রূপান্তর

গত রাতের
জড়ানো খোঁপাটি কখন আলগা হয়ে পিঠের উপর দীর্ঘ বেণী হয়ে ঝুলছিল
কল্যাণী তা টের পায় নি। তেমনি ভাবেই শিউলি তলায় ফুল কুড়োচ্ছিল।
জুতার শব্দে মুখ তুলে দেখে -- বেড়ার ধার দিয়ে কে এক অপরিচিত
তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে চলে গেল। একটু বিস্ময় ও একটু লজ্জায়
সে সরে গেল বটে কিন্তু প্রভাতের স্নিগ্ধ আলোয় তার পুষ্পকোমল
মুখের ছাপ অনিলের মন থেকে সরাতে পারল না।
শহরের ছেলে
অনিল এসেছিল পল্লীতে তার এক বন্ধুর বাড়ীতে ছুটি কাটাতে। সেখানে
যখন বাঙালী প্রেমের দেবতা সাতকূল মিলিয়েই প্রেমে পড়িয়ে দিলেন,
তখন সে কলকাতায় ফিরে বন্ধুদের দিয়ে বাপের কাছে মনের কথাটা জানাতে
দেরী করল না। তার পিতা জীবন ধারণ ও ছেলের পড়ার খরচের জন্যই বোধ
হয় ডাক্তারী একেবারে ছাড়েন নি, নয় তো বিপত্নীক হয়ে পর্য্যন্ত
সংসার ত্যাগীর মতই থাকতেন। তিনি উদাসীন ভাবেই মত দিলেন। পিতৃমাতৃহীনা,
মামাদের অন্নে পালিতা কল্যাণীর জীবনে অঘটন ঘটল। বিনা চেষ্টায়,
বিনা পণে তার বিবাহ হয় গেল। মামারা খুসী হলেন, মামীরা টিপ্পুনী
কেটে বললেন -- "বুড়ো মেয়ের কত নভেলী রঙ্গ জানা ছিল, কই
আমাদের একটা মেয়ে পুরুষ মানুষের সামনে অমন ফাঁদ পাতুক দেখি!
ছি ছি লজ্জায় মরি।" --
যাক, "চতুর্দ্দশ
বসন্তের মালাগাছি" গলায় পরে অনিল কলকাতায় ফিরল। কল্যাণী
মামাবাড়ী থেকে চিরদিনের মতই বিদায় হল।
লক্ষ্মীকে
ঘরে তুলে সরস্বতীর পূজার উপকরণগুলি অনিল অবহেলায় ছড়িয়ে ফেলল।
ঝি আর ঠাকুর মিলে এতদিন যেমন করে সংসার চালাচ্ছিল, তার কোন ব্যতিক্রম
হল না। অনিল কল্যাণীকে কোন কাজ করতে দিত না। কল্যাণীর জীবন এখানে
স্বাধীন, মুক্ত। শ্বশুর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকেন, আর কেউ
নেই যার জন্য তাকে আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হবে, দুটি নবীন জীবন প্রেমের
স্রোতে গা ঢেলে দিল। কল্যাণীর কাছে এ একেবারে নূতন জগৎ। শুধু
তারই জন্য এত আয়োজন, এত আদর, -- একজন লোকের যে সর্ব্বস্ব, এ
যেন স্বপ্নাতীত সুখ। অনিলের সোহাগ বাধা বন্ধন সীমাহারা হয়ে কল্যাণীকে
ঘিরে যেন এক নিমেষে নিঃশেষ হতে চায়, কি সে আবেগচঞ্চল দিবস ও
রাত্রিগুলি।
বন্ধুরা
দুচার দিন সবুর করে অনিলকে আক্রমণ করল। বলল, -- "বউ কি
আর কারো হয় না নাকি? সব প্রেম এক সঙ্গে শেষ করলে চলবে কেন? দেউলে
হয়ে যাবি যে।"--
অনিল তাদের
সঙ্গে পেরে ওঠে না, কাজেই এক একদিন সন্ধ্যায় বেরিয়ে যেত। কল্যাণীর
সেদিন সারা সন্ধ্যা যেন কাটতে চাইত না।
একদিন এমনি
এক সন্ধ্যায় কল্যাণী গালে হাত দিয়ে জানালার ধারে বসে পথ চেয়ে
আছে, -- হঠাৎ পেছন থেকে ঝরণার কলহাস্যে ঘর ভরিয়ে কে যেন বলে
উঠল, --"বলি ও নতুন বৌ, একা বসে হচ্ছে কি?"
কল্যাণী
চমকে চেয়ে দেখে রাজ্যের রূপ দিয়ে গড়া একখানি প্রতিমা, ঘর আলো
করে দাঁড়িয়ে, এবারে সে একেবারে কল্যাণীর কাছে এসে বসল। বলল,
-- "পাশের বাড়ীতে একা একা থাকি, তোমায় আসতে দেখে ভাবলাম
যাহোক সঙ্গী জুটল। ওমা! তা তোমার নজরই নেই। আমিই কি আসতে ফুরসুৎ
পাই? তোমার কত্তাটি তো নড়বার নাম করে না। কি তুক করেছ ভাই? আমায়
একটু শিখিয়ে দেবে?"
কল্যাণী
হেসে ফেলল। তারপর আর কি -- নিমেষে দুজনের মধ্যে নিবিড় প্রণয়
জন্মে গেল। খানিক গল্পের পর কল্যাণী বলল, -- "আমি তোমায়
তা'হলে স্বর্ণদি বলেই ডাকব, কেমন?"
স্বর্ণ
মুখখানা ভার করে বললে, -- "তা ত বলবেই, না হয় আমার সাত
বছর বিয়ে হয়ে গেছে, না হয় আমি তোমার চেয়ে দু তিন বছরের বড়, তোমার
নয় সবে বিয়ে হয়েছে, তুমি না হয় কচি খুকী, তাই বলে "দিদি"
বলে আমায় বুড়ী করে দেবে? সে হবে না। এস আমরা সই পাতাই।"
ব্যস অমনি
তাই ঠিক হয়ে গেল, আর দুই সইতে মনের কথা বলাবলির আর শেষ রইল না।
ঘুরে ফিরে সেই স্বামী সৌভাগ্যের কথা। কল্যাণী বলল, -- "তুমি
ভাই কি সুন্দর দেখতে, তোমার বর তোমায় খুব ভালোবাসে, না?"
স্বর্ণ অমনি বলল, -- "ও আমার পোড়া কপাল, আমি নাকি সুন্দর,
তোমার বরকেই জিজ্ঞাসা কর না কে বেশী সুন্দর, তুমি না আমি?"
কল্যাণী লজ্জায় লাল হয়ে বলল, -- "যাও তুমি ভারি দুষ্টু।"
স্বর্ণর হাসিতে আবার ঘরের অন্ধকার কোণাগুলিও যেন হেসে উঠতে লাগল।
এমন সময়
অনিলের গলার স্বর বাইরে শোনা যেতেই স্বর্ণ পালাল, বলে গেল, --
"আর জানালা খুলে প্রেম করো না, আমি সব দেখতে পাই কিন্তু।"
অনিল ঘরে ঢুকে বলল, -- "বেশ, বেশ, আমি ভাবছি তুমি একা কষ্ট
পাচ্ছ, তাই তাড়াতাড়ি ফিরছি, আর তুমি এদিকে এমন বন্ধুত্বে মগ্ন
যে কখন ফিরেছি টেরই পাওনি। নীচে ঠাকুরের সঙ্গে কত চেঁচামিচি
করে তোমাদের হুঁস আনতে হল।"
তারপর দুদিন
অনিল বেরুল না। শেষে বন্ধুরা একদিন বাইরে থেকে ডেকে বলল, --
"ও বৌদি, দড়িটা একটু লম্বা করে দিন, ওকে চরিয়ে আনি। আবার
ফিরিয়ে দেব ঠিক।"
এ সব শুনে কল্যাণী লজ্জায় মরে যেতো, জোর করে অনিলকে বাইরে পাঠিয়ে
দিত।
একদিন কথায়
কথায় স্বর্ণ বলল, -- "তুমি ভাই কেমন রোজ সেজেগুজে থাক,
বেশ লাগে দেখতে।"
কল্যাণী বলল, "তুমি সাজলে পার।"
স্বর্ণ হতাশভাব দেখিয়ে বলল, -- "সে কথা বল কেন? সাজতে কি
আমার অসাধ? বিয়ে হয়ে পর্য্যন্ত ভাবলাম এইবার দুখানা গয়না কাপড়
পরবো, ভালমন্দ পাঁচরকম খাবদাব, তার জন্যেই তো বিয়ে। নয়তো বাপ
মা কি শুধু শুধু অম্বলরুগী মাষ্টারের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে? বয়সকালে
একটু সখ মেটাবার জন্যেই ত বিয়ে। তাও আমার কপালে হল কই?"
কল্যাণী বিবাহ সম্বন্ধে সইর এমন হীন আদর্শের কথা শুনে দুঃখিত
ভাবে বলল, -- "ছি, ভাই, স্বামীর কথা অমন করে বলতে নেই?
বিয়ে বুঝি শুধু সাজগোজ করা? -- আর তোমার সাজতে সখ হলে কি আর
তিনি বারণ করবেন?"
স্বর্ণ বলল, -- "তবে শোন, তোমার দেখাদেখি কাল বিকেলে দিব্যি
রঙীন সাড়ীখানী পরে, টিপটী কেটে, মুখে একটু পাউডার ঘসে বসে আছি।
ওমা! এসে বলে কিনা -- 'থিয়েটারে যাবার উদ্যোগ হচ্ছে বুঝি, ও
সব আমি পারব-টারব না'। -- বলেই চোখ বুঁজে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে
পড়ল। তবেই বোঝ কার জন্যই বা সাজা, দেখবে না, তারিফ করবে না,
শেষে উল্টো চাপ কিনা থিয়েটারে যাবার জন্যে সেজেছি। টান মেরে
সব খুলে ফেলে, এমন বকুনিটাই দিলাম। আমার চেঁচানিতে বাড়ীর কাক
চিল বসতে পেল না, কিন্তু তার কানে কি কিছুই গেল?"
বিস্মিত হয়ে কল্যাণী বলল, -- "স্বামীকে বক?"
স্বর্ণ বলল, -- "বকি না? একশবার বকি। শুধু বকি, পারলে মারি।
সে ছেলে ঠেঙিয়ে খায়, আমি তা'কে ঠেঙিয়ে খাই।"
কল্যাণী জিভ কেটে বলল, -- "ছি, ছি।"
স্বর্ণ আড়চোখে কল্যাণীর মুখের ভাব দেখে কোন মতে হাসি চেপে দীর্ঘনিশ্বাস
ফেলে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, -- "আমায় যদি ভালবাসে তবে কি
আর বকিঝকি? তোমাদের দৃষ্টান্ত দেখাই, বলি অনিল বাবুর মত হও,
তা, কোন গ্রাহ্য করে না। আমি যা শক্ত মেয়ে, নয় ত কবে হাত ছাড়া
হয়ে যেত। তোমরা সুখী লোক, আমার দুঃখ কি বুঝবে বল।"
কল্যাণীর মন স্বর্নর প্রতি করুণায় ভরে উঠল। সে বলল, -- "নাঃ
সই, তোমায় কেমন করে না ভালবেসে থাকে?"
স্বর্ণ
এবার হাসিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বলল, -- "হাঃ তোর সঙ্গে
দুষ্টুমি করেও সুখ নেই। ঠাট্টাও বুঝিস না।"
২
স্বচ্ছন্দ
জীবনগতির মাঝখানে হঠাৎ বাধা পড়ে গেল। অনিলের বাবা দুদিনের জ্বরে
মারা গেলেন। ছেলের জন্য এমন কিছু রেখে গেলেন না যাতে দিনের পর
দিন বসে খাওয়া যায়। অনিল বি এ পরীক্ষা দিতে ছুটল। বইগুলি ঝেড়ে
মুছে কল্যাণী বারবার তাতে মাথা ঠেকিয়ে বলল, -- "মা ওঁকে
পাশ করিয়ে দাও।" কিন্তু সরস্বতীর কৃপা হল না। অনিল ফেল
হল, আর সঙ্গে সঙ্গে বহু কষ্টে এক সদাগরী আপিসে সামান্য মাইনের
একটা কেরাণীগিরি জুটিয়ে নিল। অনিলের কবি কল্পনার সঙ্গে এ জীবন
মাপ না খেলেও, পেটের দায়ে তাকে এটা মাথা পেতে নিতে হল।
ঝি, ঠাকুর
বিদায় নিল। এ বাড়ীতেও আর চলে না। অনিল অল্প ভাড়ায় একখানি ঘর
খুঁজছে শুনে স্বর্ণ বলল, -- "আমাদের একতলার একখানি ঘর অমনি
পড়ে থাকে, তোমরা সেইখানে এসো। কল্যাণী খুব খুসী হয়ে অনিলকে রাজি
করাল। অত অল্প ভাড়ায় অন্য জায়গায় ঘর পাওয়াও যেত না। ঘরের জানালার
ধারে একটা শিউলি গাছ আছে। সেটা দেখে অনিল বলে উঠল, -- "বাঃ
কি মজা, ফুল ফুটলে আবার তুমি তেমনি করে কুড়োবে, আমি আমি চেয়ে
দেখবো, তোমায় দেখাবে যেন মূর্ত্তিমতী শারদলক্ষ্মী।" এমনি
করে পরিবর্তিত জীবনের কষ্টটুকু তার আনন্দ দিয়ে বরণ করে নিল।
অনভ্যস্ত দুঃখের মধ্যে অনিলের সুখ -- কল্যাণীর তন্ময় সেবা, সে
যে এমন সুনিপুণা গৃহিণী তা অনিলের জানা ছিল না। অনিল মুগ্ধ হয়ে
প্রশংসা করলে কল্যাণী হেসে বলত, -- "বিযের আগে পর্য্যন্ত
ঘরের কাজইত করে এসেছি, এতে আর বাহাদুরী কি?"
অনিল বলত, -- "তোমার হাতের সেবা বড় মিষ্টি লাগে, তবু করতে
দিতে কষ্ট হয়। আমার হাতে পড়ে তুমি একটু বিশ্রাম করতে পাও না।"
কল্যাণী ছলছল চোখে অনিলের মুখ চেপে ধরত -- তার এই সুমিষ্ট প্রতিবাদটুকু
অনিল প্রাণ ভরে উপভোগ করত।
কল্যাণী
ভারী হিসেবী হয়েছে। অধিকাংশ দিন নিজের ভাগের তরকারিটুকু ও-বেলার
জন্য রেখে ডাল, টক যা হয় দিয়ে পাতের ভাতগুলি শেষ করত। অনিল তাড়াতাড়ি
খেয়ে চলে যায়, কিছু টের পায় না। নিজের কোন ভাগ কতটুকু কমিয়ে
অনিলের ভাগ বাড়ানো যায়, এই তার চিন্তা। একদিন স্বর্ণ দুটো পান
দিয়েছিল, কল্যাণী কি ছুতোয় নীচে এসে সে দুটো তুলে রাখল। বাজে
খরচ কমাতে গিয়ে পান আনা তাদের বন্ধ ছিল। অথচ অনিল পান খেতে কি
ভালবাসে, বিকেলে অনিল পান খেয়ে কত খুসী, বলল, -- "আপিসে
মাঝে মাঝে বাবুরা পান দেয়, তোমার খাওয়া হয় না ভাবতাম। যাক, তোমার
সই থাকতে ভাবনা নেই দেখছি, -- বলেই চোখ পড়ল কল্যাণীর তাম্বুলরাগলেশহীন
ঠোঁটের উপর, অনিল বলে উঠল, -- তুমি বুঝি খাওনা? পানের দাগ দেখছি
না যে!"
কল্যাণী
বলল, -- "সে ধুয়ে ফেলছি। কখন দিয়েছিল।" -- মিথ্যা
বলতে গিয়ে হেসে ফেলতেই অনিল তাকে বাহুপাশে বন্দী করে বলল, --
"ও দুষ্টু। অন্যায় করে আবার মিথ্যা কথা।"
কল্যাণী বলল, -- "দোষের জন্য এ রকম শাস্তি পেলে দোষ যে
রোজই করব।"
স্বামীর জন্য এইটুকু করতে পারলে এত খুসী করা যায় ভেবে কল্যাণীর
আনন্দ আর ধরে না, এমনি করে দারিদ্র্যের মধুরতাটুকু তারা ভোগ
করত, বিষটুকু গায়ে মাখত না।
কল্যাণীর
নিপুণ হাত দুখানি অভাবের মধ্যেও লক্ষ্মীশ্রী ফুটিয়ে রাখত। অনিল
একদিন বলল, -- "আমার মত সৌভাগ্য কারুর নেই, আমার পরিষ্কার
কাপড় চোপড় আর চেহারার চাকচিক্য দেখে আপিসের বন্ধুরা হিংসায় মরে।
বৌয়ের মুখঝামটা খেয়ে অর্দ্ধেকের দিন কাটে। তারওপর আমাদের মতন
গরীব কেরাণীরাও কত জনে বৌয়ের গয়না গড়াবার ভাবনায় পাগল পারা।
আর তুমি ত একখানা কাপড়ও চাও না।"
কল্যাণী উত্তর দিল, -- "অভাব থাকলে তো!"
অনিল বলল, -- "নাঃ, অভাব আবার কিসের? রাজার হালে তোমায়
রেখেছি।"
কল্যাণী বলল, -- "না ত কি!"
অনিল একটু চুপ করে থেকে বলল -- "সত্যিই যাই বল, পৃথিবীতে
তোমার মত কেউ নেই।"
কল্যাণী
মনে মনে জানত তার মত কেন, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নারী জগতে শতসহস্র
আছে, তবু এই কথাটী তার অন্তর মধুতে ভরে দিল। প্রিয়তমের কাছে
সে অতুলনীয়া, এর চেয়ে সুখ তার কল্পনারও অতীত।
অনিল আবার বলল, -- "তোমার কোন সাধ নেই কল্যাণী?"
কল্যাণী মাথা নীচু করে বলল, -- "তোমার পায়ে মাথা রেখে মরতে
পারলেই আমার সব সাধ মিটবে।"
জানি না
কথা শুনে অদৃষ্টদেবতা অলক্ষ্যে হেসেছিলেন কিনা।
৩
প্রথম যখন
আপিসে ঢোকে তখন অনিলের বিশ্বাস ছিল, সে শীঘ্রই এই জাঁতাকল থেকে
বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু অন্ন জোটাবার মত কাজ আর কোথায় পেল
না। শেষে অনিল কেমন করে তার চির অবজ্ঞাত কেরাণী জীবনে বেশ অভ্যস্ত
হয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত কেরাণীকুলের সর্ব্বনাশা নেশা
রেস খেলাও তাকে পেয়ে বসল। কল্যাণী প্রথম প্রথম কত বোঝাতো, শেষে
কান্নারূপ অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করল, অনিল কখনও কখনও অনুতপ্ত হয়ে
বলত, -- "আচ্ছা এই শেষ।" কখনও জিতে কখনও হেরে কতবার
যে প্রতিজ্ঞা করত আর এ সবে সে যাবে না, কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ
করতেও বিন্দুমাত্র বিলম্ব হত না।
এই সময়
কল্যাণীর জগতে আবার নূতন রং ধরল, সে নাকি মা হবে। অনিল যখন আনন্দ
করতে গিয়েও বলল, -- "খরচপত্র বড্ড বাড়বে তাইতো?" --
তখন কল্যাণী অনাগত সন্তানের পক্ষ নিয়ে অনিলের উপর ভারি অভিমান
করল, ও মনে মনে অজাত শিশুটিকে আদরে ডুবিয়ে ফেলল।
এই সময়টা
তার স্বামীর সঙ্গ তাকে যথেষ্ট তৃপ্তি দিত না, অনিলকে কাছে পাবার
ও তার আগেকার আদর যত্ন পাবার তৃষ্ণায় তার মন ভরে উঠত। আবার অনিল
শিশুটির কথায় তেমন উৎসাহ দেখায় না বলে অভিমানে সে আলোচনা বন্ধ
করে ফেলত। অনিল আজকাল ক্রমশঃ যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে -- শুধু
খাওয়া আর শোওয়া বাড়ীতে হয়, অধিকাংশ সময় ছুটির দিনটাও বাইরে কাটায়,
যে সময় মনের শন্তি সব চেয়ে প্রয়োজন, সেই সময়টা কল্যাণীর কেবল
উদ্বেগের মধ্যেই কাটতে লাগল, আর এতদিন এই শান্ত কোমল মেয়েটির
স্বভাবে যা মোটেই ছিল না, সেই খিটখিটে ভাব দেখা দিল।
কল্যাণীর
প্রাণপণ প্রয়াস ছিল স্বর্ণ যেন এ সব জানতে না পারে। কিন্তু তীক্ষ্ণবুদ্ধি
স্বর্ণর চোখে অনিলের পরিবর্তন ধরা পড়তে কি দেরী হয়? স্বর্ণর
বুকটা বেদনায় ভরে উঠত। স্বামীর অনন্যানিষ্ট প্রেমের অধিকারিণী
স্বর্ণ সইর সৌভাগ্যে কতই সুখী ছিল, সে প্রথম প্রথম অনিলের অতটা
আঁচল ধরা ভাব পছন্দ করত না, কিন্তু তাও যে এ অবহেলার থেকে ভাল
ছিল; কেমন করে অনিল এত বদলাতে পারল তা সে ভেবেই পেত না। অনিলের
মন ভোলাবার জন্য সন্ধ্যা হলেই সে নানা ছুতায় কল্যাণীকে একটু
সাজিয়ে গুজিয়ে দিত। দু'একদিন আপত্তি করে কল্যাণী কিছুই বলত না,
কিন্তু সুযোগ পেলেই অনিল ফিরবার আগেই সব খুলে ফেলত। অমন করে
ফাঁদ করে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার যেন মাথা কাটা যেত।
চুপ করে
থেকে থেকে একদিন কল্যাণী অনিলকে বেশ দু কথা শোনাবে ঠিক করল।
অনিল তাসের আড্ডায় বেরুবার উদ্যোগ করতেই কল্যাণী বিরক্তভাবে
কি বলল, অনিল পাল্টা জবাব দিল, -- "তুমি কেবল পেঁচার মত
মুখ করে থাকবে, তাই যতক্ষণ পারি বাইরে কাটাই।"
কল্যাণী
আহত পক্ষীর মত বিছানায় লুটিয়ে কাঁদতে লাগল। অনিলও ভয়ানক লজ্জিত
হয়ে পড়ল। তারপর বোঝাপড়র ধুম, কল্যাণী বলল, -- "তুমি আর
আগের মত নেই মোটেই আমায় দেখতে পার না" ইত্যাদি।
অনিল ও
অনেক যুক্তি দেখিয়ে স্বপক্ষ সমর্থন করল, -- তার সময় কই দু'দণ্ড
বাজে কথা বলবার, তা ছাড়া কল্যাণীও কি বদলায়নি, তাছাড়া বয়সও তো
বেড়েছে, তা ছাড়া আরও কত কি। শেষে কল্যাণীর যুক্তি -- দুঃখ দারিদ্র্য
লাঘব করবার জন্যই তো প্রেম ও তার নিতান্ত প্রকাশ দরকার, -- একথা
মেনে নিলেও অনিল কার্য্যতঃ খুব বদলাল না।
নিয়ত পরিবর্ত্তনশীল
জগতে মানুষের মন যদি বদলায় তাতে দোষ কি? একদিন যে অফুরন্ত প্রেম
জুটেছিল তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়াই তো উচিত, তা কেন চিরদিন থাকবে
না বলে আবদার করা কি বিজ্ঞের কাজ? দর্শন শাস্ত্রের এত কথা কল্যাণীর
জানা ছিল না। জীবনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের বয়েস ও তার তখন হয় নি,
বিজ্ঞতার বালাইও ছিল না। কাজেই কল্যাণী নিজের অদৃষ্টের উপর রাগ
করত, তাতে অদৃষ্টের ক্ষতি হল না, তার নিজের বুকটাই ভেঙে চুরে
শত খান হতে লাগল।
যে দিন
কল্যাণীর মেয়েটি ভূমিষ্ঠ হল, সে দিন স্বর্নকেই সব ব্যবস্থা করতে
হয়েছিল। সারাদিনে অনিলের দেখা পাওয়া যায় নি, রেসে হেরে রাত্রে
যখন ফিরল তখন সংবাদ পেল কি না মেয়ে হয়েছে। বাঙালী পিতৃপিতামহের
কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মনের সংস্কারটি যে মেয়ে হওয়ার
খবরে উৎফুল্ল হল না, তা বলাই বাহুল্য। টাকাও সেদিন অনেক হেরেছিল।
যে কারণেই হোক শ্রান্ত কল্যাণীকে দুটো মিষ্ট কথা বলবার অবকাশ
আজকার দিনেও তার হল না।
এমনি করেই
ধীরে ধীরে একটী বছর ঘুরে গেল, শেফালী আপন মনে ফুটে ঝরে গেল,
কেউ খোঁজ নিল না। কল্যাণীর শারীরিক দুর্ব্বলতার উপর মানসিক অশান্তি
জুটে তাকে যেন সেরে উঠতে দিল না। এখন ঝগড়া না করে যখন তখন কেঁদে
কেটে সে অনিলকে উত্যক্ত করে তুলত। বুঝত না, আগে এক ফোঁটা চোখের
জল দেখলে যে অধীর হত, সে আজকাল এত বুক ভাঙ্গা কান্নায় কেমন করে
উদাসীন থাকে। আগে অত না পেলে, না পাওয়ার ব্যথা কি এমন করে বাজত?
রাণী কখনও ভিখারিণী হয়ে বাঁচে? এই রকম নানা চিন্তায়, নিরর্থক
অভিমানে, আপনাকে সে আপনি কষ্ট দিত। আহা অনিল তবু যদি মেয়েটার
পানে তাকায় তাহেলেও বুঝি কল্যাণী শান্তি পায়। তারপর আকাঙ্খাও
রইল না, অভিমানও রইল না, -- রইল শুধু বিরাট শুষ্কতা ও শূন্যতা,
মরুভূমির জ্বালাও বুঝি তার মত উগ্র নয়।
কল্যাণীর
অবহেলায় অনিল আরও দূরে গেল। স্বর্ণের কাছেও কল্যাণী মনের দ্বার
রুদ্ধ করল। তার একান্ত আপনার রইল শুধু একটী মেয়ে, লুকিয়ে তাকে
বুকে চেপে কত কথা বলত, তার শিশু তার কোমল হাতখানি মায়ের মুখের
উপর বুলিয়ে ডাকত -- "মাম্মা।"
কল্যাণী
যখন শয্যা নিল, তখন অনিল তো দূরের কথা স্বর্ণও ভাবে নি প্রদীপ
এত শীঘ্র নিভবে। তাই চিকিৎসার ব্যবস্থাও কিছু হয়নি। যেদিন স্বর্ণ
অবস্থা সঙ্কট বুঝতে পারল সে দিন ব্যাকুল হয়ে স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে
বলল, -- "আমার সইকে বাঁচাও।" তিনি ডাক্তার ডেকে আনলেন,
-- ডাক্তার জবাব দিয়ে গেল।
উদ্বেলিত
অশ্রু চোখে চেপে স্বর্ণ কল্যাণীর মুখের উপর ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল,
-- "সই, বড় কষ্ট হচ্ছে কি? অনিল বাবুর আপিসে খবর পাঠাব?"
অতি শ্রান্ত কণ্ঠে কল্যাণী উত্তর করিল, -- "না ভাই, স্বামীর
কোলে মাথা রেখে মরে সতীর স্বর্গে যাবার ইচ্ছা নাই। ভগবানের কোন
দয়ার ভিখারী আমি নই।"
স্বর্ণর
চোখের জল বাধা না মেনে উছলে উঠল। চোখ দুটি ঈষৎ খুলে কল্যাণী
বলল, -- "না, না, ভগবানের দয়া দয়া আছে বই কি। না হতে কি
তোমায় পেতাম? মেয়েটাকে দেখো ভাই।"
তারপর শেফালী
বনের অশরীরী কামনা যেন শেষ নিঃশ্বাস ফেলে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
লোকেরা কল্যাণীকে যখন পথে বার করে "হরিবোল" দিল, তখন
দুটি নারী বলাবলি করে গেল, -- "আহা সৌভাগ্যবতী সতী, নোয়া
সিঁন্দুর নিয়ে চলল।"
কথাটা শুনেই স্বর্ণ শিউরে
উঠে দুই কান ঢেকে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল।
সুনীতি
দেবী