বিবিধ প্রসঙ্গ
অক্টোবর ১৫, ২০১৬
থ্রিলার যখন বিজ্ঞানে
অভীক দত্ত
জ্যাকব ব্রনস্কিকে একবার একটা সাক্ষাৎকারে অদ্ভূত , কিছুটা বা বেয়াক্কেলে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল। প্রশ্নকর্তা বক্তব্য শুরু করেছিলেন আলগোছে। তিনি বলছিলেন -এই যে বিবিধ বিদ্যার যে জনপ্রিয় ধারাগুলি নিয়ে নানা মহাজন কাজ করছেন-যেমন পপুলার হিস্ট্রি, পপুলার ফিলোসফি-সেগুলো আম আদমি-যাঁরা একাডেমিয়া থেকে শতহস্ত দূরে থাকেন , তাঁদের কাছে ক্রমশই আরও আরও বেশি করে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। এমনি একটা ধারা হলো পপুলার সায়েন্স। ছোট্ট ভণিতার পরেই হঠাৎ দুম করে সেই সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসেন-'আচ্ছা মিস্টার ব্রনস্কি, আপনিতো বহু বছর ধরে পপুলার সায়েন্সের লেখালিখি করছেন। আপনার নামটা আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু আপনি কি সত্যিই মনে করেন আপনারা যাকে পপুলার সায়েন্স বলছেন-সেই জগাখিচুড়ি বস্তুটি আদৌ পপুলার হয়ে উঠেছে?' চার্লি চ্যাপলিনকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো'আচ্ছা মশায়, আপনি কি সত্যিই ভাবেন যে নির্বাক সিনেমাও আসলে সিনেমা'-তাহলেও চ্যাপলিন সায়েব হয়তো আরেকটু কম অবাক হতেন। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানশিক্ষক ও প্রচারক সেদিন বলেছিলেন -'আসলে বিজ্ঞানের জনমোহিনী হওয়ার একটা সাংঘাতিক অসুবিধা রয়েছে।সেটা হলো প্রশিক্ষণের অভাব। বিজ্ঞানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভবের জন্যেও একটা নির্দিষ্ট পরিমান প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।সাধারণ মানুষের মধ্যে সেইটির অভাবই বিজ্ঞানকে মানুষের নিকটতর বান্ধব হয়ে ওঠায় নিয়ত বাধাদান করেছে।'
জ্যাকব ব্রনস্কি ও তাঁর বিখ্যাত 'দ্য অ্যাসেন্ট অফ ম্যান'
|
ব্রনস্কির এই কথাটিতেই বিজ্ঞান ও আম- আদমির ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্কের রহস্যটি লুকিয়ে রয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্তার এতো বিপুল, যে সঠিক প্রশিক্ষণ ও অধ্যয়ন ছাড়া এর রসগ্রহণ অত্যন্ত কঠিন। এটুকু জানাই ছিল, আর তাঁতীও তাঁত বুনে খাচ্ছিলো-এবং পপুলার সায়েন্স পপুলার না-পপুলারের ঝগড়ার মাঝে থানা গেড়ে বসে ছিল। মুশকিল হলো কিছু একলষেঁড়ে একবগ্গা লোককে নিয়ে। এঁয়ারা যে শুধু বিজ্ঞানের মধ্যে উপভোগ্য রস খুঁজে পেলেন তাই নয়, এমনকি থ্রিলও খুঁজে পেলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ বিলকুল ভুল পড়েন নি, থ্রিল। এদিকে উৎসাহের পালে হাওয়া দিলো থ্রিলার সম্পর্কে বহুপ্রচলিত একটি কথা- পৃথিবীর যেকোনো বিষয় নিয়ে থ্রিলার লেখা যায়, শুধু তাতে থ্রিল থাকতে হবে। তো এই কম্যান্ডমেন্টকে শিরোধার্য করে সেই মহাজনেরা বিজ্ঞান নিয়ে থ্রিলার লিখতে কোমর বাঁধলেন। কেউকেউ তো সাহস দেখিয়ে শুরু করলেন বিজ্ঞানভিত্তিক ননফিকশন থ্রিলার রচনা।
ভাবুন একবার। একে বিজ্ঞান, তায় নন ফিকশন। সাধারণ পাঠককে তিতিবিরক্ত করে মারার এমন আয়োজন কমই হয়। অন্তত এমনটাই ছিল প্রচলিত ধারণা। তাই লেখক তাঁর রচনাকে সর্বজনবোধ্য করে তোলার জন্য অধিকাংশ সময়েই নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে শুরু করলেন। কৌশলগুলি বিরল কিছু নয়, পপুলিস্ট মিডিয়ায় বহুযুগ ধরে চলে আসছে। প্রথমত একটি নিতান্ত সাধারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা বিশ্লেষণের নেপথ্যে যেসব ব্যক্তিগত লড়াই-রেষারেষি-কেচ্ছা থেকে যায়-সেগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে একটি জম্পেশ কাহিনীর ছাঁচে বিষয়টিকে ফেলা।উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়, ক্যালকুলাস আবিষ্কার নিয়ে লেখা জন বার্ডির 'দ্য ক্যালকুলাস ওয়ার্স'। গল্পে প্রাথমিক ও প্রধান বিষয় ক্যালকুলাসের আবিষ্কার ও প্রয়োগ। কিন্তু দুই বিজ্ঞানীর (নিউটন ও লিবনিজ ) রেষারেষি, পারস্পরিক কর্দমনিক্ষেপ আর সমকালীন ইউরোপের কেচ্ছা এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। খোদ বিজ্ঞানীরাও অনেক সময় সর্বজনগ্রাহ্যতার এই আকর্ষণ এড়াতে পারেন না। তাই দেখা যায়, জেমস ওয়াটসনের মতো বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীও যখন লিখছেন 'দ্য ডাবল হেলিক্স', ডি. এন. এ -র গঠন বিশ্লেষণের থেকে বড়ো হয়ে দেখা দিচ্ছে রেষারেষি আর প্রথম স্থানের জন্য প্রতিযোগিতা।
এডিসনের জীবন ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ
|
অবিশ্যি বিজ্ঞানীদের কেবল যশের কাঙাল আপনভোলা শিল্পীসম ভেবে বসলে বেদম ভুল হবে। বিজ্ঞানীদের রেষারেষির উপর বাজারও কম প্রভাব ফেলেনা। মরি ক্লেইন -এর দ্য পাওয়ার মেকার্স:স্টীম , ইলেক্ট্রিসিটি এন্ড দ্য মেন্ হু ইনভেন্টেড মডার্ন আমেরিকা কেতাবখানায় অতি সুললিত ভাষ্যে বর্ণনা করা আছে বিজ্ঞানের জগতের এক অতি খারুশ রেষারেষির গল্প। এসি ও ডিসি কারেন্টের বন্টন নিয়ে ঝগড়া, যা গোটাদুনিয়ায় বিখ্যাত ওয়ার অফ কারেন্টস নামে-তার ইতিহাস যেমন উপাদেয় তেমন থ্রিলিং। আজ্ঞে হ্যাঁ, থ্রিলিং। সেই মহাজনেরা যে বিজ্ঞান নিয়ে ননফিকশন থ্রিলার লেখায় বহুলাংশে সফল-তা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণে। স্বনামধন্য টমাস আলফা এডিসন ও বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের বাণিজ্যিক রেষারেষি চলছিল উনিশ শতকের শেষ পাদ জুড়ে। শেষ হাসি হাসেন অবিশ্যি ওয়েস্টিংহাউস। এডিসনের ডিসি কারেন্ট বন্টন সংস্থাকে পিছনে ফেলে ওয়েস্টিংহাউসের এসি বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা যে বিজয়ের পথে হাঁটতে শুরু করেছিল, তার সে পদসঞ্চার আজও অব্যাহত। তবে এবিষয়ে লেখা সেরা বই সম্ভবত টম ম্যাকনিকোল -এর এসি/ডিসি: দ্য স্যাভেজ টেল অফ দ্য ফার্স্ট স্ট্যান্ডার্ড ওয়ার।ভাগ্যের এমনি পরিহাস, এডিসন নির্মিত মারণ যন্ত্র ইলেকট্রিক চেয়ারও শেষ পর্যন্ত চালানোর বরাত পেলেন ওয়েস্টিংহাউস, তাঁর এসি বিদ্যুতের সুবাদে। এডিসনের উত্থানপতনের এই কাহিনী অদ্ভুত সুন্দর ঢঙে বর্ণিত আছে মার্ক এসিগ সায়েবের এডিসন এন্ড দ্য ইলেকট্রিক চেয়ার:এ স্টোরি অফ লাইফ এন্ড ডেথ বইখানিতে।
দ্বিতীয় ধরণটি হলো বিজ্ঞানীর জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখাটিকে সাজিয়ে তোলা। এই ক্ষেত্রে সাধারণত থ্রিলারের যা আবশ্যিক দাবি-ক্রাইসিস, সেটি জোগাড় করতে দুটি পন্থা নেওয়া হয়। হয় এমন কোনো বিজ্ঞানীকে বেছে নেওয়া হয়, যাঁর সময়কাল ঐতিহাসিক ভাবে অত্যন্ত সংকটপূর্ণ। রেনেসাঁসের সময়কার সামাজিক- রাজনৈতিক উত্থানপতনকে কাজে লাগিয়ে জেমস কোনোর লিখেছেন 'কেপলারস উইচ '। জোহানেস কেপলারের জীবন বিধৃত হয়েছে এই অসম্ভবরকম সুলিখিত বইটিতে। সাথে সপ্তদশ শতকের ইউরোপে ধর্মান্ধতা আর নবজাগ্রত বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব , কেপলারের মায়ের ডাকিনীবিদ্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া , চার্চের সামনে কেপলারের মায়ের হয়ে সওয়াল , গ্যালিলিও আর কেপলারের দ্বন্দমধুর সম্পর্ক আখ্যানটিকে সফলভাবে থ্রিলারধর্মী করেছে। কোনোরের আরেকটি অতীব সুখপাঠ্য লেখা আছে পাস্কাল-কে নিয়ে-পাস্কালস ওয়েজেস। বিজ্ঞানশহীদ জিওর্দানো ব্রুনোর জীবনী নিয়ে ইনফ্রিড রোল্যান্ড লিখেছেন 'ব্রুনো, দ্য ফিলোসফার হেরেটিক।' চার্চ, অন্ধবিশ্বাস, বিজ্ঞান, ব্রুনো, ক্যপারনিকাস, চার্চ আর ব্রুনোর লুকোচুরি-শেষে ব্রুনোর বিচার ও মৃত্যুবরণ-থ্রিলারধর্মী আখ্যানে সবকিছু অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা। আবার অন্যদিকে গ্যালিলিও আর তাঁর মেয়ে মারিয়া সেলেস্তা-র ( যিনি পিতার নামের অধিকারিণী হন নি কখনো, সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন সন্ন্যাসিনীর পোশাকে , এক ক্রীশ্চান মঠে) সম্পর্ক, গ্যালিলিওর জীবন, ফ্লোরেন্সের রাজনীতি আর চার্চের স্বেচ্ছাচারিতায় অনবদ্য কাহিনী-'গ্যালিলিওস ডটার ' নির্মাণ করেছেন দাভা সোবেল।
বিজ্ঞানীর জীবনকথায় ক্রাইসিস আমদানির দ্বিতীয় পন্থাটি হলো বিজ্ঞানীর জীবনের একটি নির্দিষ্ট পরিসর বেছে নেওয়া-যার সাথে যোগাযোগ রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের, সম্বন্ধ রয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের কোনো অতিপরিচিত ঘটনার। ম্যানহাটান প্রজেক্ট আর অ্যাটমিক বোমা নিয়ে লিখিত 'ব্রাইটার দ্যান থাউসেন্ড সান্স ' এমনি এক গ্রন্থ। অ্যাটম বোমা তৈরির গল্পে শীতালি পাখির ঝাঁকের মতো এসেছে নিলস বর , আইনস্টাইন, ফাইনম্যান, জিলার্ড-এর মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রমিছিল, নির্দেশিত হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম বাঁক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অ্যালেন টুরিংয়ের ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এর সাথে ব্লেচলি পার্কে কাটানো সময় আর জার্মান সংকেত প্রেরক মেশিন এনিগমার রহস্যভেদের কাহিনী নিয়ে লেখা হয়েছে 'অ্যালেন টুরিং, দ্য এনিগমা '-লেখক অ্যান্ড্রু হজেস।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ - বিজ্ঞান থ্রিলারের এল ডোরাডো
|
মিস্টিসিসমের কুয়াশা কাটিয়ে বিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ। তাই দুজনের যৌথতার যে দিগন্ত, তাতে খানিক আলো-খানিক আঁধার। মিস্টিক বিষয়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ-অথবা বিজ্ঞানের কুয়াশাঘেরা মিস্টিক -অকাল্টে ফিরে যাওয়া - সাধারণ পাঠককে আকর্ষণ করতে বাধ্য। সেপথেই হিটলারের অকাল্ট সায়েন্টিস্ট গ্রুপ নিয়ে চর্চা আর লেখালিখি হয়েছে প্রচুর। উদাহরণ - 'এঞ্জেল অফ ডেথ' জোসেফ মেঙ্গেল , যিনি কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে মানব শরীরের উপর নানা উদ্ভট পরীক্ষা করতেন-যথা জ্যান্ত অবস্থায় দুটি শিশুকে জুড়ে দেওয়া, মানুষের দেহে নানা রাসায়নিক প্রয়োগ করে তাকে সুপারম্যান বানানো ইত্যাদি-সেই মেঙ্গেল কে নিয়ে বিস্তৃত লিখেছেন জেরাল্ড পস্নার আর জন অয়ার তাঁদের 'মেঙ্গেল : দ্য কমপ্লিট স্টোরি ' তে। আলকেমির জগৎ থেকে বিজ্ঞানের উত্তরণের গল্প-ও উঠে এসেছে নানা নন ফিকশন থ্রিলারে। লরেন্স প্রিন্সিপে-র বিতর্কিত বই-দ্য অ্যাস্পায়ারিং অ্যাডেপ্ট - এ উঠে এসেছে বিশ্রুত রসায়নবিদ রবার্ট বয়েলের আলকেমি চর্চার রোমহর্ষক কাহিনী। আলো -আঁধারি-র বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে যে ননফিকশন থ্রিলার তাও কিছু কম আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু তার পরিসর অন্য।
ঋণস্বীকার:
সায়েন্স ইন হিস্ট্রি - জে . ডি . বার্নাল।
দ্য সায়েন্টিস্টস : এ হিস্ট্রি অফ সায়েন্স টোল্ড থ্রু দ্য লাইভস অফ ইটস গ্রেটেস্ট ইনভেন্টর্স - জন গ্রিবিন
দ্য অ্যাসেন্ট অফ ম্যান - জ্যাকব ব্রনস্কি
এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ নিয়ারলি এভরিথিং - বিল ব্রাইসন
লাইব্রেরি অফ ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি অ্যান্ড পপুলার সায়েন্স - আর্কাইভ ডট অর্গ
আন্তর্জালিক নানা নিবন্ধ
নিবন্ধে উল্লিখিত বইসমূহের কয়েকটি
চিত্রঋণ – আন্তর্জাল
লেখক পরিচিতি: লেখক রসায়নবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত। বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো ও লেখালিখিতে আগ্রহী।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।