বিবিধ প্রসঙ্গ

অক্টোবর ৩০, ২০১৬
আপ রুচি খানা
রিমি পতি
“ও মা তিব্বতে শুনেছি কুকুর খায় অথবা চীন দেশে যে কোন জীবন্ত প্রাণী খাদ্যবস্তুর তালিকায় স্থান পায়।” নাক মুখ কুঁচকে এধরনের মন্তব্য অনায়াসে করে থাকেন অনেক বঙ্গ সন্তান। আজকের বিশ্বায়নের যুগে এই রকম অচলায়তনে আবদ্ধ থাকা ক্ষতিকারক। আমাদের নিজসব কিছু খাদ্য অভ্যাস অন্য দেশের মানুষের কাছে কতখানি আজব, তা ভাল করে তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে, এই মন্তব্য গুলির কোন শক্ত ভিত নেই। আমাদের বর্ষার ইলিশ প্রেম, শীতে নলেন গুড় বা প্রখর গ্রীষ্মে ল্যাংড়া আমে আসক্তি অতি সুপরিচিত। এই বিশেষ খাদ্যবস্তু গুলিতে আসক্তি না থাকাটা অনেক বাঙালির কাছে আশ্চর্য বোধ হয়। আমাদের মত প্রবাসীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কিন্তু এইসব খাদ্যে বিশেষ আকর্ষণ বোধ করে না। মানুষের অনেক অভ্যাসই তাদের পারিপার্শ্বিকের উপর নির্ভরশীল ।
ফুগু
|
কুকুরের মাংস, সাপ অথবা যে কোন পাখি মায় পেচক পর্যন্ত চীনেদের খাদ্য তালিকায় আছে। জাপানী খাদ্যরসিক, একটি বিশেষ পদের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতে প্রস্তুত। কি সে সাত রাজার ধন মানিক? সেই বস্তু হোল ফুগু বা পাফার ফিস। এই মাছের বিষাক্ত অংশ অতি সাবধানে বাদ দিয়ে তবেই পরিবেশন করা হয় জাপানি রেস্তোরাঁয়। এই মাছের লিভার নাকি সব চেয়ে সুস্বাদু, আবার শোনা যায়, এই অংশটি খেতে গিয়ে কেউ কেউ মৃত্যু বরণ করেছেন। এখন ফুগু লিভার নিষিদ্ধ। মারাত্মক বিষ তবু ও এর অমোঘ আকর্ষণ কেউ কেউ এড়াতে পারেন না। একেই বোধ হয় বলা যায়, “জেনে শুনে বিষ করেছি পান”। এখানে মাছের মুড়ো বা কাঁটা দিয়ে বাঙ্গালির বিভিন্ন পদের কথা, না উল্লেখ করে পারছি না। ভারতের অন্য প্রদেশের মানুষের কাছে মাছের ওই পদগুলি ভক্ষণযোগ্য নয়।
এবার আসি দুর্গা পুজোর কথায়। বাঙালির কাছে পুজো মানেই খাওয়া। ফল, মিষ্টি প্রসাদ খেলেও মন পড়ে থাকবে আমিষের দিকে। নবমীর পাতে পাঁঠার মাংস না থাকলে বঙ্গসন্তানের চোখে জল আসে। জনপ্রিয় মাসিক পত্রপত্রিকার শারদ সংখ্যাগুলিতে পুজোর প্রতিদিন কী খাবেন, কী পরবেন তার নয়নলোভন ছবি থাকে। মাছ, চিকেন, বিরিয়ানি কাবাব জাতীয় আমিষ পদ ছাড়া বাঙালির মুখে কিছু রোচে না। ওই এক ই সময়ে ভারতের অন্য প্রদেশের মানুষ নয় দিন উপবাস করেন (নবরাত্রি), সামান্য ফল, মিষ্টি, দুধ খেয়ে। তাদের চোখে আমাদের এই প্রবল আমিষ প্রেম এক আজব বিকৃতি বলেই মনে হয়। তখন আমরা বিরক্ত হয়ে বলি “আমাদের উৎসব, আমাদের খাওয়া আমরা বুঝবো, আগ বাড়িয়ে ছিঃ ছিঃ করতে এসো না”। এটা পুরোপুরি অহমিকা সংস্কৃতি।
এবার আরেকটি মিষ্টি চেহারার প্রাণীর কথায় আসি। গিনিপিগ অনেক শিশুর কাছে পেট শপ থেকে কিনে আনা খরগোশ জাতীয় পোষ্য। তাকে লেটুস পাতা, গাজর দিয়ে তুষ্ট করা যায় বা সঙ্গে নিয়ে খেলা করা চলে। কিন্তু রোস্ট করে খাওয়া একেবারেই চিন্তায় আসে না। এই গিনিপিগ কিন্তু আদপেই পিগ বা বরাহ নয়, গিনি অঞ্চলে এদের উৎপত্তিও নয়। এই ইঁদুর জাতীয় ছোট্ট প্রানীকে, পেরুতে একটি আমিষ পদ বলেই ধরা হয়। সেদেশে গিনিপিগের বিভিন্ন পদ, যেমন, ডিপ ফ্রাই, গ্রিল , ব্রয়েল, রোষ্ট, অথবা সুপ বা কাসারোল অত্যন্ত জনপ্রিয়। গিনি পিগ বা কুই পেরুর জাতীয় ও ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পেরুর কুস্কো শহরের একটি বিখ্যাত গির্জার দেওয়ালে আঁকা “লাস্ট সাপার” ছবিতে যীশু ও তার সহচররা গিনিপিগ সহযোগে তাদের শেষ নৈশ ভোজ সমাপন করছেন। এই ছবি দেখে অন্যরা খুবই চমকে উঠবেন সন্দেহ নেই । আবার বলি, ভাল মন্দ আপেক্ষিক ব্যাপার। আপনি আমি বিচার করার কে?
মধ্য প্রাচ্যে ভেড়ার মাথা আস্ত রান্না করে ভাত-সহ, বেশীর ভাগ ভোজ বাড়িতেই পরিবেশন করা হয়। বাঙালির সানন্দে মাটন খেলেও মাথাটা বাদ দেওয়া পছন্দ করেন। মাছের মুড়ি ঘন্টের ক্ষেত্রে আবার আমরা অন্য মূর্তি ধরি আমরা। ষাঁড়ের অন্ড কোষ, জীহবা, এমন কি লেজ পর্যন্ত সুপ বা ব্রয়েল করে খেয়ে থাকেন অনেক মানুষ। আমরা গরু, ষাঁড় ইত্যাদিকে নিষিদ্ধ খাদ্যবস্তুর তালিকায় রাখি। ঠিক তেমন ইহুদী ও ইসলাম ধর্ম অবলম্বীরা বরাহ মাংস খান না। আগের দিনে অধিকাংশ গোঁড়া হিন্দু পরিবারের হেঁসেলে মুর্গি ব্রাত্য ছিল। পাঁঠার মাংস রান্না হত বাইরের তোলা উনুনে, নিরামিষ হেঁসেল থেকে দূরে। সময়ের সাথে সাথে আমরা বদলেছি, বদলেছে আমাদের চিরচারিত অভ্যাসগুলি।
স্বাভাবিকের সংজ্ঞা বদল হতে থাকে একটি দেশ বা জাতির সাংস্কৃতিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান হিসেবে। লাল পিঁপড়ের কামড় আমরা প্রত্যেকেই খেয়েছি, তবে পিঁপড়েকেও কামড় দেওয়া যেতে পারে, সে কথা বোধহয় ভাবিনি। অথচ ভারতের ধুরুভা নামক আদিবাসীরা অনায়াসে পিঁপড়ে ও পিঁপড়ের ডিমের চাটনি রান্না করেন। ঝাড়খন্ডের চাইবাসা অঞ্চলে এই পিঁপড়ে, পাতায় ঢেলে বাজারে বিক্রি করা হয়। স্থানীয় মানুষ মনে করেন ফরমিক এসিড থাকায় এই খাদ্য শরীরের পক্ষে উপকারী।
পূর্ববঙ্গীয়রা মনে করে থাকেন, ঝাল খাওয়ায় তাঁদের কেউ টেক্কা দিতে পারবে না। তাঁরা হয়ত নাগা জল্কিয়া বা ভুত জল্কিয়া মরিচের সঙ্গে পরিচিত নন। নাগাল্যান্ডে শুকনো মাছ, টমেটো ও এই ভুতড়ে মরিচ দিয়ে নাগে থুম নামক পদ একবার মুখে দিলে আনাড়ি ভোজন রসিক ঝাল কাকে বলে টের পাবেন।
এবার আসি সুসভ্য ফরাসি দেশের ব্যাঙ বা ভেক প্রীতির কথায়। সেখানে ফ্রগ লেগ একটি অতি পরিচিত সুখাদ্য। তাদের রান্নাও অসাধারণ তবে আমরা মন থেকে এই ব্যাঙ-এর ঠ্যাং-কে মুরগীর জায়গায় বসাতে পারি নি। অথচ এই ফ্রগ লেগ প্রোটিন, ওমেগা থ্রি , ভিটামিন এ- তে ভরপুর। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চীন সব জায়গায় এটি সুখাদ্য হিসেবে সুপরিচিত।
উইক এন্ড ডিনার
|
এবার দু’একটি বহুমুল্য খাদ্যের কথায় আসি। ‘ট্রাফল’ নামক এই দুর্লভ ছত্রাক বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শূকরের ঘ্রাণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুঁজে আনা হয়। প্রায় ঝিনুকের মধ্যে মুক্তার মত এর বাণিজ্যিক মূল্য। ফরাসী রেস্তোরাঁয় এই ট্রাফলের অতি ক্ষুদ্র অংশ পাস্তা বা অন্যান্য ডিশে খেয়ে অভিভূত হয়েছি। তবে আমার পোস্ত বা ইলিশ পাতুরী খাওয়া জিহবাকে এই পর্যন্ত পৌঁছতে, প্রবাসে কয়েক দশক কাটাতে হয়েছে। এরকম আরেকটি পদ হোল ফোয়াগ্রা বা গুস লিভার প্যেটে। লন্ডনে থাকাকালীন ওখানে প্রখ্যাত দোকান হ্যারডস এর ডেলিকেটেসেন এ এই বস্তুটি দেখতাম তবে সাহস করে খেয়ে দেখতে আরও কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। নিজের লিভারটিকে সুস্বাদু বানানোর জন্য বেচারি হংসকে প্রচুর পরিমাণে খেয়ে হৃষ্ট পুষ্ট হতে হয়। শেষে তার নড়বার ক্ষমতা হ্রাস পায়। সেই অর্থে দেখতে গেলে পশুপ্রেমীদের কাছে এই সুখাদ্য, ফার কোট এর মতই ব্রাত্য। চুপিচুপি স্বীকার করি, অত্যাধিক কৌতূহল বশত আমি কয়েক বার এটা খেয়ে দেখেছি। আবারও বলি, এর স্বাদ গন্ধে আপ্লুত হওয়ার মত অবস্থায় সবাই পৌঁছতে পারবেন না।
বর্ষায় ভাজা ইলিশ মাছের ডিমের মর্ম অবাঙালিকে বোঝানো অসম্ভব।এবার আরেক মাছের ডিমের কথায় আসি। বিদেশী ছবিতে রুশ দেশি ক্যভিয়ার, শ্যাম্পন সহ রোমান্টিক দৃশ্য অভিনীত হতে দেখেছি অনেক বার। খেয়ে দেখলাম, মুলত স্টারজেন মাছের ডিম, আদপেই আমাদের ইলিশ মাছের ডিমের মত নয়। কিছুটা আঁশটে, টক এর স্বাদ। কোনমতে টোস্ট এর ওপর বা ক্র্যাকার দিয়ে খাওয়া যায়। শ্যাম্পেন এর ক্ষেত্রেও একই কথা। ভাল লাগবেই, এ কথা বলা যায় না।
তাজা শঙ্খ- Turks and Caicos দ্বীপপুঞ্জে
|
আবার ধরুন, ছেলেবেলায় অনেকেই পুরী সমুদ্রতটে শাঁখ, ঝিনুক বা স্টারফিশ কুড়িয়েছেন কিন্তু শাঁখ আমাদের পাতে খাবার হিসেবে স্থান পায়নি। শাঁখ বাজবে, তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলবে এটাই আমাদের মানস পটের চিরচারিত ছবি। এবছর টার্কস আন্ড ক্যাকোস নামক ক্যারিবিয়ান দ্বীপ এ গিয়ে দেখলাম শাঁখ তাদের প্রধান ডিশ। যাকে বলে ঝোলে, ঝালে, সিদ্ধ, ভাজা, বেক, গ্রিল মায় স্যালাদে সবেতেই শাঁখ। স্থানীয় মানুষদের সাপ্তাহিক মেলায়, অনেক খাবারের সঙ্গে শাঁখের তেলেভাজা খেলাম। শক্ত মাংস, মুখে দিলে গিলতে কষ্ট হয়। ওদিকের মানুষ তা ভাবেন না। নির্বিকার চিত্তে রাম পানীয় সহ শঙ্খের নানা পদ তারা খেয়ে চলেছেন গোলাপী বালুকারাশির উপর পাতা চেয়ারে বসে।
ডেজার্ট- ক্রিম ব্রু লী, কলোরাডোর ভেল-এ।
|
অতএব মানতেই হয়, সুখাদ্যর সংজ্ঞা বিভিন্ন জাতির কাছে বিভিন্ন রকম। আমার কাছে রুপালি বর্ণের ইলিশ, সব মাছের সেরা আবার এদেশে দেখি সব জায়গায় স্যামন মাছের কদর। কেউ কেউ আবার মাছের নামে ওয়াক তুলবেন, কিন্তু চিকেনে তাদের অরুচি নেই। বাঙালি নলেন গুড়ের সন্দেশ পেলে আর কিছু চায় না অন্য দিকে লেমন মেরিং পাই বা চিজ কেক ছাড়া কারো কারো মিষ্টি মুখ সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের স্বস্তিসীমার বাইরে অন্য অনেক খাদ্যাভাস, অনেক জীবন যাপন বা রীতি নীতি আছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে অযথা ভ্রূ-কুঞ্চন বা নাক সিঁটকে নেতিবাচক মন্তব্য করা অর্থহীন। বরং আসুন, একটু সময় নিয়ে অন্যের খাওয়া দাওয়া, রীতি নীতি, ভাল লাগা মন্দ লাগা বিষয় উদারমনস্ক হই।
আমাদের উপলব্ধির ব্যাপ্তি যত বাড়বে, ততই আমরা যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবো। অপরিসর গণ্ডির সীমা রেখা মুছে ফেলে, এগিয়ে যেতে পারলে আমাদের নিজেদের লাভ বই ক্ষতি নেই। অযথা নিজেকে বিচারকের আসনে বসাবেন না, কারণ এই ভাল-মন্দের মাপকাঠি একেবারেই আপেক্ষিক। নিজের রুচি অনুযায়ী চলুন, খান বা খাওয়ান- তবে সংস্কার মুক্ত হন, দেখবেন আপনিই উপকৃত হবেন, অপরে নয়।
লেখক পরিচিতি:
২০ বছরেরও বেশি বসবাস ও কাজ সাউথ ক্যারোলিনায়। কর্মসূত্রে স্পার্টনবার্গ স্কুল ডিস্ট্রিক্ট-এর সঙ্গে যুক্ত। লেখালেখি ও বেড়ানোতে খুব আগ্রহ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।