বিবিধ প্রসঙ্গ
অক্টোবর ৩০, ২০১৬
বৈষ্ণব ধাম নবদ্বীপ ও “পোড়া-মা” ভবানী
সুশান্ত কুমার মুখোপাধ্যায়
বাংলাদেশের ইতিহাসে নবদ্বীপ-এর নাম আজ প্রায় হাজার বছর ধরে জড়িত। সাধারণভাবে, নবদ্বীপ মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবভূমি নবদ্বীপ-ধাম হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করে ষোড়শ শতাব্দী থেকে। কিন্তু নবদ্বীপ বাংলার ইতিহাসে এমনই একটি উজ্জ্বল নাম যে একসময়ে একে "অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গল" বলা হত। কারণ নবদ্বীপ পূর্বাঞ্চলের মধ্যে এক অগ্রগণ্য শিক্ষার স্থান ছিল। তৎকালীন সময়ে বেনারসের পরেই সংস্কৃত শিক্ষা ও চর্চাভূমি ছিল নবদ্বীপ।
সেই একাদশ শতকে সেন রাজাদের আমল থেকেই নবদ্বীপ তাই এক বিশেষ মহিমায় আসীন। চৈতন্যদেবের জন্ম ও বৈষ্ণবধর্মের প্রবক্তা হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ার পর নবদ্বীপ প্রধানতঃ বৈষ্ণৱ তীর্থভূমি হিসেবেই অতি পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাস ও স্থানীয় লোকেদের সাথে আলোচনা করলেই জানতে পারা যায় নবদ্বীপ আশ্চর্যজনকভাবে বৈষ্ণব ও শাক্তের মিলনভূমি। শাক্ত বা মা কালিকার ভক্তদের তথা সবরকমের ভক্তিপ্রবণ মানুষের কাছে যে জাগ্রত দেবীর মাহাত্ম্য-কাহিনী শোনা যায় তাঁর নাম "পোড়া-মা ভবানী" । অনেক লোককাহিনী তো আছেই নবদ্বীপ-এর এই "পোড়া-মা ভবানী”-কে নিয়ে, তার সঙ্গে ইতিহাসসূত্রেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
নবদ্বীপ শহর ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে, ভাগীরথী ও জলঙ্গীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। নবদ্বীপ নাম হয় নয়টি দ্বীপ - রুদ্রদ্বীপ, বদ্রুদ্বীপ, সীমন্তদ্বীপ, অন্তর্দ্বীপ, মধ্যদ্বীপ, গোদ্রুদ্বীপ, জাহ্নুদ্বীপ, ঋতুদ্বীপ ও মাদাদ্রুদ্বীপ-এর সমাবেশে। তবে অনেকের মতে সেই নবদ্বীপ চলে গেছে অধুনা বাংলাদেশে রাজশাহী অঞ্চলে, যদিও স্থানীয় লোকেদের মতে নদীয়ায় গঙ্গাতীরে নবদ্বীপ এইভাবেই তৈরী হয়। নয়টি দ্বীপ মিলে একটি শহর ভাবতে যেমন অবাক লাগে তেমনি কিংবা তারও বেশী অবাক লাগে, যখন জানা যায় কীভাবে বৈষ্ণব, শাক্ত এবং শৈব ভক্তদের সুন্দর সহাবস্থান ঘটেছে বিদ্যাচর্চার এই পীঠস্থানে।
পনেরো শতাব্দীর কথা। বৃহদ্রথ নামে এক তন্ত্রসাধক ও সিদ্ধ সন্ন্যাসী বাস করতেন নবদ্বীপে। তিনি একসময়ে এখানকার এক বনের মধ্যে দেবী কালিকাকে স্থাপন করলেন একটি ঘটে। সেই ঘটেই তিনি দেবীর নিত্যপূজা করতেন নিষ্ঠাভরে, যথানিয়মে। কালের নিয়মে একদিন দেহ ছাড়লেন সন্ন্যাসী বৃহদ্রথ। সেইসময়ে নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌম যাঁর পিতামহ ছিলেন বৃহদ্রথের মন্ত্রশিষ্য। বৃহদ্রথের প্রয়াণের পর পূজার দ্বায়িত্ব পেলেন বাসুদেব। তিনি বন থেকে দেবীর ঘটটি এনে নবদ্বীপের কেন্দ্রস্থলে একটি বৃক্ষতলে পুনঃস্থাপন করে সেখানে তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করলেন এক চতুস্পাঠী, তাঁর নিজস্ব পরম্পরা বজায় রেখে। পরবর্তী সময়ে দেবীর সেবার ব্যবস্থা করলেন নদিয়ার রাজবংশ। বাসুদেব সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত সেই মা-কালিকা স্বরূপিণী ঘটে নিত্যপূজা ও ভক্তসমাগম ঘটত সেই বৃক্ষতলে। হঠাৎ একদিন প্রচন্ড অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেলো বৃক্ষটি, শোনা যায় আগুন লেগেছিলো বাজ পড়ে। সেই থেকে দেবী হয়ে গেলেন “পোড়া-মা ভবানী”।
এরপরে নবদ্বীপ বাজারের মধ্যে প্রাচীন একটি বটগাছের গোড়ায় ছোট্ট একটি মন্দিরে স্থাপিত হয় সেই কালিকা-মাতা ঘট এবং চলতে থাকে আগের মতোই নিষ্ঠাভরে নিত্যপূজো। প্রাচীন বট তার শাখা প্রশাখা ও হামাগুড়ি দেওয়া অজস্র গুঁড়ি দিয়ে যেন একদিকে তৈরি করেছে এক মন্দির আবার অন্যদিকে আগলে রেখেছে মা-কে। তাই এই জায়গা হয়ে গেছে ‘পোড়া-মা’তলা ও পোড়া-মা র “থান”। সেবায়েতদের কাছেই জানা যায় দক্ষিণ কালিকার নিয়মনীতি ও পূজা পদ্ধতিতেই পূজিত হন দেবী পোড়া-মা ভবানী। অগ্নিকাণ্ডটি সঠিক কোনসময় ঘটেছিলো সেই নিয়ে অনেক মতামত থাকলেও বৃক্ষমন্দির-এ যে আগুন লেগেছিল সে সম্বন্ধে সবাই একমত।
যদিও একটা বিষয় খুব অদ্ভুত এবং লোককাহিনীর রহস্য যে প্রথম থেকে জানা গিয়েছিলো কালিকা-মাতা রূপে ঘট-এই হতো পূজা। কিন্তু শুধু নবদ্বীপ নয়, আরো বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একই কথা বলেন যে অগ্নিকাণ্ডে মা-কালিকার মুখ পুড়ে যাওয়ায় তারপর থেকে মা "পোড়া-মা ভবানী" বলে আখ্যাতা হন। যদিও তাতে ভক্তিপ্রদর্শন এবং দর্শন বিন্দুমাত্র তো কমেইনি, বরং নিত্যদিনই যেন মায়ের জাগ্রত ও কল্পতরু আখ্যান বেড়েই চলেছে। বিগ্রহবিহীন মন্দির ফুল মালা ও ভক্তসমাবেশে প্রতিদিনই থাকে সুসজ্জিত ও পূর্ণ। দূর-দূরান্ত থেকে সদাজাগ্রত ও আশা পূরণ দেবীর দর্শনে আসে অসংখ্য পুণ্যার্থী এই নবদ্বীপধামে।
পোড়া-মা দেবীর সঙ্গে এক হয়ে গেছেন দেবী ভবতারিণী। পোড়া-মা থানের পাশাপাশি দুটি মন্দির বা রত্নমন্দির, একদিকে “ভবতারণ” ও অন্যদিকে “ভবতারিণী”। শোনা যায় এই দুটি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮২৫ সাল, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশধর নদীয়া-রাজ গিরিশচন্দ্র রায় স্থাপন করেছিলেন ভবতারণ ও ভবতারিণীর বিগ্রহদ্বয়। গর্ভমন্দিরে স্থাপিত ভবতারণ যা এক বিশাল শিবলিঙ্গ। এই শিবলিঙ্গ সম্পর্কে প্রচলিত আছে পরম্পরাগত ইতিহাস। এক সময় নদীয়ার রাজা রুদ্র রায় নবদ্বীপে গঙ্গাতীরে এক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাঘবেশ্বর নামে শিবলিঙ্গ। কালক্রমে গঙ্গার ভাঙ্গন ধরে এবং আগ্রাসী গঙ্গার স্রোতে ধ্বংস হয় মন্দির। তখন শিবলিঙ্গটিকে রক্ষা করার জন্য পুঁতে রাখা হয় গঙ্গাতীরবর্তী একটি স্থানে। রাজা গিরিশচন্দ্র পোড়া-মা তলার পাশে রত্ন-মন্দিরে এই শিবলিঙ্গটিকে প্রতিষ্ঠা করেন "ভবতারণ" নাম দিয়ে। ভবতারিণী কালিকা মায়ের আর এক রূপ, আর এক নাম। ভবতারিণী মূর্তি নিয়ে আরো রোমাঞ্চকর লোককাহিনী প্রচলিত। ভবতারিণী মূর্তিটি নাকি আগে গনেশ মূর্তি ছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা রাঘব রায়। একসময়ে সেই গণেশমন্দিরও রাঘবেশ্বর শিবের মন্দিরের মতো গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হয়। পরে কিভাবে শুঁড়ভাঙা অবস্থায় মূর্তিটি উদ্বার করেন রাজা গিরিশচন্দ্র। তারপর নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজের মত নিয়ে অঙ্গহীন বিগ্রহটিকে ধ্যানানুযায়ী ভবতারিণী মূর্তিতে রূপ দেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন বহুখ্যাত পোড়া-মা'তলার মন্দিরে।
পোড়া-মা তলায় এই দেবী বিগ্রহ এক অনন্যসাধারণ অন্যরূপা। বিশাল ফালা-ফালা চোখ ও ও লকলকে জিভ হলেও মা বসনপরিহিতা এবং তাঁর হাতে নেই খাঁড়া। মা বাবু হয়ে বসে আছেন শিবের বুকের ওপর। দেবীর নিতম্বের নীচে সদাশিব শুয়ে আছেন হাত ও হাঁটু মুড়ে আরাম করে কাত হয়ে শুয়ে থাকার ভঙ্গিমায়। সুন্দর ভাবে সাজানো সেই অপূর্ব বিগ্রহ।
এইভাবেই নবদ্বীপ হয়ে গেছে কৃষ্ণ ও কালী ভক্তদের মিলনস্থল অর্থাৎ বৈষ্ণব ও শাক্ত দুই-এরই পীঠস্থান। বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে দোলপূর্ণিমা, রথযাত্রা, রাসযাত্রার তীর্থক্ষেত্রে পোড়া-মার মহিমা এবং প্রভাব এতটাই যে রাসযাত্রার নবমীর দিন সমস্ত শোভাযাত্রা পোড়া-মা মন্দির ঘুরে যায়। লক্ষণ সেন বল্লাল সেন আমলের রাজধানী নবদ্বীপের গরিমাময় ইতিহাস মনে না থাকলেও ভক্তিরসের মহাক্ষেত্রে চৈতন্যজন্মভূমিতে পাশাপাশি পোড়া-মা ভবানী ও মা ভবতারিনীর দর্শনক্ষেত্র হিসেবে অজস্র ভক্তের মনে এর আকুতি আকর্ষণ অনেক।
লেখক পরিচিতি: সুশান্ত কুমার মুখোপাধ্যায়- বয়স ৮৮। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও আইনের স্নাতক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদ থেকে অবসর-এর পর থেকে লেখার প্রতি সবিশেষ আগ্রহ। ভারত ও আমেরিকার সংবাদপত্রে ও পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।