পোনুর
চিঠি -
পিজায় পোনু

ফ্লোরেন্স্
থেকে বেরিয়ে "হঠৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে, ফিরবে
আবার বাঁয়ের দিকে" করলেই পশ্চিমমুখে গিয়ে পিজা
শহরে পৌঁছনো যায় । ব্রেকফাস্টের সময় ছড়িদারের সঙ্গে
ঠাকরুণ কী ফুস্ফুস গুজগুজ করছিলেন, আমার মোটেই ভালো
ঠেকেনি । যাবো সেই আমড়াতলার মোড়ে, রোমে, সটান নাকবরাবর
রাস্তা, তা তার সঙ্গে আদ্যানাথেরই বা তার মেসোরই কী
সম্পর্ক । পালি নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করলেন, সংস্কৃত
তো পড়লেন না, পড়লে জানতেন ঋষিরা কেন "পথি নারী
বিবর্জিতা" লিখে গেছেন । আরে মশায় আমাদের দেশে
ভিজে ছোলার কল্যাণে আকছার মাটি ফুঁড়ে আসল শিবলিঙ্গ
উঠে যাচ্ছে, আমাদের আর পিজার ঘণ্টাতলা দেখাতে হবে
না । তবে সায়েবদের ব্যাপার তো জানেন, তাঁদের দেবতা
একটু কানে খাটো, তাই ঘণ্টা বাজাতে হয় একেবারে কানের
পাশেই, নয়তো ঠিক গাঝাড়া দিয়ে উঠতে পারেন না । ঘণ্টাতলার
আকাশ-ছোঁয়া দৈর্ঘ্য সেই কারণে ।
তা
যাওয়া হোলো । দূর থেকেই গম্বুজ দেখা যাচ্ছে, তার পাশেই
হেলে পড়া লিনিং টাওয়ার অফ পিজা । সেদিন আবার গির্জেতে
এক বিয়ের ব্যাপার আছে, গির্জার ভেতরে নেপোকে দই মারিয়ে
(সেকী, ওই যে বলে আমার হৃদয় তোমার হউক, তোমার হৃদয়
আমার হউক, উভয়ের মিলিত হৃদয় ঈশ্বর নামক নেপোর হউক),
তাঁরা বাইরে এসে গেছেন, বেশ হুটোপাটি ব্যাপার । ছবি
তোলা হচ্ছে, বর কাঁধে করে পিজার টাওয়ার ধরে রেখেছে,
বৌ টাওয়ারের চূড়ায় বসে হাতছানি দিচ্ছে, নেশার ঘোরে
যা হয় । গির্জের চত্বরে তিনচার ডজন টিন, রাংতা আর
প্লাস্টিকের ফঙ্গবেনে সুভেনিরের দোকান, লোকে মেছোবাজারের
মতো দরাদরি করে কিনছে । তার একটিতে বাংলাদেশী দোকানদার,
বাপের বাড়ি বামুনবাইড়্যা । গিরীন চক্রবর্তীর গানটা
শোনালাম, কোনো ভাববিকৃতি দেখা গেলো না । তিনি নাকি
ইতালীতেই জন্মেছেন; বটেই তো ।
টাওয়ারে ফেরা
যাক । হ্যাঁ, ছবিতে যেমন দেখায় তেমনই হেলানো । বেশীক্ষণ
তাকিয়ে থাকলে একটু মাথা ঝিম ঝিম করে । না তা বললে
চলবে না, আমি সকালে চা আর নেড়ো বিস্কুট ছাড়া আর কিছু
খাই নি । প্রায় দুশো ফুট উঁচু, গোলাকার আটতলা টাওয়ার,
সাতট ঘণ্টা আছে, টঙে চড়তে গেলে প্রায় তিনশো সিঁড়ি
ভাঙতে হয়, ২০০১ সাল থেকে টাওয়ারে ঢুকতে আর ওপরে উঠতে
দেওয়া হচ্ছে । ঘণ্টাবাড়ির এই কাত্ হওয়ার ব্যাপারে
কিছু মজা আছে, টাওয়ারের হেলন এখন বন্ধ হয়েছে তাই একটু
খুলে বলা যেতে পারে ।

ব্যাপারটা হোলো
এই রকম । ১১৭৩ সালে শুরু করে ১১৭৮ সালে চারতলা ওঠার
পর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয় । তার সঠিক কারণ জানা যায়না,
তবে তখনই টাওয়ার দক্ষিণদিকে বেশ কিছুটা হেলে গেছে,
সে কারণে হতে পারে । মুখ্যত জমি হোলো বালি আর কাদার,
তার ওপর ঘরবাড়ী না বসানোই ভালো, তা তখন তো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
আবিষ্কার হয় নি, এসব ঠিক জানা ছিল না । তারপর প্রায়
একশো বছর ধরে টাওয়ারের চাপে মাটি একটু শক্ত হয়েছে
বলে মনে হোলো, তখন আবার কাজ শুরু হোলো । রাজমিস্ত্রিরা
দেখে, এ তো বড়ো জ্বালা, ওলন আর সোজা হয়না, তাই তারা
ওপরের তলাগুলো একটু হেলিয়ে দিল উল্টোবাগে । টাওয়ারের
আকৃতি হোলো খানিকটা কলার মতো, হনুমান হলে ঠিক ধরে
ফেলতেন, আপনি আমি অবশ্য চর্মচক্ষে বুঝতে পারবো না
। এবার সাততলা পর্যন্ত ওঠার পর যুদ্ধ বাধলো, সেই যুদ্ধে
পিজার লোকেরা বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেলো, টাওয়ার বন্ধ্ ।
১৩৬০ সালে আবার কাজ শুরু, এবার ঘণ্টাঘরটা চড়ানো হোলো
। কাজ চলতে চলতেই কিন্তু টাওয়ার হেলছে (ওজন চড়ানো
হচ্ছে তো) আর মিস্ত্রিরা "কলা"-রূপ দিয়ে
কোনোরকমে তা ম্যানেজ করছে । পাশেই অবশ্য গির্জা আছে
মানত করার জন্য । এই করে শেষ পর্যন্ত টাওয়ার প্রায়
চার ডিগ্রী ঝুঁকে আসার পর ছাড়ান দেওয়া হোলো ।
তারপর কাল কেটে
যায় আর টাওয়ার হেলতে থাকে । এর মধ্যে সুযোগসন্ধানী
গ্যালিলিও টাওয়ারের টঙে চড়ে কী সব মাটিতে ফেলে সাঙঘাতিক
কী সব আবিষ্কার করলেন তা আর এখন মনে করতে পারছি না
। লোকে অবশ্য বলে ওসব গল্পকথা, গ্যালিলিও ওই নড়বড়ে
টাওয়ারে ওঠার ঝুঁকি নেবার মতো মূর্খ ছিলেন না, পুরোটাই
মনে মনে । যাকগে, ইটালী কিন্তু ইতিমধ্যে টাওয়ারের
দেখভাল করার জন্য একটা কমিশন বসিয়ে ফেলেছে । তাঁরা
যথারীতি রিপোর্ট লিখে ফাইল করে যাচ্ছেন আর টাওয়ারও
হেলে যাচ্ছে, যদিও হেলবার হার কমেছে, বোধহয় কমিশনের
ভয়ে । ইটালীয়ানদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের খুব মিল
পাওয়া যায়, লেখা লেখি আর ফাইল করার ব্যাপারে আমরা
বিশেষ পটু । ওইখানে এসেই আটকে থাকার ব্যাপারেও । ১৮০০
সাল থেকে বেশ কয়েকটা কমিশন; তাঁরা রিপোর্ট লেখেন,
পেয়ারের স্থপতিদের পয়সা দেন, খুচখাচ এদিক ওদিক একটু
খোঁড়াখুঁড়ি হয় কিন্তু টাওয়ার হেলেই চলে । শেষে ১৯০২
সালে ভেনিসে একটা অমনতরো টাওয়ার (নাম ছিল বোধহয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়;
নাঃ ভুল বলাম, সে হোলো হিজিবিজ্বিজের গল্প) হুড়মুড়িয়ে
ভেঙে পড়ে গেলো, কর্তাদের ভারী বেইজ্জত্ । এবার কমিশন
বসার আর শেষ নেই, একের পর এক । এতোদিনে অবশ্য সিভিল
ইঞ্জিনিয়ারিং বার হয়ে গেছে, প্রচুর মাপজোপ করার যন্ত্রপাতি
পাওয়া যাচ্ছে । কমিশন তাই দিয়ে মাপজোপ করেন, বুদ্ধির
গোড়ায় ধোঁয়া দেন আর পার্লামেণ্টে গিয়ে আর এক বছর আয়ু
ভিক্ষা করেন । তাড়াহুড়োয় পার্লামেণ্ট কমিশনকে কমিশন
করতেই ভুলে গেছেন ।
এই মাপজোপ করে
অবশ্য অনেক কিছু জানা গেল । যেমন খোঁড়াখুঁড়ির ফল বিশেষ
ভালো হয়নি, ভিত্তিতে জল ঢুকে গেছে, এই ধরণের ব্যাপার,
বড়ো কাজে ওরকম ছোটোখাটো ভুলচুক হয়েই থাকে । আরো জানা
গেল যে দক্ষিণ দেয়ালের ইঁটকাঠ চুণবালির খুব কাহিল
অবস্থা, ফাটল ধরেছে আর যে টাওয়ার শুধু হেলছে তাই নয়,
একটু পাকও খাচ্ছে, একেবারে সান্নিপাতিক জ্বর । কমিশনকে
আন্তর্জাতিক করা হোলো, সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক
প্রতিযোগিতা আহূত হোলো, মজার মজার সব প্রয়োগ এলো ।
ইতিমধ্যে ছোট ছোট টোটকা চলেইছে, তার লাগিয়ে টাওয়ারের
ঝুঁটি টেনে রাখা, জল বেরোবার নালা তৈরী করা ইত্যাদি
। অবশেষে, বোধহয় নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে কমিশনের
নজরে এলো যে টাওয়ারের ভিত্তি থেকে দেখলে শুধু যে দক্ষিণ
দিকটা নেমে যাচ্ছে তাই নয়, উত্তর দিকটা উঠে যাচ্ছে
। এর থেকে এলো দিব্যদৃষ্টি-- টাওয়ারের ঝুঁটি ধরে সোজা
করার চেষ্টা না করে এই উত্তরদিকটা নামিয়ে দিলে কী
হয়? যেমন কথা তেমনি কাজ । উত্তরদিকে বিশাল বিশাল সীসের
তাল আস্তে আস্তে রাখা হোলো । সবশুদ্বুì সাতশো টন হবে
বোধহয় । তাতে হেলনের হার একটু হ্রাস পেলো বলে মনে
হয়, কিন্তু শিল্পরসিকদের প্রতিবাদ, এম্যা ইকী কুচ্ছিত্
ব্যাপার, টাওয়ারের দিকে যে আর তাকানোই যায়না । কমিশন
আবার কাজে লাগলেন, কী সব যাদু করলেন, ফলে ১৯৯৫ সালের
সাতই সেপ্টেম্বর একদিনে টাওয়ার গত একবছরের চেয়ে বেশী
ধবসে গেল । না, না, এর মধ্যে স্বজনতোষণের কোনো ব্যাপার
নেই, কমিশন নিদ্র্বিধায় স্বীকার গেলেন । কমিশনের চোদ্দোজন
বিশেষজ্ঞ, তার দুজন মাত্র বাইরের লোক, তাও তার একজন
আবার ১৯৯৬ সালেই টাওয়ারের বালাই মাথায় নিয়ে হার্টফেল
করে মরলেন । শেষকালে সেই বাকী বাইরের লোক, বুর্ল্যাণ্ড
তাঁর নাম, তিনি বুদ্ধি বাত্লালেন, উত্তরদিকে টাওয়ারের
তলা থেকে ভোমর চালিয়ে আস্তে আস্তে, খুউব আস্তে আস্তে,
মাটি বের করে দিলে কী হয় । যেমন কথা তেমনি কাজ-- ১৯৯৯
সালে শুরু হয়ে আড়াই বছর ধরে সত্তর টন মাটি বার করা
হোলো । তারপর ২০০৩ সালে ওই বুর্ল্যাণ্ড সায়েবই আবার
বুদ্ধি করে বার করলেন টাওয়ারের উত্তরদিক কেন চড়ে যাচ্ছে
। দেখা গেলো প্রকৃতির কোন যাদুতে বর্ষাকালে ওইদিকে
একটু বেশী জল এসে যায় । সেই জল নিষ্কাশনের একটা ব্যবস্থাও
করে দিলেন । সেই থেকে পিজার টাওয়ার আর হেলছেনা । পণ্ডিতরা
হিসেব করে বলছেন এখন আটশো বছরের মতো নিশ্চিন্ত হওয়া
গেলো । পিজার বাসিন্দেরা কিন্তু মোটেই খুশী নয় । তাদের
মতে এই টাওয়ারের অনিশ্চয়তা ছিলো কতো রোম্যাণ্টিক ব্যাপার,
মত্ত অবস্থায় কতো বাজিই না ধরা হয়েছে, কবে হুড়মুড়
করে পড়ে তার আশায় আশায় লোকে সারা জীবন কাটিয়ে দিত--
সে সব এখন মিথ্যে হয়ে গেলো । বেঁচে থাকার সেই মজাই
রইলো না আর ।
টাওয়ারের উল্টোদিকে
গির্জার ওপর নশো বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রিফিন ।
তার সিংহের দেহ, তার ঈগলের পাখা, সে বহুদর্শী । সে
ভাবে এখন ভায়াগ্রা যখন সস্তাতেই পাওয়া যাচ্ছে তখন
এতো ঝামেলা করার কী দরকার ছিলো বাপু? এই মানুষজাতিটি
অতি মূর্খ ।
আমরা নির্বাক
।