ইতিহাসের কথা
মে ৩০, ২০১৫
হননবৈশাখ ও একজন কবি
শিবাংশু দে
সেটা ছিলো একটা নিমবসন্তের কাল। মন্দমন্থরে নেমে আসা দুঃসময়ের কালো ছায়ার দিন। ভারতবর্ষ অনেক পালাবদল দেখেছে। বিংশশতক পড়ার পর এইবার প্রথম মানুষকে এতোটা নিষ্ঠুর ভবিতব্যের সম্মুখীন হতে হলো। বিশ্বযুদ্ধের চাপে পর্যুদস্ত ঔপনিবেশিক দস্যুদের কেউ যেন মরণকামড় দিতে প্ররোচিত করেছিলো। 'ভালো' ইংরেজরাও মুখোশ ছিঁড়ে মন্দ ইংরেজদের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে শুরু করেছে। ভারতবর্ষ সাম্রাজ্যের লক্ষ্মী। সেখান থেকে নিহিত স্বার্থে আঘাত কোন হিজ ম্যাজেস্টিস অনারেবেল সাবজেক্ট সহ্য করবে। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতসচিব মন্টেগু মহামান্য স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করলেন। তার কাজ হলো ভারতবর্ষে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কীকরে কাবু'র মধ্যে রাখা যায় সে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া। রাওলাটসাহেব ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে প্রস্তাব করলেন ভারতবর্ষে যে সব ছিঁচকে লোকজন সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছোবার কষ্টে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে, তাদের সবাইকে বিনাবিচারে গারদে পোরা হোক। প্রেসের কণ্ঠরোধ করা হোক আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিসকে সম্পূর্ণভাবে দমননীতি গ্রহণ করার ক্ষমতা দেওয়া হোক। সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল মার্চ মাসেই প্রস্তাবটিকে অনুমোদন দিয়ে দিলো।
-----------------------------------------------
এই পর্যায়ের দমনমূলক নীতি ও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া যে কতোটা ভয়াল হতে পারে সেই চিন্তায় এদেশে মানুষের আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। রাওলাট প্রস্তাবকে কালা কানুন আখ্যা দিয়ে সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গান্ধিজি তখন রণকৌশল হিসেবে সত্যাগ্রহের কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। এই কানুনের প্রতিবাদে সারা দেশে হরতাল ডাকা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচী হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। তার চরিত্র অবশ্যই গান্ধিজির সত্যাগ্রহের নিয়মমতো হতে পারেনি। অহিংস থাকা যাচ্ছেনা এই অভিযোগে অকস্মাৎ গান্ধিজি ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়া এই হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন হত্যাকান্ড সম্পন্ন হয়ে যাবার পর ।
---------------------------------------------------
বৈশাখি উৎসব পঞ্জাবের একটি মুখ্য উদযাপন। পড়েছিলো ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯। সেই দিনটিতে অমৃতসরের সাধারণ মানুষ পঞ্জাবের দুই বিশিষ্ট আন্দোলনকারী জননেতা ডঃ সতপাল এবং সইফুদ্দিন কিচলু'র গ্রেফতারের প্রতিবাদে একটি সভা ডাকলো। হিন্দু কলেজ, ধাব খটিকন, অমৃতসরে এক সমাবেশে এই সভাটি প্রস্তাব করেছিলেন ডঃ কিচলু'র সহযোগী মেঘরাজ। স্থান, পুরোনো শহরে একটি জনবহুল এলাকায় একটি ঘেরা জায়গা, নাম জালিয়াঁওয়ালা বাগ। ২০০ গজ বাই ২০০ গজ মাপের একটুকরো ভূখন্ড। বর্ষাকালে কিছু চাষবাস হয়। অন্যসময় স্থানীয় সভাসমিতি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। অবস্থান হরমন্দির সাহিবের কাছেই একটি ঘিঞ্জি পরিবেশে। একটি মাত্র সরু গলিপথ দিয়ে সেখানে ঢোকা যায়। বাকি চারটে গেট সাধারণত তালাবন্ধ থাকে। চারদিক দশফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রাঙ্গনটির মাঝখানে একটি সমাধিস্থল এবং একদিকে একটি গভীর কুয়ো। এর আগে ১০ই এপ্রিল অমৃতসরের জেলাশাসকের বাংলোর সামনে ঐ দুজন নেতার মুক্তি দাবি করে সমবেত সত্যাগ্রহীদের শান্তসমাবেশে পুলিস কোনও প্ররোচনা ছাড়াই গুলি চালায়। বেশ কিছু সত্যাগ্রহী নিহত হ'ন, সঙ্গে ছিলো বহু আহত মানুষও। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ই এপ্রিল সরকার সারা শহরে কারফিউ জারি করলো। সেদিন অপরাণ্হে দলে দলে সাধারণ মানুষ, যাঁরা মূলতঃ বৈশাখির দিন তীর্থ করতে সকালে হরমন্দির সাহিব এসেছিলেন, জালিয়াঁওয়ালাবাগের প্রতিবাদ সমাবেশে সামিল হতে এসে পৌঁছোতে লাগলেন। তার সঙ্গে আরো বহু মানুষ যাঁরা বৈশাখি মেলায় যোগদান করতে এসেছিলেন; কারফিউয়ের জন্য মেলা বন্ধ করে দিতে এই সভায় দলে দলে এসে পৌঁছোলেন। তাঁদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, শিখ সব সম্প্রদায়ের মানুষই ছিলেন। সেদিন তাঁদের একমাত্র পরিচয় অত্যাচারিত ভারতবাসী। সভার সময় নির্দিষ্ট হয়েছিলো বিকেল সাড়ে চারটে। মুখ্য বক্তা, শহরের জনপ্রিয় দুই নেতা মুহম্মদ বশির আর লালা কনহইয়া লাল।
---------------------------------------
জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার বৈশাখির সকালে শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে তার পাইকপেয়াদা'দের নিয়ে শহর পরিভ্রমণে বেরোলো। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কারফিউ লাগার কথা ঘোষণা করাই তাদের প্রকাশ্য উদ্দেশ্য। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ গুপ্তচরদের মুখে সাড়ে চারটে'র সময় জালিয়াঁওয়ালাবাগে সভা হতে যাচ্ছে শুনে তারা তৎকাল ব্যারাকে ফিরে গেলো। তাদের মতলব ছিলো কিছু অন্যরকম।
ঠিক সাড়ে চারটে'তে সভা শুরু হলো। প্রায় কুড়ি হাজার মানুষের সমাবেশ। অতো ছোটো জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে তারা জড়ো হয়েছে নেতাদের মুক্ত করার দাবিতে সামিল হতে। তখন মঞ্চে সবে লালা কনহাইয়া লাল বলতে শুরু করেছেন। জেনারেল ডায়ার তার পঁয়ষট্টিজন গুর্খা আর পঁচিশজন পঠান'বালোচ সৈন্যসামন্ত নিয়ে সেখানে এসে পৌঁছোলো। তাদের পঞ্চাশজনের সঙ্গে ছিলো থ্রি-নট-থ্রি লী-এনফিল্ড আর চল্লিশজনের সঙ্গে খুকরি। তাতেই শেষ নয়, দু'টো মেশিনগানসহ সাঁজোয়াগাড়িও ছিলো তাদের সঙ্গে। ঢোকার গলিটি অত্যন্ত সরু হবার জন্য সেগুলিকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া গেলোনা। বাইরেই থেকে গেলো তারা। এই জন্য ডায়ার পরে খুব দুঃখ করেছিলো। ভিতর-বাহির করার একমাত্র গলিপথটিকে সম্পূর্ণ আটকে দিয়ে ডায়ার গুলি চালানোর আদেশ দিলো। এছাড়া, যাতে বুলেট বৃথা নষ্ট না হয় সেজন্য এ আদেশও ছিলো সমাবেশের যে যে অংশে বেশি ভিড় আছে সেদিকেই যেন বন্দুক তাক করা হয়। তাতে অনেক বেশি মানুষ মারা পড়বে। প্রায় পনের মিনিট ধরে ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালানো হলো নির্দোষ, নিরপরাধ, শান্ত জনতার উপর। তারা অবশ্য আরো কিছুক্ষণ গুলি চালানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু গুলি'র রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তাদের পুণ্যকাজটি অসমাপ্ত থেকে যায়। ডায়ার পরে দুঃখ করে বলেছিলো সাঁজোয়াগাড়িগুলো ভিতরে নিয়ে যেতে পারলে একজনকেও জীবিত ছাড়তো না। গুলি, অন্য আঘাত ও পদপিষ্ট হয়ে সেদিন বিকেলে নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক নিরীহ মানুষ, জখম দেড় হাজারেরও বেশি। সরকারি পরিসংখ্যান ৩৭৯ জন নিহত, ১১৩৭ জন আহত। সব থেকে মর্মান্তিক ছিলো বহু মারাত্মকভাবে আহত মানুষ ও ভাবেই সারারাত সেখানে পড়ে থেকে মারা গেলেন। কারণ কারফিউয়ের জন্য কাউকে উদ্ধারকাজ করতে যেতে দেওয়া হয়নি, সকাল না হওয়া পর্যন্ত। শুধু কুয়োটি থেকে ১২০টি মৃতদেহ তোলা হয়েছিলো, যাঁরা প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার মধ্যে, তাঁদের।
----------------------------------------
প্রেস অ্যাক্ট লাগিয়ে যাবতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়ে এলো। অমৃতসরে সমস্ত বহিরাগত মানুষের প্রবেশ নিষেধ। দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ লোকমুখে কিছু খবর পেয়ে পঞ্জাব যাত্রা করলেন। তাঁকে প্রথমে অনুমতি দেওয়া হলেও অমৃতসরে পৌঁছোনোর আগেই ট্রেনে তাঁকে গ্রেফতার করে ফেরত পাঠানো হলো। নানাসূত্রে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু খবর কবির কাছে আসছিলো। তিনি অনুভব করছিলেন বড়ো কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু বিশদ খবর পাচ্ছিলেন না। এই ঘটনার পাঁচদিন পরে ১৮ই এপ্রিল গান্ধিজি সত্যাগ্রহীদের সংযমহীন কার্যকলাপে নিরুৎসাহ হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন। মন্তব্য করলেন " a blunder of Himalayan miscalculation"। অথচ গান্ধিজিকে এই আন্দোলনের কর্মপদ্ধতির সম্ভাব্য চ্যুতির কথা জানিয়ে কবি ১২ই এপ্রিল একটি চিঠি দিয়েছিলেন । কিন্তু গান্ধিজি নিজের রণকৌশল বিষয়ে এতো আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে কবির সাবধানবাণীর প্রতি কর্ণপাত করেননি। গত একশো বছর ধরে ইংরেজ প্রচারিত তথাকথিত সাম্যমূলক ন্যায়বিচার ও সমদৃষ্টির যে ভাঁওতা প্রচার করা হতো, গান্ধিজি তাতে কিছু হলেও বিশ্বাস করতেন। কবির এ বিষয়ে মন্তব্য "one continual lie, one perpetual deceit", গান্ধিজি ঠিক বিশ্বাস করতেন না। কবি আরো বললেন, "And today in 1919 the last shred of pretence at equality is thrown away and race insolence stands out stark naked for every one to see, in flogging Indians in their own public streets, in martial law proclamations that are frankly, brutally for Indians only, in aeroplanes bombing helpless villagers and machine guns firing on crowds armed only sticks." তিনি হয়তো আরো কিছু লিখতেন, কিন্তু সে চিঠি সেন্সরের কাঁচি পেরিয়ে গান্ধিজির কাছে কখনও পৌঁছোতো না। তাই এতোটাই লেখা হয়েছিলো।
------------------------------------
এই সময়টা কবি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। ২২শে মে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। শরীর খুব দুর্বল। মন আরো অস্থির। ২৮শে মে তারিখে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যখন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি যান, তখন দেখেন দোতলার বারান্দায় কবি ও সাংবাদিক অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বসে কিছু আলোচনা করছেন। তিনি অনুমান করেন পঞ্জাব বিষয়েই তাঁদের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে। স্মৃতিচারণে রামানন্দকন্যা সীতাদেবী'র মনে পড়ে তিনি যখন সেদিন কবি'র কাছে কুশলসংবাদ নিতে যা'ন তখন কবি বলেন, " যেরকম চারদিক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, ভিতরে ভিতরে পুড়ে পুড়ে কী করে ভালো থাকবো।" সেদিন সকালের কথা পাই কালিদাস নাগে'র ডায়রি'র সূত্রে। " ..... বিচিত্রায় এসে কবির সঙ্গে দেখা। Punjab ও present discontent সম্বন্ধে যে চিঠি পড়লেন, শুনে অবাক।" সম্ভবত কবি'র কাছে কোনও প্রত্যক্ষ সাক্ষীর চিঠি এসে পড়েছিলো সে সময়। পঞ্জাব ও জালিয়াঁওয়ালাবাগ সম্বন্ধে নানা সূত্র থেকে কবি'র কাছে খবর এসে পৌঁছোচ্ছিলো। রুচিরাম সাহনি'র থেকে অনেক প্রাসঙ্গিক কথা জেনে বনোয়ারিলাল চৌধুরী জোড়াসাঁকোয় কবি'কে এসে জানালেন। এই সব সংবাদ মানসিকভাবে কবি'কে এমন অস্থির করে তুললো যে প্রশান্তচন্দ্র তাঁরা মাতুল ডাক্তার নীলরতন সরকারকে ডেকে এনে কবি'র স্বাস্থ্যপরীক্ষা করালেন। ডাক্তার কবি'কে সম্পূর্ণভাবে শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম নিতে নির্দেশ দিয়ে গেলেন। শারীরিকভাবে তিনি তখন এতো দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে চলাফেরা করতে অসুবিধে হতো। সারাদিন একটি লম্বা চেয়ারে বিষাদগ্রস্ত হয়ে শুয়ে থাকেন। কথা-বার্তা, হাসি-গল্প, সব নিরুদ্দেশ। এই অবস্থায় অ্যান্ড্রুজসাহেব'কে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করলেন, পঞ্জাবে যা ঘটেছে তা নিয়ে দেশে কোনও প্রধান ব্যক্তিরা প্রতিবাদ করছেন না, এই ব্যাপারটা কবি'র অসহ্য বোধ হচ্ছে। তাঁকে নির্দেশ দিলেন গান্ধিজির সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কবি'র ইচ্ছা, কবি ও গান্ধিজি একসঙ্গে পঞ্জাব যাবেন এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য যদি ব্রিটিশ পুলিস তাঁদের গ্রেফতার করে, তবে সেভাবেই তাঁদের প্রতিবাদটি পৌঁছে দেওয়া হবে বর্বর শাসকের কাছে। অ্যান্ড্রুজসাহেব গেলেন গান্ধিজির সঙ্গে কথা বলতে। কবি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকেন অ্যান্ড্রুজ কতো দ্রুত গান্ধিজির সম্মতি নিয়ে ফিরে আসেন।
----------------------------------------
কয়েকদিন পর সকালবেলায় পুরোনো বাড়ির দোতলায় পশ্চিম বারান্দায় কবি বসে আছেন। অ্যান্ড্রুজ এসে বসলেন সেখানে। তাঁকে দেখেই কবি অধীরভাবে প্রশ্ন করলেন, " কী হোলো? কবে যাবেন?" অ্যান্ড্রুজ খুব শান্তভাবে বললেন, "বলছি... আপনার শরীর এখন কেমন আছে?" কবি বললেন, ওসব কথা এখন থাক। গান্ধিজি কবে যাবেন বলেছেন? একটুক্ষণ চুপ থেকে অ্যান্ড্রুজ বললেন, গান্ধিজি এখন পঞ্জাবে যেতে রাজি ন'ন। বলেছেন, " I do not want to embarrass the Government now." এই কথা শুনে কবি একেবারে নির্বাক। পরদিন সন্ধেবেলা প্রশান্তচন্দ্র একজন দর্শনপ্রার্থী'কে নিয়ে কবির কাছে বিচিত্রাভবনে দেখা করতে এলেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন কবি কোথাও বেরিয়েছেন। তিনি খুবই অবাক। কারণ সেইসময় রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতি'র কারণে তিনিই কবি'র জনসংযোগের মাধ্যম ছিলেন। তাঁকে না জানিয়ে কবি কোথাও যেতেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কবি ফিরলেন। খুব বিপর্যস্ত লাগছিলো তাঁকে। কথা বলতে যেন নিতান্ত অনিচ্ছুক। দর্শনপ্রাথী সজ্জন বুঝতে পেরে বিদায় নিলেন। কবি ডাকলেন, " প্রশান্ত, শুনে যাও।" তিনি আসার পর কবি বললেন, " তুমি কাল এখানে এসোনা।
-কেন?
-তা জানবার দরকার নেই। তোমাকে বারণ করছি। আমার কথা তোমাকে রাখতেই হবে। কাল তুমি এখানে আসবে না। আমি বারণ করে দিচ্ছি।"
কবি'কে এতো বিচলিত সচরাচর দেখা যায়না। কিছু না বলে প্রশান্তচন্দ্র ফিরে গেলেন।
-----------------------------------
রাতে তাঁর ভালো ঘুম হলোনা। ভোর আঁধারে আবার ফিরে গেলেন জোড়াসাঁকোয় । বুঝতে পারছিলেন না কেন কবি এতো অস্থির, বিচলিত ? নীচে থেকে দেখা গেলো দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। দারোয়ানদের ডেকে দরজা খুলিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকেই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলেন একটা টেবিলবাতি জ্বেলে কবি কিছু লিখছেন। প্রশান্ত ঘরে ঢুকতেই একবার তাকিয়ে বললেন, " কী এসেছো?" আবার লেখায় ডুবে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে লেখা কাগজটা তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, "পড়ো"। তিনি পড়লেন। তারপর কবি বললেন, " কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। ব্যস, এখন চুকলো। আমার যা করবার, তা হয়ে গিয়েছে। মহাত্মাজি রাজি হলেন না পঞ্জাব যেতে। কাল তাই নিজেই গিয়েছিলুম চিত্তরঞ্জনের কাছে। প্রশান্ত শুধোলেন, কী বললেন তিনি?
কবি চিত্তরঞ্জন'কে বলেছিলেন,
-এই সময় সারা দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে, এ অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদ সভা ডাকো। আমি নিজেই বলছি যে, আমি সভাপতি হবো...
চিত্তরঞ্জন একটু ভেবে বললেন,
-বেশ, আর কে বক্তৃতা দেবে?
- সে তোমরা ঠিক করো...
-আপনি যদি সভাপতি হ'ন, তবে তার পরে আর কারুর বক্তৃতা দেওয়ার দরকার হয়না...আপনি একা বললেই যথেষ্ট...
-তাই হবে। এবার তবে সভা ডাকো....
-আপনি একা যখন বক্তৃতা দেবেন, আপনিই সভাপতি, তখন সব চেয়ে ভালো হয় শুধু আপনার নামে সভা ডাকা।
কবি বুঝলেন রাজনীতিকদের দিয়ে কিছু হবেনা। প্রশান্ত'কে বললেন, " অথচ আমার বুকে এটা বিঁধে রয়েছে। কিছু করতে পারবো না, এ অসহ্য। আর আমি একাই যদি কিছু করি, তবে লোক জড়ো করার দরকার কী? আমার নিজের কথা নিজের মতো করে বলাই ভালো। এই সম্মানটা (নাইটহুড) ওরা আমাকে দিয়েছিলো। কাজে লেগে গেলো। এটা ফিরিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ্য করে আমার কথাটা বলবার সুযোগ পেলুম।
-------------------------------------------------
আকাশে ততোক্ষণে আলো ফুটেছে। অ্যান্ড্রুজসাহেব এলেন। বড়োলাট'কে তার পাঠানো আর খবরকাগজে দেবার কপি তৈরি করে তিনি বেরিয়ে গেলেন। রামানন্দবাবুকে একটা কপি দেওয়া হলো। কবি'র ধিক্কারের ভাষা ছিলো অগ্নিময়। সারা দেশের প্রধান রাজনীতিকরা যখন সরকারি আইন ও অপশাসনের চাপে নতিস্বীকার করে, কঠোর শাস্তির ভয়ে প্রতিবাদহীন মৌনতা অবলম্বন করেছে, তখন কবি সারা ভারতের আহত'বিবেকের ভূমিকায় নির্ভীক, দ্ব্যর্থহীন এক প্রতিবাদী অবস্থান নিয়ে অত্যাচারিত, অবমানিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। অ্যান্ড্রুজসাহেব নাকি চিঠির বয়ানটিকে একটু 'নরম' করার জন্য কবি'কে অনুরোধ করেছিলেন। তার উত্তরে কবি অ্যান্ড্রুজসাহেবের দিকে এমন চোখে তাকিয়েছিলেন যা তিনি সারাজীবন ভুলতে পারেননি। " Such a look as I had never seen in the eyes of Gurudev before or after." কালিদাস নাগ তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন কবির মুখে চিঠিটির বয়ান শুনে, " গায়ের রক্ত গরম হয়ে গেলো।"
------------------------------------------------
একটি চিঠি যে কোন পর্যায়ে জনমনে বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারে তার নমুনা আমরা এই সূত্রে দেখতে পেয়েছিলাম। সেগুলির মধ্যে অমৃতবাজার পত্রিকায় বিপিনচন্দ্র পালের 'Taking risk' শীর্ষক সম্পাদকীয় রচনাটি উল্লেখযোগ্য। সেখানে লেখক লিখেছিলেন " ....Under existing law in India, and in the present temper of authorities, common prudence would have certainly counselled silence in this case; and Rabindra Nath has undoubtedly done a rather risky thing in refusing to listen to it.... Rabindra Nath would indignantly repudiate such an appeal as an insult. But we ask the Government to take this view in its own interest only." সীতাদেবীর আত্মকথায় এই লেখাটিকে ' রবীন্দ্রনাথকে বাঁচাইবার জন্য বোকামিপূর্ণ প্রবন্ধ' বলা হয়েছে। জালিয়াঁওয়ালাবাগের ঘটনাক্রম প্রসঙ্গে তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া বিচার করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ট্র্যাডিশনটিকেই আজকের রাজনীতিকেরাও হুবহু বহন করে চলেছেন। এসব 'ছোট্টো' ঘটনার প্রতি কথিত 'common prudence' অনুযায়ী অবস্থানই নিয়েছিলেন গান্ধিজি, চিত্তরঞ্জন, বিপিনচন্দ্রের মতো 'দেশবরেণ্য' জননেতারা। 'সোনার ঠাকুর, মাটির পা' জাতীয় প্রবাদ এভাবেই জন্ম নেয়। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন "... মানুষ এতো দুমুখো হতে পারে? আশ্চর্য।" এই লেখাটি পড়ে কবি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, " আমাকে এমন অপমান কেউ কখনও করেনি।" এর সঙ্গেই আবার একটি বাংলা সংবাদপত্রে সরাসরি সারল্যে লেখা হয়েছিলো, " .... উপাধিনির্মুক্ত হইয়া রবীন্দ্রনাথ এখন মেঘমুক্ত রবির ন্যায় প্রোজ্জ্বল হইয়া উঠিলেন। ..... সমগ্র দেশ যে সময় নির্বাক, ভীত, সকলেই যে সময় 'চাচা আপনা বাঁচা' নীতির আশ্রয় লইবার জন্যই ব্যস্ত ঠিক সেই সময়েই রবীন্দ্রনাথ সকল লজ্জা ভয় ভাবনা পরিত্যাগ করিয়া অগণিত মূক জনসঙ্ঘের গভীর বেদনা এক অপূর্বভাবে প্রকাশ করিয়া যে অনন্যসাধারণ স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দিলেন তাহা ইতিহাসে বিরল।" ঘোষিত রবীন্দ্রবিরোধী পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'নায়ক' পত্রিকায় লিখলেন, " রবীন্দ্রনাথ উপাধিবর্জন করিয়া নিজের সুবিধা কি করিয়াছেন তাহা জানিনা, দেশের ও জাতির যে কোন সুবিধা করিতে পারেন নাই, তাহাই বলিব। আমরা তাঁহার কার্যের সমর্থন করিতে পারিলাম না।"
-------------------------------------------
এই চিঠি লেখার সময় কবি সচেতন ছিলেন, রাওলাট আইন অনুমোদিত হয়ে গিয়েছে। সে অবস্থায় সরকার তাঁকে অনায়াসে গ্রেফতার করতে পারেন। এমনই ইঙ্গিত সে সময় সোলানস্থিত রাণু অধিকারীকে নিজস্ব সরস ভঙ্গিমায় দিয়েও ছিলেন। রবীন্দ্রবিরোধিতায় অগ্রণী সুরেশচন্দ্র সমাজপতি কিন্তু কবিকে লিখেছিলেন, " শ্রীচরণকমলেষু, এই ত তোমার যোগ্য কথা"। আচার্য জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন, " বন্ধু, তুমি ধন্য।" মৃত্যুশয্যায় শায়িত আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী কবি'কে অনুরোধ পাঠান, তিনি যেন নিজে এসে ঐ চিঠিটি তাঁকে পড়ে শোনান। কবি ২রা জুন সকালে রামেন্দ্রসুন্দরের শয্যাপার্শ্বে বসে মূল চিঠিটি তাঁকে পড়ে শোনান। রামেন্দ্রসুন্দর নীরবে কবির পদধূলি গ্রহণ করেন। কবি তাঁর বাড়ি থেকে নিষ্ক্রান্ত হতেই রামেন্দ্রসুন্দর তন্দ্রানিমগ্ন হয়ে পড়েন। সেই তন্দ্রাই তাঁর মহানিদ্রা হলো। ৬ই জুন, মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তিনি তিরোহিত হলেন।
-----------------------------------------------
কবির তরফ থেকে এবং শুধুমাত্র তাঁরই তরফ থেকে এ জাতীয় প্রতিবাদে সরকারি ও সরকারপদলেহী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রেস উভয়েই সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো। ইংলিশম্যান পত্রিকা লিখেছিলো, " As if it mattered to the reputation, the honour and the security of British rule and justice whether this Bengali poet remained a knight or a plain Babu." বড়ো লাট চেমসফোর্ড ভারতসচিব মন্টেগু'কে ১১ই জুন একটি প্রাইভেট টেলিগ্রাম পাঠান। " A letter dated 31st May has been addressed to me by Rabindranath Tagore announcing his desire to resign Knighthood, which was conferred on him in June 1915, as a protest against the policy followed by the Government in dealing with the recent troubles in the Punjab. He, however, communicated it to the press before its receipt here. ......... the title can, it is presumed, only be revoked by His Majesty by whom it was granted. I propose to reply, in view of the advertisement that would be given to Tagore and of the fact that grant of his request might be interpreted as admission of mistaken policy in the Punjab, that I am unable myself to relieve him of his title and, in the circumstances, do not make any recommendation to His Majesty on the subject...."
এইভাবে চিঠিটি পাবার দশদিন পর বড়োলাটের আপ্তসহায়ক একটি প্রাপ্তিস্বীকার পত্র পাঠিয়ে দেন। তার পর নানা সরকারি আমলারা বহু চিঠিচাপাটি করার পর বড়োলাট সাহেবের উক্ত আপ্তসহায়ক সিগনেল সাহেব ২০শে জুন কবি'কে একটি চিঠিতে জানান। " ...His Excellency the Viceroy is unable himself to relieve you of your title of Knighthood, and that, in the circumstances of the case, he does not propose to make any recommendation on the subject to His Majesty the King Emperor." এভাবেই চতুর ইংরেজ রাজশক্তি সরকারিভাবে গোটা ব্যাপারটির উপর যবনিকা টেনে দেয়। তাদের চাতুর্যের আরো একটা নির্দশন এক্ষেত্রে চোখে পড়ে। তারা সফল হয়েছিলো তাদের পরীক্ষিত ছলনা পদ্ধতি দিয়ে তৎকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিজেদের পক্ষে টেনে নিতে। তাদের এই ছলনার স্বরূপ বুঝতে আমাদের রাজনীতিকদের অনেক সময় লেগে গিয়েছিলো। যখন তাঁরা সচেতন হতে পেরেছিলেন, ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। এমন কি গান্ধিজি ৬ই জুন শ্রীনিবাস শাস্ত্রী'কে লেখেন, " The Punjab horrors have produced a burning letter from the Poet. I personally think it is premature. But he can not be blamed for it." সরকারি সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ নিজে এবং তাঁর অনুসারীরা তাঁর নামের সঙ্গে স্যার বা ডঃ আখ্যা চিরদিন বর্জন করে চলেছেন। ব্যতিক্রম ছিলো হিজ ম্যাজেস্টি'জ অনুগত প্রজারা। তারা চিরকাল কবির নামের সঙ্গে স্যার উপাধি লিখে গেছে। আশ্চর্য হতে হয়, অন্যে পরে কা কথা, গান্ধিজি'ও বহুদিন পর্যন্ত কবিকে 'স্যার' বিভূষণে সম্বোধিত করেছেন। ১৯২৫-২৬ সালে 'The Poet and the Charka' শীর্ষক একটি রচনায় গান্ধিজি কবি'র নামের সঙ্গে 'স্যার' উপাধি ব্যবহার করায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও সুবোধচন্দ্র বসু তীব্র প্রতিবাদ জানান। এই বিতর্কের সূত্রে কবি সেই সময় ' Rabindranath Tagore and Knighthood' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে লেখা হয়, " ......in regard to my Knighthood, I feel it right to put clearly my own view of it before the public. It is obvious that it was solely to give utmost emphasis to the expression of my indignation at the Jallianwallaa Bagh massacre and other deeds of inhumanity that followed it that I asked Lord Chelmsford to take it back from me. If I had not fully realised the value of this title , it would have been impertinent on my part to offer it as a sacrifice when such was needed in order to give strength to my voice. ...... I was driven to it when I hopelessly failed to persuade our political leaders to launch an adequate protest against what was happening at that time in the Punjab......... I do not like any addition to my name, Babu or Sriyut, Sir or Doctor, or Mr.., and, the least of all, Esquire. A psycho-analyst may trace this to a sense of pride in the depth of my being and he may not be wrong."
------------------------------------------------
দেশের বৃহৎ ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আচার্য জগদীশচন্দ্র ব্যতিরেকে কেউ কবির পাশে এসে দাঁড়াননি। তাঁকে চূড়ান্ত অসম্মান করা হয় ১৯১৯ সালেই আয়োজিত অমৃতসর কংগ্রেস অধিবেশনে। সেখানে তিনদিন ধরে নানা রাজনীতিক গরম গরম বক্তৃতা দিয়েছিলেন ইংরেজ রাজশক্তি'র অত্যাচার ও বর্বরতা নিয়ে। কিন্তু একবারও কবি'র প্রতিবাদের উল্লেখ করা হয়নি। শুধু স্বামী শ্রদ্ধানন্দ একবার কবির নাম উল্লেখ করেছিলেন অতি সংক্ষেপে। আজ আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, সেই সময় কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে বাঙালিরা ছিলেন বৃহৎ অংশ। তবু তাঁরা কবির এই প্রতিবাদ নিয়ে সম্পূর্ণ মৌন থাকাই শ্রেয় বোধ করেছিলেন। ২৫শে জুন তারিখে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন, " আমাদের কতো দুঃখ, কতো যে দায়িত্ব তার সীমা নেই---অথচ আমরা শুধু দুঃখটাই বহন করে চলেছি, দায়িত্বকে গ্রহণ করছিনে , এইটেতে আমরা কেবল নেমে যাচ্ছি........ এতদিন এই নিয়ে কেবলি লড়াই করেছি এবং দেশের লোকের কাছ থেকে নিয়ত মার খেয়েচি।"
------------------------------------------
বহুদিন হয়ে গেলো। ১৯৬৯ সালে কবির'র নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের পঞ্চাশবর্ষ পূর্তি হিসেবে আমাদের শহরে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছিলো। আমার প্রয়াত পিতৃদেব ছিলেন এই আয়োজনের একজন উদ্যোক্তা ও প্রধান বক্তা। আমি তখন নিতান্ত বালক। কিন্তু পারিবারিকসূত্রে এই সব অনুষ্ঠানে জ্ঞানবয়স থেকে থাকার সুযোগ পেতুম। সেদিন সভায় যে সব কথাবার্তা হয়েছিলো তার অধিকাংশই ঠিক বোধগম্য হয়নি। পরে পিতৃদেবের কাছে প্রশ্ন করে করে কিছু জানা হয়ে গিয়েছিলো। তবে যে অনুভূতিটি এখনও ভুলিনি সেটি আমার পিতৃদেবের এই ঘটনা প্রসঙ্গে কবি'র অসম্মানজনিত ক্ষুব্ধ আক্ষেপ। তাঁরা ভাবতেন একদিন কবির এই প্রতিবাদ মানুষের কাছে উপযুক্ত স্বীকৃতি পাবে। নানা নৈরাশ্যের মধ্যে তাঁদের এই আশাবাদ যথেষ্ট প্রখরভাবে বিরাজমান ছিলো। কিন্তু বস্তুতঃ ঘটেছে ঠিক বিপরীত। সেদিন এক যথেষ্ট আলোকপ্রাপ্ত, শিক্ষিত বাঙালি বন্ধু বললেন কবি নাকি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রশ্ন করি, কেন? তিনি জানান গান্ধিজিকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে। তিনি আমাদের প্রজন্মের মানুষ। যদি এই অবস্থা হয়, তবে তাঁর সন্ততিরা কোন অবস্থানে আছে ভাবতে অবসাদ বোধ করি। তখনই এই লেখাটি মাথায় আসে। যদিও এই নিয়ে অনেক কথা বলা বা লেখা হয়েছে, কিন্তু তা মোটামুটি অ্যাকাডেমিক বাতাবরণে। আমাদের মতো ইতরজনদের জন্য এই নিয়ে মূলস্রোতের ইতিহাস একান্ত মৌন। আবার যখন এই মূহুর্তে জালিয়াঁওয়ালা বাগের প্রামাণ্য ইতিহাসগ্রন্থগুলি নিয়ে পড়তে বসি, সেই ঘটনায় ব্রিটিশ শাসকের হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা নিয়ে প্রায় একশো বছর পরেও তড়িৎস্পৃষ্ট হয়ে যাই। বিস্মিত হইনা ইংল্যান্ডে জেনারেল ডায়ার'কে দেওয়া তার দেশবাসীর অভ্যর্থনায়। কিন্তু স্তম্ভিত করে এই ঘটনার প্রতি আমাদের নেতৃবৃন্দের সামূহিক অবহেলা ও ঔদাসিন্য। শুধু কবিই সেদিন সম্মান রেখেছিলেন সমগ্র জাতির আত্মগৌরব, আত্ম উপলব্ধির।
তিনি যে শুধু পঁচিশে বৈশাখ ন'ন, তার প্রমাণ আরেকবার পেয়ে যাই, এভাবেই।
লেখক পরিচিতঃ শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।