প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪

 

আকাশগঙ্গা

শ্যামল সেন


হেমন্ত দেশাই সেতারে বেহাগ বিলম্বিতে ধরেছে। মা সারা ফ্ল্যাটবাড়ি ঘুরে কাজ করতে করতে শুনছেন, কখনো দূর থেকে শুধরে দিচ্ছেন, কখনো কাছে এসে নতুন স্বরগুচ্ছ সংযোজন করছেন। কখনো বারান্দায় গিয়ে পায়রাদের খেতে দিচ্ছেন। আকাশগঙ্গার সাততলা থেকে আরব সাগর দেখতে পাচ্ছি, গতিমান বম্বে শহর পায়ের নীচে, কানে হেমন্তের সেতার, মা'র গান গেয়ে শেখানো।

আবার আমি শিখছি। ইমন। ইমনে আছে শাঁখের আওয়াজ। মা'র গলায় ইমন, যা দিচ্ছেন তা আমার কাছে কঠিন, মীড়ের কৃন্তনের দুঃসাধ্য সমাবেশ। আরব সাগরের জল চিকচিক করছে, নীচে ধাবমান বম্বে শহর। একটা একটা করে সিঁড়ি পার হয়ে যাওয়া, প্রত্যেকটা স্বরের সাথে একটা অভাবনীয় অভিজ্ঞতা, সুরের সঙ্গে মনের সঙ্গতি, সুরের অনুগামী হয়েই শেখা। গুরু এইরকমেরই, অনাহত সঙ্গে পরিচয় গুরুর হাত ধরেই, উত্তরণ গুরুর অনুগামী হয়েই।

১৯৭৮ সালের নভেম্বরে তিমিরবরণের লেখা পরিচয়পত্র হাতে আকাশগঙ্গায় গিয়েছিলাম। রবিবার সকাল। বেল বাজালাম কিছুক্ষণ, দরজা খুলল না। বিকেলে আবার। পরিচারিকা দরজা খুলল, আমার দেওয়া চিঠি হাতে নিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। আমি বাইরে অপেক্ষায়। শেষে দরজা খুলল, আমি ভেতরে গিয়ে বসলাম। মা এলেন। সাধারণভাবে শাড়ি পরা, দেখে বোঝার উপায় নেই যে ইনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কন্যা, ওস্তাদ আলী আকবর খান সাহেবের বোন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের স্ত্রী। বললেন, তিমিরদা যে আমাকে কি বিপদে ফেললেন। আমাকে শেখাতে চাইলেন না, কিন্তু চলে যেতেও বললেন না। হেমন্ত বাজাচ্ছে, আমি বসে রইলাম, শুনতে থাকলাম। ভাবলাম, নিখিলবাবুর বাজনা যেখান থেকে এসেছে তার উৎসে এসেছি। আমাকে তো বের করে দেননি। আমার পরিবারে রবীন্দ্রসংগীতের চলন, ক্লাসিকাল আমার মা শিখেছিলেন বটে, কিন্তু আমার তো কোনো জোর নেই এমনভাবে মাইহার ঘরানার অন্দরমহলে প্রবেশ করার, শুধু তিমিরবরণের দেওয়া একটা চিঠিই যা ভরসা। বসে রইলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ইমনের হাত ধরে ছায়ার মত নেমে এলো।

যিনি তিমিরবরণকে বড় দাদা বলেন, তিনি চিঠিটা ফেলতে পারলেন না। তার আগে আমি চার বছর সরোদ শিখেছিলাম, কিন্তু ঘরানার হিসেবে আমার ছিল মিশ্র জাতি। আমার প্রথম গুরু, আমার অত্যন্ত ভালবাসার মানুষ, তিমিরবরণ আর ওস্তাদ আলী আকবর খানের বন্ধু, শ্রী সন্তোষ চন্দ্র প্রথমে শিখেছিলেন সরোদিয়া ওস্তাদ আমীর খানের কাছে। যার অপর ছাত্র পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র। আমার সরোদ ধরা থেকে কোনো কিছুই মার পছন্দ হল না, প্রথম থেকে শুরু করতে হলো। আবার অলঙ্কার দিয়ে শুরু। মার কাছে আবার সঙ্গীতজীবনের সূচনা। যার হাত ধরে একদিন এসে পড়ল ইমন।

কিছুদিনের মধ্যে আমার হাতে এসে পড়ল মা'র এক জুনিয়র ছাত্র, যাকে আমার মাধ্যমে মা শেখাতে শুরু করলেন। নিজে কখনো যিনি আমার কাছে কোনো গুরুদক্ষিণা নেন নি, তিনি জোর করে, আমার বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও আমাকে সেই ছাত্রের কাছ থেকে অর্থ নিতে বাধ্য করলেন।

ততদিনে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন। আপনি চলেছিল বছরখানেক, তবে আমার পীড়াপীড়িতে বলেছিলেন - যদি কখনো ভুল করে তুমি বলে ফেলেন, তবে আমাকে সেটা ধরিয়ে দিতে। যাকে মা বলি, তিনি যে কখনো ভুল করে ফেলবেন এটা আর আশ্চর্য কি? আমি একদিন ধরে ফেললাম, সেই থেকে তুমি। আমাকে দিয়ে চিঠি লেখাতেন। নিচে কুণ্ঠিত হস্তাক্ষরে লিখতেন, অন্নপূর্ণা। কিছু চিঠি হত আলী আকবর খানসাহেবকে লেখা। লিখতে আমার হৃদস্পন্দন হত। কখনো আমার সাহায্য নিতেন ভাষা ঠিক করে দেবার জন্য। আবার কখনো অনমনীয় - লিখতে যখন বলছেন - দাদা বিলিতি বাঁদরগুলোকে শেখাচ্ছেন, আমি তখন ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যদি একটু ভাষাটা পাল্টে দেন, কিন্তু উনি আপসহীন থাকতেন, আমি লিখে যেতাম মাথা নিচু করে।

প্রথম শেখার দিনে বললেন, যাও ওঘরে গিয়ে বাবার ছবিকে প্রণাম করে এসো, বাবাকে বলো যেন তুমি ছেড়ে না দাও। সুন্দর হাতে আঁকা ছবি, ফ্রেমে বাধানো। আকাশগঙ্গায় ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানহাতে ঘর, পরবর্তীকালে রাণু মুখার্জি ওনার কাছে গিয়ে ছিল ওই ঘরে, বাজনা নিয়ে ঢোকার সময়ে শুনতাম রাণু রেওয়াজ করছে, সেই ইমন। একদিন রাণু একটা দুর্গার ছবি নিয়ে এলো। জোর করে, মাকে রাজি করিয়ে, আমার সাহায্য নিয়ে ঘরে টাঙ্গাল। মাকে বোঝাল, এখানে একজন মা আছেন। আমরা তিনজনেই হাসলাম। জানতাম, এখানে একজন মা থাকেন যিনি কঠিন গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানসাহেবের কঠিন কন্যা। যিনি আমাকে সত্যি সত্যিই নিতে চান নি, যিনি কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করেন না, সেটা গুরুদক্ষিণাই হোক, বা মা দুর্গার ছবিই হোক।

বলতেন, দেখো পন্ডিতজীর কৃন্তন আর সুর। এদিকে তখন পন্ডিত রবিশংকরের সাথে বিচ্ছেদের পালা চলছে, অভিমান নিয়ে একলা জীবন কাটাচ্ছেন। তখনও শুভশঙ্কর বেঁচে কিন্তু কাছে নেই। এই সময়ে যিনি স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন, তিনি আমাদের দিয়ে পন্ডিতজীর প্রোগ্রাম করালেন তেজপাল হলে। আমরা ওখানেই আলাউদ্দীন সঙ্গীতসমাজের হয়ে আরও দিকপালদের প্রোগ্রাম করেছি, বিসমিল্লা খানসাহেব, নিখিলবাবু - সেই অভিজ্ঞতাগুলো মা'র হাত দিয়েই এলো।

আমি থাকতাম সান্তাক্রুজে। সেখান থেকে ওয়াডের্ন রোডের আকাশগঙ্গার দূরত্ব অনেক। সরোদ নিয়ে গ্রান্ট রোড এ নেমে কেম্প্স কর্নারের তলা দিয়ে যেতে গেলে দূরত্বটা যেন আরো বেড়ে যায়। তাই একটা ব্যবস্থা হল। আমার একটা সরোদ আমি ওনার কাছে রেখে আসা শুরু করলাম। যখন যেতাম, তখন দেখতাম ওনার বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আমার সরোদের স্থান। এ যেন সত্যিকারের সংগীতের অন্দরমহলে প্রবেশ করা। নিখিলবাবু, আশিসদা, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার গুরু আমারও গুরু। সংগীত আমাকে আরো আচ্ছন্ন করলো। বম্বের ধাবমান জীবনের মধ্যে সাততলা থেকে দেখা সমুদ্রের স্নিগ্ধতা, মা'র গান আর সরোদের সুরে জীবন একটা অভূতপূর্ব সঙ্গতি নিয়ে এলো।

আমি অনেক রাগ বাজাই, কিন্তু ইমন আজও আমার প্রিয় রাগ। সেটা আমার বম্বে জীবনের শিক্ষার জন্য না রাগটার অন্তর্নিহিত শান্ত সৌন্দর্যের জন্য সেটা বলা কঠিন। আমার আজ মনে হয়, সেটা মা'র হাত ধরে আমার রাগটার বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে পারার জন্য। সুন্দর জিনিষকে সুন্দর হয়ত অনেকেরই লাগে, কিন্তু তাকে ভালবাসতে হলে একটা ইন্দ্রজাল দরকার, একটা জাদুকাঠির প্রয়োজন।

১৯৮২ তে বম্বের বাসস্থান সমস্যার মুখে দাঁড়ালাম। পশ্চিমে পাড়ি দিতে হল। মাকে অত্যন্ত আশাহত করলাম। কিন্তু আমাকে দূরে ঠেলে দিলেন না। প্রতি চিঠির উত্তর দিয়েছেন, আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন। অন্য কোনো ছাত্রের, পরবর্তীকালে শ্রীরুশিকুমার পান্ডিয়ার হাতে লেখা চিঠি পেয়ে আমার মনে হত, বম্বেতে থাকলে এ চিঠিটা তো মার হয়ে আমিই লিখতাম। নিচে নিজের হাতে "মা" লেখাটা বাদে।

যখন মাঝে মাঝে ওনার সঙ্গে দেখা করতে বম্বে যেতে পেরেছি, তখন কখনো আশিসদা, কখনো রুশিজি দরজা খুলেছেন। উনি জানতে চাইতেন, আমি এখনো বাজাই তো? আমি যখন জানাতাম, শুধু আমিই নই, আমার মেয়েও বাজায়, তখন খুশী হতেন। একবার বললাম, আলমের বাজনা শুনেছেন? আলি আকবর খানসাহেবের ছেলে, ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী আলম তো আমেরিকান মায়ের সন্তান। আলমের কথা শুনে মা'র মুখে একটা কোমলতা নেমে এলো। আমি মনে করিয়ে দিলাম, আগে হলে আলমকে হয়ত বিলিতি বাঁদর বলতেন। হাসলেন - আলম তো আর তা নয়, নিজের বিশ্ববরেণ্য দাদার ছেলে, আর আমাদের ঘরানার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।

জানুয়ারি ২০১৪। আবার দেখা হল। মধ্যে দেখা হয়নি অনেক দিন, গত বছর রুশিজি জানিয়েছিলেন যে হাসপাতাল থেকে ফিরে উনি এখন কারো সঙ্গে দেখা করার জন্য তৈরি নন। আগে এন সি পি এ যাবার সময়টা বাদে যিনি আর বিশেষ কারো সঙ্গে দেখা করতেন না, তিনি সেবার আমার সঙ্গেও দেখা করেন নি। কিন্তু এবার বাঁশরীবাদক ছাত্র নিত্যানন্দ হলদিপুরের মাধ্যমে জানালেন, দেখা হবে। আবার দেখা হল। শরীর দুর্বল, কিন্তু মন, স্মরণশক্তি, আগ্রহের কোনো ঘাটতি নেই। এক ঘণ্টা কথা হল। আমি বাজাই তো? মেয়ে? কিছু রাগ নিয়ে কথা হল -তিলাককামোদে গা থেকে সা তে নেমে আসার সময়ে পৃথিবী যেন থেমে যায়। আর ওস্তাদজী সঙ্গে একাসনে বসে বাইশ বছরের ছেলে আলমের বাজানো দরবারী শোনা দশবছর আগে। বললাম, এই যে দেখা হচ্ছে, অনুপ্রেরণা পাচ্ছি, প্রশ্রয় পাচ্ছি, এটা হারাতে আমি রাজি নই।

মাইহারে ১৯২৭ সালে জন্ম। দাদা চলে গেছেন কিছুদিন, ছেলে পঁচিশ বছর আগে। কিছুদিন আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে পণ্ডিত রবিশংকর আর রুশিকুমার পান্ডিয়া। জীবনের অন্তিম লগ্নকে যেন চোখে দেখতে পাচ্ছেন। আমি আটকে রাখার কে? তবুও বললাম। কারণ আমি তো তৈরি নই।

সেই আকাশগঙ্গা, যেখানে বাবা আলাউদ্দিন খান, মা দুর্গার ছবি সাজানো থাকত, জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ হত, পায়রাদের দল আসত ওনার হাতে দানা খাবার জন্য, আরব সাগরের ফ্রেমে বাধানো বারান্দা - আজ ধুলোয় ভরা, অযত্নে মলিন। স্তূপ করে জিনিষ ছড়ানো মাটিতে। বললেন, আলম আমার কাছে শিখতে চায়, কিন্তু আমি তো আর শেখাতে পারি না।

আকাশগঙ্গার সাত তলা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি, আরব সাগরের জল আগের মতই চিকচিক করছে। মা'র পুরো জীবনটাই তখন মনে হয় একটা অশ্রুবিন্দু।

(লেখাটি উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলন স্মরণিকা ২০১৪-তে পূর্ব প্রকাশিত।)


লেখক পরিচিতি: লেখক একজন সরোদিয়া। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অন্নপূর্ণা দেবীর ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে আমেরিকা নিবাসী, নিউ ইয়র্কের একটি বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।


সেতারবাদক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়

সরোদবাদক আশিস খান - আলী আকবর খানের পুত্র।

(অবসর-এর পক্ষ থেকে সুজন দাশগুপ্তের সংযোজন)

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপাল মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন খানের কন্যা ও খ্যাতনামা সরোদবাদক আলী আকবর খানের ভগ্নী অন্নপূর্ণা দেবীর (রওশন আরা খান) জন্ম ১৯২৭ সালে। ১৯৪১ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে উনি বিয়ে করেন ওঁর বাবার বিখ্যাত সেতারবাদক শিষ্য রবিশঙ্করকে। বিয়ের পর হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে রওশন আরা অন্নপূর্ণা নাম নেন। পিতার কাছে দীক্ষিত অন্নপূর্ণা দেবী নিজেও ছিলেন স্বনামধন্য সুরবাহার শিল্পী। ওঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান শুভেন্দ্র (শুভ) শঙ্করের সেতার বাজানোর হাতেখড়ি হয় অন্নপূর্ণাদেবীর কাছে। ১৯৬২ সালে রবিশঙ্করের সঙ্গে ওঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদ ঘটার আগে থেকেই বাইরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা উনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সঙ্গীতের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয় নি। মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডিতে ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে সঙ্গীত শিক্ষার সুযোগ পাওয়াটা ছিল পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার । ওঁর সুপ্রতিষ্ঠিত শিষ্য তালিকায় রয়েছেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ আরও অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী।

নিজের বিবাহ-বিচ্ছেদ নিয়ে অন্নপূর্ণাদেবী বরাবরই নীরব ছিলেন। ২০০০ সালে কয়েকটি লিখিত প্রশ্নের উত্তরে এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করেছিলেন। মাস দুয়েক আগে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্নপূর্ণাদেবী বলেন, “পঞ্চাশ দশকে আমরা যখন একসঙ্গে বাজাতাম, তখন শ্রোতা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে আমার বেশী প্রশংসা পাওয়াটা পন্ডিতজীর (রবিশঙ্কর) ভালো লাগত না। *সেটার একটা বিরূপ প্রভাব আমাদের বিয়ের ওপরে পড়ত। যদিও উনি (রবিশঙ্কর) সরাসরি আমাকে অনুষ্ঠানে গিয়ে বাজাতে বারণ করে নি, কিন্তু ওঁর নানান আচরণের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেত - আমি যে এই বেশী হাততালি পাচ্ছি, তাতে উনি বিরক্ত বোধ করছেন।”

সুখী বিবাহিত জীবন, না শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ? অন্নপূর্ণা প্রথমটিই বেছেছিলেন। “স্বভাবে আমি অন্তর্মুখী, সংসারই আমার কাছে বড়। তাই যশ বা খ্যাতির বদলে বিয়েটাকেই রক্ষা করতে চেয়েছিলাম।”
অন্নপূর্ণাদেবীর এই আত্মত্যাগ সত্ত্বেও ওঁদের বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। রবিশঙ্করের জীবনে তখন অন্য নারী এসে গেছেন।

বিচ্ছেদ ঘটে যাবার পরেও অন্নপূর্ণা দেবী কেন বাইরের সঙ্গীতজগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন - তার উত্তর অজ্ঞাত। মনে হয় উনি সঙ্গীতসাধনায় যতটা বিশ্বাসী ছিলেন, পরিবেশনায় ততটা নয়। আড়ালে থাকার দরুণ ওঁর সম্পর্কে একটা ঔৎসুক্য ও আগ্রহ অনেকেরই রয়েছে, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই যে খ্যাতি ওঁর প্রাপ্য ছিল, সেটা উনি পান নি। তবে ওঁর প্রতিভা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অনেকে করেছেন। অন্নপূর্ণা দেবী সম্পর্কে উস্তাদ আমীর খান নাকি বলেছিলেন, “উস্তাদ আলাউদ্দীন খানের ৮০ শতাংশ পেয়েছেন অন্নপূর্ণা, ৭০ শতাংশ আলী আকবর আর ৪০ শতাংশ রবিশঙ্কর!" আলী আকবর নিজেও নাকি সেটা অস্বীকার করেন নি; এক সময়ে বলেছিলেন, “একদিকে আমাকে, রবিশঙ্করকে আর পান্নালালকে (ঘোষ) বসাও, অন্য দিকে অন্নপূর্ণাকে। পাল্লায় অন্নপূর্ণাই ভারি হবে।” হয়ত বোনের সম্পর্কে সেটা ছিল দাদার সস্নেহ উক্তি।

নীচে অন্নপূর্ণাদেবীর বাজানো দুটি রাগের লিঙ্ক দেওয়া হল।

সুরবাহারে মাঝ-খামাজ

অন্নপূর্ণা দেবী ও রবিশঙ্করের যুগলবন্দি - রাগ ইমন কল্যাণ

*প্রায় একই কথা রবিশঙ্করের ছাত্র ও সঙ্গীত-সমালোচক মদনলাল ব্যাস বলেছেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।