নিউ
ইয়র্ক শহরে আমার প্রথম ম্যারাথন দৌড়ে সাফল্য!
ম্যারাথন
দৌড়ে অংশ নেব কোনওদিনই ভাবি নি। একজনের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে
গিয়ে কথায় কথায় বলে ফেলেছি, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির হয়ে কলেজ জীবনে
ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল আমি প্রচুর খেলেছি। সেটা শুনে এক অপরিচিত
ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, ‘পৃথিবীর সত্যিকারের স্পোর্টস হল ম্যারাথন।
ম্যারাথন যে দৌড়য় – সেই একমাত্র বাপকা ব্যাটা!’
কথাটা যে আমাকে বিঁধিয়েই বলা – সন্দেহ নেই। বেশ একটু অপমানিতই
বোধ করলাম। কিন্তু এর কী জবাব দেব? একথা তো সত্যি, কলেজে দৌড়ের
প্রতিযোগিতায় অংশ নিই নি। ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে আমার ধারণা ছিল
১০ মাইল দৌড়ানোই একটা বিশাল ব্যাপার – ২৬ মাইলের তো কোনও প্রশ্নই
ওঠে না। পার্টি শেষ হল, কিন্তু খোঁচাটা মনের মধ্য গেঁথেই রইল।
চেনাজানার মধ্যে একমাত্র বন্ধু রঞ্জিত দাস ম্যারাথনে দৌড়েছে। তাকে
একদিন কথাটা বলতে রঞ্জিত বলল, দেখ, সব কিছুই করা সম্ভব – যদি তোর
ইচ্ছে থাকে, আর সেই সঙ্গে থাকে ইচ্ছে পালন করার জন্যে মানসিক দৃঢ়তা।
লাখ কথার এক কথা বলেছে রঞ্জিত।
ইচ্ছেটা তো আমার আছে, লড়াইটা হবে সেটা পূরণের জন্যে নিজেকে শারীরিক
আর মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা নিয়ে! রঞ্জিতের সঙ্গে পরামর্শ করে
নিউ ইয়র্ক ম্যারাথনে দৌড়নোর জন্যে একটা আবেদন পত্রও জমা দিয়ে দিলাম।
সালটা ২০০২, মাসটা জানুয়ারি।
নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যারাথন
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যারাথন প্রতিযোগিতা। এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা
সামনা সামনি বা টেলিভিশনে দেখার জন্যে প্রতি বছর অজস্র দর্শক প্রতীক্ষা
করে থাকে। নিউ ইয়র্কের পাঁচটা বরো জুড়ে – স্ট্যাটেন আইল্যাণ্ডের
ভেরাজোনা ন্যারোস ব্রিজ থেকে শুরু করে এটা শেষ হয় সেন্ট্রাল পার্কের
ট্যাভার্ণ অফ দ্য গ্রিন-এ। এই ২৬.২ মাইলের পথ শুধু দূর নয় – পথের
বন্ধুরতা প্রত্যেকটি প্রতিযোগীর স্বাস্থ্য, শারীরিক প্রস্তুতি
এবং সহ্যশক্তির একটা অগ্নিপরীক্ষা। দেরি করে হলেও নিজেকে ‘বাপকা
ব্যাটা’ প্রমাণ করতে ম্যারাথনের অ্যাপ্লিকেশনটা তো পাঠালাম, কিন্তু
আমার বয়স ৬২ বছর – শেষ রক্ষা করতে পারব কি?
নিউ ইয়র্ক ম্যারাথন-এ আন্তর্জাতিক
মানের দৌড়বীর হিসেবে যাদের ranking আছে – তারাই সরাসরি দৌড়াবার
সুযোগ পায়। কিছু লোককে লটারি করে অবশ্য নেওয়া হয়, তাদের মধ্যে
যদি নাম ওঠে! পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে দশ লক্ষের মত লোক আবেদন
করে। তিরিশ জন আবেদন করলে তাদের মধ্যে এক জন সুযোগ পায়। মনে মনে
ভাবছি, লটারিতে নামটা না উঠলেই বাঁচি! কিন্তু সেই ভরসায়(!) থাকলে
তো চলবে না, নাম উঠলে দৌড়াতে হবে! অতএব, ট্রেনিং নেওয়া শুরু হল।
গুরু আমারই বন্ধু রঞ্জিত। প্রথম দিন একশো গজ দৌড়তেই প্রায় প্রাণ
যায়! কিন্তু তা বললে তো চলবে না, লড়তে হবে। ছয় মাসের মধ্যেই দেখলাম
এক নাগাড়ে পাঁচ মাইল দিব্বি দৌড়তে পারছি! ২০০২-এর জুলাই মাসে খবর
এলো আমার নাম লটারিতে উঠেছে। এখন আর পালাবার উপায় নেই – এসপার
কি ওসপার! শুরু হল সত্যিকারের ট্রেনিং। দিনটা আমার মনে, অক্টোবর
১৩, ম্যারাথন দৌড়ের ঠিক তিন সপ্তাহ আগে পুরো ছাব্বিশ মাইল দৌড়ে
ফেললাম (এই প্র্যাক্টিস নাকি করা বারণ!)। দৌড়ে্র পরেই অসুস্থ!
ভাগ্যক্রমে ম্যারাথনের কয়েকদিন আগে সুস্থ হয়ে উঠলাম।
নভেম্বর ৩ হল D-Day। ভোর
৯-টার সময় রঞ্জিত আমাকে স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের একটা হোটেল থেকে
তুলে নিল। ভেরাজোনা ব্রিজের কাছে পৌঁছে সেখান থেকে এক মাইলের মত
হেঁটে সিকিউরিটি চেক-এর পরে ফোর্ট ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এ হাজির হলাম।
সেটাই হল দৌড় প্রস্তুতির জায়গা। নানা দেশের নানা রঙের লোক সেখানে
জড় হয়েছে – সংখ্যায় ৩২ হাজার! একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য! বেশ ঠান্ডা
৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট, ঘন্টার দশ মাইল বাতাস – নিউ ইয়র্ক ম্যারাথনের
ইতিহাসে এটা দ্বিতীয় শীতলতম দিন! মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে আমি ফিলাডেলফয়াতে
অর্ধেক ম্যারাথন (১৩.২ মাইল) দৌড়েছি। সেখানে সকাল আটটার সময়েই
গরম ছিল ৮০ ডিগ্রি, আর্দ্রতা প্রায় ১০০ পারসেন্ট। দুটোর মধ্যে
অবিশ্বাস্য তফাৎ! ২ ঘন্টা ১৯ মিনিটে সেই দৌড় যখন শেষ করেছি, তখন
মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘামে শরীর জবজব করছে! যাক সে কথা। ভেরাজোনা
ব্রিজের নীচে সাড়ে দশটায় টয়লেটের সামনে বিরাট লাইন, সেখানে বাথরুম
সেরে সবাই দৌড় শুরুর লাইনে দাঁড়ালাম। রঞ্জিত আমাকে শেষ উপদশটা
দিল, ‘ঘন্টিদা, তুমি শুধু নিজের দৌড়টা দৌড়ও, তাহলেই দেখবে সব ঠিক
থাকবে।’
ঠিক ১১টা ১০ মিনিটে জাতীয় সংগীতের পর আরম্ভ হল দৌড়। বেশ কয়েক হাজার
প্রতিযোগী আমার আগেই দৌড়তে শুরু করেছে। আমার জুতোর ফিতেতে লাগানো
কম্পিউটার টাইমিং চিপ গন্ডগোল করছে। সেটাকে ঠিক করতে করতে দশ মিনিট
লেগে গেল!
ম্যারাথনের পথ পাঁচটা বরো
– স্ট্যাটেন আইল্যান্ড, ব্রুকলিন, কুইন্স, ব্রঙ্কস এবং ম্যানহাটান-এর
মধ্যে দিয়ে। উঁচু নিচে পথের মধ্যে পাঁচটা লম্বা ব্রিজ। আমি ঠিক
করলাম পুরো দূরত্বটা মাথায় না রেখে, একটা একটা বরো করে ভাববো,
না তাও নয় – এক একটা মাইল করে ভাববো। তার থেকেও ভালো এক একটা ব্লক
করে ভাবা আর সেটাকে জয় করা।
সারা রাস্তা জুড়ে অগুনতি দর্শক আমাদের সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের
কাউকেই চিনি না, দেখাও হয়তো কোনও দিন আর হবে না। কিন্তু তাদের
ভালোবাসা আর উৎসাহ মনের মধ্যে যে উত্তেজনা আনলো – সেটা ভাষায় ব্যক্ত
করা অসম্ভব!
একটু দৌড়তেই বুঝতে শুরু করলাম,
এই ম্যারাথন শেষ করা কতটা কঠিন হবে! পাঁচটা বড় বড় ব্রিজে ওঠার
খাড়াই প্রায় এক আধ মাইল ধরে – উৎরাইটাও প্রায় সেই একই দূরত্ব।
এছাড়া রাস্তায় ছোটখাটো ওঠা নামা তো আছেই। শেষ তিন মাইলের সাতটা
খাড়াই হল সবচেয়ে মারাত্বক! মুশকিল হল, আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম
সমতল জায়গায় দৌড়িয়ে। এই রকম পথে দৌড়ানোর কোনও অভ্যাসই গড়ে ওঠে
নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পায়ে ব্যথা শুরু হল। ২১ মাইল যখন চার ঘন্টায়
পৌছলাম, তখন মনে হল আর পারবো না। আমার পা আর চলছে না, শরীরে এতটুকু
শক্তি অবশিষ্ট নেই। আমার কাছে দুটো পথ খোলা – হাল ছেড়ে পরাজয়ের
গ্লানি বহন করে গুটি গুটি বাড়ি ফিরে যাওয়া, অথবা কোনও মতে নিজের
শরীরটাকে টেনে ফিনিশ লাইনে পৌছনো! এখনও ৫.২ মাইল বাকি!
না হার আমি মানবো না - no
pain no gain । প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে চললাম। সেন্ট্রাল পার্কে
যখন পৌঁছলাম – অগুনতি লোক দেখি রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে। আমার পা
এখন সত্যিই চলছে না। যাদের পেছনে ফেলে এসেছিলাম, তারা একে একে
আমাকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে! যাক তারা, রঞ্জিতের উপদেশবাণী মনে
পড়ল - আমি আমার নিজের দৌড় দৌড়চ্ছি। ৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট ১৮ সেকেন্ড।
আমি ফিনিশ লাইন অতিক্রম করলাম। একজন আমার গায়ে গরম কম্বল জাড়িয়ে
দিল। আমার চোখ দিয়ে তখন আনন্দাশ্রু বইছে!
পরিশেষে এই দৌড় আমি উৎসর্গ
করেছি অনেকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এঁরা হলেন আমার ও আমার স্ত্রী
সুপ্তির বাবা-মা, বৌমা লীনার বাবা রামাকান্ত গায়েকোয়াদ, আমার প্রয়াত
বন্ধু প্রভাত দাস, বলাই চৌধুরী, আজিত অধিকারী, কেষ্ট মন্ডল এবং
মৃণাল বিশ্বাস। আমার ম্যারাথনের মেডেলটা আমি আমার স্ত্রী সুপ্তিকে
দিয়েছি। আমার এই বুড়ো বয়সের ভীমরতিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং এর ফলে
কী ঘটতে পারে সেই নিয়ে নিরন্তর দুর্ভাবনা দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও
দিনের পর দিন ম্যারাথন দৌড়বিদদের খাবার পাস্তা বানিয়ে যাওয়া –
এটাও ম্যারাথনের থেকে কিছু মাত্র কম কঠিন কাজ নয়! বলা বাহুল্য,
রঞ্জিত দাসের উৎসাহ আর কোচিং না থাকলে এ কাজ অবশ্যই সম্ভব হত না।
পরিশিষ্টঃ নিউ ইয়র্ক ম্যারাথনের
ব্যাপারে একটাই আক্ষেপ। ৭৫ বছরের এক তরুণী আর ৮০ বছরের এক যুবক
আমার আগে দৌড় শেষ করেছে!
ঘনশ্যাম
অধিকারী
(সুজন
দাশগুপ্তের সৌজন্যে)
[ঘনশ্যাম
অধিকারী (চেনাজানা সবার কাছে ঘন্টিদা) যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে
’৬৩ সালে টেলিকম পাশ করে ’৬৫ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ
স্নাতক হন। ইতিমধ্যেই ৬-টা মহাদেশে ম্যারাথনে দৌড়েছেন। বাকি রয়েছে
দক্ষিণ মেরুর ম্যারাথনে দৌড়নো। সেটা দৌড়বেন ৭৩ বছর বয়েসে! ওঁর
প্রথম ম্যারাথন দৌড়ের কাহিনী এখানে ছাপা হল। পরের বার বেরোবে এশিয়ার
ম্যারাথন – চাইনীজ ওয়াল-এর ওপর দিয়ে যে দৌড়টা হয় – প্রথম বাঙালী
হিসেবে সেটা জয় করার কাহিনী। ‘দুঃসাধ্য মনে করলেই দুঃসাধ্য’ –
এই নতুন বিভাগে ব্যক্তিগত কিছু কিছু কাহিনী ছাপা হবে।]
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।