বিবিধ প্রসঙ্গ - ব্যক্তিগত স্মৃতি -বিস্মৃতি
মার্চ ১৫, ২০১৪
হোলির সময় হোলি-র স্মৃতি
নীনা গাঙ্গুলী
ছোটবেলার সব কথাই আজ নতুন করে , আরও বেশি করে মনে পরে, ভাল লাগে। পাটনায় আমরা থাকতাম খুব সাদামাটা জনতা জনার্দন পাড়ায়---দামী পাড়ায় নয়। হবে কি করে, বাবা মা যখন সংসার পাতলেন, বাবা ফুলটাইম ট্রেড-ইউনিয়ন করেন আর মা স্কুলে চাকরী। স্বদেশী আমলের বাবার চেনা ডাক্তারদাদু জোর করে নিজের বাড়ীর কাছে খুব সস্তায় অনেকটা জমি কিনিয়ে দিয়েছিলেন---" বিয়ে করেছ, সংসারী হয়েছ, এবার তোমাদের ভবিষ্যতের কথা, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে " ইত্যাদি বলে। সেইটুকু কেনারও সঙ্গতি ছিলনা তখন, ট্রেড ইউনিয়ন জীবনের বন্ধু বসন্ত ঘোষ (এই সব বন্ধুত্বের পরিভাষা বড় পবিত্র) টাকা ধার দিয়েছিলেন । তারপর যেমন যেমন ওকালতির পসার বেড়েছে তেমন তেমন হাতে টাকা এসেছে ---একটু একটু করে বাড়ী বেড়ে উঠেছে। সেই সময়কার টিপিক্যাল ধরণে, বড় বড় বারান্দা, বড় উঠান, বড় ছাদ, ঘর কম :-) আর বিরাট বাগান। ওপরে দুটো ফ্ল্যাটে দুই মাসতুতো দিদি-জামাইবাবু টেনান্ট। একতলায় আমরা। "একটি সন্তান" এই ডিসিশনের জন্য মা নিজের দিদির ছেলে ও মেয়েকে এনে একসঙ্গে মানুষ করছিলেন। পরে মাসীমা মেসোমশাই (রিটায়ার্ড) ও আমাদের সঙ্গে থাকতেন।
এক কথায় জমজমাট বাড়ী , তিনটি হেঁসেল শেয়ার করা, গল্প-গুজব, সবসময় বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন আসা যাওয়া, তাই আমি কোনওদিন "আমি একলা" বুঝতে পারিনি। একলাষেঁড়ে হই নি ☺।
বিহারে "হোলি" সবচেয়ে বড় তেওহার - উৎসব। বাপরে সাজ সাজ রব পড়ে যেত " ফাগুয়া আ গইল বা" । মা, দিদিরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ত সব্বার নতুন জামা কাপড় আর কাজের লোকেদের তাদের মনপসন্দ সব নতুন জামা কাপড় দেবার জন্য বাজার করতে। আমাদের ছোটদের, মেয়েদের হত সাদা অর্গ্যান্ডির ফ্রক--মা নিজেই সেলাই করত, পরে দিদি। আর মা একটা খুব নরম মলমলের লম্বা জোব্বা টাইপের জামা বানাত--ঐ ম্যাক্সির মতন আর কি! সেও একজনের জন্য--বলছি পরে কার। এ ছাড়া বাবার হাইকোর্টের মুন্সী নাত্থুজীর ( মুসলমান, কিন্তু নতুন জামা পরতেন) লোয়ার কোর্টের চাপরাসী জানকী প্রসাদ এরকমও কিছু লিস্টে ছিল---আর ছিল নাগিনা ডোম!!
এই নাগিনা ছিল এক অদ্ভুত চরিত্র। রোগা ডিগডিগে বেখাপ্পা লম্বা, চোখদুটো সবসময় টকটক করছে লাল, পরনে নোংরা ধুতি আর ফতুয়া, নেশায় টলছে , সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না--আর ছিল পিলে চমকে দেয়া বাজখাঁই গলার আওয়াজ! সব ছোটরা, আমরা খুব ভয় পেতাম ওকে। নেশাখোর নাগিনা মাঝে মাঝেই উদয় হত , বাইরে দাঁড়িয়ে বিকট চেঁচাত " বাবুজি নাগিনা ডোম আইলবা" । বাবা বেরোলেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম আর " বাবুজি কাম দিউ, ভুখা বানি" টলতে টলতে দুটো নালাও পরিষ্কার করে উঠতে পারত না, কিন্তু ভিখ নেবে না, সেই জেদ ছিল। মাকে মাইজী ডাকত আর খুব ভয় পেত কারণ মা বলত--যা নহা কে আব" অত বড় মানুষটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদত, কিছুতেই চান করবেনা---কত রকমের বাহানা বুখার হয়েছে, গায়ে খুব ব্যথা ইত্যাদি। রুটি গুড় আর চা এ ছাড়া কিচ্ছু খেত না, দিলেও না । কখনও কখনও নেশার ঘোরে নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে নালার মধ্যেই পরে থাকত। যাইহোক, এই নাগিনা এলেই একটা হৈ হৈ রই রই পরে যেত বাড়ীতে---বাড়ীর চাকরবাকরদের একটা মস্ত খোরাক ছিল এই মানুষটা----ওরা পেছনে লাগত " কেকর জোরু, তোরা মেহেরারু" বল্লে ও ভীষণ ক্ষেপে যাতা গালাগালি করত, ঢিল ছুঁড়ে মারত।
এই দেখ, হোলি থেকে কি আনহোলি কথায় চলে গিয়েছিলাম, সরি!
হোলির দিন সক্কালবেলা পুরনো জামা পরে, ফুলহাতা জামা যাতে গায়ে হাতে রঙ কম লাগে, আর সাদা জামা পরতাম , রঙ লেগে বেশ খোলতাই হয় যাতে। গায়ে মাথায় আচ্ছা কষে সর্ষের তেল মাখতাম ---পরে ঐ বাঁদুরে সবুজ রঙ রুপোলী পেন্ট সটাসট উঠে যাবে চানের সময়। তারপর কচিকাঁচা ছেলেমেয়ের দল বেরিয়ে পরতাম পাড়ায় ---বাড়ী বাড়ী ঘুরে খেলা--বাড়ীর সামনে গিয়ে হাঁক "বুরা না মানো , হোলি হ্যায়" সেই বাড়ীর লোকজন বেরিয়ে আসত রঙ খেলতে, আর যে বাড়ীর লোকজন বেরতো না তাদের জানলা দিয়ে রঙভর্তি বেলুন ছুঁড়তাম ( ইস,কি দুষ্টুই ছিলাম তাই ভাবি) আমি একজন পালের গোদা কারণ হাতের টিপ ভাল ছিল, অব্যর্থ জানলা গলে বেলুন চলে যেত। এই করে সারা পাড়া হৈ হৈ করে সব্বাইকে রঙ দিয়ে , নিজেরা ভূত হয়ে বাড়ী ফিরতে ফিরতে সেই বেলা একটা । শুরু হত "স্নান প্রজেক্ট" অনেক ঘষেও সব রঙ একদিনে উঠত না। চান করে হাল্কা ঝোলভাত খেয়ে ছোট্ট একটা ঘুম---কারণ বিকেল থেকে শুরু হবে হোলির নেওতার খানা, পুয়া পুরী পাকওয়ান ( হে হে পিনা ছিলনা, ধ্যুস!)
মেনু হত ডালপুরি, না না ছোলার ডলের নয়--অড়হড়-দাল তাও আবার সর্ষের তেলে সেঁকা ভাজা ( বিহারী ডেলিকেসি, যে খেয়েছে সে জানে তার স্বাদ নয় "সোয়াদ") ঝাল ঝাল আলুরদম, মিঠা পোলাউ, গরগরে মাংস, ক্ষীর ( ঘন খোয়া-ক্ষীর) আর মালপো। সারা বাড়ীতে কি খুশবু সেসব রান্নার! আর একটা জিনিষ মা বানাত চাল-ডাল আর আলু দিয়ে সাদা খিচ্ড়ী, ঘী পরত কিন্তু নুন না। এই সাদা খিচুড়ি একজনের জন্য তৈরি হত।
বিকেলে সব নতুন জামা পরে রেডি। বাড়ীতে আসতেন বাবার পার্টি অফিসের ( R.S.P. ) লোকেরা, স্টেট ও সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ইউনিয়নের পুরোনো কিছু বাবার বন্ধুর----নিয়মিত ছিলেন দুর্গা বাগচী ( বর্মা থেকে পালিয়ে আসা এই মানুষটির ঝুলিতে থাকত সব রোমহর্ষক গল্প) সিয়াবাবু, খাস ছাপড়াইয়া , একখান ঝাঁটার মতন গোঁফ, গুরুবচন সিং (মোনা স্র্দার ) জয়কিষুণবাবু ( বাবার ডানহাত ফ্রম স্বদেশী আমল টু হাইকোর্টে প্র্যাকটিস, সবেতে) প্রীতিরঞ্জন সেন ( লেবার কমিশনার) বাবামার আজীবন বন্ধু--ও দিল্লী কিম্বা কলকাতা থেকে ত্রিদিব চৌধুরী (ঢাকুকাকু) প্রতুল সেন পাটনায় এসেছেন তখন কোনও কাজে-- এঁরা সব্বাই কনফার্মড ব্যাচেলর, দেশই ছিল এনাদের সংসার। শুধু জয়কিষুণচাচাজী ছিলেন সংসারী , আমার মা ই তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন।
বিকেলে ঠাকুরের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করে তারপর গুরুজনদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করে শুরু হত বিকেলের আবীর খেলা--সুখা হোলি। সবাই সবাইকে নানা রঙের আবীরে রঙিন করত--শুরু হত খাওয়া-দাওয়া । সিয়াবাবু কি একটা শরবৎ বানিয়ে আনতেন, শুধু বড়দের জন্য, আমরা বাদ ( হে হে এখন বুঝি ভাঙ্গের) কত হাসি গল্প ঠাট্টা, মা দিদিরা গান গাইত, আমরা ছোটরা কবিতা বলতাম । গুরুবচনচাচাজী শায়রি বলতেন।
ও হ্যাঁ আমাদের বাড়ীর পাশে গুরুদয়াল অর উত্তীমলালের খাটাল ছিল। এই দুই যাদবভাই হোলি সিজন মাতিয়ে রাখত। রাত নটা-দশটা থেকে শুরু হত তাদের যাদব-গোষ্ঠীর হোরি-ধুন চৈতি গান ( হা হা গান না gun ) হেঁড়ে গলায় সুরের ভুষ্টিনাশ, তার সঙ্গে ঢোলক ডুম্ডুমাডুমডুম ধ্ম , ঠনঠনাঠন খঞ্জুনি --মাঝে মাঝে পাড়ার নেড়ি কুকুর গুলো ভয়ে উঁউউউউ করে কেঁদে উঠত ( না গানে যোগ দিত , কে জানে) আরও রাত করে শুরু হত নৌটঙ্কি নাচ --কি হুল্লোড়! ছোকরা মেয়ে সেজে নাচত যদিও--তা তাও আমাদের ছোটদের দেখা বারণ ছিল--কারণ ভাষা ও অঙ্গভঙ্গি বেশ R রেটেড হয়ে উঠত। ঐ খুব চুরি করে জানলা দিয়ে একটু আধটু যা দেখেছি--খুব রাগ ধরত বড়দের ওপর--সবতাতে যে কেন এত না না ছিল, উফ!
তো এই হোলির নেওতায় নিয়মিত ছিল নাগিনাও। আসত বিকেল পাঁচটা নাগাত। মা ওকে তেল, সাবান নতুন গামছা আর জামা কাপড় দিত। ঘষে ঘষে চান করত সে, ঝাঁকড়া চুল পরিপাটি করে ঝুঁটি বাঁধত। পরিষ্কার চেহারা, নতুন ধুতি-ফতুয়া পরে বেশ ভাল দেখাত। চেনাই যেত না। আর সেদিন সে থাকত ১০০% সোবার, কোনও নেশার জিনিষের ধার দিয়ে যেত না। আমাদের ছোটদের একটা করে তালপাতার সেপাই ( নিজেই বানাত) গিফ্ট দিত আর হেসে বলত " ডরো নহি খোখি, ই হই আচ্ছা আমদি নাগিনা । (পাটনায় আদমিকে আমদি বলে)
নাগিনার একট ছোট্ট গল্প --
বহুদিন আগে তখন নাগিনা জোয়ান মরদ, একবার হোলির সময়, আগজার দিন ( হোলির আগের দিন যেদিন রাত্রে হোলিকাকে পোড়ানো হয়) কয়েকটি উঁচা ঘরানার বড়লোকের ছেলেরা কোনও গ্রাম থেকে একটি গরীবের যুবতী মেয়ে কিম্বা বউ কে তুলে এনে, তার ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। নাগিনা ডোমকেও টাকা, গাঁজা ভাঙ্গ মদ নিজেদের থেকে পরসাদি দেয় এবং ভোগ্যা মেয়েটারও পরসাদি পায় নাগিনা। নেশার ঘোরে কারুরই জ্ঞান ছিলনা। এবং যাবার আগে মেয়েটিকে পুড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করে যায় ঐ নাগিনা ডোমের সাহায্যে --নাগিনা যখন হুঁশ হয় , তখন বহু দেরী হয়ে গেছে। আর মেয়েটিও এতই দুর্ভাগা যে সে পোড়ে সাংঘাতিক ভাবে কিন্তু মরে না। সেই আধপোড়া মেয়েটিকে নাগিনা নিজের খোলিতে রাখে, সাধ্যমত সেবা করে বাঁচায়--কিন্তু সে চোখে ভাল করে দেখতেও পেত না, কোনও কিছু চিবিয়ে খেতেও পারত না আর শুধু গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর তার কোনও ভাষাও ছিলনা। সেই পঙ্গু দলা পাকানো মেয়েটির কেউ কোনোদিন খোঁজ করেনি---নাগিনার কাছেই সে থেকে গেছে।
এরই জন্যে প্রতি হোলিতে ঐ সাদা খিচুড়ি, মলমলের আলখাল্লা -জামা , ক্ষীর মালপো বুকে করে নিয়ে -----সারা শহর যেদিন ঝুম বরাবর ঝুম শরাবি আনন্দে মেতে থাকে ---রোজকার নেশাখোর নাগিনা---১০০% সোবার , লম্বা লম্বা পা ফেলে আমাদের বাড়ীর গেট পেরিয়ে চলে যেত---- সম্ভ্রান্ত নাগিনা --আর একটি অনুতপ্ত হোলি উদযাপনে!!
লেখক পরিচিতি - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরে থাকেন। কর্মজীবনে ফাইনান্সের সংখ্যা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, কিন্তু শব্দরা টানে ... মন তাই অবসর পেলেই তাদের নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।