পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
সেকালের বিবাহ
শ্রীযোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়
[ লেখক পরিচিতি : লেখকের সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায়
নি | ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে হুগলী জেলার চন্দননগরে জন্ম | পিতার
নাম ইন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় | ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে প্রবেশিকা
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং হুগলী কলেজে পড়াশোনা করেন | কেরাণীর
চাকরী ছেড়ে ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান
করেন| ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন | ‘হিতবাদী’,
‘সাহিত্য’ ইত্যাদি বহু পত্র পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন
| জীবনে বহু খ্যাতনামা লোকের সংস্পর্শে যে তিনি এসেছেন সেটা
বর্তমান লেখাটি পড়লেই বোঝা যাবে | তার প্রকাশিত কযেকটি গ্রন্থ
: বৃদ্ধের বচন (১৯১৮) , আগন্তুক ( গল্প-১৯০৬) , শ্রীমন্ত
সদাগর , অমিয় উৎস , জামাই-জাঙ্গাল , সওদাগর| ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে
তার মৃত্যু হয়| ]
দীপক সেনগুপ্ত
আমার
প্রবন্ধের নাম শুনিয়াই হয়ত অনেকে বলিবেন - "বিবাহে আবার সেকাল-একাল
কি? সেই বৈদিক মন্ত্র, সেই স্ত্রী-আচার, সেই বাসর, সেই কুশণ্ডিকা,
সেই ফুলশয্যা-সেকালে যাহা ছিল, একালেও তাহাই আছে, তবে সেকালের
বিবাহ নাম দিয়া একটা প্রবন্ধ লিখিবার প্রয়োজন কি?'
প্রয়োজন
আছে| কারণ, আমরা সেকালে, অর্থাৎ আমাদের বাল্যকালে বা যৌবনে, বিবাহের
ক্রিয়াকর্ম্ম যেরূপ দেখিয়াছি, একালে তাহার অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে|
আমার মনে হয় যে, আর পঁচিশ - ত্রিশ বৎসর পরে ভাবী তরুন-তরুণীরা
কল্পনাও করিতে পারিবেন না যে, তাহাদেরই পিতামহ প্রপিতামহের বিবাহ
কিরূপে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল| এখানে একটা কথা বলিয়া রাখি, আমি যাহাকে
'সেকালের বিবাহ' বলিতেছি, তাহা কলিকাতা অঞ্চলে ও মফস্বলের অনেক
শহরে সেকালের তালিকাভুক্ত হইলেও এখনও পল্লীগ্রামের বহু স্থানে
'একাল' হইয়াই আছে, অর্থাৎ আমরা পঞ্চাশ-ষাট বৎসর পূর্ব্বে কলিকাতা
বা শহর অঞ্চলে বিবাহের যে-সকল আচার-অনুষ্ঠান ও পদ্ধতি দেখিয়াছি,
মফস্বলের বহু স্থানে তাহা এখনও বিদ্যমান আছে, সুতরাং সেই সকল গ্রামের
অধিবাসীরা আমার এই প্রবন্ধে নূতন কিছু দেখিতে পাইবেন না বরং তাঁহাদের
জন্য "একালের বিবাহ" নাম দিয়া প্রবন্ধ লিখিলে হয়ত সেই
প্রবন্ধে তাঁহারা অনেক নূতন বিষয় দেখিতে পাইবেন|
বিবাহে
এমন অনেক আচার-অনুষ্ঠান আছে, যাহা সকল জেলায় সমান নহে| জেলাভেদে
অনুষ্ঠানের পার্থক্য ত আছেই, অনেক আচার ও অনুষ্ঠান গ্রামভেদে,
অমন কি পরিবারভেদে পৃথকরূপে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে| আমি যখন 'হিতবাদী'তে
কার্য্য করিতাম, সেই সময় আমার কোন পুত্রের বিবাহের পূর্ব্বে 'হিতবাদী'র
ভূতপূর্ব্ব প্রুফ-রীডার, বিখ্যাত জ্যোতিষী পণ্ডিত ধীরানন্দ কাব্যনিধি
মহাশয়কে গাত্রহরিদ্রার জন্য একটা শুভদিন দেখিতে অনুরোধ করিলে 'হিতবাদী'র
তদানীন্তন সম্পাদক পণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ মহাশয় বলিলেন,
"বিবাহের পূর্ব্বে পৃথক একটা দিনে গাত্রহরিদ্রা আমাদের দেশে
নাই, ওটা পশ্চিম-বঙ্গেই প্রচলিত দেখিতে পাই|" আমি বলিলাম
- "কিন্তু পঞ্জিকাতে ত গাত্রহরিদ্রার দিন শুভকর্ম্মের তালিকায়
লেখা থাকে|" তাহাতে তিনি বলিলেন, "অধিকাংশ পঞ্জিকাই
পশ্চিম-বঙ্গে কলিকাতা হইতে প্রকাশিত হয়, সেই জন্যই পশ্চিম-বঙ্গে
প্রচলিত গাত্রহরিদ্রার দিনও পঞ্জিকাতে লিখিত হয়| আমাদের ত্রিপুরায়,
বিবাহের পূর্ব্বে এক দিন 'অভিষেক' হয়, আপনাদের দেশে অভিষেক বলিয়া
কিছু হয় না|" এইরূপ অনেকে ব্যাপার, অনেক ক্ষেত্রে একই স্থানে
এক পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়, অন্য পরিবারে অনুষ্ঠিত হয় না| আমি পশ্চিম-বঙ্গ
(হুগলী জেলা) নিবাসী নিকষ কুলীন সন্তান, সুতরাং আমার এই প্রবন্ধে
পশ্চিম-বঙ্গের ব্রাহ্মণ, বিশেষতঃ কুলীন ব্রহ্মণ সমাজের কথাই অধিক
থাকিবে|
সেকালে আমাদের ব্রাহ্মণ সমাজে, ঘ্টকের সাহায্য ব্যতীত কোন বিবাহই
হইত না| অমৃতলাল বসুর বিবাহবিভ্রাট প্রহসনে ঘটক বলিতেছেন, "আমি
ঘটক, প্রজাপতির পাখ্না|" অর্থাৎ পক্ষ না থাকিলে কোন পতঙ্গ
যেরূপ অচল হইয়া থাকে, ঘটক না থাকিলে সেইরূপ বিবাহের অধিষ্ঠাত্রী
দেবতা প্রজাপতিও অচল অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়েন| সেকালে অনেক দেশবিখ্যাত
বড় বড় ঘটক ছিলেন, তাঁহাদের চতুষ্পাঠী থাকিত, সেই চতুষ্পাঠীতে ঘটকালি
শিক্ষার্থী ছাত্র থাকিত| ঘটকের ব্রাহ্মণদিগের কুলের সংবাদ রাখিতেন
বলিয়া, জ্যোতির্ব্বিদ পণ্ডিতেরা যেরূপ গ্রহাচার্য্য নামে অভিহিত
হইয়া থাকেন, ঘটকেরা সেইরূপ কুলাচার্য্য নামে খ্যাত ছিলেন| সেকালে
অধিকাংশ ঘটকেরই "চূড়ামণি" উপাধি ছিল|
পাত্র
বা পাত্রীর পিতা অথবা অভিভাবকেরা ঘটকের নিকটে গিয়া সংবাদ লইতেন
যে, তাঁহাদের সমক্ষ কৌলীন্যমর্য্যাদাসম্পন্ন ব্রাহ্মণ কোথায় আছেন|
যিনি সংবাদ লইতে যাইতেন, অগ্রে তিনি নিজের বংশ-পরিচয় ঘটকের নিকটে
বর্ণনা করিতেন| সেই বর্ণনা শুনিয়া তবে ঘটক-মহাশয় তাঁহাকে বলিতেন
যে, কোন্ গ্রামে তাঁহার সমকক্ষ ব্রাহ্মণ আছেন| একালে যাঁহারা
ঘটকালি করেন, তাঁহারা পাত্র বা পাত্রীর সন্ধান বলিয়া দেন, সেকালের
ঘটকেরা পাত্র-পাত্রীর সংবাদ বড় রাখিতেন না, তাঁহারা বলিয়া দিতেন-"অমুক
স্থানে আপনার সমকক্ষ তিন-চারি ঘর ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁহাদের কাহারও
বিবাহযোগ্য পুত্রকন্যা আছে কি না, গিয়া সংবাদ লইতে পারেন|"
ঘটকেরা এই সকল সংবাদ বিনা-পারিশ্রমিকে সরবরাহ করিতেন না, কিঞ্চিত
দর্শনী লইতেন| তাঁহারা পাথেয় এবং পারিশ্রমিক পাইলে স্বয়ং গিয়া
পাত্র-পাত্রীর সংবাদ লইয়া আসিতেন|
সেকালে কন্যাদায়গ্রস্ত
কুলীন ব্রাহ্মণেরা পাত্রের বিদ্যা, বুদ্ধি, রূপ, গুণ, স্বভাব,
চরিত্র বা বয়স ও বিষয়সম্পত্তি অপেক্ষা কৌলীন্যমর্য্যাদাই শ্রেষ্ঠ
বলিয়া মনে করিতেন| তাঁহাদের প্রধান লক্ষ্য থাকিত, কৌলীনমর্য্যাদার
প্রতি| রূপে, গুণে, বিদ্যায়, চরিত্রে বা বিষয়সম্পত্তিতে হাজার
উৎকৃষ্ট হইলেও যদি পাত্রের কৌলীন্যমর্য্যাদায় বিন্দু মাত্র কলঙ্ক
থাকিত, তাহা হইলে সে পাত্র কন্যাদায়গ্রস্ত কূলীনের নিকট অচল| তিনি
যদি কোন সূত্রে জানিতে পারিতেন যে, তাঁহার মনোনীত পাত্রের পিতার,
পিতামহর বা প্রপিতামহের ভগিনীর যে-পরিবারে বিবাহ হইয়াছিল, সেই
পরিবারের "কেশরকুনি" বা "বীরভদ্রী" অথবা ঐরূপ
কিছু একটা দোষ আছে, তাহা হইলে আর সেই পাত্রের সহিত বিবাহ হইত না|
কারণ, রাঢ়ী শ্রেণীর কূলীন ব্রাহ্মণদিগের কন্যা-গত-কূল; অর্থাৎ
কন্যার যদি অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে বিবাহ হয়, তাহা হইলে সেই কন্যার
পিতা এবং তাঁহার অধস্তন সন্তানসন্ততি সকলেই সেই নিম্নস্তরের দোষ
প্রাপ্ত হন| সুতরাং পাত্রের পূর্ব্বপুরুষগণের মধ্যে কাহারও কন্যা
অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে বিবাহিতা হইয়াছিলেন কি না, তাহা জানিবার
জন্যই ঘটকের সাহায্য গ্রহণ অপরিহার্য্য ছিল| সেকালে কৌলীন্যমর্য্যাদা
থাকিলে অপর সমস্ত দোষ উপেক্ষিত হইত, তাহা স্বর্গীয় নাট্যকার দীনবন্ধু
মিত্র মহাশয় "লীলাবতী" নাটকে নদেরচাঁদের বিবাহ সম্বন্ধে
বর্ণনা করিয়াছেন| নদেরচাঁদ মূর্খ, অসভ্য, অশিক্ষিত, সকল প্রকার
মাদক দ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত, হীনচরিত্র এবং অতি কদাকার, তথাপি একজন
ধনবান জমিদার তাঁহার একমাত্র কন্যা রূপে গুণে অতুলনীয়া লীলাবতীকে
সেই নদেরচাঁদের হস্তে সমর্পন করিবার জন্য একান্ত আগ্রহান্বিত,
কারণ নদেরচাঁদ তাঁহার অপেক্ষা কূলে শ্রেষ্ঠ| আমরা শুনিয়াছি, আমাদের
একজন নিকষ কূলীন প্রতিবেশীর বাঁয়া-তবলা বাজাইবার খুব সখ ছিল, কিন্তু
সে গণ্ডমূর্খ এবং মধ্যে মধ্যে চুরি করিয়া লাঞ্ছিতও হইয়াছিল| একবার
সে কোন বিবাহে বরযাত্রী হইয়া গিয়াছিল; সেখানে-কন্যা-কর্ত্তার বাড়ীতে,
এক জোড়া খুব সুন্দর বাঁয়া-তবলা দেখিয়া সে লোভ সংবরন করিতে পারিল
না, চুরি করিল, কিন্তু শেষে ধরা পড়িয়াছিল| কন্যাপক্ষের কয়েক জন
লোক যখন তাহাকে পুলিশের হস্তে সমর্পন করিবার পরামর্শ করিতেছিল,
তখন কন্যাকর্ত্তা কোন সূত্রে জানিতে পারিলেন যে, সেই চোর নিকষ
কূলীন, তখন তিনি প্রস্তাব করিলেন যে, চোর যদি তাঁহার অন্য এক কন্যাকে
বিবাহ করে, তাহা হইলে তিনি আর পুলিস ডাকিয়া কোন গোলমাল করিতে দিবেন
না| চোর জেলে যাওয়া অপেক্ষা বিবাহ করা শ্রেয়ঃ মনে করিয়া কন্যাকর্ত্তার
প্রস্তাবে সম্মত হইলে কন্যাকর্ত্তা সেই রাত্রেই তাঁহার প্রথমা
কন্যাকে পূর্ব্বনির্দ্দিষ্ট পাত্রে এবং দ্বিতীয় কন্যাকে সেই চোরের
হস্তে সমর্পন করিয়া স্বীয় বংশমর্য্যাদা উজ্জ্বল করিলেন| এইরূপ
জানিয়া শুনিয়া, হীনচরিত্র, মূর্খ মদ্যপ কূলীনসন্তানকে জামাতৃপদে
বরণ সেকালে বিরল ছিল না|
আমাদের
পরিচিত একজন কুলীন ব্রাহ্মণের দুইটি কন্যা ছিল, পুত্রসন্তান ছিল
না| তাঁহার কিছু জমিজমা ছিল এবং সাত-আট হাজার টাকা নগদ ছিল| তিনি
তাঁহার প্রথমা কন্যার সমান ঘরে অর্থাৎ কুলীনের সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন,
দ্বিতীয়া কন্যা অবিবাহিতা ছিল, তাহার জন্য তিনি পাত্র অনুসন্ধান
করিতেছিলেন| তাঁহার নগদ টাকা তিনি কোথায় লুকাইয়া রাখিতেন, তাহা
তাঁহার পত্নী ব্যাতীত আর কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই| তাঁহার
জ্যেষ্ঠা কন্যা কোনরূপে পিতার গুপ্তধনের সন্ধান পাইয়া তাহা নিজ
স্বামীকে বলিলে তাহারা স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করিয়া সেই টাকা
অপহরণ করিল| কয়েকদিন পরে সেই ব্রাহ্মণ জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার
সমস্ত নগদ টাকা তাঁহারই কন্যা ও জামাতার দ্বারা অপহৃত হইয়াছে|
তখন তিনি জামাতার বাড়ীতে গিয়া কাঁদিয়া পড়িলেন এবং বলিলেন যে, তাঁহার
অবিবাহিতা কন্যার বিবাহ দিতে হইবে, সেই জন্য তিনি তাঁহার টাকার
কিয়দংশ জামাতার নিকট দাবি করিলেন| তাহা শুনিয়া তাঁহার জামাতা বলিল,
"আপনার অবর্ত্তমানে আপনার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি
আপনার এই দুইটি কন্যাই পাইবে, তা আপনি যদি এক কাজ করেন, তাহা হইলে
সকল গোলমাল মিটিয়া যায়| আপনার দ্বিতীয়া কন্যাকে আমার হস্তেই সম্প্রদান
করুন; আমি যদি আপনার দুইটি কন্যাকে বিবাহ করি, তাহা হইলে আপনার
সম্পত্তি লইয়া কাহারও সহিত ভাগবাঁটোয়ারা করিতে হইবে না, আপনিও
কন্যাদায় হইতে উদ্ধার পইবেন|" শ্বশুরমহাশয় দেখিলেন, এই প্রস্তাব
অতিসমীচীন; তিনি জামাতার প্রস্তাবে আনন্দ সহকারে সম্মত হইয়া তাহারই
সহিত দ্বিতীয়া কন্যার বিবাহ দিলেন| সেই শ্বশুরমহাশয় অনেক দিন হইল
লোকান্তরে - সম্ভবতঃ কৌলীন্যলোকে - গমন করিয়াছেন, আর তাঁহার জামাতা
শ্বশুরের টাকা চুরি করিয়া এখন গ্রামের মধ্যে এক জন গণ্যমান্য মাতব্বর
হইয়াছে|
এস্থলে
একটা বিষয়ের উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না| অনেকেরই ধারণা
আছে যে, সেকালের নিকষ কুলীনেরা বহু বিবাহ করিতেন| কিন্তু এই ধারণা
ভ্রান্ত| বহু বিবাহকারীরা সকল পত্নীকে ও তাঁহাদের গর্ভজাত পুত্রকন্যাদিগের
ভরণপোষণ করিতেন না, সাধারণতঃ তাঁহারা একটি বা দুটি পত্নীকে লইয়াই
"ঘর" করিতেন; অনেকে কলহ বিবাহ ও পারিবারিক অশান্তির
ভয়ে একাধিক পত্নীকে বাড়ীতে রাখিতেন না, কেহবা পর্য্যায়ক্রমে দুইটি
বা তিনটি স্ত্রীকে বাড়ীতে রাখিতেন, অবশিষ্ট সকল পত্নীকেই চিরকাল
পিতা ভ্রাতার সংসারে বিনা-বেতনে পাচিকা ও দাসীরূপে কালযাপন করিতেন|
বৎসরের মধ্যে একদিন বা দুই দিন যদি তাঁহারা পতিসেবার সুযোগ পাইতেন,
তাহা হইলে আপনাকে ধন্য বলিয়া মনে করিতেন| তাঁহাদের গর্ভে যে সকল
পুত্র কন্যা জন্মিত, তাহারা চিরকাল মাতুলালয়ে বাস করিত, মাতুলেরাই
তাহাদের ভরণপোষণ, শিক্ষা এবং বিবাহের ভার লইতেন, ভাগিনেয়ীর বিবাহ
মাতুলেরাই দিতেন| আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, রাঢ়ীশ্রেণী ব্রাহ্মণের
কন্যাগত কুল অর্থাৎ কন্যা অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট কুলে বা 'দোষ'গ্রস্ত
কুলে বিবাহিতা হইলে কন্যার পিতার এবং তাঁহার অধস্তন বংশাবলীর কুল
চিরদিনের জন্য কলঙ্কিত হইয়া যায়| সেই কারণে কুলীন ব্রাহ্মণেরা
কন্যার বিবাহের সময, যাহাতে নিজের কুলমর্য্যাদায় কোনরূপ কলঙ্ক
স্পর্শ না করে, সেজন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিতেন| কোন কুলীন
ব্রাহ্মণ যদি তাঁহার ভাগিনেয় বা দৌহিত্রীকে নিকৃষ্ট-বংশীয় পাত্রের
হস্তে সমর্পন করেন, তাহা হইলে তাঁহার নিজের কুলের কোন ক্ষতি হয়
না, কিন্তু কন্যার পিতার কুল নষ্ট হয়| ভাগিনেয়ী বা দৈহিত্রীর বিবাহকালে
কন্যার মাতুল বা মাতামহ পাত্রের কুলশীলের প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখিতেন
না, যাহাকে হউক পাত্রীকে সম্প্রদান করিয়া দায় হইতে উদ্ধার লাভ
করিতেন| নিকষ কুলীনের সন্তান বহুবিবাহ করিলে পাছে তাঁহার কোন কন্যা
নিকৃষ্ট ঘরে বহুবিবাহ হইয়া তাঁহার কুল নষ্ট করে, সেই ভয়েই তাঁহারা
বহুবিবাহ করিতে পারিতেন না| বহুবিবাহ করিতেন ভঙ্গ কুলীনেরা| তাঁহারা
একমাত্র অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট ঘরে বিবাহ করাতে তাঁহাদের কুল ভঙ্গ
হইয়াছে, সুতরাং তাঁহাদের আর কুল ভাঙ্গিবার ভয় ছিল না, তাঁহারা
যেখানে ইচ্ছা ও যত ইচ্ছা বিবাহ করিতেন| বিদ্যাসাগর মহাশয়ের "বহুবিবাহ"
নামক পুস্তকে সেকালের বহুবিবাহকারীদের নামের একটি সুদীর্ঘ তালিকা
আছে| ঘটকমহাশয়ের মতে, সেই তালিকায় দুই-একজন ব্যতীত কোন নিকষ কুলীনের
নাম নেই| যে দুই-এক জনের নাম আছে, তাঁহারাও তিনটি বা চারিটির অধিক
বিবাহ করেন নাই|
অনেকে
মনে করিতে পারেন যে, যাঁহাদের কুল ভাঙ্গিয়াছে অর্থাৎ ভঙ্গ কুলীনগণের
মধ্যে সেকালে অবাধে বিবাহ হইত; কিন্তু তাহা নহে| যিনি নিম্নস্তরে
বিবাহ করিয়া কুল ভঙ্গ করিতেন, লোকে তাঁহাকে বলিত "স্বকৃত
ভঙ্গ"| তাঁহার পুত্র "দুই পুরুষে" পৌত্রে "তিন
পুরুষে", প্রপৌত্র "চার পুরুষে" নামে অভিহিত হইতেন|
এইরূপে সাত পুরুষ হইয়া গেলে "বংশজ" অভিধানে অভিহিত করা
হইত| যিনি "তিন পুরুষে" তিনি নিজ কন্যার বিবাহের জন্য
"দুই পুরুষে" পাত্রের সন্ধান করিতেন, সহজে "চার
পুরুষে" বা "পাঁচ পুরুষে" পাত্র কন্যাদান করিতে
সম্মত হইতেন না| সুতরাং কুল ভাঙ্গিলেই যে কৌলীন্যের জঞ্জাল মিটিয়া
যাইত, তাহা নহে| তাহার উপর কুলীন ব্রাহ্মণগণ "ফুলিয়া"
"খড়দহ" "বল্লভী" "সর্ব্বানন্দী"
প্রভৃতি নানা "মেলে" বিভক্ত, তন্মধ্যে ঘটকদিগের মতে
উল্লিখিত চারিটি মেলই শ্রেষ্ঠ| এক মেলের ব্রাহ্মণ অন্য মেলের সহিত
বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে সম্মত হইতেন না| ভঙ্গ কুলীনেরাও কিছুতেই
"মেলান্তর" হইতে সম্মত হইতেন না| ঘটকদিগের মতে "ফুলিয়া
খড়দহ নাস্তি বিশেষ" অর্থাৎ ফুলিয়া ও খড়দহ মেলের মধ্যে বিশেষ
পার্থক্য না থাকতে পশ্চিমবঙ্গের অনেকস্থানে ঐ দুই মেলের মিশ্রণ
ঘটিয়াছে| শুনিয়াছি পূর্ব্ববঙ্গে বিক্রমপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এখনও
কেহ মেলান্তর স্বীকার করেন না|
ব্রাহ্মণের
বিবাহে, সেকালে ঠিকুজি কোষ্ঠীর কথা প্রায় উঠিত না, কারণ এই কুলশীলের
হাঙ্গামার পর যদি বা একটি পাত্রী বা পাত্র পাওয়া যাইত, তাহাদের
কোষ্ঠী বিচার করিতে গেলে আর বিবাহ দেওয়া চলিত না| অনেকে সময় বিবাহের
"শুভদিন" পর্য্যন্ত দেখা হইত না, পাত্র মনোনীত হইলে
কন্যার পিতা অনেক সময় যে-কোন দিনে কন্যার বিবাহ দিতেন| আমরা বাল্যকালে
আমাদের পড়ায় এক বৃদ্ধের তরুণী ভার্য্যা দেখিয়াছি| শুনিয়াছি, তাঁহাদের
বিবাহ নাকি ভাদ্র মাসের অমাবস্যাতে হইয়াছিল, অথচ ভাদ্র মাসে বিবাহ
বঙ্গীয় হিন্দুসমাজে নিষিদ্ধ| সেকালের অনেক ব্রাহ্মণই এইরূপ "মাকড়
মারলে ধোকড় হয়" নীতি অবলম্বন করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না|
একটা বিষয়ে সেকালের
বিবাহ একালে আদর্শস্থানীয় হইতে পারে| সেকালে কোন কন্যার পিতাকেই
অর্থাভাবের জন্য "কন্যাদায়গ্রস্ত" হইতে হইত না| কোন
পাত্রের পিতাই পুত্রের বিবাহকালে কন্যার গলায় ছুরি দিতেন না| সেকালের
ধনশালী ব্রাহ্মণেরা কন্যার বিবাহে যে যৌতুক ও বরাভরণ দিতেন, একালে
সেরূপ ব্যবস্থা হইলে অতিদরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত ব্যক্তিও বাঁচিয়া
যান| কুলীনের সন্তান, বিবাহকালে কন্যার পিতার নিকটে কৌলীন্যমর্য্যাদাস্বরূপ
মাত্র ষোল টাকা দাবি করিতে পারিতেন, ইহার অধিক দাবি তিনি করিতে
পারিতেন না| এই কৌলীন্যমর্য্যাদার ষোল টাকা এখন ষোল শতে পরিণত
হইয়াছে| আমরা বাল্যকালে দেখিয়াছি, মধ্যবিত্তশালী ব্রাহ্মণের কন্যার
বিবাহে, বরাভরণ, অলঙ্কার, দানসামগ্রী প্রভৃতিতে মোট দেড় শত বা
দুই শত টাকা ব্যায় হইত| এখন সেইরূপ মধ্যবিত্ত কোনব্রাহ্মণ যদি
দুই হাজার টাকা ব্যায় করিয়া কন্যার বিবাহ দিতে পারেন, তাহা হইলে
তিনি আপনাকে ভাগ্যবান বলিয়া মনে করেন| গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসরের
মধ্যে বরের মূল্যে যেরূপ দ্রুত চড়িয়া গিয়াছে, তাহা ভাবিলে বিস্মিত
হইতে হয়|
বরের এই মূল্যবৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে, ভোজ উপলক্ষ্যে অর্থব্যয় বিস্ময়কর রূপে বাড়িয়া গিয়াছে|
সেকালে যে সময় আমাদের বিবাহ হইয়াছিল, সে সময় "পাকা দেখা"
বলিয়া কিছু ছিল না| বিবাহের পূর্ব্বে একদিন কন্যর পিতা বরকে এবং
অন্য একদিন বরের পিতা কন্যাকে আশীর্ব্বাদ করিতে যাইতেন| প্রথমে
ধান, দূর্ব্বা ও চন্দন দ্বারা আশীর্ব্বাদ করিয়া পরে রৌপ্যমুদ্র
বা ধনবান হইলে স্বর্ণমুদ্রা দিয়া আশীর্ব্বাদ করা হইত| আশীর্ব্বাদ
করিবার জন্য কন্যাকর্ত্তা বা বরকর্ত্তা একাকী না গিয়া দুই চারি
জন আত্মীয়বন্ধুকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন, যাঁহার বাড়ীতে আশীর্ব্বাদ
হইত তাঁহারও দুই চারি জন আত্মীয় বা প্রতিবেশী তথায় উপস্থিত থাকিতেন,
আশীর্ব্বাদের পর সকলকেই একটু "মিষ্টমুখ" করান হইত| সেই
"মিষ্টমুখের" জন্য বাজার হইতে তিন-চারি প্রকার মিষ্টান্ন
ক্রয় করিয়া আনা হইত| এই আশীর্ব্বাদ আজকাল কলিকাতা অঞ্চলে "পাকা-দেখা"
রূপে পরিণত হইয়া, অপব্যয় যে কতরূপে হইতে পারে, তাহারই উদাহরণস্বরূপ
হইয়াছে| গত বৎসর কলিকাতায় আমার কোন বন্ধুর পুত্রের বিবাহে পাকা-দেখাতে
নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়া লুচি ও পোলাও ছাড়া মাছ, মাংস, আমিষ,
নিরামিষ তরকারি এবং চাটনি, মিষ্টান্ন, দধি, রাবড়ী প্রভৃতিতে চল্লিশ
প্রকার ভোজ্যের আয়োজন দেখিয়া আসিয়াছি| পরে শুনিলাম যে, কন্যাকর্ত্তাও
হারিবার পাত্র নহেন, তিনি তাঁহার কন্যার পাকা দেখার দিন পাত্রের
পিতা এবং অন্যান্য নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণকে, শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথের
সমপর্য্যায়ভুক্ত করিয়া অর্থাৎ বাহান্ন প্রকার ভোজ্যের আস্বাদ গ্রহণ
করাইয়াছিলেন| এই পাত্রপক্ষ বা পাত্রীপক্ষ বিশেষ ধনশালী নহেন, মধ্যবিত্তশালী
গৃহস্থ| আমরা সেকালের বৃদ্ধগণ যখন আজকালকার পাকা-দেখা উপলক্ষে
বরকর্ত্তা ও কন্যাকর্ত্তার অর্থের অপব্যবহার দেখি, তখন মনে হয়
যে, পাত্রের পিতা ও কন্যার পিতা উভয়ের মধ্যে যে কত অধিক নির্ব্বুদ্ধিতার
পরিচয় দিতে পারেন, তাহা লইয়া যেন ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ
হইয়াছে| বোধ হয় সকলেই লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন যে, আজকাল পাকা-দেখা
অথবা অনুরূপ কোন কার্য্য উপলক্ষে, নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের পাত্রে
যে-সকল ভোজ্যদ্রব্য পরিবেশন করা হয়, কোন নিমন্ত্রিত ব্যক্তি তাহার
চতুর্থাংশও ভোজন করেন না বা ভোজন করিতে পারেন না| সুতরাং খাদ্যদ্রব্যের
বার আনা নষ্ট হয়| অনেকে বলিতে পারেন যে, নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের
পাত্রে যে সকল ভুক্তাবশিষ্ট খাদ্য পড়িয়া থাকে, প্রকৃতপক্ষে তাহা
নষ্ট হয় না, পরে সেই সকল খাদ্য দরিদ্র কাঙালীদের মধ্যে বিতরণ করা
হয়| তাহারা ঐ সকল দেবদুর্ল্লভ খাদ্য কিনিয়া খইতে পারে না, গৃহস্থের
বাড়ীতে ভোজ উপলক্ষে সেই সকল খাদ্য তাহারা ভোজন করিতে পায়| কিন্তু
এই যুক্তি নিতান্ত অসার| যে-ভোজে চারি শত টাকা ব্যয় হয়, তাহার
চতুর্থাংশ মাত্র নিমন্ত্রিতগণ ভোজন করিলে প্রায় তিন শত টাকার আহার্য্য
কাঙালীরা খায় সত্য, কিন্তু তাহাতে তাহাদের কোন উপকার হয় কি? সেই
তিন শত টাকায় অন্যরূপে কোন উপকার করিতে পারা যায় না কি? এক দিন
তাহারা আধখানা চপ, একখানা পেস্তার বরফী বা একখানা শোণপাঁপড়ি খাইয়া
চতুর্ভুজ হয় না| যাক, এ অর্থনীতির আলোচনার প্রয়োজন নাই|
আজকাল বিবাহ উপলক্ষে, বরযাত্রী সংখ্যা সেকাল অপেক্ষা অনেক অধিক
হয়| সেকালে যেরূপ অবস্থাপন্ন ব্যক্তির পুত্রের বিবাহে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ
জন বরযাত্রী হইত, আজকাল সেইরূপ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ পুত্রের বিবাহে
একশত বা দেড় শত বরযাত্রী হয়| সেকালের লোকে বোধ হয় এইরূপ মনে করিতেন
যে, আমার পুত্রের বিবাহে, যাহারা আমার আত্মীয়বন্ধু, আমার পুত্রের
বন্ধুবান্ধব বা আমার প্রতিবেশী, তাঁহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতে
হইলে আমার বাড়ীতে খাওয়াইব, কন্যাদায়গ্রস্ত অপর একজন ভদ্রলোকের
স্কন্ধে তাঁহাদের ভার চাপাইব কোন্ অধিকারে? সেই জন্য যাঁহারা
পুত্রের বিবাহে, গাত্রহরিদ্রা বা পাকস্পর্শ তিন-চারিশত লোককে নিমন্ত্রণ
করিতেন, তাঁহারাও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনের অধিক বরযাত্রী লইয়া যাইতেন
না| কয়েক বৎসর পূর্ব্বে, আমার সুপরিচিত কোন যুবকের বিবাহে, বরযাত্রীর
সংখ্যা একশতের কিছু অধিক হইয়াছিল, তন্মধ্যে প্রায় আশী জন বরের
সতীর্থ ও বন্ধু| সেই বিবাহে পাত্রীর পিতাকে সামান্য অসুবিধায় পড়িতে
হয় নাই| পাত্রীর পিতা কলিকাতাবাসী, কলিকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত
গৃহস্থের বাড়ীর ন্যায় তাঁহার বাড়ীরে একান্ত স্থানাভাব; বোধ হয়
কুড়ি জন লোককে বসাইয়া খাওয়াইবার স্থান তাঁহার বাটীতে নাই| ইহা
জানিয়াও পাত্রপক্ষ এক শতের অধিক বরযাত্রী আনিয়াছিলেন|
সেকালে
বরযাত্রী দলে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের সংখ্যা অধিক থাকিত, যুবক ও বালকের
সংখ্যা খুব অল্প থাকিত| একালে ঠিক তাহার বিপরীত হইয়াছে| সেকালে
বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীদের মধ্যে যেন একটা বিরোধ ভাব দেখা যাইত|
উভয় পক্ষ পরস্পরকে ঠকাইবার বা জব্দ করিবার জন্য যেন পূর্ব্ব হইতে
প্রস্তুত হইয়া থাকিত| ইহার ফলে অনেক ক্ষেত্রে বচসা হইতে অবশেষে
মারামারি পর্য্যন্ত হইত এবং সেটা অধিক সময়ে বালক ও যুবকগণের মধ্যেই
হইত| তবে অনেক ক্ষেত্রে, সেই বিবাদে প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধেরা পর্য্যন্ত
জড়াইয়া পড়িতেন| এই কলহবিবাদের ফলে অনেক স্থলে বিবাহ পর্য্যন্ত
হইত না, বরের অভিভাবক বিবাহের পূর্ব্বেই বরকে লইয়া প্রস্থান করিতেন|
সেরূপ ঘটনায় কন্যার পিতা, সেই রাত্রেই প্রতিবেশী বা গ্রামবাসীদের
মধ্য হইতে এক জন পাত্রের সন্ধান করিয়া তাহারই সহিত কন্যার বিবাহ
দিতেন| কারণ, সেই রাত্রেই কন্যার বিবাহ দিতে না পারিলে কন্যার
পিতাকে সমাজচ্যুত হইতে হইত, পরে সেই কন্যার বিবাহ বড়ই কঠিন হইত|
এই কারণে অনেক সময় অযোগ্য পরিণয় হইত| হয়ত কন্যার সমবয়স্ক অথবা
তাহা অপেক্ষা দুই-তিন বৎসরের বড় পাত্রের সহিত কন্যার বিবাহ হইত,
অথবা বিগত-যৌবন, কৃতদার কোন ব্যক্তিকে অনুরোধ, উপরোধ, অনুনয়-বিনয়
করিয়া বা অর্থের লোভ দেখাইয়া তাহারই হস্তে কন্যা সম্প্র্দান করা
হইত| আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, সেকালের পাত্রের বিদ্যা-বুদ্ধি
বা স্বভাব-চরিত্র অপেক্ষা তাহার কৌলীন্যমর্য্যাদার প্রতিই সমধিক
দৃষ্টি রাখা হইত| সুতরাং কোন অবিবাহ-বিভ্রাট উপস্থিত হইলে, পাত্রীর
পিতা স্ব-ঘরের অর্থাৎ নিজের মত কৌলীন্যমর্য্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরই
অনুসন্ধান করিতেন, তা সে পাত্র বিবাহিত কি অবিবাহিত, বৃদ্ধ কি
প্রৌঢ়, তাহা দেখিবার প্রয়োজন হইত না| আমরা বাল্যকালে আমাদের প্রতিবেশী
এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দেখিয়াছি, তাঁহার বিবাহ নাকি ঐরূপ অকস্মাৎ
হইয়াছিল| তিনি গল্প করিতেন - "রাত্রিতে আহারাদি করিয়া শুইয়া
আছি, রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আমার পিতার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গিয়া
গেল, ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন -ওঠ, শীঘ্র কাপড় বদলাইয়া
আমার সঙ্গে চল, তোমাকে বিবাহ করিতে হইবে; মুখুজ্যের কন্যার বিবাহ
সভা হইতে বর উঠিয়া গিয়াছে, তুমি সেই কন্যাকে বিবাহ করিবে, নচেৎ
সে ব্রাহ্মণের জাতি নষ্ট হয়|" কোথায় বা আশীর্ব্বাদ আর কোথায়
বা গাত্রহরিদ্রা! আমি বাবার সঙ্গে প্রয় আধ ক্রোশ পথ চলিয়া গিয়া
কন্যাকর্ত্তার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম| সেই রাত্রেই আমার বিবাহ হইয়া
গেল|" এরূপ বিবাহ সেকালে বিরল ছিল না|
সেকালে যে-সকল যুবক ও বালক বরযাত্রী হইয়া যাইত, তাহাদের মধ্যে
অনেকেই কন্যাপক্ষের অনিষ্ট করিবার জন্য পূর্ব্ব হইতে সঙ্কল্প যেন
করিয়া যাইত| অনেকে ছুরি বা কাঁচি পকেটে করিয়া লইয়া যাইত, বরযাত্রী
ও কন্যাযাত্রীদিগের উপবেশনের জন্য যে-সকল আসন পাতা হইত, অনেকে
সেই আসন, জাজিম বা চাদর কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিত| কেহ বা ভোজনকালে
পাত হইতে লুচি ও মিষ্টান্ন লইয়া জানালা দিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিত|
এই সকল অন্যায় কার্য্য করা অনেকে বিশেষ বাহাদুরি বলিয়া মনে করিত
এবং বাটীতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া বন্ধু বান্ধবের নিকট গর্ব্বভরে
গল্প করিত| প্রধানতঃ ঐ সকল কার্য্য করিবার সময় কেহ ধরা পড়িলেই
কলহ বিবাদ ও মারামারি হইত| সুখের বিষয়, ঐরূপ অশিষ্টতা ও অন্যায়
একালে বড় দেখা যায় না|
সেকালে বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীরা পরস্পরকে কথায় ঠকাইবার জন্যও
বিশেষ চেষ্টা করিতে ত্রুটি করিত না| এ সম্বন্ধে অনেক গল্প আমরা
বাল্যকালে শুনিতাম| দুই-একটা গল্পের উদাহরণ বোধ হয় এস্থলে অপ্রাসঙ্গিক
হইবে না| সেকালে হুগলী জেলায় গঙ্গার তীরে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া এবং
গঙ্গার অপর পারে নদীয়া জেলার উলা বা বীরনগর গ্রামের মধ্যে নানা
বিষয়ে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইত| গুপ্তিপাড়া অঞ্চলে
হনুমানের অত্যন্ত উপদ্রব ছিল| ঐ অঞ্চলে যত অধিকসংখ্যক হনুমান ছিল
এবং এখনও আছে, হুগলী জেলার অন্য কোন স্থানে সেরূপ নাই| সেই জন্য
উলা বা শান্তিপুরের লোক রহস্য করিয়া গুপ্তিপাড়ার অধিবাসীদিগকে
পাকেপ্রকারে হনুমান বলিয়া আমোদ উপভোগ করিত| একবার গুপ্তিপাড়ার
একটি পাত্রের সহিত উলার একটি কন্যার বিবাহ হয়| সেই বিবাহে কন্যাপক্ষ
বরযাত্রীদিগকে আহ্বান করিবার জন্য একটা হনুমান ধরিয়া কন্যার বাড়ীর
দ্বারে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল| ঐ রূপ করিবার উদ্দেশ্য এই যে, গুপ্তিপাড়া
হইতে এক দল হনুমান বরযাত্রী হইয়া আসিতেছে, সুতরাং একটা হনুমানই
কন্যাপক্ষের প্রতিনিধিস্বরূপ তাহাদের অভর্থনা করুক| বরযাত্রীরা
বর লইয়া কন্যার বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইবামাত্র সেই হনুমানটাকে দেখিতে
পাইল এবং কন্যাপক্ষের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিল| তখন বরযাত্রীদের
মধ্যে এক জন প্রৌঢ় অগ্রসর হইয়া হনুমানের নিকতবর্ত্তী হইলেন এবং
হনুমানের গালে একটা চড় বসাইয়া দিলেন| তাহা দেখিয়া কন্যাপক্ষের
একব্যক্তি তথায় উপস্থিত হইয়া হনুমানকে চড় মারিবার কারণ জিজ্ঞাসা
করিলে সেই প্রৌঢ় বরযাত্রী তাঁহার কথার উত্তর না দিয়া হনুমানকে
সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, "বেহায়া, দেশে থাকিয়া কি খাইতে
পাইতিস না, তাই এই শ্বশুরবাড়ীতে ঘরজামাই হইয়া দ্বারবানগিরি করিতেছিস?"
আর
একবার গুপ্তিপাড়ায় একদল বরযাত্রী শান্তিপুরে বিবাহ দিতে গিয়াছিলেন|
কন্যাকর্ত্তার বাড়ীতে দ্বারদেশে কন্যাকর্ত্তার ভাগিনেয় বরযাত্রীদিগের
অভ্যর্থনার জন্য দণ্ডায়মান ছিল| সেই যুবক প্রত্যেক বরযাত্রীকে
"আসুন, আসুন, আসিতে আজ্ঞা হউক" বলিয়া অভ্যর্থনা করিয়াই
জিজ্ঞাসা করিতেছিল - "মহাশয়, লঙ্কার সংবাদ কি?” রামায়ণে বর্ণিত
আছে যে, রামচন্দ্র সীতার সংবাদ জানিবার জন্য তাহার প্রত্যাবর্ত্তন
প্রতীক্ষা করিয়াছিলেন, তাই এই যুবক প্রত্যেক বরযাত্রীকে লঙ্কার
সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া প্রকারান্তরে তাঁহাদিগকে হনুমান বলিতেছিল|
বালক ও যুবক বরযাত্রীরা তাহার কথার কোন উত্তর দিল না| অবশেষে বরের
পিতৃস্থানীয় এক বৃদ্ধকে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন,
"তুমিই? তা বেশ হইয়াছে, আমাকে আর অধিক অনুসন্ধান করিতে হইল
না; আমার সঙ্গে এস, আমি একটু বিশ্রাম করিয়া ধূমপানের পর সব কথা
বলিতেছি|" এই বলিয়া তিনি গম্ভীর ভাবে সভামধ্যে গিয় উপবেশন
করিলেন| যাহারা ঐ প্রশ্ন এবং বৃদ্ধের কথা শুনিয়াছিল, তাহারা, বৃদ্ধ
কি উত্তর দেন শুনিবার জন্য কৌতূহলী হইয়া সভায় গিয়া উপবেশন করিল|
বৃদ্ধের ধূমপান শেষ হইলে সেই যুবা আবার তাঁহাকে বলিল, "মহাশয়,
লঙ্কার সংবাদ কি বলুন|" তখন বৃদ্ধ বলিলেন, "লঙ্কার সংবাদ
জানিবার জন্য তোমার আগ্রহ হইবারই কথা| আমিও এইমাত্র লঙ্কা হইতেই
আসিতেছি| লঙ্কার সংবাদ বড় ভাল নহে| লঙ্কাতে গিয়া দেখিলাম, তথায়
অনেক গৃহ দগ্ধ ও বিধ্বস্ত হইয়াছে| ব্যাপার কি জানিবার জন্য আমি
রাবণ রাজার সঙ্গে দেখা করিলাম| তিনি বলিলেন, যে, সাগরপার হইতে
একটা হনুমান আসিয়া তাঁহার সুবর্ণপুরী লঙ্কার এই দশা করিয়াছে, তিনি
প্রতিশোধ লইবার জন্য হনুমানটাকে ধরিয়া তাহাকে বন্ধনপূর্ব্বক সমুদ্রতীরে
পাঠাইয়া দিয়াছেন এবং অনুচরদিগকে আদেশ দিয়াছেন যে, হনুমানটাকে যেন
জীবিত অবস্থায় দগ্ধ করা হয়| রাজার মুখে ঐ কথা শুনিয়া আমি তখনই
সমুদ্রতীরে গিয়া দেখিলাম, একটা বীরহনুমান রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় সমুদ্রতীরে
পড়িয়া আছে, রাজার অনুচরেরা দূরে চিতাসজ্জা করিতেছে| আমি হনুমানের
কাছে যাইবা মাত্র সে আমাকে দেখিয়া কাতর স্বরে বলিল, "আপনাকে
দেখিয়া বাঙ্গালী বলিয়া মনে হইতেছে| যদি আমার এই আসন্ন মৃত্যুকালে
একটি উপকার করেন, তাহা হইলে বড়ই বাধিত হইব|' আমি তাহার উপকারে
সম্মত হইলে সে বলিল, "আমার পুত্রকে আমার এই বিপদের কথা জানাইয়া
তাহাকে অবিলম্বে এখানে আসিতে বলিবেন|" আমি বলিলাম-"আমি
ত তোমার পুত্রকে চিনি না, কোথায় তাহার সাক্ষাৎ পাইব?" তাহাতে
সে বলিল, "আমার পুত্র শান্তিপুরে আছে| আমি লঙ্কায় আসিয়াছি
সে জানে| অনেক দিন আমার সংবাদ না পাইয়া সে বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়াছে|
সে যাহাকে দেখিতেছে, তাহাকেই লঙ্কার সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতেছে|"
যাহা হউক, সহজেই তোমার সহিত দেখা হইল, আমাকে অধিক অনুসন্ধান করিতে
হইল না| এখন ত লঙ্কার সকল সংবাদ শুনিলে, যাহা কর্ত্তব্য হয় কর|"
এইরূপ বাক্যুদ্ধ সেকালে বিবাহসভায় বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীদের
মধ্যে সর্ব্বদাই হইত|
সেকালে,
বিবাহরাত্রিতে, বিবাহকার্য্য শেষ না হইলে বরযাত্রী বা কন্যাযাত্রী
খাওয়ান হইত না| বোধ হয় কোন ক্ষেত্রে বিবাহ পণ্ড হইত বলিয়াই ঐরূপ
ব্যবস্থা ছিল| তবে যদি অধিক রাত্রিতে বা শেষরাত্রিতে বিবাহের লগ্ন
থাকিত, তাহা হইলে এই ব্যবস্থার ব্যতিক্রম হইত, বিবাহের পূর্ব্বেই
নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণকে খাওয়ান হইত| প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বরযাত্রীদিগকে
অগ্রে খাওয়াইয়া তাহার পর কন্যাযাত্রীদিগকে খাওয়ান হইত, ইহাতে কন্যাযাত্রীরা
কোন আপত্তি করিতেন না| বোধ হয়, বরযাত্রীরা অভ্যাগত, সেই জন্য কন্যাযাত্রীরা
তাঁহাদিগকে অতিথি মনে করিয়াই অগ্রে তাঁহাদিগের ভোজনে কোন আপত্তি
করিতেন না| বরযাত্রীদিগের মধ্যে ব্রাহ্মণদিগকে অগ্রে ভোজনস্থানে
লইয়া গিয়া বসান হইত, তাঁহারা ভোজনে প্রবৃত্ত হইলে তবে শূদ্র বরযাত্রীদিগকে
ভোজনস্থানে লইয়া যাওয়া হইত| কোন কোন ক্ষেত্রে বরপক্ষীয় ও কন্যাপক্ষীয়
উভয় পক্ষীয় ব্রাহ্মণদিগকে একসঙ্গেই ভোজন করান হইত, কারণ তাহা না
করিলে শূদ্র বরযাত্রীরা বলিতেন, "যে বাড়ীতে কোন ব্রাহ্মণ
অভুক্ত থাকেন, সে বাড়ীতে আমরা অগ্রে কিরূপে ভোজন করিব?"
সেই
জন্য উভয় পক্ষের ব্রাহ্মণগণকে একযোগেই খাওয়ান হইত| তবে কন্যাযাত্রীদিগের
মধ্যে যাঁহাদিগকে ট্রেন ধরিবার জন্য ষ্টেশনে যাইতে হইত, তাঁহাদিগকে
ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্ব্বিশেষে সকলের অগ্রে খাওয়ান হইত| তখন আর সামাজিক
বিধিনিষেধের প্রতি লক্ষ্য রাখা হইত না| সেকালের ভোজে আমিষের কোন
সংশ্রব থাকিত না, সমস্ত ব্যঞ্জনই নিরামিষ হইত| ব্রাহ্মণ ব্যতীত
অন্য কোন জাতির বাড়ীতে ভোজে ব্যঞ্জনে লবণ দেওয়া হইত না, কারণ,
ব্যঞ্জনে লবণ দিলেই তাহা "শকড়ি" হয়| স্বজাতীয় ভিন্ন
অন্য কোন জাতি সেরূপ শকড়ি ব্যঞ্জন ভোজন করিতেন না| আমি যৌবন কালে
কোন বন্ধুর বিবাহে বরযাত্রী হইয়া হাওড়াতে গিয়াছিলাম| আমার বন্ধুটি
শূদ্র| সেই বিবাহ-বাটীতে প্রথম দেখিলাম যে, লুচির সঙ্গে ছোলার
ডাল দেওয়া হইল, তাহার পূর্ব্বে কোন শূদ্রের বাড়ীর ভোজে ছোলার ডাল
দেখি নাই| বলা বাহুল্য যে, সেই ডাল ও অন্যান্য ব্যঞ্জনে লবণ ছিল
না| আমরা তখন "ছেলে ছোকরা", সুতরাং আমরা বিনা আপত্তিতে
সেই ডাল ভোজন করিলাম| কিন্তু গোল বাধাইলেন এক জন বৃদ্ধ তিলি| তাঁহার
পাতে ডাল দিবামাত্র তিনি ভোজনে বিরত হইয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া রহিলেন|
কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন, "ব্রাহ্মণ এবং আমার স্বজাতি
ছড়া অন্য শূদ্রের বাড়ীতে ডাল খাইব কিরূপে? যদি ডাল খাইলাম, তহা
হইলে ভাত খাইতে আপত্তি কি? ডাল ভাত একই কথা|" তখন তাঁহার
সেই ডালস্পৃষ্ট ভোজনপাত্র সরাইয়া আবার নূতন করিয়া পাতা দেওয়া হইলে
তিনি ভোজনে প্রবৃত্ত হইলেন|
সেকালে বিবাহের প্রধান অনুষ্ঠান স্ত্রী-আচারের সময় অনেক ক্ষেত্রেই
বর বেচারাকে নানারূপ শারীরিক নিগ্রহ ভোগ করিতে হইত| শ্যালিকা,
শ্যালকজায় বা ঠানদিদি প্রভৃতি মহিলাদিগের সুকোমল করস্পর্শে বরের
কর্ণ অনেক সময় রক্তাক্ত হইত, বর প্রতিবাদ করিলেই সে বদরসিক বলিয়া
গণ্য হইত| "ছাদনাতলা"য় যখন বরবধূকে বরণ করা হইত, তখন
অনেক সময় বরের পৃষ্ঠদেশ আজকালকার পুলিশের মৃদু যষ্ঠি চালনার ন্যায়
কোমলমুষ্ঠ্যাঘাতে জর্জ্জর হইত| ছাদনাতলায় বরকে যে পীঠ বা পিঁড়ার
উপর দাঁড়াইতে হয়, অনেক সময় কোন কোন সুরসিকা সেই পিঁড়ার তলায় পাঁচ-সাতটা
সুপারি দিয়া রাখিতেন, উদ্দেশ্য যে বর পিঁড়ার উপর দাঁড়ইবা মাত্র
পিঁড়া সরিয়া যাইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে বরও পড়িয়া যাইবে| এই অদ্ভুত
রসিকতার জন্য কোন কোন বরকে গুরুতররূপে আহত হইয়া শয্যাগত হইতে হইত|
সেই জন্য, বিবাহেযাত্রা করিবার পূর্ব্বে বরের বাড়ীর গৃহিণীরা বরকে
সাবধান করিয়া বলিয়া দিতেন, "ছাদনাতলায় পিঁড়ায় দাঁড়াইবার পূর্ব্বে
পায়ে করে পিঁড়াটা ঠেলিয়া দেখিও তাহার তলায় সুপারি আছে কি না|"
এই ছাদনাতলাতেই বরকন্যা "শুভদৃষ্টি" হয়, অর্থাৎ বর বধূকে
এবং বধূ বরকে প্রথম দর্শন করে| শুভদৃষ্টির পূর্ব্বে বরবধূর পরস্পরকে
দেখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল| বরের অভিভাবকগণ কন্যা দেখিয়া পছন্দ
করিতেন, কন্যার অভিভাবক বরকে দেখিয়া আসিতেন| শুনিয়াছি, সেকালে
(অর্থাৎ আমাদের পিতৃপিতামহের আমলে) নিকষ মুলীন বিবাহে অনেক ক্ষেত্রে,
বিবাহের পূর্ব্বে বর বা কন্যাকে দেখিবারও প্রয়োজন হইত না, ঘটকের
দ্বারাই সমস্ত কার্য্য সমাধা হইত, বিবাহের দিন স্থির হইলে বর বিবাহ
করিতে যাইত, তখন সকলে বরকে প্রথম দেখিত| বিবাহের পর কন্যা শ্বশুরালয়ে
গেলে, লোকে কন্যা দেখিত এবং তখন তাহার রূপের সমালোচনা হইত|
ছাদনাতলায়
অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেই বর বেচারা নিষ্কৃতি পাইত না, তাহার
কঠোরতর অগ্নিপরীক্ষা হইত বাসরঘরে| বর বাসরঘরে গিয়া উপবেশন করিলে
প্রথমেই সমাগত স্ত্রীলোকগণ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, "কন্যা
পছন্দ হইয়াছে কি?" যেন পছন্দ না হইলে তাঁহারা কোন প্রতিকার
করিতে পারেন| তাহার পর বরকে গান গাহিবার জন্য অনুরোধ| বর যত ক্ষণ
গান না করিত, তত ক্ষণ তাহার উপর জুলুম চলিত| বাসরঘরেও বরের কর্ণমর্দ্দন
প্রভৃতি শারীরিক দণ্ডের অভাব হইত না| বাসরঘরে সমবেত মহিলারা অনেক
সময় বরের সহিত এরূপ প্রাকটিক্যাল জোক করিতেন যে, বরের প্রাণ লইয়া
টানাটানি হইত| তাম্বুলের মধ্যে অত্যাধিক পরিমাণে চূণ বা লঙ্কাবীজ
দিয়া বরকে খাইতে দেওয়া হইত| আমরা বাল্যকালে গল্প শুনিয়াছি যে,
একবর সুদূর পল্লীগ্রামে বিবাহ করিতে গিয়াছিল, বাসরে তাহার গ্রীষ্ম
বোধ হওয়াতে সে একখানা পাখা চাহিয়াছিল| তাহা শুনিয়া বাসরে সমাগত
স্ত্রীলোকেরা বলে, "আমাদের দেশে গরম বোধ হ'লে লেপ গায়ে দিতে
হয়|" এই বলিয়া একখানা লেপ বরের উপর চাপা দিয়া তাহাকে এমন
চাপিয়া ধরিয়াছিল যে, শ্বাস রুদ্ধ হইয়া বরের মৃত্যু হয়| এই গল্প
অতিরঞ্জিত হইতে পারে, কিন্তু সেকালে পল্লীগ্রামে অশিক্ষিতা রমণী
সমাজে রসিকতাজ্ঞান কিরূপ ছিল, তাহা এই গল্প হইতে অনুমান করা যাইতে
পারে|
আমাদের সময়ে
বিবাহের বয়স, পাত্রপক্ষে পনর-ষোল হইতে কুড়ি-একুশ এবং পাত্রীপক্ষে
নয় হইতে বার বৎসর পর্য্যন্ত নির্দ্দিষ্ট ছিল| আমার এবং আমার সতীর্থগণের
মধ্যে অনেকেরই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবার দুই-এক বৎসর পূর্ব্বেই
বিবাহ হইয়াছিল| সেকালে এগার-বার বৎসর বয়সে বালিকাদের বিবাহ না
হইলে তাহার অভিভাবকবর্গের আর দুশিন্তায় রাত্রিতে নিদ্রা হইত না|
কুমারী কন্যার বয়স বার বৎসর উত্তীর্ণ হইলে তাহার জনক-জননীর, বিশেষতঃ
জননীর পাড়ায় মুখ দেখান ভার হইত| ইহার ব্যতিক্রম হইত কুলীন কুমারীর
বেলা| স্বঘরে পাত্র অন্বেষণ করিতে করিতে অনেক সময় কুলীন কুমারীর
বয়স সতর, আঠার এমন কি কুড়ি বৎসরও পার হইয়া যাইত, অনেকের একেবারেই
বিবাহ হইত না| আমি এইরূপ দুইটি কুমারীকে দেখিয়াছি| আমার কোন বন্ধুর
বিবাহ উপলক্ষ্যে, হালিশহরে বন্ধুর বাড়ীতে গিয়া তাহাদের সাক্ষাৎ
লাভ করি| তাহারা দুইটি সহোদরা, উভয়েরই মাথার চুল পাকিয়াছে, দাঁত
পড়িয়াছে| তাহারা সধবার মত শাড়ী ও অলঙ্কার পরিয়াছিলেন, কিন্তু মাথার
সিন্দুর ছিল না দেখিয়া বিস্মিত হইয়া আমার বন্ধুকে কারণ জিজ্ঞাসা
করায় তিনি বলিলেন, "উঁহারা প্রাতঃস্মরণীয় দীননাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের
ভগিনী| উঁহারা বড় কুলীন, উঁহাদের সমান ঘর এ অঞ্চলে না-থাকাতে উঁহাদের
বিবাহ হয় নাই|" সেই কুমারীদ্বয়ার বয়স তখন বোধ হয় ষাট হইতে
সত্তর বৎসর হইবে| সেকালে বালিকাদের অল্প বয়সে বিবাহ হইতে বলিয়া
বালিকারা অল্প বয়সেই সন্তানের জননী হইত| অনেকে বার-তের বৎসর বয়সেই
মাতৃত্ব লাভ করিত|
('
প্রবাসী', বৈশাখ ১৩৪৫)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।