পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
একাল ও একালের মেয়ে
[
জনৈক হিন্দু বিধবা দ্বারা রচিত লেখাটির রচয়িতার নাম আজ আর জানার
কোন উপায় নেই। শেষের মন্তব্যটি ‘অন্তঃপুর’ সম্পাদিকার। ‘অন্তঃপুর’
সে সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা; এটি ছিল সম্পূর্ণ মহিলাদের
দ্বারা পরিচালিত ও একমাত্র মহিলাদের লেখাই এতে প্রকাশিত হত।
পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন ‘ভারত শ্রমজীবী’ খ্যাত সেবাব্রতী
শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা বনলতা দেবী। বনলতা দেবীর
মৃত্যুর পর সম্পাদিকা হন হেমন্তকুমারী চৌধুরী। সে সময়ে মহিলাদের
মধ্যে শিক্ষিত ছিল খুবই কম। বাধা নিষেধের গন্ডি পেরিয়ে নিজেদের
কথা তুলে ধরার মানসিকতা ছিল আরও কম সংখ্যক মহিলার। অতএব শুধু
মহিলাদের লেখা নিয়ে একটা পত্রিকা চালানোর প্রচেষ্টা ছিল কিছুটা
দুঃসাহসিক। এজন্য পত্রিকা সম্পাদিকার পরিচিতি জেনে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক
হবে না।
সাহিত্যিক
ও সমাজসেবী হেমন্তকুমারী চৌধুরী ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে লাহোরে জন্মগ্রহণ
করেন। পিতা ছিলেন লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
শিক্ষাব্রতী নবীনচন্দ্র রায়। হেমন্তকুমারী বার বছর বয়সে লাহোর
থেকে এসে বেথুন স্কুলে ভর্তি হন। বোর্ডিং-এ থাকার সময় পিতার
বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন তার স্থানীয় আভিভাবক। স্কুলে পড়বার
সময় হেমলতা সরকার, সরলা দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, যামিনী সেন,
হেমপ্রভা বসু, স্বর্ণপ্রভা বড়ুয়া প্রমুখরা ছিলেন তার সহপাঠিনী।
পরবর্তি কালে এরা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।
১৭ বছর বয়সে শ্রীহট্টের জননেতা শিক্ষানুরাগী রাজচন্দ্র চৌধুরীর
সঙ্গে বিয়ের পর স্বামীর কর্মক্ষেত্র প্রথমে শিলং ও পরে শ্রীহট্টে
বাস করেছেন হেমন্তকুমারী। শিলং-এ তিনি বয়স্কদের স্বনির্ভর করে
তুলতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। মেয়েদের হাসপাতাল তৈরি
করতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। শ্রীহট্টে চা বাগানের কুলীদের
ওপর নিপীড়ন বন্ধ করতে তিনি সচেষ্ট হন এবং তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের
কাছে তারই আবেদনের ভিত্তিতে চা বাগানে রাত্রি বেলা মহিলাদের
কাজে যাওয়া রদ হয়। পরবর্তিকালে লেডি সুপারিন্টেডেন্ট হয়ে হেমন্তকুমারী
পাতিয়ালায় চলে যান এবং সরকারের অনুরোধে সেখানে তিনি ভিক্টোরিয়া
মেমরিয়াল স্কুল স্থাপন ও পরিচালনা করেন। বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজিতে
তিনি অনর্গল সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারতেন। একবার প্রবাসী বঙ্গ
সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেছেন তিনি। শেষ জীবনে ১৯৩০ সাল
থেকে প্রায় ২০ বছর তিনি দেরাদুনে কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি দেরাদুন
মিউনিসিপ্যালটির কমশনারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫০ খৃষ্টাব্দের
১৪ ই ফেব্রুয়ারি দেরাদুনেই তার মৃত্যু হয়।
মহিলা লেখকদের নিয়ে মহিলাদের জন্য তিনি ‘অন্তঃপুর’ মাসিক পত্রিকা
চালু করেন; মাঘ ১৩০৪ থেকে বৈশাখ ১৩১১ পর্যন্ত তিনিই পত্রিকা
সম্পাদনা করেছেন। এর আগে ১২৯৪ বঙ্গাব্দে হিন্দি ভাষায় ‘সুগৃহিণী’
মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন তিনি। তার রচিত গ্রন্থ – ‘আদর্শমাতা’;
‘নবীন শিল্পমেলা’ (উল বোনার বই); ‘নারী পুষ্পাবলী’ (আদর্শ মহিলাদের
জীবনী)। হেমন্তকুমারী টেক্সট বুক কমিটির পুরস্কারও লাভ করেছেন।
]
দীপক সেনগুপ্ত।
অধিক আর কিছু বলিবার
নাই, একটু ভাবিয়া দেখিলে সকলেই বুঝিবেন যে কালের পরিবর্ত্তনে ও
ইংরাজ রাজা হওয়াতে আমাদের যথেষ্ট পরিবর্ত্তন হইয়াছে ও হইতেছে|
ইহার গতিরোধ মানুষের অসাধ্য| আমাদের নব্য সম্প্রদায়, ইংরাজী সেইরূপ
ধরণ ধারণ অনুকরণ করিতেছেন| কিন্তু তাহাতে সম্পূর্ণ সুখী না হইতে
পারিয়া বোধ হয়, মহিলাদিগকে সকল অসুখের মূল বিবেচনা করিতেছেন| রমণীগণ
চিরকালই পুরুষদিগের আশ্রিত ও তাহারা যে চিরকালই পুরুষদিগের দৃষ্টান্ত
অনুসারে চলিয়া থাকেন, তাহা কাহারো মনে হইতেছে না| আমাদের বাঙ্গালী
যুবকদিগের রুচি রীতিনীতি আচার ব্যবহার অনুসারেই একালের মেয়ে গঠিত
হইতেছে| লাল কস্তাপেড়ে সাড়ি পরা, মাথায় চওড়া সিন্দুর, কপালে বৃহৎ
টিপ, নাকে নথ, দাঁতে মিশি, কৃষ্ণবর্ণ ঠোঁট, হাতে শাঁখা, পায়ে দুগাছা
মল, ঝোঁটন করিয়া খোপাবাঁধা স্ত্রীর সহিত, বোধ করি একালের স্বামী,
বাক্যালাপ করা দূরে থাকুক, ঘরে ঢুকিতেও দিবেন না| তাঁহারা অতীত
কালের মহিলাদের গুণটুকু মাত্র স্মরণ করিয়া, একালের মেয়েদের উপর
নানাবিধ দোষার্পণ করিতেছেন| বাস্তবিক ঐ সকল দোষে মহিলারা একটু
দোষ দেখিতে পাইলে সকলে শত কণ্ঠে তাহা প্রকাশ করিতে এবং সেই হতভাগিনীদিগকে
লাঞ্ছনা করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন না| এ সংসারে বৈধব্য-জীবনের
ন্যায় বিড়ম্বিত জীবন আর কাহারও নাই|
শিক্ষার অভাবে একটী বৈধব্য-জীবনে যে শোচনীয় পরিণাম দেখিয়াছি তাহা
এখানে উল্লেখ করিতেছি|
একটী স্ত্রীলোক ষোড়শ বৎসর বয়সে বিধবা হয়, বৃদ্ধা শাশুড়ী ব্যতীত
তাহার অপর কোন অভিভাবক ছিল না| সে শাশুড়ীর সহিত কোন আত্মীয়ের আশ্রয়ে
বাস করিত| কয়েক বৎসর পরে মাতৃসমা বৃদ্ধা শাশুড়ী অভাগিনীকে নিরাশ্রয়া
করিয়া পরলোকগতা হন| উক্ত বিধবার যৎসামন্য অর্থ আশ্রয়দাতার নিকট
গচ্ছিত ছিল| বিধবা রমণী সুন্দরী ছিল বলিয়া, কুলোকের কুদৃষ্টি তাহার
উপরে পড়িল এবং সে প্রলোভনের মোহজালে আচ্ছন্ন হইয়া জীবনের মহৎ লক্ষ্য
ভুলিয়া অধঃপতিতা হইল| কেহ তাহাকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিল না,
কিন্তু তাহার দুর্নাম ঘোষণা করিতে কেহ ত্রুটী করিল না| আশ্রয়দাতা
প্রতিবেশী কিছুদিন তাহাকে তাহার জ্ঞান ও বুদ্ধিমতে শাসন করিয়া
গৃহে রাখিতে চেষ্টা করিলেন বটে, কিন্তু সেইরূপ শাসনে তাহার কি
হইবে? ক্রমে ক্রমে একেবারে পাপস্রোতে জীবন ভাসাইয়া দিল| পরে অপরাপর
প্রতিবেশীগণ একত্রে পরামর্শ করিয়া তাহাকে গৃহ হইতে তাড়াইয়া দিল|
তখন সে আর এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় লইল| কিন্তু সে স্থান হইতেও
তদপেক্ষা লাঞ্ছিত হইয়া তাড়িত হয়| কয়েক বৎসর পরে একদিন দেখিলাম
তাহার গচ্ছিত অর্থ প্রতারকের প্রোরচনায় হারাইয়া অনাথা ভিখারিণীর
বেশে পথে পথে ক্রন্দন করিয়া বেড়াইতেছে| তখন তাহার আর সেই পূর্ব্বের
সৌন্দর্য্য নাই, অন্নাভাবে শরীর কৃশ ও মলিন, তৈলাভাবে কেশ রুক্ষ
শতগ্রন্থিযুক্ত মলিন বস্ত্র পরিধান করিয়া কাঁদিতেছে| কিছুদিন পরে
শুনিলাম তাহার কোন খোঁজ নাই; তাহার উদ্ধারের চেষ্টা কেহ করিল না|
এই তো আমাদের সমাজের অবস্থা! এই তো আমাদের সমাজের বিচার! সেই হতভাগিনী
বিধবা অসহায়া পতিতা বলিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইল| আর অশিক্ষিতা
অসহায়া রমণীর অধঃপতনের মূল যে পুরুষ, তিনি সমাজের শীর্ষস্থানে
থাকিয়া সমাজের দশ জনের মধ্যে একজন হইয়া সুখভোগ করিতে লাগিলেন|
তাহার প্রতি কোন শাসন নাই শাসনের কোন বিধি ব্যবস্থাও নাই| পরিতাপের
কথা কি বলিব তাহারাই নাকি কোন কোন স্থানে সমাজপতি!!!
এ সংসার পাপ প্রলোভনময় ! শিক্ষিত পুরুষ পর্য্যন্ত অসার প্রলোভনে
প্রলুব্ধ হইয়া আত্মহারা হন এবং দুর্গতি ভোগ করেন| কোমলমতি অশিক্ষিতা
বিধবা এই ভীষণ পরীক্ষানল হইতে কি প্রকারে রক্ষা পাইবে? কঠোর শাসন
ও সমাজভয় মানুষকে কতকটা রক্ষা করে বটে কিন্তু তাহাতেই কি তাহাদের
দুর্ম্মতি দূর হয়? মানুষকে পশুর মত শাসন করিলেই কি সামাজিক কর্ত্তব্য
সম্পন্ন হয়?
সুশিক্ষার অভাবই বিধবাদের অধঃপতেনের ও দুঃখের মূল কারণ| আমাদের
সমাজের অধিকাংশ মেয়েরা যেরূপ বিদ্যা শিক্ষা করে তাহা শিক্ষাই নহে|
সধবা রমণীদের এরূপ শিক্ষায় ক্ষতি না হইলেও বিধবাদের যথেষ্ট ক্ষতি
হইয়া থাকে|
ধর্ম্ম, সাহিত্য ও বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভ দুর্লভ বলিয়া তাহারা
সহজলব্ধ, আশু তৃপ্তিকর কুরুচিপূর্ণ উপন্যাস ও নাটক সর্ব্বদা পাঠ
করিয়া থাকে| জ্ঞানাভাবে তাহারা ঐ সকল উপন্যাস ও নাটকোল্লিখিত বিষয়ের
প্রকৃত অর্থ ও আদর্শ চরিত্রের মহৎভাব হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া
শুধু কল্পিত ভাবের মধুরতায় মুগ্ধ হইয়া আত্মবিস্মৃত হয়| ইহাতে তাহাদের
মানসিক চঞ্চলতা বৃদ্ধি হইয়া পরিণামে দুঃখদায়ক হয়, ইহার কি কোন
প্রতিকার করিতে পারা যায় না?
শিক্ষার গুণে অসভ্য সুসভ্য হয়, বর্ব্বর বুদ্ধিমান হয়| বন্য পশু
পক্ষী পর্য্যন্ত পোষ মানিয়া কিয়ৎ পরিমাণে উন্নতি লাভ করে| কোমলমতি
বিধবা বালিকাগুলি সুশিক্ষা ও যত্ন পাইলে অবশ্যই মনুষ্য নামের যোগ্য
হইতে পারে| যাহারা শিক্ষার অভাবে নিজ হিতাহিত বুঝিতে অসমর্থ তাহাদের
মঙ্গল কি প্রকারে সম্ভবে? সংসারে পুরুষ শিক্ষিত ও সবল| স্ত্রীলোক
দুর্ব্বলা কোমলপ্রাণা ও পুরুষের পদাশ্রিতা| সর্ব্বদা তাহারা পুরুষের
উপরে নির্ভর করিয়া আত্মরক্ষা করে| প্রায় সকল পুরুষেরাই অবস্থানুরূপ
অল্পাধিক পরিমাণে শিক্ষা উন্নতি লাভ করিতেছে| এরূপ অবস্থায় অশিক্ষিতা
বিধবা রমণীদিগকে প্রলোভন ও পরীক্ষাপূর্ণ সংসারে একাকিনী আত্মরক্ষা
করিতে হইবে| কুটিলতাময় এ সংসারে দুর্ব্বলা রমণীর জীবনপথে অগ্রসর
হওয়া কি ভয়াবহ| কত চিন্তা, ধৈর্য্য, জ্ঞান, সংযম ও দৃঢ়তা ইত্যাদি
গুণের প্রয়োজন তাহা কেহ কি কখনও ভাবিয়াছেন? এবং শিক্ষাভাবে একাধারে
সামঞ্জস্যাভাবে এই সকল সদ্গুণ লাভ করা কি সহজ? হিংস্রক জন্তু
দস্যু তস্কর পরিপূর্ণ অরণ্যে একাকী পথিকের যাত্রা করা যেরূপ কঠিন
তদ্রূপ নানা প্রলোভনময় সংসার অরণ্যে সঙ্গীবিহীনা অনাথা বিধবার
বিচরণ করাও সঙ্কটাপন্ন| সংসার অরণ্যে একাকী বিচরণ করিবার উপযোগী
একটি জীবন প্রস্তুত করিতে কি সামান্য যত্ন ও চেষ্টার কাজ? যেমন
পতঙ্গগণ অনলের দাহিকা শক্তি অজ্ঞাত বলিয়াই অনলের আলোকে মুগ্ধ হইয়া
তাহাতে পুড়িয়া মরে, তদ্রূপ বিধবাগণও নিজ নিজ হিতাহিত বুঝিতে অনভিজ্ঞা
বলিয়াই সময় সময় নানা প্রকার বিপদে পতিতা হয়| তাহারা আত্মরক্ষার
উপযোগী শিক্ষা না পাইলে কিরূপে নিরাপদে থাকিবে? সচরাচর দেখিতে
পাওয়া যায় যে ব্যক্তি আত্মীয় স্বজনের নিকট অবজ্ঞার পাত্র ও নানা
প্রকারে লাঞ্ছিত হয় সে কখনও আত্মসম্মান লাভ করিতে শিখে না| আত্মসম্মান
জ্ঞানের অভাবে আত্মোন্নতি চেষ্টা মনে জাগ্রত হয় না| এবং সেইজন্যই
এইরূপ ব্যক্তি উচ্ছৃঙ্খল চরিত্র ও মূর্খ হয়| স্নেহ যত্ন লাভ করিলে
কর্কশ প্রকৃতিও কোমল হয়, পতিত ব্যক্তি চরিত্রবান হয় অসাধু সাধু
হয় এমন দৃষ্টান্ত মানবসমাজে বিরল নহে| আমাদের সমাজে বিধবাগণ সর্ব্বদাই
অনাদৃতা ও অভাগিনী বলিয়া তাহারাই যেন সমাজের অমঙ্গলের হেতু| এরূপ
স্থলে তাহাদের উন্নতির আশা কোথায়? এ সংসারে উদ্যানে বিধবা পবিত্র
কুসুম| ইহাদের সেবার সামগ্রী ভগবচ্চরণই উপযুক্ত স্থান| আমরা আমাদের
পুষ্পোদ্যানে যে সকল পুষ্প বৃক্ষ রোপণ করি, তাহাতে নিয়মমত জল ও
সারাদি দিয়া থাকি, তাহার মূল হইতে কীট সকল বাছিয়া বৃক্ষকে সযত্নে
রক্ষা করি| তবে সে পুষ্প বৃক্ষ বর্দ্ধিত ও ফল পুষ্পে সুশোভিত হইয়া
সৌরভে সকলকে আমোদিত করে| এবং আমরা সেই পুষ্প দেবতার চরণে দিয়া
কৃতার্থ হই| আর এ সংসারে উদ্যানে বালবিধবারূপ কুসুম কলিকাগুলি
অনাদরে অযত্নে শুকাইয়া যাবে না কি? উহাদের মানসিক পোকাগুলি বাছিয়া
না দিলে কীট দষ্ট হইয়া অকালে ঝরিয়া পড়িবে না কি? তাহারা কি দেবপূজার
যোগ্য থাকিতে পারে? বিধাতার বিধানে সকলেই স্বামী পুত্র লইয়া সংসার
ধর্ম্ম রক্ষা করিবে ইহা যেমন অসম্ভব, বিধবা হইলেই যে তাহার জীবন
জ্বলন্ত অনলময় হইবে ইহাও তেমনি অসম্ভব| বৈধব্য জীবন কি শান্তিপূর্ণ
হইতে পারে না? সে প্রেমময় হরি তো কাহাকেও করুণা প্রেম বিতরণে বিমুখ
নন? পশুপক্ষী স্থাবরাদি পর্য্যন্ত তাঁহার প্রেমাধীন| একমাত্র বিধবাই
কি সেই প্রেম হইতে বঞ্চিতা থাকিবে? কখনই নয়| তাঁহার অনন্ত সর্ব্বব্যাপী
প্রেমে নরনারী সধবা, বিধবা পশুপক্ষী ইত্যাদি সকলেই সমান অধিকারী|
তাঁহার রাজ্যে এ অবিচার এ হাহাকার কেন? সামাজিক বিশৃঙ্খলাই বিধবাদিগের
জীবনের দুঃখের মূল| তাহাদের জীবন উন্নত ও সুখ শান্তি পূর্ণ করিবার
প্রধান উপায় তাহাদের জীবনোপযোগী শিক্ষা|
বিধবাদের শিক্ষা কি প্রণালীতে হওয়া উচিত, তাহা বিধবার সুযোগ্য
অভিভাবকেরই বিবেচনা করিয়া নির্দিষ্ট করা কর্ত্তব্য| বিধবার শিক্ষারপ্রধান
অঙ্গ ব্রহ্মচর্য্য ও ধর্ম্মসাধন তাহা অনেকই জানেন|
নিঃসন্তানা বালবিধবা ও অপেক্ষাকৃত বয়োধিকা সন্তানবতী বিধবাদিগকে
ইহাদের পৃথক্ পৃথক্ উপায়ে শিক্ষাদান করা কর্ত্তব্য| শ্রমশীলতা,
সত্যপ্রিয়তা, দৃঢ়তা ও পরসেবা ইত্যাদি যাহাতে বৃদ্ধি হয় সেজন্য
প্রত্যেক বিধবারমণীরই অভ্যাস করা উচিত| ব্রহ্মচর্য্য সম্বন্ধে
এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে আলোচনা করিলে ইহা বিস্তৃত হইয়া পড়িবে| সুতরাং
এখানে ইহা লিখিতে পারিলাম না| বিশেষত আমিও একজন শিক্ষাথিনী অভাবমাত্র
বুঝিতে পারি|[?] এই অভাব পুরণের আশা করিয়া আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত
হইয়াছি|
বিধবাদিগকে ধর্ম্মনীতি গার্হস্থ্য চিকিৎসা সম্বন্ধীয় গ্রন্থ সাধু
ও সাধ্বীদের জীবনচরিত পাঠ করিতে দেওয়া উচিত| সদ্গ্রন্থ পাঠ করিলে
প্রাণে অপার আনন্দ ও শান্তিলাভ হয়| ধর্ম্মসাধন বিধবার জীবনের প্রধান
কার্য্য| ইহার অভাবে মানবজীবনের শোচনীয় পরিণাম হয়| ধর্ম্মসাধনকে
জীবনের সম্বল করিয়া কত বিধবা চিরজীবন কঠোর তপস্যা করিতেছেন|
ধর্ম্মসাধনের অভাবে কত শিক্ষিত পুরুষের জীবন ঘৃণিত অবস্থা প্রাপ্ত
হইয়াছে| বৈধব্য জীবনের প্রধান অবলম্বন ধর্ম্মসাধন| তাহাদিগকে আজীবন
এই মহারত্ন প্রাণে সযন্তে রক্ষা করিতে হইবে| এজন্য ধর্ম্মশিক্ষাদানের
জন্য ব্যবস্থা করা কর্ত্তব্য| তাহাদের জীবনের ধর্ম্মসূত্রে অপর
সকল বিষয় গ্রথিত করিতে হইবে| কেহ কেহ মনে করিতে পারেন অল্প বয়স্কা
বালিকারা কি ধর্ম্মসাধন করিবেন ইহা অতি ভ্রম| ধর্ম্মসাধনের অভাবে
বালবিধবাগণের জীবন ঘোর বিপদে পতিত হইবে| ধর্ম্মশিক্ষা কি প্রণালীতে
হইবে তাহাও আমি বলিতে অপারগ| প্রাচীন আর্য্য ঋষিগণ ব্রতপালন প্রভৃতি
যে সকল বিধি ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন, তাহার উদ্দেশ্য অতি মহৎ এখন
সেই চিরপ্রচলিত ব্রতাদিতে অনেকেরই নিষ্ঠা নাই| কিন্তু সেইজন্য
এই গুরুতর বিষয়ে উদাসীন হইলে বিধবাদিগের অত্যন্ত অনিষ্ট হইবে|
যাহাতে তাঁহার বাল্যাবধি ধর্ম্মশিক্ষা লাভ করিতে পারেন তদ্বিষয়ে
অভিভাবকগণের যত্নশীল হওয়া কর্ত্তব্য|
বিধবাগণকে সৎসংসর্গে রাখা অত্যন্ত আবশ্যক| বিধবাগণকে সদাচারী সংযত
চরিত্র ও ধর্ম্মানুরাগী ব্যক্তিদিগের আশ্রয়ে রাখা কর্ত্তব্য| সৎসংসর্গের
গুণে কত অসচ্চরিত্র নরনারী নবজীবন লাভ করিয়াছে| সৎসংসর্গ যেরূপ
শুভফলপ্রদ কুসংসর্গ সেইরূপ সংক্রামক রোগের ন্যায় বিষময়| কুসংসর্গে
পড়িয়া কত সরলপ্রাণা রমণীর চিরজীবন দুঃখময় হইয়াছে| একটি সাধুলোক
কুসংসর্গে বাস করিলে প্রথম কুব্যবহার অসৎপ্রকৃতি দেখিয়া কষ্ট বোধ
করেন ও কদর্ঘ্য আচার ব্যবহারে ঘৃণা প্রকাশ করেন| কিন্তু ক্রমে
সেই যন্ত্রণা ও ঘৃণার হ্রাস হইয়া প্রলোভনে মুগ্ধ সাধুলোকের জীবন
অধঃপতিত হয় ও তিনি সকলের ঘৃণার পাত্র হন| সুশিক্ষিত ও চরিত্রসম্পন্ন
পুরুষদিগের জীবনে যখন সংসর্গের তারতম্যে এতদূর উন্নতি অবনতি হইতে
দেখা যায়, তখন কোমলমতি বালিকাগুলি যে সংসর্গদোষে অধঃপাতে যাইবে
তাহাতে আর সন্দেহ কি? নরনারী সকলের পক্ষেই কুসঙ্গ সর্ব্বদা পরিত্যজ্য|
অনেক বালবিধবা যুবতী সধবা বয়স্যাগণের সহিত সর্ব্বদা বাস হেতু তাহাদের
ন্যায় আশু সুখপূর্ণ জীবন যাপন করিতে ইচ্ছা করে| ইহাতে তাহাদের
কি বিষম অনর্থ ঘটে; তাহা তাহারা অল্প বয়সে বুঝিতে পারে না| অশিক্ষিতা
বালবিধবার এই সকল বুঝিবার জ্ঞান কোথা হইতে আসিবে? সধবাদিগের সহবাসে
বাস করিয়া তাহাদের বাহ্যিক সুখময় জীবনের সহিত স্বীয় দুঃখময় জীবনের
প্রভেদ তাহারা সর্ব্বদাই মনে আলোচনা করিয়া ম্রিয়মানা হন| এবং সর্ব্বদা
এইভাবে প্রাণে পোষণ করিয়া তাহাদিগকে বিবাহিত জীবনের বিলাসপূর্ণ
ভাব দেখিয়া প্রলুব্ধ হইতে দেখা যায়| আত্মসংযমে অসমর্থা বিধবা নারী
স্বীয় জীবনের পবিত্রতা রক্ষা করিতে পারেন না| অশান্তির অনলে তাঁহার
হৃদয় মন দগ্ধ হয়| এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা হইতে তাহাদিগকে কে রক্ষা
করিবে? বিধবাদিগের সুবিজ্ঞ অভিভাবকবর্গ কি একবার এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত
করিবেন? তাঁহারা কি হতভাগিনী বিধবাদিগকে এই মহাবিপদ হইতে রক্ষা
করিয়া তাহাদের জীবনের উন্নতির পথে সহায়তা করিবেন, আমাদের কাতরধ্বনি
কি শূন্যেই মিলাইয়া যাইবে? কেহ কি কর্ণপাত করিবেন না?
অল্পবয়স্কাবিধবাগণ নিতান্ত আত্মীয় ব্যতীত অপর পুরুষের সহিত বেশী
ঘনিষ্ঠতা করিতে না পারেন সে বিষয়েও তাঁহাদের অভিভাবকবর্গের তীব্র
দৃষ্টি রাখা উচিত|
বিধবাদের আহার ও পরিচ্ছেদাদি বিলাসিতা বিহীন এবং সাত্ত্বিকভাবাপন্ন
হওয়া কর্ত্তব্য| বেশভূষা ইত্যাদিতে অনেক সময় চিত্ত প্রলুব্ধ হইতে
পারে| দ্রব্যগুণ বিবেচনা করিয়া খাদ্যাখাদ্য নির্ব্বাচন করা বিধেয়|
এ বিষয়ে প্রাচীন আর্য্যগণকৃত ব্যবস্থা অতি সুন্দর ও উপকারী| কিন্তু
কাহাকেও বলপূর্ব্বক আহারাদি নিয়মপালনে বাধ্য করা উচিত নহে; তাহাতে
বিশেষ অনিষ্ট হইতে পারে| অল্প বয়স্কা বালিকা বিধবাদিগের জন্য ভিন্ন
নিয়ম প্রচলন করিলে ভাল হয়| স্নেহের পাত্রীগুলিকে যৌবনে যোগিনী
সাজান অত্যন্ত কষ্টকর সেই বিষয়ে সন্দেহ নাই| কিন্তু স্নেহান্ধ
হইয়া তাহাদিগকে অতিরিক্ত বিলাসিতা করিতে দিলে তাহাদের ভবিষৎ দুর্গতির
পথ উন্মুক্ত করা হইবে|
পতির স্মৃতি রক্ষা করা বড়ই পবিত্র কার্য্য| প্রত্যেক বিধবা নারীর
এই অক্ষয় কবচ প্রাণের অন্তরালে সযত্নে রক্ষা করা কর্ত্তব্য| আত্মরক্ষর
জন্য স্বামীর পবিত্র স্মৃতি অমোঘ অস্ত্র ইহা যেন কোন অবিধবা বিস্মৃতা
না হন| এবং আশা করি কোন বিধবা মহিলা মৃত স্বামীর শোকস্মৃতি বিস্মৃত
হইবেন না| পাঠিকা ভগিনীগণ ! পুরুষগণ এবিষয়ে চিন্তা না করুন, কিন্তু
আমরা ত স্ত্রীলোক| আমরাও যে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন| বিধবাদের,
মাতা, ভগিনী, শাশুড়ী, ননদ, জা প্রভৃতি রহিয়াছেন তাঁহারা কি দুঃখিনীদের
বিষয়ে কখনও চিন্তা করেন? বিধবাদের প্রকৃত মঙ্গলোদ্দেশে কি কোন
উপায় কেহ করিতে পারেন না? দুঃখের কথা কি বলিব? বিধবা পর্য্যন্ত
বিধবার দুঃখে উদাসীনা|
আমি এই নিবেদন লইয়া সদাশয়া অন্তঃপুর গ্রাহিকাদের নিকট উপস্থিত
হইয়াছি| ভরসা করি আপনারা এই হতভগিনীদের জীবনোন্নতির উপায় করিয়া
তাহাদের মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার করিবেন|
শ্রীজনৈক হিন্দু বিধবা|
(এই গুরুতর বিষয়ে সকলেরই মনোযোগ প্রদান করা কর্ত্তব্য| আমরা সময়ান্তরে
এ সম্বন্ধে আমাদের মতামত প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিব| পাঠিকাগণ,
এ বিষয়ে আলোচনা করিলে ও প্রবন্ধ লিখিলে প্রকাশ যোগ্য হইলে আমরা
অন্তঃপুরে প্রকাশ করিব| )
অ, স,
('অন্তঃপুর'
পত্রিকা, মাঘ ১৩০৯)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।