প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

নব উদাসীন

সূর্য্যকান্ত এণ্ট্রান্স পাস করিয়াছিল। অর্থাভাব নিবন্ধন পড়াটা বন্ধ রাখিয়া সে গবর্ণমেণ্ট স্কুলে ২৫ টাকা বেতনে মাষ্টারি যোগাড় করিল।
জজ আদালতের বড় উকীল দেবেন্দ্রনাথের সহিত তাহার পিতার জানাশুনা ছিল। উকীল মহলে ইঁহার খুব সুনাম ছিল; কেননা ইনি দিঙমণ্ডল কাঁপাইয়া বক্তৃতা করিতে পারিতেন। হারিয়া অনেক মক্কেলও বলিত; -- "হায়রে, আমার অদৃষ্ট মন্দ, কেননা, দেবেন বাবু যেরূপ বলেছিলেন এ'তে কখনও আমি মোকদ্দমা হারতে পারি না। কিন্তু জজ বেটা একেবারে বোকা; কিছু বোঝে সোজে না তাই ডিসমিস করে ফেলল।"
পাঠে সূর্য্যকান্তের অপরিসীম মনোযোগিতা ও পরিশ্রমের কথা দেবেন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। তিনি তাহাকে নিজের গৃহে ডাকাইলেন। অর্থভাবেই তাহার পড়া বন্ধ হইয়াছে জানিয়া তিনি কিছু আফসোসের ভাব দেখাইলেন এবং এফ এ পড়ার সুবিধা করিয়া দিবেন বলিলেন।
দুইদিন পরেই দেবেন্দ্রবাবুর চাকর সূর্যকে ডাকিতে আসিল। সূর্য্য দেবেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে গেল। দেবেন্দ্রবাবু বলিলেন; -- "জগন্নথ কলেজে তুমি যাতে বিনা বেতনে পড়তে পার তার বন্দোবস্ত করেছি। ভরতি হয়ে পড়া আরম্ভ কর।"
সূর্য্য উত্তর করিল; -- আমি মহাশয়ের নিকট চিরবাধিত রহিলাম। আমারও নিতান্ত ইচ্ছা আরও পড়ি; কিন্তু ইহাতে কিঞ্চিত্ বাধা দেখিতেছি।"
"কি বাধা?"
আমি আর না পড়ি ইহাই মায়ের ইচ্ছা। তিনি বলেন, "আর বেশী পড়ে কি করবি? যে ২৫ টাকার চাকুরিতে পেয়েছিস তাতেই মা ছেলের সংসার কেটেও কোন রকমে ৮/১০ টাকা হাতে থাকবে।"
দেবেন্দ্রনাথ ভ্রুকুটী করিয়া বলিলেন -- "বাপু, স্ত্রীলোকের বুদ্ধি নিয়ে চল্লে কি কাজ হয়? তাদের যদি ভালমন্দ ক্ষমতা থাকত তাহলে কি তাদের দুর্ব্বলা জাতি বলা হত? তাদের অধীনতায় চলা বুদ্ধিবত্তার পরিচায়ক নহে।"
সুর্য্যকান্ত -- মহাশয় অবগত আছেন, সংসারে আমার এক মা ভিন্ন আর কেহই নাই। আমিই তাঁহার একমাত্র সন্তান। তিনি আমার মুখ চাহিয়া সংসার সমুদ্রে ভাসিতেছেন। এন্ট্রান্স পড়িবার সময় খরচের জন্য প্রায় ৫০ টাকা ঋণ করিতে হইয়াছিল। উহা সুদে আসলে এখন প্রায় ১০০ টাকা হইয়াছে। বিশেষতঃ বাবাও কিছু ঋণ রখিয়া গিয়াছেন। মা বলিতেছেন -- "কাজটি নিয়ে থাক, এতে দুজনের ভরণ পোষণের ব্যয় বাদে যা থাকবে তা দিয়ে ক্রমশঃ ঋণ শোধ হবে। মহাজনেরাও বড় পীড়াপীড়ি কত্তে আরম্ভ করেছে। --" দেবেন্দ্রনাথ একগাল আশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিলেন, -- "আরে, তার জন্য ভাবনাকি? তোমার মাকে বলে কয়ে আজই জিনিসপত্র নিয়ে আমার এখানে এসে পড়। কাল ভত্র্তি হতে হবে।"
সূর্য্যকান্তের নিকট ইহা স্বপ্নবৎ বোধ হইল। সে দেবেন্দ্রনাথের সদাশয়তায় নিতান্ত মু±ধ হইয়া গেল। কত সুন্দর করিয়াই সে মনে তাঁহার ছবিটি আঁকিতে লাগিল; তাঁহাকে দেবতার আসনে বসাইয়াও তাহার মনস্তুষ্টি হইল না। সে শত করিয়াও দেবেন্দ্রবাবুর স্বরূপ নিজের হৃদয়কারায় ধরিতে পারিল না, তাহার কল্পনার নিকট তিনি এতই মহান।
অনেক বুঝাইয়া সূর্য্য মায়ের সম্মতি গ্রহণ করিল এবং দেবেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে থাকিবার বন্দোবস্ত করিয়া পরদিনই কলেজে ভর্তি হইল।
এদিকে বিদায় না পাওয়ায় বাধ্য হইয়াই স্কুলের চাকরিটা তাহাকে ছড়িয়া দিতে হইল।


সূর্য্যকান্তের শীলতা, নম্রতা ও অন্যান্য সদগুণাবলী অল্পদিন মধ্যেই দেবেন্দ্রপরিবারে সকলের হৃদয় আকর্ষণ করিল। কিন্তু একটি হৃদয় সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট হইয়াছিল। সূর্য্যকান্তের র প্রশংসা শুনিলে সে হৃদয়টি আনন্দে উত্ফুল্ল হইত; কেন হইত তাহা সে বুঝিতে পারিত না। দুজনের কথোপকথনের মধ্যে সূর্য্যকান্তের নাম শুনিলে সে হৃদয়টি বেগে সেদিকে ধাবিত হইত। দেখিবার সম্ভব হইলে হয়ত অনেক সময়ে দেখা যাইত সেই হৃদয়মনটিতে শ্রীমান সূর্য্যকান্ত ঘোষ আসীন রহিয়াছে।
কলেজের ছুটির পর সূর্য্য একদিন বাসায় ফিরিতেছিল। পাঠাগারে প্রবেশ করিয়া কিছু আশ্চর্য্যান্বিত হইল; -- দেখিল তাহারই কাষ্ঠাসনে বসিয়া স্বয়ং বীণাপাণি যেন 'কাব্য কুসুমাঞ্জলি' পড়িতেছেন! কালবিলম্ব না করিয়া সূর্য্যকান্ত পশ্চাৎ হইতে ডাকিল -- "সরোজিনী!"
দেবেন্দ্রনাথের ত্রয়োদশ বর্ষীয়া একমাত্র কন্যা সরোজিনী কিঞ্চিত্ অপ্রতিভ হইল; লজ্জায় তাহার গণ্ডস্থল রক্তিমাভা ধারণ করিল। কিয়ত্কালের জন্য সূর্য্য-হৃদয়ের তমোরাশি বিদূরিত করিয়া সে বিজলীর মত বেগে পলায়ন করিল।
সূর্য্যর ভাবিবার সময় আসিল দেবেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে আসা অবধি যে মনোমোহিনীকে সে (কল্পনায়) স্বকীয় হৃদয়াসন পাতিয়া দিয়াছিল, অদ্য প্রকৃতই নিজের কাষ্ঠাসনে সে মূর্তি উপবিষ্ট দেখিতে পাইল।
ক্রমে উভয়ের ভালবাসা ঘনীভূত হইল। তখন আর কলেজের ছুটীর পর পাঠাগারে প্রবেশোদ্যত সূর্যকে দেখিয়া অধ্যয়ননিরতা সরোজিনী বেগে পলায়ন করিত না। অধিকন্তু পূব্র্ব হইতেই তাহার জলখাবারের বন্দোবস্ত করিয়া তাহার অপেক্ষায় বসিয়া থাকিত।
একদিন সূর্য্য কলেজ হইতে ফিরিয়া পাঠাগারে বিশ্রাম করিতেছিল। সরোজিনী মৃদু হাসিয়া বলিল; "তুমি আমার কিছু চুরি করেছ?
সূর্য্যকান্ত হাসিয়া বলিল, -- "হাঁ, করেছি বই কি।"
"বল দেখি কি?"
"তোমার মন।"
"দেখ, আমি উপহাস করছি না।"
"না আমিও উপহাস কল্লেম কই? চুরি না কল্লে কি চোরের পাঠাগারটা রোজ রোজ এমন করে পবিত্র হতো? বলি, হারান জিনিসটি ফিরে পাবার জন্যই নাকি প্রত্যহ এখানে আসা হয়?"
সরোজিনী কিঞ্চিত্ গাম্ভীর্য্যের ভাব দেখাইল। কিন্তু পরক্ষণেই হাসিটা চাপিয়া রাখিতে না পারিয়া বলিল; -- "চোরের আবার এত দীর্ঘ ছন্দের কথা কেন? এই দেখত আমার বইখানি চুরি করে রেখেছ।"
সূর্যzকান্তর পুস্তকরাশির মধ্য হইতে শ্রীমতী মানকুমারী বসুর কাব্যকুসুমাঞ্জলি বাহির করিয়া উহার ১ম পৃষ্ঠা খুলিয়া সরিজিনী সূর্য্যকান্তের সম্মুখে ধরিল। সূর্য্যকান্ত পড়িল -- "ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ শ্রীমতী সরোজিনীকে উপহার প্রদত্ত হইল। S.K.G
বলা বাহুল্য বইখানি সূর্য্যকান্তই ক্রয় করিয়া এরূপ লিখিয়া রাখিয়াছিল। সূর্য্যকান্ত একটু মুচকি হসিল। রহস্য করিয়া বলিল; -- "কোন প্রেমিকের ভালবাসার নির্দেশ?"
"সুশীলার আবার কটি থাকে?"
"থাকিলেই বা দোষ কি? কার্য্যে ত দেখছি তাই।" পরক্ষণেই বলিল -- "বাস্তবিকই জিজ্ঞাসা কচ্ছি এই S.K.G মহাশয়ই কি তা হলে তোমার একমাত্র --"
সরোজিনী বাধা দিয়ে ঈষত্ হাস্যে বলিল; --"না।"
প্রেমের অভিধানে যে 'না' শব্দের অর্থ হ্যাঁ সূর্য্যকান্তের খুব জানা ছিল। তবুও পুনরুক্তি করিল; -- বাস্তবিকই "না?"
"না।"
"না?"
"না" সরোজিনী সূর্য্যের গলদেশ বেষ্টন করিয়া প্রত্যুত্তর করিল; -- "না।" দুজনেই হাসিল।

দেবেন্দ্রবাবুকেও অনেক সময় বলিতে শুনা গিয়াছিল যে পরীক্ষার পরই তিনি তাঁহার প্রিয়তমা কন্যা সরোজিনীকে সূর্য্যকান্তের করে অর্পণ করিবেন।
কথাটি সূর্য্য-- সরোজিনীর কর্ণেও পৌঁছিয়াছিল। তাহারা ব্যগ্রতার সহিত সেই সুখময় মুহূর্তের অপেক্ষা করিতেছিল এবং পরমপিতা পরমেশ্বরের নিকট কায়মনোবাক্যে আশা করিতেছিল -- মিলন।
"মানুষ ভাবে এক, ভগবান ঘটান আর।" এবার সূর্য্যের পরীক্ষার বত্সর; পরীক্ষার আর মাত্র ৬ মাস আছে। এমন সময়ে তাহার প্রেমের বিমল আকাশে ক্ষুদ্র একখানি মেঘের সঞ্চার হইল, ক্রমে তাহা সারাটি আকাশ ছাইয়া ফেলিল।

নরেন্দ্রনাথ নামে দেবেন্দ্রের এক ভ্রাতা ছিলেন। সাংসারিক বিষয়ে তাঁহার সহিত দেবেন্দ্রনাথের খুব বিবাদ ছিল। দেবেন্দ্রবাবুরই চক্রান্তে একবার নরেন্দ্রকে ফৌজদারী মোকদ্দমায় বিংশ মুদ্রা অর্থদণ্ড দিতে হইয়াছিল। নরেন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রদ্বয় রমণীমোহন ও নগেন্দ্রনাথের সহিতও দেবেন্দ্রবাবুর বড় সদ্ভাব ছিল না। রমণী জজ আদালতের নূতন পাশ করা উকীল -- একেলে যুবক; সুতরাং খুড়া মহাশয়ের পরিপক্ত ওকালতি বুদ্ধির উপরও সে অনেক সময়ে টেক্কা মারিতে পারিত।
রমণীমোহন খুড়ার সহিত বেশ একটু মিশামিশি করিতেছিল। ক্রমে দেবেন্দ্রনাথও শত্রুতার কথা ভুলিয়া গেলেন। এখন রমণীকে তিনি তাঁহার পুত্র যতীন্দ্রমোহনের ন্যায়ই জ্ঞান করিতেন। কোন বিষয়েই তাহার উপর অবিশ্বাস হহিল না।
দেবেন্দ্রনাথ বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। রমণীমোহন তথায় প্রবেশ করিল বলিল -- "কাকাবাবু, আপনি এই সম্বন্ধ ছেড়ে দিন। একটি উপযুক্ত বর পাওয়া গিয়াছে। মনোমোহন গেলবার এফ.এ. পাশ করে সেণ্ট জেভিয়ারে বি.এ. পড়েছে। তার পিতা সুরেন্দ্রকুমারের বিষয় সম্পত্তিও বড় কম নয়; প্রায় ২৫০০০ টাকার কোম্পানির কাগজ করেছেন, ৫০,০০০ টাকা মহাজনীতে আছে; বাড়ীতে খড়ের ঘর একখানিও রাখেননি।"

আলবোলার নলটি ফরাসের উপর রাখিয়া দেবেন্দ্রনাথ ব্যস্ততাসহকারে বলিলেন -- "বল কি?"
"আজ্ঞে, অমি কি আর মিছে বলছি?"
চুপি চুপি অনেক কথার পর দেবেন্দ্রবাবু বলিলেন -- "দেখ বাবা, তুমি আজই সুরেন্দ্রবাবুর নিকট চিঠি লিখে দাও। আমি ত সূর্য্যের সহিত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইনি; তবে কি; তাবেত্ "হাতের পাঁচ" বলে রেখেছিলেম, যখন অন্যদিকে ভাল সুবিধে না ঘটত তখন হাতের পাঁচ যোগ করে নিতেম।"
হ্যাঁ, এই ত বুদ্ধিমানের কাজ। 'যখন যেমন, তখন তেমন' হতে না পাল্লে কি আর আজকাল সংসারে চলা যায়? আর এমন গরীবের ছেলেকে কি সরোজিনীর মত রত্ন সম্প্রদান করা উচিত? ইহাতে কি সম্মান রক্ষা হয়?" বলিয়া রমণীমোহন বাহির হইল। যদি কেহ তখন তাহার মুখখানির প্রতি দৃষ্টিপাত করিত তবে ঘৃণাজনক শঠতাপূর্ণ ক্রুর হাস্য ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাইত না। কেননা, তাহার চির ইপ্সিত প্রতিশোধ ও মতলব হাসিলের পথ পরিষ্কার হইল বলিয়া তাহার অধরে একটু হাসি দেখা দিয়েছিল।

যথাসময়ে সুরেন্দ্রকুমারের প্রত্যুত্তরে আসিল। দেবেন্দ্রনাথের মাথায়ও অতিরিক্ত পরিমাণে রক্তের সঞ্চার হইল। একদিন তিনি গৃহিণী ও যতীন্দ্রমোহনের নিকট পরিণয় প্রসঙ্গ পাড়িলেন।
যতীন্দ্রমোহন মেডিকেল কলেজে পাশ দিয়া বাড়ীতে ডাক্তারখানা খুলিয়াছিল। শিশুবেলা হইতেই ধম্র্মভয়টা তাহার একটু বেশী।
সে বলিল -- "অসম্ভব। আপনি অনেক ভদ্রলোকের সম্মুখে বলেছেন সূর্য্যের সহিত সম্বন্ধ করবেন। বিশেষতঃ আপনি তাঁকে আশাও দিয়েছেন। তা না কল্লে লোকে আপনার নিন্দে করবে; পরমেশ্বরের নিকটেও আপনি দায়ী হবেন।"
"আমি কার কাছে বলেছি?"
"কেন, কার কাছে না বলেছেন? শহরের বড় ছোট কে না জানে আপনি সূর্য্যের সহিত সরোজিনীর বিয়ে দেবেন?"
দেবেন্দ্রনাথ -- "আমি ত আর প্রতিজ্ঞা করিনি, বলেছিলেম মাত্র। এখন আমার ইচ্ছে, আমি এ সম্বন্ধ ছেড়ে দেব।"
যতীন্দ্রমোহন -- "তা হলেই গরীবের ছেলেটার সর্ব্বনাশ হবে এখন বেশ সুখে চাকরিটে কচ্ছিল, আপনি পরামর্শ দিয়ে এনে ওর সর্ব্বনাশ কল্লেন।"
দেবেন -- "সর্ব্বনাশ হল কিসে? অর্থাভাবে পড়তে পাচ্ছিল না; কত চেষ্টায় বিনাবেতনে পড়বার জোগাড় করে দিয়ে, নিজের বাসায় রেখে পড়াচ্ছি; পাশটাস করে বেশ চাকরি করবে; তাই বলে আমার দোষ হল।"
যতীন -- "ওর আর পরীক্ষাও দিতে হবে না; পড়াও কত্তে হবে না। সরোজিনীর প্রতি যেরূপ ভালবাসা দেখছি তাতে তাঁকে না পেলে কি আর ওর দিকবিদিক জ্ঞান থাকবে? -- পরীক্ষা ত দূরের কথা। তাই বলেছিলেন সর্ব্বনাশ হচ্ছে। কেননা এতে ছেলেটার দুইদিক নষ্ট হল -- পড়া ত হলই না ওদিকে চাকরিটেও নষ্ট হল। এন্ট্রান্স পাশ করে এখন চাকরী আজকাল মিলে? ঋণ শোধ করে দেবেন বলে কর্ম্মছাড়া কল্লেন এতদিন চাকরিতে থাকলে ওর সব ঋণটা শোধ হয়ে যেত। আপনি যত করেছেন সবই কেবল স্বার্থে।"
দেবেন -- "তবে দেখছি এ বিয়েতে তোর নিতান্তই অমত। তা হোক নূতন সম্বন্ধ ছাড়তে আমি কোনমতেই রাজি নই। রমণী বলেছে পাত্র খুব উপযুক্ত।"
যতীন -- "তবেই ত, সেই ত আপনার সর্ব্বনাশ করবার জন্য আপনার সঙ্গে মিশেছে। আপনি ত তাকে চিনেও চেনেন না। উমাকান্ত খুড়ার খতের মোকদ্দমায় সে কি করেছিল মনে আছে? তেমনি করে ভদ্রসমাজে আপনাকে হাস্যাäপদ করবে?"
পিতাপুত্রে অনেকক্ষণ যাবত্ কথা কাটাকাটি চলিল। অবশেষে পিতা বলিলেন -- "আমার ইচ্ছে আমি একাজ করবোই করবো। তুই আমাকে উপদেশ ও বাধা দেবার কে? না হবে কেন, আজ কালকের ছেলে ত? -- হায় আমাদের সেই অতীত জীবন! তখন পিতার কথা রাজ বিধানের চেয়েও বেশী ছিল। আমি ইচ্ছে কল্লে তোকেও আমার বাড়ী থেকে বের করে দিতে পারি।"
যতীন্দ্রমোহন মৌনাবলম্বন করিল।
অতঃপর গৃহিণী আসরে নামিলেন। তিনিও প্রতিজ্ঞাভঙ্গের ভয় দেখাইয়া বলিলেন,
-- "আমার একটি মাত্র মেয়ে, আমি কখনও তাকে ভিন্ন দেশে লক্ষ সমুদ্র কোটি নদীর পারে বিয়ে দিতে পারব না।"
দেবেন্দ্রনাথ চটিয়া একেবারে লাল, বলিলেন -- "তুমিও দেখছি ছেলের ধারা ধরেছ। আমিও এ বিষয়ে কাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করবো না। আমার যা খুসী তাই করব।"

যতীন্দ্রমোহন, গৃহিণী, এমনকি আত্মীয় স্বজনের সকলেরই অমতে দেবেন্দ্রনাথ মনোমোহনের সহিত সরোজিনীর বিবাহের ঠিক করিলেন। শুভদিন (!) ও নির্ধারিত হইল।

অদ্য মনোমোহনের সহিত সরোজিনীর উদ্বাহ ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। দেবেন্দ্রবাবু তাঁহার শয়ন প্রকোষ্ঠে বসিয়া সুখের স্বপ্ন দেখিতেছেন; হঠাৎ যতীন্দ্রমোহন তথায় প্রবেশ করিল। বলিল -- "আপনি আজ যে অধম্র্মাচরণ কল্লেন, ইহাতে কখনও আপনার মঙ্গল হবে না। অত্রপ্রাতেই দেখেন না কেন, এ বিবাহে আত্মীয় স্বজন সকলেই নারাজ; তারপর, একপ্রকার বিনা কারণেই ভদ্রলোকেরা সকলে আপনার বাড়ীর নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলেন; করুণাবাবুর স্কুলের ছেলেদের নিমন্ত্রণ করে নিজেই উহা ফিরিয়ে আনতে হলো। গতকাল বাড়ীর সম্মুখের পৈতৃক বাজারখানা নীলরতন কুণ্ডু উঠিয়ে নিলে। এসব কি শুভ লক্ষণ?"
দেবেন্দ্রনাথ সরোষে উত্তর করিলেন -- "তুই বড় বাড় বেড়েছিস, এত বাড় ত ভাল নয়। দেখ, তুই আমার বাড়ী থেকে বেরিয়ে যা। তোরও মুখ আর আমি দেখতে চাইনে।"
"যাব বই কি!" অশ্রুপূর্ণলোচনে যতীন্দ্র উত্তর করিল, "যাব বই কি?"
সকালে উঠিয়া আর কেহই যতীন্দ্রমোহনকে দেবেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে দেখে নাই।

দু'তিন দিন পূর্ব্বে ঋণের দায়ে সূর্য্যকান্তের বাড়ীটা নিলামে উঠিয়াছিল। আর, বিবাহের দিন সে ত সব দিক অন্ধকার দেখিল। তাহার মনের ভাব যে কি হইয়াছিল তাহা কল্পনাতীত। সে হয়ত ভাবিল, -- "আর আমি কেন তবে থাকি রে এখানে, কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?" ইহা ভাবিতেই তাহার ভাবনার পরিসমাপ্তি ঘটিল।

সপ্তাহ মধ্যেই রমণীমোহনের কনিষ্ঠ সহোদর নগেন্দ্রনাথেরও বিবাহ হইয়া গেল। অধিকদিন যাইতে না যাইতেই গুমর ফাঁক হইতে চলিল। গিল্টিটা উঠিয়া গেল। সকলেই জানিল দেবেন্দ্রনাথ রায়ের জামাতা এন্ট্রান্স পাশ মাত্র বিশেষতঃ পড়াটাও বন্ধ করিয়া নামকাটা সিপাহির মত সে টো টো কোম্পানীর ম্যানেজারি পদে ভরতি হইয়াছিল। কোথায় তাহার পিতা, কোথায় বা তাঁহার কোম্পানীর কাগজ ও মহাজনী।
অনেকদিন হয় তাহার পিতার মৃত্যু হইয়াছে। যে সুরেন্দ্রবাবু বিবাহনাট্যে মনোমোহনের পিতার পাঠ গ্রহণ করিয়াছিল, তাঁহার সহিত মনোমোহনের পিতার মিত্রতা ছিল। ইনি খুব বড়লোক ছিলেন। মৃত্যুকালে সুরেন্দ্রনাথ বন্ধì সুরেন্দ্রকুমারের হস্তে পুত্রকে সমর্পণ করিয়া যান।
এন্ট্রান্স পাশ করিয়া মনোমোহনের ভাবটা বড় খারাপ হইয়া উঠিয়াছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তাহার সুনাম গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। কাজেই কেহ তাহাকে মেয়ে দিতে রাজি হইল না। এমন সময় নগেন্দ্রনাথের জন্য সুরেন্দ্রকুমারের দুহিতার বিবাহের প্রস্তাব হইল। সুরেন্দ্রকুমার সুবিধা পাইলেন; তিনি বলিলেন যে মনোমোহনের বিবাহের একটী সুবন্দোবস্ত করিতে না পারিলে কখনই তিনি নগেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার মেয়ের বিবাহ দিবেন না। কাজেই মনোমোহনের বিবাহে রমণীমোহন রায় উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিল।
এইরূপে মনোমোহনের একটা কুলকিনারা করিয়া, সুরেন্দ্রকুমার মুমূর্ষু বন্ধুর সহিত যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন তাহা রক্ষা করিলেন। রমণীমোহন 'কাকাবাবুর' মাথায়ই কাঁঠাল রাখিয়া স্বীয় স্বার্থোদ্ধার করিল এবং পিতার অপমানের প্রতিশোধের চূড়ান্ত করিল।

রমণীমোহন পূর্ব্বমূর্তি ধারণ করিল। এইবার দেবেন্দ্রর কিঞ্চিত্ চক্ষু ফুটিল।

কনে লইয়া বরযাত্রীরা ষ্টিমার যোগে স্বদেশ যাত্রা করিয়াছিল। পথে এক স্থানে সন্ধ্যা হওয়ায় তথায় নোঙ্গর করিয়া তাঁহারা গাঢ়নিদ্রায় অভিভূত হইল। সকালে সরোজিনীকে তাহার কেবিনে দেখা গেল না।

এক বৃদ্ধা সরোজিনীরই নিকটে শয়ন করিযাছিল। সে বলিল, -- "আমার বোধ হইল যেন খুব ভারি একটা বস্তু দুপুর রাতে আমাদের নৌকা হইতে জলে পতিত হইল। আমি মনে করিলাম, হয়ত জোয়ারের ঢেউ আসিয়া জোরে নৌকার সহিত ধাক্কা লাগিয়াছে বলিয়া এরূপ শব্দ হইয়াছে।"
সরিজিনীর অলঙ্কারের বাক্স খুলিতেই উহাতে সর্বোপরি একটুকরা কাগজ হাওয়া গেল। তাহাতে লাল পেন্সিলে লেখা রহিয়াছে --

"জগদীশ,
জীবনে এক ভিন্ন দুই আমার অভিপ্রেত নহে। তবে আর এ জীবনে প্রয়োজন কি? তোমার দাসী তোমারই চরণে আসিতেছে, শ্রীচরণে স্থান দিও।

ইতি -- সরোজিনী"

ঘটনাটা আর কাহারও বুঝিতে বাকী রহিল না।

অতুল নামে সূর্য্যকান্তের এক বন্ধু ছিল। সূর্য্যের অদৃশ্য হওয়ার পর তাহার বৃদ্ধা মাতাকে অতুল নিজের বাড়ীতে আনিল। কয়েক মাস অতীত হইলেই অতুল ডাকে একখানা পত্র পাইল। উহাতে লেখা রহিয়াছে:

"গয়াধাম
১২ ই জুন, ১৮৯৮

প্রিয়সুহৃদ অতুল,
আমি কোথায় আছি হয়ত ইহার পূর্ব্বে জানিতে না। মনকে বুঝাইবার জন্যই পরীক্ষাটা দিয়াছিলাম। ফলত তদ্রুপ। আমি কষ্টে আছি বলিয়া হয়ত তোমরা অনেকেই দুঃখ করিতেছ; আমি কিন্তু ভাই খুব সুখেই আছি। দিবারাত্রি ভগবানের নাম করি। পৃথিবীতে এর বাড়া সুখকর আর কি আছে?
সরোজিনী আমাকে ভালবাসিত ইহা আমি বেশ জানিতাম। সুতরাং সেখানে থাকিয়া তাহার মনে কষ্ট দেওয়া উচিত বিবেচনা করি নাই বলিয়াই দেশত্যাগী হইয়াছি। তবে, মা এখনও জীবিত আছেন তাই স্বদেশের কথা সর্ব্বদা মনে পড়ে। কিন্তু সেই 'স্বর্গাদপি গরীয়সী' জন্মভূমিকে জীবনে আর দেখিব কিনা সন্দেহ।
সরোজিনী যেন আমাকে ভুলিয়া যায়, আমি ভগবানের নিকট অহরহ এই প্রার্থনা করি। আমাকে ভুলিলে হয়ত সে সুখী হইতে পারিবে।
মাকে তোমার কাছে রাখিও। তাঁহার সেবাশুশ্রুষা সম্বন্ধে লেখা বাহুল্য। কষ্টের হ্রাস হইবে; অন্যপক্ষে আমিও 'নব উদাসীন '। অল্পদিন মধ্যেই প্রয়াগ, মথুরা, সোমনাথ ইত্যাদি স্থান পরিদর্শনে বাহির হব। এইরূপ করিয়াই জীবনের অবশিষ্টাংশ কাটাইব ইচ্ছা করিয়াছি। সুতরাং আমার নিকট হইতে আর কোন চিঠি পাওয়া তোমার পক্ষে অসম্ভব হইবে, বোধ হয় এই চির বিদায়।

তোমার স্নেহের
সূর্য্যকান্ত"

হায়, হতভাগার অদৃশ্য হওয়ার মাসাধিক পরেই যে তাহার স্নেহময়ী জননীর সকল জ্বালার অবসান হইয়াছে এবং বঙ্গোপসাগরের শান্তিদায়িনী ক্রোড়ে যে দুঃখ জর্জরিতা সরোজিনী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে তাহা হতভাগা এ পর্যন্তও অবগত নহে।

শেষকালে দেবেন্দ্রনাথের দুঃখ দেখিলে পাষাণ হৃদয়ও গলিত হইত।

ফতেমা খাতুন

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা