প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ - ব্যক্তিগত স্মৃতি -বিস্মৃতি 

জুন ১৫, ২০১৫

 

এক অখ্যাত যাত্রাশিল্পীর কথা

বিমোচন ভট্টাচার্য


আমি কেন লিখি? কোন কারণ নেই। রিটায়ার করার পরে হাতে অফুরন্ত সময়। আমার লেখা কাউকে ট্যাগ করি না। এত মানুষ আমার লেখা পড়েন। তাই লিখি। কি লিখবো তাও ভেবে রাখি না। কোন ঘটনা দেখে / শুনে/পড়ে, কিছু মানুষের কথা মনে পড়ে যায়,যাঁদের আমি দেখেছি, শুনেছি তাঁদের কথা,বা শুধুই পড়েছি তাঁদের সম্বন্ধে । ডাইরি লেখার অভ্যাস করিয়েছিলেন বাবা, নিজেও লিখতেন, তাই বাবার ডাইরি বা নিজের পুরনো ডাইরি পড়লে অনেক কথা মনে পড়ে যায়। তাই আমার বেশীরভাগ লেখাই স্মৃতিচারণ। আমার মত করে।

এই যেমন আজ, ৩০শে মে, ২০১৫, শনিবার, সকালে একটি লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল অভয়কাকার কথা। অভয় হালদার। যাত্রাশিল্পী ছিলেন। বিশ্বরূপা থিয়েটারে আমরা থাকাকালীন যাত্রা উৎসব হত। সব নামকরা যাত্রাশিল্পীকে আমি/আমরা দেখেছি সেই সময়। সম্ভবতঃ, ১৯৬০ সালে, বাবা নিজে " কর্ণার্জুন" নাটকটিকে কাটছাঁট করে, প্রতি রবিবার সকালে অভিনয় শুরু করলেন বিশ্বরূপা থিয়েটারে। ছোট করে বলি, রবি ঘোষ করেছিলেন শকুনি। বাবা পরিচালকও ছিলেন সেই নাটকে। একেবারে অন্য মাত্রা এনেছিলেন শকুনি চরিত্রে যুবক রবি ঘোষ। পুরোপুরি সিরিয়াস ছিলেন সেই শকুনি। যাত্রা জগতের দিকপাল অভিনেতারা ছিলেন সেই প্রযোজনায়। দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, তপনকুমার। তো, সেই সময় থেকেই যাত্রাশিল্পীদের সংগে আমাদের পরিচয় হওয়া শুরু। অনেকেই বাবাকে অনুরোধ করতে থাকেন যাত্রার জন্যে নাটক লেখার জন্যে। স্বপনকুমার, পঞ্চু সেন ( বিখ্যাত অভিনেতা, বাবার বন্ধুও ছিলেন)। বাবা কিছুতেই যাত্রার নাটক লিখবেন না। আমার নিজের ন কাকা ছিলেন যাত্রা জগতের মানুষ, প্রথমে অভিনেতা/ অভিনেত্রী হিসেবে, তারপর ম্যানেজার হিসেবে, সেইজন্যেই সব যাত্রাশিল্পীদের কাছে বাবা ছিলেন বড়দা। অভয় কাকা তখন নিউ গণেশ অপেরায় অভিনেতা/ম্যানেজার। তিনি প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি। অত্যন্ত ভদ্রলোক, সুকন্ঠের অধিকারী, সু অভিনেতা, বিদুর করতেন কর্ণার্জুনে। লেগে থেকে বাবাকে দিয়ে লেখালেন "আগুন"। সেটাই বাবার প্রথম যাত্রা নাটক। হীট হল সেই নাটক। অভয়কাকা তারপরেও প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি। বাবা তখন ব্যস্ত সিনেমা, বেতারনাটক, নাটক এ সব নিয়ে। আমার কাকা, অভয়কাকা আর স্বপনকুমার একইসঙ্গে যাত্রাজগতে ঢোকেন। সম্পর্ক টা তাই কাকা ভাইপোর মতই হয়ে যায় অভয়কাকার সঙ্গে।

তারপর ১৯৬৬ সালে বাবাকে প্রায় তাড়িয়ে দেওয়া হয় বিশ্বরূপা থেকে। বাবার নাটক হচ্ছে না, অভিনেতা হিসেবেও বাবাকে প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন কর্ত্তৃ পক্ষ অথচ আমাদের, বিশেষ করে বাবাকে যাতায়াত করতে হয় থিয়েটারের ভেতর দিয়েই। আমরা বিশ্বরূপা ছাড়লাম। আমাদের বাড়ির কেউ আর কোনদিন বিশ্বরূপা থিয়েটারের ভেতর ঢুকিই নি।

১৯৬৮ সালে আমরা এলাম মিল্ক কলোনীতে। তখন মানিকতলায় যেতাম আড্ডা মারতে। ৬৯এ গ্রাজুয়েট হলাম। বেকার,কোন কাজ নেই, মানিকতলা যাওয়া আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।পাড়ায় আড্ডা মারি। একদিন দেখি অভয়কাকা একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে স্কুলে দিতে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে অবাক। বললেন - এখানে কি করছো? তখনকার দিনে সবাই আমাদের "তুই" বলতেন, আমাদের ভালও লাগতো। অভয়কাকা ব্যতিক্রম ছিলেন। বললাম - যে স্কুলে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তার পাশের বাড়িটার দোতলায় ভাড়া এসেছি আমরা। বললেন,- আমার সংগে চল, ছেলেকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে তোমাদের বাড়ি যাব।গেলাম অভয়কাকাকে নিয়ে। বাবা তখন অসুস্থ। কাজকর্ম নেই। খুব খুশী হয়েছিলেন বাবা অভয়কাকাকে দেখে। অভয়কাকাও। আমার মাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন অভয়কাকা। তারপর থেকে প্রায়ই আসতেন আমাদের সেই বাড়িতে। আমরা বাড়ি চেঞ্জ করে, ওই পাড়াতেই আর একটি ছোট বাড়িতে এলাম ভাড়ায়। অভয়কাকার দুই ছেলে বড় হয়ে গেল। তাদের আর স্কুলে পৌঁছে দিতে হত না। অভয় কাকা কিন্তু আসতেন প্রায়ই আমাদের বাড়ি। চা খেতেন, বাবাকে সঙ্গ দিতেন। কয়েক বছর পর আবার অভয়কাকাকে একটি বাচ্চাকে নিয়ে সেই স্কুলেই আসছেন। হেসে বললেন - "নাতী/নাতনী। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।" আমরা তখন ভিলায় চলে এসেছি। অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হয়েছে আমাদের। সব দাদা সহ আমিও চাকরী পেয়ে গেছি। মাকে ধরলো মারণ রোগে। ৮০ সালের সপ্তমীর দিন মা চলে গেলেন মহাপ্রস্থানে। খবর পেয়ে এলেন। বাবার হাত ধরে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। খুব বেশী কথা বলতেন না। আমাদের বললেন- তোমাদের মা ছিলেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা । কত মানুষকে যে আশ্রয় দিয়েছেন তোমাদের বাড়িতে! এত দুখঃকষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছেন তবু কোনদিন দেখা হলে দেখি নি মুখে হাসি নেই। দেখো, তোমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হলে জীবনে আর বৌদি ই চলে গেলেন। অনাত্মীয়, আমার মায়ের জন্যে অভয়কাকার চোখের কোন চিকচিক করছে দেখেছিলাম সেদিন।

বাবা চলে গেছেন ১৯৮৬ সালে মহাবীর জয়ন্তীর দিন। সেদিনও এসেছিলেন অভয়কাকা। কাছেই জে কে মিত্র রোডে থাকতেন। ছিলেনও আমরা বাবার দেহ নিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত, আমার নিজের কাকার মত। বাবার ছেলে হবার জন্যে অনেক, অনেক মানুষ দেখেছি আমরা। বাবা লেখা ছেড়ে দেবার পর আর কেউ আসতেন না আমাদের বাড়ি। ব্যতিক্রম ছিলেন " ভুতের রাজা" রমেশ মুখোপাধ্যায়। ব্যতিক্রম ছিলেন অভয় হালদার। তার বহু আগে থেকে অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ম্যানেজার ছিলেন একাধিক যাত্রা দলের। সেই করেই, আজীবন সৎ থেকে ছেলেদের মানুষ করেছেন অভয় হালদার, আমাদের অভয় কাকা।

অভয় কাকা বেঁচে নেই। কবে মারা গেছেন জানতেও পারি নি। সাধারণ এক যাত্রাশিল্পীর মৃত্যু সংবাদ কবেই বা খবরের কাগজ বা টিভি তে পেয়েছি আমরা। কাছাকাছিই থাকতাম। সেদিন, জানতে পারলে আমরা দুই ভাই অন্ততঃ যেতাম শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। বিধায়ক ভট্টাচার্যর পরিবারের খুব কাছের মানুষ ছিলেন সেই স্থিতধী, সাধারণ অথচ অসাধারণ মানুষটি। কিন্তু ওঁর পরিবারের কারুর সংগেই আলাপ নেই আমাদের। তিনি চলে যাবার পর তাঁর বাড়ি গিয়ে কিইবা বলতে পারতাম আমরা। আর যাই হই, আমরা তো ওঁর পরিবারের " অভয়কাকা" ছিলাম না।

আজ সকালে, কাগজে একটি লেখা পড়ে মনে পড়লো অভয়কাকাকে, মনে পড়লো, মুগ্ধ বিস্ময়ে এক বালকের চোখ দিয়ে প্রথম দেখা, যাত্রার সেই ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে। মনে পড়লো বিশ্বরূপা থিয়েটারের সেই বাড়ি। বাবার সেই অপমানিত মুখ, মার সেই যন্ত্রণা কাতর দিনগুলি। সব, সব ফিরে এল অভয় হালদারের হাত ধরে।

লেখা শেষ করার সময় কানে বাজছে কেতকী দত্ত গাইছেন ( আহা কি কন্ঠস্বর ছিল তাঁর!) "অতীত দিনের স্মৃতি কেউ ভোলে না কেউ ভোলে। কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে কেউ ভুলিতে গায় গীতি।"

এমন কত, কত অখ্যাত অভয় হালদার বেঁচে থাকবেন আমাদের স্মৃতিতে... ওই আমরা যতদিন আছি, সেই কদিন আর কি......।


লেখক পরিচিতঃ নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের ছোট ছেলে। লেখালিখি সিরিয়াসলি শুরু করেছেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের চাকরী থেকে ২০১০ সালের অবসর নেয়ার পর। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে। কবিতা ছাপা হয়েছে দেশ এবং শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।