলে নামক একজন মহারাষ্ট্রীয় সাধকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ
হয়, ও তাঁহার নিকট হইতে অরবিন্দ বাবু দীক্ষা গ্রহণ করেন|
সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি সুবোধ বাবুর বাড়ী ছাড়িয়া
আলাদা বাসায় বাস করিতে লাগিলেন| ধর্ম্ম সাধনায় তাঁহার
অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হইতে লাগিল| অফিসে তাঁহার সহকারীদের
উপর হুকম দিলেন-'কাগজে কাহাকেও গালি দিতে পারিবে না| হেমেন্দ্র
বাবু ত হুকুম শুনিয়া গালে হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন| খবরের
কাগজ হইতে যদি গালাগালিটুকুই বাদ গেল তাহা হইলে আর বাকি
রহিল কি?
সাধনের জন্য এই সময় অরবিন্দ বাবু আহারাদি বিষয়ে কঠির সংযম
অভ্যাস করিতেন| নুন, লঙ্কা ত নিষিদ্ধই ছিল; ভাতের সঙ্গে
ডাল বা তরকারী পর্য্যন্ত খাইতেন না| ভাত, দুধ ও ফলমূল
খাইবার ব্যব্স্থা ছিল; তবে অধিকাংশ দিনই দুধ জুটিত না|
দেশে একটা প্রবল ধর্ম্মভাব না জাগিলে যে রাজনৈতিক বিপ্লব
সফল হইবে না, এই মতবাদ তিনি এই সময় হইতে প্রচার করিতে
আরম্ভ করেন| এই সময়ের কথা উল্লেখ করিয়া অরবিন্দ বাবু জেলে
একদিন বলিয়াছিলেন-"ভগবান আমায় জেলে নিয়ে এসে বাঁচিয়ে
দিয়েছেন| চারদিকের টানাটানিতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলুম|
বাইরে একদিকে টানছিল ন্যাশনাল কলেজ, আর একদিকে টানছিল
'বন্দে মাতরম', আর ভিতরে একদিকে টানছিল বারীন, আর একদিকে
টানছিল বৌ| জেলে এসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি|"
তাঁহার জীবনের গতি এই সময় হইতে নূতন দিকে ফিরিল|
( ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকা
শ্রাবণ, ১৩২৯ )