পোনুর
চিঠি -
রোমে পোনু

আমার ছড়িদারকে
মনে রেখেই সলিল চৌধুরী মশায় গান বেঁধেছিলেন, "পথ
হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি"। ছড়িদার স্বয়ং
ধর্মপ্রাণ লোক, এক জগদ্খ্যাত গুরুর চেলা, গুরুর দৈববাণীতে
তাঁর তনুমন আচ্ছন্ন, জিপিএসের আকাশবাণী তাঁর কানে
পৌঁছোয় না। তা এসব জেনেশুনেই নাচতে নেমেছিলাম,এখন
ঘোমটা টানলে তো চলবে না। অতএব পিজা থেকে রোম পথ হারাতে
হারাতে। এ পথটি নাকবরাবর নয়, এ পথটি ভূমধ্যসাগরের
গা ঘেঁসে যাচ্ছে, ছোটো ছোটো শহর, দুপুরের ঝিম ধরা
গ্রাম, বহুবিস্তীর্ণ জলপাই বাগিচার আড়ালে মাঝে মাঝে
নীল শাড়ির, থুড়ি সাগরের ঝলক, রৌদ্রস্নাত দিন-- মোটামুটি
নালিশ করার মতো কিছু নেই। তবু লেখায় নালিশ নালিশ গন্ধ
কেন? ও আমার স্বভাব। রোম নগরীতে পৌঁছবার পরেও "ভুল
পথ", "রিক্যালকুলেটিং" ইত্যাদি চিৎকার
করে করে আমাদের জিপিএস মহিলার গলা ভেঙে গেল, ছড়িদার
কিন্তু নির্বিকার। তবে পৌঁছে গেলাম হোটেলে এটা ঠিক,
নিশ্চয় গুরুর কৃপায়। তখন "রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি,
বেলাশেষের তান"।
ছড়িদারের ভরসায়
রাতের রোমে আর বেরোনো গেলো না। গাড়ী করে যাওয়ার তো
কথাই ওঠে না, কে জানে আবার হয়তো পিজায় গিয়ে বসে থাকবো।
চোথায় বলছে রাতের রোম দেখতে হলে আলোকোজ্জ্বল এ পিয়াৎজা
থেকে ও পিয়াৎজা হেঁটে হেঁটে যাবে। দলে বেশী লোক থাকলেই
ভালো যাতে মত্ত প্রলাপে গলির আঁধারে লুকিয়ে থাকা সীজারদের
ভূত উচ্চকিত হয়, পকেটমাররা সতর্ক হয়, চাই কী স্কুটার
চড়ে মেয়েপুলিশও আসতে পারে। আমাদের লোকবল নেই তাই পরদিন
সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হোলো রোমের সঙ্গে শুভদৃষ্টির
জন্য। বড়ো শহরে যথারীতি "রাজার পথে লোক ছুটেছে,
বেচাকেনার হাঁক উঠেছে"। গোড়াতেই বলে রাখি, ঐ
যে স্কুটারবাহিনী মেয়েপুলিশের কথা বলছিলাম না, দেখলাম
ঝলমলে রোমানীরা স্কুটারই চালিয়ে থাকেন, ভেস্পার চল
বেশী। ট্র্যাফিক আলোতে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে যখন ভ্রা-ভ্রা-ভ্রূম
শব্দ তোলেন, তখন স্পেস হেলমেট মাপের হেলমেটে মুখচোখ
ঢাকা থাকলেও বোঝা যায় এঁরা অ্যাগ্রিপ্পিনার (একনম্বর
অ্যাগ্রিপ্পিনা আমাদের দিয়েছিলেন ক্যালিগুলা, দুনম্বর
মর্ত্যে আনলেন নিরোকে-- এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়
দ্যাখ) দৌহিত্রী হতেই পারেন। রোমান হলিডে ছবিতে অড্রে
হেপবার্নকে মনে আনুন। তারপর ফুটপাথে হাঁ করে দাঁড়ানো
আপনার হৃদয়টি মুখে তুলে এনে দিয়ে, আপনার তিনইঞ্চির
মধ্যে এসে সড়াৎ করে স্কুটার পার্ক করে, হেলমেট খুলে,
চুল ঝাড়া দিয়ে মুচকি হাসি মেরে যখন চলে যান তখন আপনার
গায়ত্রী মন্ত্রের সঙ্গে ক্লিওপ্যাট্রাকেও মনে পড়তে
পারে। ও, উনি আবার মিশরী বলছেন; মোহিনীদের কী কুহক
দেখুন, রোমদর্শনের পর বছর ঘুরে গেলো, এতদিনেও গামছাটা
যে কোথায় রাখলাম তাই মনে করতে পারি না, আর ক্লিওপ্যাট্রার
কুলুজী।
রোমান হলিডের
কথায় মনে পড়লো, আচ্ছা মশায়, একগাদা টাকা খরচ করে,
পকেটমারের ভয়ে সদা শুঁটকে থেকে, এবড়োখেবড়ো (আদর করে
এঁরা বলেন cobbled) রাস্তায় পায়ের বুড়ো আঙুল উৎসর্গ
করে রোম ঘোরার কী প্রয়োজন, ঘরে বসে রোমান হলিডে ছবি
দেখলেই তো হয়। মোটামুটি তো সবই পাওয়া যাবে,-- ট্রেভি
ফোয়ারা, স্প্যানিশ সিঁড়ি, চোদ্দো রকমের পিয়াৎসা, ভাঙা
কলোসিয়াম। আর নৈবেদ্যের চূড়ার সন্দেশটির মতো অড্রে
হেপবার্ন। আর কলোসিয়ামের কথা যদি বলেন তাহলে রাসেল
ক্রোর গ্ল্যাডিয়েটর দিয়ে শুরু করতে পারেন, সে সবে
কলির সন্ধ্যে। আসল কলোসিয়ামে ঢুকতে দুঘণ্টা লাইনে
দাঁড়িয়ে, সানস্ট্রোক বাধিয়ে, হুড়মুড় করে ভাঙা সিঁড়ি
দিয়ে পড়ে, পকেট মারিয়ে, একগাদা সস্তার টুপী, ছাতা,
চশমা কিনে এবং পুরো একমাসের মাইনে গিন্নির কল্যাণে
জলাঞ্জলি যেতে দেখার মর্মবেদনায় জ্বলে এক ডজন ঝুলকালো
ফটো না তুলে একটা বিয়ার নিয়ে নিজের সোফায় বসে দেখার
মজা বেশী, সে মান্ছেন তো। আর এসব হলিউডের ব্যাপার,
আজকাল আবার কম্প্যুটারে ছবি বানানো হয়, সেখানকার কলোসিয়ামের
জৌলুসই আলাদা, সব টিপটপ, বাঘসিংহের গর্জন শুনলেই পেট
নেমে যায়, টোম্যাটো কেচাপের আদ্যশ্রাদ্ধ,-- আসল কলোসিয়ামে
নিজের রক্তপাত করে আর যত্তো নেড়ি কুকুর আর হুলো বেড়াল
তাড়িয়ে ঘরে ফিরতে হয় না। এইসব দেখাদেখির কথায় মনে
হোলো, গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন দেখতে যাবেন বলে তড়পাচ্ছিলেন,
তো ভালো কথা বলি শুনুন। আইম্যাক্সে গ্র্যাণ্ড কানিয়ন
আর কলোরাডো নদী দেখে ফিরে আসুন, রোদে পুড়বেন না আর
সস্তাও হবে। কলোরাডো নদীর কথায় মনে পড়ে গেলো, ফরাসীরা
যখন আমেরিকায় রাজত্ব করতো তখন তারা দুটি পাহাড় আবিষ্কার
করেছিলো, নাম দিলো টেটন, দি গ্র্যাণ্ড টেটন। ফরাসী
শব্দ টেটনের অর্থ স্তন; তার ওপর আবার গ্র্যাণ্ড। তো
ভালো, এখন ভেবে দেখুন কী ভাগ্য আমাদের যে এই ফরাসীরা
কলোরাডো নদী আবিষ্কার করেনি। তাহলে "ডার্টি জোকের"
বাজার আরেকটু গরম হোতো বটে, কিন্তু আর ফেমিলি নিয়ে
এসব জায়গায় আসাই যেতো না [বিল ব্রাইসনের কৃপায় এই
তথ্যটি পাওয়া গেছে]।
অতএব রোমে এসে
রোমানরা যা করে তাই করুন। ঐসব "দর্শনীয় স্থান",
"টুরিস্ট ট্র্যাপ"-এর ধারে কাছে যাবেন না।
কাফেতে বসে রোদ পোয়ান, কফি খান, বেলা একটু বাড়লে তাড়িটা
ঠিক গেঁজে উঠবে যখন তখন তাই সেবন করুন আর ভেস্পা-আরোহিণীদের
দেখুন সমঝদারের চক্ষু দিয়ে। আমি কী করলাম তাই জিগ্যেস
করছেন। হেঁ হেঁ, আমার মুগুর আমার সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা
আছেন সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে, তাই আমি খিঁচুনি
খেতে খেতে গুটগুট করে চললাম বাস ধরতে। hop-on-hop-off
বাস, উঠে বাসের দোতলায় বসবেন, খোলা ছাত, রোদে পুড়বেন,
জলে ভিজবেন, হাওয়ার দাপটে দম বন্ধ হয়ে আসবে, তারই
মধ্যে পিটপিট করে রোম দেখবেন আর কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে
বর্ণনা শুনবেন। সব দর্শনীয় স্থানে বাস দাঁড়াবে, যেখানে
খুসী নেমে যাবেন, আবার পরের বাসে উঠবেন। ভালোই ব্যবস্থা
যদি একটু মেঘলা মেঘলা দিন আর মলয় সমীরণ অর্ডার করতে
পারেন। আমি পারিনি, সর্বকর্মে ভাগ্যের কাছে ল্যাং
খাওয়া তো আমার কুষ্ঠিতেই লেখা আছে। তো সেই বাস ধরতে
এলাম পিয়াৎসা ভেনেজিয়াতে। এককালে ভেনিসের দূতাবাস
ছিলো, তাই এই নাম। ওঃ সে কী ধুন্দুমার ব্যাপার রে
মশায়, "ছুট্ছে কত খ্যাপার মত, পড়্ছে কত চাপা
/ সায়েব মেমে থম্কে থেমে বলছে মামা পাপা"। তারই
মধ্যে অবিমিশ্র বাঙাল উচ্চারণে ইংরেজী, ইটালিয়ান,
ফরাসী-- মাঝে মাঝে ও কি চীনে ভাষা শুনছি,-- ভাষাতে
বাংলাদেশীদের এক বিশাল দঙ্গল সমবেত পথিকদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য
ও ট্যাঁকের তত্ত্বাবধান করছেন। তাঁরা বাসে তুলছেন,
নামাচ্ছেন, টিকিট বেচছেন, হ্যাণ্ডবিল বিতরণ করছেন,
জলের বোতল, ছাতা, টুপি, কালো চশমা ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয়
এবং তার সঙ্গে পোপের ছবি থেকে ফুলঝাড়ু অবধি যতোসব
অতি অপ্রয়োজনীয় জিনিষের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। সিংহবাহিনীর
বাংলায় প্রিয়সম্ভাষণ শুনে এক মিঞা জিগাইলেন, কঅর থিক্যা।
কোলকাতা শুনে বলেন, অ, ইণ্ডিয়ান, ভাবটা এই যে নয়তো
এমন আকাট বাঙাল আর কোথায় পাওয়া যাবে। সিংহবাহিনী নোয়াখালির
মাইয়যা হুইন্যা ডিসকাউণ্ট দিয়ে বাসের টিকিট বেচলেন।
সারা চত্বরে কেবল চারটি কুলিশপাণি পুলিশ, তাঁরা প্যাণ্টের
ক্রিজ আর জুতোর চাকচিক্য বজায় রাখতে ব্যস্ত, যদিও
এই একান্ত নিরীহ টুরিস্ট গড্ডলিকার পক্ষে একজনই যথেষ্ট।
পাশে ঘাসের ওপর দুজন রোমান যোদ্ধাদের বেশ পরে, ফোম
রবারের ভাঙা থাম পেতে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছেন আর
হুস্হাস সিগারেট ফুঁকছেন, পয়সা ফেললেই আপনি এক ভীষণদর্শন
তরোয়াল দিয়ে তাদের একজনকে বধ করতে, এবং সেই ঘটনা ডিজিট্যাল
ক্যামেরাবদ্ধ করতে পারেন। মহিলারা হয় এঁদের দ্বারা
অপহৃতা বা এক, চাই কি দুজনেরই কণ্ঠলগ্না হতে পারেন।
আরে না, না, এঁরা বাংলাদেশী নন। খদ্দেরও হচ্ছে। একসময়ে
নাকি এখানকার একটা প্রাসাদে থাকতেন বেনিতো মুসোলিনি,
আর একটায় থাকতেন লেটিশিয়া বোনাপার্ট, আমাদের নেপোলিয়ানের
মা। কি, শুনে রোমাঞ্চ হচ্ছে কিনা বলুন।
রোমের কলোসিয়াম
ভুল করার কোনো উপায়ই নেই। রোমের কোনো পোস্টার যদি
দেখে থাকেন তাহলেই দেখবেন ভূপাতিত হনুমানের হনু অস্থি
শোভা পাচ্ছে, সেই হোলো কলোসিয়াম। সেই কলোসিয়ামের সামনে
বিশাল সর্পিল লাইন। ছড়িদার ত্বরিৎ কাজে লেগে গেলেন,
দশ মিনিটের মধ্যে লাইনের শেষে দাঁত খিঁচিয়ে ছবি তোলা
বন্ধ রেখে সরাসরি কলোসিয়ামের গেটে বিমল হাস্যময় উপস্থিতি।
তার মধ্যেই বাংলাদেশী ভাই টুপি আর রোদচশমা গছিয়ে দিয়েছেন।
ছড়িদারের কী কৌশল জানিনে, রোম যাবার আগে ছড়িদার পুরিয়া
বেচেন কিনা খবর করতে পারেন। ঢুকলাম তো, আরে মশায় একেবারে
যাচ্ছেতাই, এরা এসব পুরাকীর্তির কোনো মর্যাদা দেয়
না, কোনো যত্নও নেয় না, সব ভেঙেচুরে একাক্কার। ব্যাপারটা
হোলো এইরকম। পুরাকালে রোমের এক সম্রাট ছিলেন, নাম
নিরো, অতি হারামজাদা। সেকালে রোমের সম্রাট হতে গেলে
পর্বতপ্রমাণ আত্মম্ভরিতা আর পাশবিক নৃশংসতা একটু আধটু
রাখতেই হোতো, তবে এঁর মাত্রা ছিল একটু বেশীর দিকে।
অবশ্য আধুনিককালেও যে এমনটি হয়না তা নয়, হাতের কাছে
সাদ্দাম হোসেন বা মুয়াম্মর গদ্দাফি আছে, তবে এখন একটু
নলচে আড়াল দেওয়া হয়। তখন এসবের দরকার ছিল না, সম্রাটেরা
ছিলেন দেবাংশী, তাঁদের সাত কী, সাত লক্ষ খুন মাপ।
যাই হোক, চৌষট্টি খ্রিস্টাব্দে নিরোর কিছু জমির প্রয়োজন
হয়ে পড়লো-- বোধহয় রামায়ণে স্বর্ণলঙ্কার কথা জেনে তেমনটি
বানাবার ইচ্ছে হয়েছিল (বানিয়েছিলেনও শেষ পর্যন্ত,
নাম Domus Aurea), রাবণের সঙ্গে অনেক চরিত্রগত মিল
ছিলো তো। যাই হোক, যেমন কথা তেমনি কাজ, পেয়ারের লোকেরা
রোমে অগ্নিসংযোগ করে দিলো, সব সাফসুতরো করে খাসা খানিকটা
জমি পাওয়া গেল। প্রসঙ্গত, অগ্নিকাণ্ডের সময় নিরো ব্যায়লা
বাজিয়ে গান গাইছিলেন বলে যে রটনা আছে, তা বিশ্বাস
করবেন না, সব এ্যাণ্টিপার্টিদের রটনা। সেখানে নিরো
অনেক কিছু বানালেন, সঙ্গে নিজের একটি দেড়শো ফুট উঁচু
ব্রোঞ্জের মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হোলো-- অনেকটা প্রাচীন
সপ্ত আশ্চর্যের একটি, রোডসের কলোসাসের মতো। তারপর
শত সহস্র লোকের আন্তরিক প্রার্থনা চরিতার্থ করে তিনি
গত হলেন।
নিরোর পরেই যে
তিন সম্রাট এলেন তাঁরা অল্পবিস্তর খেটেখুটে ওইখানেই
এক বোম্বাই ক্রীড়াপ্রাঙ্গণ দাঁড় করালেন। এটা হোলো
থিয়েটার নয়, তার বাবা অ্যাম্ফিথিয়েটার-- অ্যাম্ফি,
অর্থাৎ চারদিকে থেকেই খেলা দেখা যাবে, খেলোয়াড়দের
কোথাও পালাবার জায়গা নেই। একটু মাপজোক না দিলে লোকে
ছ্যা ছ্যা করবে তাই বলি-- দুশো বাই তিনশো ফিটের মাঠ
ঘিরে পাঁচশো বাই ছশো ফিটের ডিম্বাকৃতি ব্যাপার, লিখছে
যে পঁচাত্তর থেকে আশি হাজার লোক ধরতো। প্রায় বারো
তলা বাড়ীর সমান উঁচু, মাটির ওপর (আসলে আরো পনেরো ফুট
ওপরে) বসার জায়গা চারটি তলা, মাটির নীচে দুটি, আর
খিলেনের তো মোচ্ছব। চারটি বড়ো প্রবেশপথ সেনেটর, জেনারেল,
ট্রিবিউন আদি মদগর্বী রোমানদের আত্মম্ভরিতার মাপমতো
আর বাকী ছিয়াত্তরটি ছোটমাপের প্রবেশপথ আমজনতার জন্য।
মাটির নীচে পয়ঃপ্রণালী আছে, প্রাকৃতিক প্রয়োজন তো
ছিলোই,তাছাড়া রক্তগঙ্গা বহমান রাখাটাও তখন ছিল জরুরী।
যৌবনে যখন কলোসিয়ামের খুব রম্রমা, তখন মাথার ওপর
চাঁদোয়া খাটানো হোতো। ভাগ্যিস! অ্যাম্ফিথিয়েটার ঢুকে
এমনিতেই পঞ্চ-ম্কারের প্রভাবে রোমান দর্শকদের তখন
মারমূর্তি, হাতে মাথা কাটছেন প্রাঙ্গণে পরাস্ত খেলোয়াড়দের,
তার ওপর বৈশাখের রোদ্দুরে পুড়তে হলে আর দেখতে হোতো
না।
তো হঠাৎ এই অ্যাম্ফিথিয়েটার
বানাবার কী প্রয়োজন ঘটলো? মুখ্য কারণ নিরোকে মরণোত্তর
বংশ দেওয়া। আসলে ঠিক তা নয়, আসল কারণ প্রজাদের মেজাজ
একটু ঠাণ্ডা করা। নিরোর নানা কুকীর্তির কারণে প্রজারা
আস্তে আস্তে চটছিল, শেষে তো সৈন্যসামন্তরা বিদ্রোহই
করে বসলো আর নিরোকে নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা করতে হোলো।
সে ব্যাটাচ্ছেলে আবার রোমে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে রোমানদের
দুটো স্টেডিয়াম পুড়িয়েছিল, তারপর কাটা ঘায়ে নুনের
ছিটের মতো নিজের আখাম্বা এক মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে
ব্যক্তিগত প্রমোদ উদ্যান বানিয়েছিলো-- নির্লজ্জতার
পরাকাষ্ঠা। এই কলোসিয়াম করে এক ঢিলে বেশ কয়েকটা পাখি
মারা গেলো-- নিরো যা আত্মসাৎ করেছিলো তা জনতার সেবায়
লাগানো হোলো বলে প্রজাদের বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করা গেলো;
শীর্ষস্থ রোমের ঐশ্বর্য আর প্রতিপত্তির মাপম্তো একটা
সৌধ খাড়া করা গেলো; নিরোর পরে যে নতুন রাজবংশ ক্ষমতায়
এলো, তাদের মহত্ত্ব ঘোষিত হোলো। এর ওপর আবার তাৎক্ষণিক
এক গোষ্ঠী, ক্রিশ্চান বলা হোতো তাদের, নানা রকম ঝঞ্ঝাট
বাধাচ্ছিলো, তা সেই ক্রিশ্চানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিরোধের
একটা যুগপৎ অভিনব ও জনরঞ্জক উপায়ও পাওয়া গেলো। কয়েকজন
পণ্ডিত অবশ্য বলছেন যে সত্যি সত্যি জনসংখ্যা তেমন
একটা হ্রাস করা হয়নি, শহীদত্ব, martyrdom-এর কাহিনী
পল্লবিত হতে হতে এমনটি এসে দাঁড়িয়েছে। এসব বলার পর
সে পণ্ডিতদের হুঁকো-নাপিত চল আছে কিনা তা অবশ্য জানা
যায় না। প্রসঙ্গত, গোড়ার দিকে এটিকে সীজারের অ্যাম্ফিথিয়েটার
বলেই লোকে জানতো, অনেক পরে, একাদশ শতাব্দীতে এটির
নাম হয়ে যায় কলোসিয়াম। ওই নিরোর কলোসাস মূর্তির টিকি
ধরে, বুঝতে পারলেন তো। শেষ রাতের মার দিলো সেই নিরো
ওস্তাদই, কি বলেন?
আজ থেকে দুহাজা
বছর আগের ব্যাপার হলেও, সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতেই একটু
খতিয়ে দেখুন। পত্তনের প্রায় আটশো বছর পরে রোম সাম্রাজ্যের
প্রতিপত্তি তখন আকাশচুম্বী। প্রযুক্তি, প্রয়োগরীতি,
কল্পনাশক্তি, vision ও তাকে রূপ দেবার কৌশল-- সবই
আছে, প্রচুর আছে। প্রযুক্তি ধরুন। খিলেন arch , বিশেষত
ধনুক-খিলেন, vaulted arch ব্যাপারটা রোমান স্থপতিরা
তখন জলভাত করে ফেলেছেন। ইটপাথর জোড়া দেবার জন্য সিমেণ্ট
তো বটেই, কংক্রিটেরও চল দেখা যাচ্ছে। ঠিক এত বড়ো না
হলেও মাঝারি সাইজের অ্যাম্ফি গড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে।
লোকবল? সম্প্রতি ইহুদীদের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে সম্রাট
এক লক্ষ বন্দী ধরে এনেছেন, তাদের দিয়ে অর্ধ পেটভাতায়
কাজ করানো যায়, হেল্থ ইন্সিওরেন্স, এম্প্লয়ার
কন্ট্রিবিউশন-- এসবের বালাই নেই। শহর থেকে একটু দূরেই
মার্বেল আর ট্র্যাভার্টাইন পাথরের খনি, মাল চালান
করার জন্য হাতী, ঘোড়া আর অবরেসবরে হাজার পাঁচেক দাস
মজুর জমায়েত আছে। আর তখন এই বাইপার্টিজান ব্যাপারটা
ছিলো না, একটিই পার্টি, তিনি সম্রাট, তিনি চাইছেন।
আর কী দরকার। তবে হ্যাঁ, মাপটা প্রমাণ সাইজ, আশিহাজার
মদমত্ত রোমানদের সুষ্ঠুভাবে আগমন-নির্গমনের কথা ভেবে
গলিঘুঁজি, অলিন্দ ইত্যাদির বিন্যাসে মুন্সিয়ানা আছে
আর খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেলে লক্ষ্য করা যায় যে ইঁটপাথরের
মাপ্জোক বেশ ছকমাফিক-- যাতে আসন, সিঁড়ি, বারান্দা
ইত্যাদি প্রায় সব কিছুরই গঠন কৌষ্ঠিক, modular। বড়ো
কর্তা মাঝে মাঝেই নির্মাণকর্ম কেমন চলছে দেখতে আসতেন,
তাঁকে খুসী রাখা এবং নিজেদের ঘাড়ের ওপরকার এক একটি
মাথা রক্ষার জন্য স্থপতিরা এই কায়দাটি প্রয়োগ করেছিলেন।
তবে আজকের কলোসিয়ামে গিয়ে এসব কিছু দেখতে পাবেন না,
সেখানে গিয়ে জাপানী দম্পতীর ছবি তুলে, নিজের ছবি তোলাতে
গিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে চোয়ালে ব্যথা করে, এবং ভাগ্য প্রসন্ন
থাকলে পকেটমার এড়িয়ে আপনার আর কিছু করার ফুরসৎ থাকবে
না। তাই বলছিলাম ঘরে বসে ডিভিডিতে সব দেখে নিন, কলোসিয়াম
দেখবেন, সুন্দরী নায়িকা দেখবেন, সাপও মরবে, লাঠিও
ভাঙবে না।

টুরিস্টদের
গাঁটের কথা মনে রেখে-- পিয়াৎসা ভেনেজির তাঁরা ছিলেন
ভারী লাজুক; এঁরা ছিলেন কলোসিয়ামে|

রোমে
কলোসিয়াম-- প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতো নয় কিছু|

পাখীরা
কলোসিয়ামকে এরকমই দেখবে|

কলোসিয়ামের
ভেতরে| তক্তা আর তার নীচের কাণ্ডকারখানাটা নজর করবেন|
ওঃ,
একটা জিনিষ কিন্তু এই ভাঙা দেউলেও দেখবার মতো, সেটি
মাটির ওপরে নয়, সেটি মাটির তলার ব্যবস্থা। এটা কোনো
চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে বলে জানিনা। মাটির বদলে ওই
থিয়েটারের মাঠ ঢাকা হোতো কাঠের তক্তা দিয়ে, তার ওপর
পড়তো সাত-আট ইঞ্চি বালির আস্তরণ। খেলাধুলো যা হোতো
সব এরই ওপরে। আর তক্তার নীচেই থাকতো পাঁচিল আর খোপর-খুপরীর
এক অবিশ্বাস্য গোলকধাঁধা। খেলার দিন সেইখানে মানুষ,
পশু, সব কুশীলবদের জড়ো করা হোতো এবং তারপর কপিকল ও
আরো যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তাদের ওঠানো, নামানো, লুকোনো,
দেখানো-- এই সব করা হোতো। বাঘ সিংহ সব মাটি ফুঁড়ে
অতর্কিতে লাফিয়ে বেরোতো, সৈন্যদল আসতো যেতো, রোমান
সুন্দরী সব দর্শিকারা মূর্চ্ছা যেতেন, এই সব আর কী।
। ব্রডওয়ের অত্যাশ্চর্য সব মিউজিক্যালের কথা ভাবুন।
আমি এসব ব্যাপারে বেশ আকাট সে তো আপনি জানেনই, সেই
নীচ তলায় ঢুকে এই সমস্ত ব্যাপারটাকে আমার বুদ্ধিগ্রাহ্য
করতে প্রায় অর্ধেক দিন লেগে গেলো। বললে যে এখানে এক
সময় নৌবহরের যুদ্ধও নাকি দেখানো হয়েছিল, তা সেটা আর
আমার বুদ্ধিতে কুলোলো না। সঙ্গের ছবিটা দেখুন, তাহলে
হয়তো আপনি কিছু হদিশ পাবেন।

রাতের
কলোসিয়াম, টুর পাওয়া যায়, আমি যাই নি|
এইখানে
ক্লিক করলেকলোসিয়ামের খুব কায়দার ছবি একটা দেখতে
পাবেন। কাঠের তক্তার নীচে ব্যাপারটা লক্ষ্য করবেন।