নারী
মার্চ ১৫, ২০১৪
আলোর খোঁজে
কেয়া মুখোপাধ্যায়
আরো একটা আন্তর্জাতিক নারীদিবস চলে গেল।
প্রতিবছর নারীদিবস এলে কিছু প্রশ্ন খুব শোনা যায়। তাহলে কি ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন পুরুষদিবস আর এই ১ দিন পুরুষদেরই করুণায় নারীদিবস? মুখে প্রগতিশীলতার কথা বলেও নারীর জন্যে এভাবে একটা দিন সংরক্ষণ করাটা কি নারীর মধ্যে তীব্রভাবে বেঁচে থাকা ‘মানুষ’ সত্ত্বাটির পক্ষে চূড়ান্ত অবমাননাকর নয়? ৩৬৫ দিনই ‘মানবদিবস’ এই ভাবে কেন ভাবতে পারি না সকলে?
একটামাত্র দিন কেন, বিশ্ব নারী আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ১৯৭৫ থেকে ৮৫ এর গোটা দশকটিকেই আন্তর্জাতিক নারী দশক ঘোষণা করেছিলেন। নানা ‘থিম’ নিয়ে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন করা হয়ে চলেছে প্রতিবছর। কিন্তু সমাজে নারীর অবস্থা কি পাল্টেছে খুব একটা? উত্তরটা আমরা সবাই জানি, না! তাই এবছর রাষ্ট্রসঙ্ঘ আবারো বলেছিলেন নারীর ক্ষমতায়নের কথা। নারীর ক্ষমতায়ন হলে তবেই নাকি মানবতারও ক্ষমতায়ন: “Empowering Women, Empowering Humanity!”
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজের বৃহত্তর অংশ আজও নির্যাতন আর বঞ্চনায় বিপর্যস্ত। অধিকাংশ সমাজ ব্যবস্থাই পুরুষ প্রধান। সামাজিক বিধিনিষেধই হোক কিংবা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ- সবই পুরুষদের হাতে। তাই কবি যতই বলুন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক নর”, নারীকে এই স্বীকৃতিটুকু সমাজ কিন্তু দেয় না। মেয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়াটাই এখনো অনেকের কাছে অপরাধ! যদি বা কষ্টেসৃষ্টে ভ্রূণ অবস্থায় আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার থেকে সে বেঁচে যায়, তবু সে নেহাতই ‘মেয়ে’ একজন, মানুষ নয় মোটেই। সিমোন দ্য বোভোয়ারের কথায়, ‘মেয়েরা নারী হয়ে জন্মায় না, তাদের নারী হিসাবে গড়ে তোলা হয়।’ আস্তে আস্তে হাঁটো, আস্তে আস্তে নিচু স্বরে কথা বলো, লাফিও না, দৌড়িও না, বাইরে জুজু আছে, যেও না- এইরকম অজস্র “না”-এর ঘেরাটোপে আটকে পড়ে সেই মেয়েদের জীবন, ছোট্ট থেকে। তারপর সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে, বাবা-ভাই—স্বামী-পুত্র- এঁদের পরিচয়কে আর শাসনকে মানতে মানতে বেশিরভাগ মেয়েরা হয়ে যায় এক একটা পরিচয়হীন অস্তিত্ব।
আসলে নিরাপত্তার আশ্বাস মেয়েদের কেউ দেয় না, না পরিবার, না সমাজ, না রাষ্ট্র! অথচ নিগ্রহের শিকার হলে, তার দিকেই আঙুল তোলে সবচেয়ে আগে। নারী মানেই যেন যৌনতার ভাষ্য, তার মনের কোন স্বীকৃতি নেই। ব্যক্তিগত শারীরিক লালসাই হোক কিংবা কোন পারিবারিক সম্পত্তিগত বিবাদ-বিসংবাদের জের, আক্রোশ মেটাবার কিংবা প্রতিশোধস্পৃহার সহজ শিকার হয়ে পড়ে নারী। সপ্রতিভ মেয়ে থেকে নিরীহ গৃহবধূ, হতদরিদ্র কাগজকুড়ুনি থেকে মূক-বধির তরুণী, স্কুল ছাত্রীকে থেকে শিশু- নারী-হিংসা থেকে রেহাই নেই কারোর। কোন মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলে তার কথার যাবতীয় সত্যতা প্রমাণের দায় একমাত্র তারই ওপর বর্তায় (যদিও সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এর বিপরীত বিন্দুতে), কত সহজে তাকেই ‘খারাপ’ কি ‘নষ্ট’ বিশেষণে দেগে দেওয়া যায়! ধর্ষকের চরমতম অপরাধও কত অনায়াসে পাল্টে যায় ধর্ষিতার লজ্জায়। ধর্ষণের পরেও এইভাবে শুরু হয় আর এক রকম ধর্ষণ, সমাজের। শুধু পুরুষরাই নন, অনেক নারীও তুমুল আগ্রহে ধর্ষিতার পেশা, জীবনযাত্রার ধরণ, পোশাক-আশাক, বিয়ের সুলুকসন্ধান ইত্যাদি করে শেষ অবধি নারীটিকেই অনায়াসে দোষী সাব্যস্ত করে স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। এই নারীরাও আসলে পুরুষতন্ত্রেরই মুখ।
“হে ধর্ষিতা, তুমি জান, শরীর কোথায় শেষ হয়
কোথা থেকে শুরু হয় অদ্ভুত, দ্বিতীয় অপমান...”
(যশোধরা রায়চৌধুরী)
সমাজের এই ভয়ানক দ্বিতীয় অপমান মেয়েদের জীবন তছনছ করে দেয়, বেদনার দীর্ণতায় ভরে দেয় মেয়েদের অস্তিত্বকে। অপমানে পুড়তে পুড়তে ক্ষয়ে যেতে থাকে মেয়েদের বাইরের সব শক্তি, ভেতরের সব অঙ্গীকার, কুঁকড়ে যেতে থাকে তারা ক্রমশ।
২০১২-র ১৬ই ডিসেম্বরে দিল্লি গণধর্ষণের পরে দিল্লি আর দেশের অন্যান্য শহর দেখেছিল এক অভূতপূর্ব জনজাগরণ। দেশ জুড়ে সেই আন্দোলনকে জিইয়ে রেখে নারীসুরক্ষার দাবির পাশাপাশি ধর্ষক ও নারী-অত্যাচারীর কড়া শাস্তির দাবি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রকে যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। আবার এটাও বাস্তব যে নির্ভয়া জ্যোতি সিং পান্ডের নৃশংস ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের প্রবল চাপেও কিন্তু কামদুনির অপরাজিতা বা মধ্যমগ্রামের কিশোরীর বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু রক্ষা পায়নি৷ ধর্ষণের শিকার হয়ে ‘অপরাধ’ করেছিল মধ্যমগ্রামের কিশোরীটি৷ বাড়িওয়ালা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে, ওই ‘অপরাধ’-এর পরে আর তাকে পাড়ায় থাকতে দেওয়া যায় না৷ তাই আগুনে পুড়তে পুড়তে সে বলেছিল,
‘মা আর বাঁচতে চাই না৷ তুমিও পুড়ে মরে যাও৷ তুমিও তো মেয়ে!’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ আর বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২০ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন৷ আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ ২০১৪-র প্রথম আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷
কি দিশেহারা আতঙ্ক তাহলে মেয়েদের নিত্য সহচর! অল্প চেনা থেকে অতিপরিচিত, এমনকী নিকটতম পুরুষ বন্ধুটিকে ঘিরেও সম্পর্কের নামে সর্বদা সন্দেহের পাঁচিল তুলে রাখতে হবে মেয়েদের, এমনই গভীর ট্রাজেডি! এ ভাবে কি বাঁচা যায়?
সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’ তথ্যচিত্রে দিল্লির নৃশংস ধর্ষণকান্ডের অপরাধী মুকেশ সিং অনায়াসে ভাবলেশহীন মুখে বলেছেঃ ‘ধর্ষণের সময় বাধা দিয়ে মেয়েটা ভুল করেছে', ‘ও চুপচাপ থাকলে আমরা ‘কাজ সেরে’ ওকে ফেলে রেখে চলে যেতাম’, ‘আমাদের যদি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তা হলে এর পর কেউ ধর্ষণ করলে মেয়েটাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে!’
আর ক্যামেরার সামনে আইনজীবীরা কী বললেন? আইনজীবী এ পি সিং এর কথাঃ “আমার মেয়ে বা বোন যদি বিয়ের আগে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তা হলে তাকে আমার বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সব আত্মীয়স্বজনের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেব,” আর আইনজীবী এম এল শর্মা-র বক্তব্যঃ “lady should not be put on road like food!...We have the best culture. In our culture, there is no place for a woman.”
‘নির্ভয়া’ জ্যোতি সিং ইন্ডিয়া’জ ডটার, ভারতের মেয়ে। এই মুকেশ সিং, এ পি সিং, এম এল শর্মা-ও যে একইভাবে ‘ভারতের পুরুষ’! আর এরা কিন্তু একা নয়। অনেক পুরুষের, অনেক তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পুরুষের মনে চেপে রাখা আসল কথাটা এরা বলে দিয়েছে।
আর শুধু এঁরা কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অবলীলায় বলেছিলেন, "জনসংখ্যা বেড়েছে, ধর্ষণ তো বাড়বেই''৷ আমরা কি তা ভুলে গেছি? ভারতের পুলিশ মেয়েদের রাতে ঘর থেকে না বেরোনোর উপদেশ আর ‘শোভন' পোশাক পরার পরামর্শ দিয়েছেন- তাও কি মনে নেই আমাদের? মনে নেই কি পুরুষমনে পরিবর্তন আনতে চেয়ে নরেন্দ্র মোদী কে স্বাধীনতা দিবসে বলতে হয়েছিল,
‘‘মেয়েদের বাইরে যেতে বাধা দেওয়ার বদলে বাবা মায়েদের উচিত নিজেদের ছেলেদের উপর নজর রাখা৷ ”
নির্ভয়া জ্যোতি মারা যাবার পর এক দরদী রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন, “ভালই হয়েছে, মেয়েটা মরে বেঁচেছে। নইলে জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে থাকত।”
স্বাধীন একটি দেশে মেয়েদের অবস্থা বুঝতে তারপরও কি আর কিছু বাকি থাকে? এর পাশাপাশি যখন দেখি দশটা মন্দিরের মধ্যে সাতটাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে দেবী মূর্তি আর সকাল সন্ধ্যায় ধুপ ধুনো, ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো হচ্ছে, পরিহাস বলে মনে হয় না কি একবারও? মনে হয় না, নারী অধিকার, নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা শুধু কথার কথা?
নির্যাতিত মেয়ে যে ‘জিন্দা লাশ’, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেক মানুষের এই মনোভাবটাই নির্যাতিত মেয়েটির বেঁচে থাকার পক্ষে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এটা আমাদের সমাজের মানসিক বিকার। আর এই বিকারগ্রস্ত সামাজিক মনোভাবই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেও ভাবতে বাধ্য করে তার হয়তো মরে গেলেই ভাল হত! শুধু ধর্ষকের শাস্তিতেই সব দায়িত্ব শেষ নয়, সমাজের এই ভয়ানক ব্যাধি আর মানসিক বিকারকে পাল্টানোটা খুব জরুরি।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবছর বলেছেনঃ "Planet 50-50 by 2030. Step it up for Gender Equality।"
আগামী ১৫ বছরে কেন, সত্যি সত্যি কি কোনদিন লিঙ্গবৈষম্য দূর হবে? গণতন্ত্রের প্রভাবে মেয়েদের সমান অধিকার স্বীকার করেও যুগ যুগ ধরে চলে আসা সব ধারণা থেকে সমাজ আজও মুক্ত হল না৷ সমাজে সংসারে সর্বত্র পৌরুষের প্রবল প্রভাব আজও। কর্মক্ষেত্রে আজকাল নারী-পুরুষের সমান অধিকার, যোগ্যতা অনুসারে যে যার কাজ করেন, তবু সেখানেও নারীকে কিছুটা ছোট করে রাখার প্রবণতা বিরল নয়৷ শুধু অনুন্নত কি উন্নয়নশীল দেশ নয়, খোদ আমেরিকাতেও অনেক জায়গায় মেয়েদের বেতন সমান পোস্টের ছেলেদের থেকে কম। এই কারণে কিছুদিন আগেই ওয়ালমার্টের মেয়েদের প্রতিবাদ করতে দেখেছি।
অনেক সময় কিছু পুরুষকে দেখা যায় সকলের সামনে সামনে স্ত্রীকে ছোট করতে, ‘যে ব্যাপারে তুমি কিছু বোঝো না, ফালতু কথা বলো না।’ আপাতদৃষ্টিতে একে সামান্য ঘটনা বলে মনে হলেও, এই বীজটি কিন্তু নিহিত আছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। এভাবে নিজের স্ত্রীকে পাঁচজনের সামনে ছোট করে পুরুষটি যে নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করতে চাইছে, তাতে তার মনুষ্যত্বই খাটো হচ্ছে, নিজেকেই সে ছোট করছে। প্রতি মুহূর্তে নারীজাতিকে ছোট করা বা হেয় করার মধ্যে কোন গৌরব নেই, এই সত্য পুরুষকেও বুঝতে হবে। অশিক্ষিত সমাজে তো বটেই, ভারতে অনেক শিক্ষিত মেয়েও সংসারে স্বামীর হাতে মার খায়, অত্যাচারের শিকার হয়। কিল খেয়ে কিল চুরি করে রাখে তারা। বাইরের প্রসাধন, আর উজ্জ্বল পোশাকে সংসারের প্রতিদিনের সব অপমানকে ঢেকে রাখতে চায় আর মনে মনে সমাজকে প্রশ্ন করে:
“বিয়ের পরের বাড়ি, বিয়ের পরের বাড়ি, বলো, মা
কোন বাড়ি আমার নিজের অধিকারে?..”
(কৃষ্ণা বসু)
দৃষ্টিকে একটু অতীতের দিকে প্রসারিত করে একবার আমাদের সাহিত্যের দিকে তাকাই। সাহিত্য আমাদের সমাজের দলিল। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ মহাকাব্যে কী দেখেছি আমরা? লঙ্কা-ফেরত সীতাকে আগুনের সামনে দাঁড় করায় এপিক পুরুষ রামচন্দ্র। মহাভারতে দেশের ভবিষ্যৎ রাজা পাশা খেলায় স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি রাখে। সীতা ও দ্রৌপদী রাজকন্যা, রাজবধূ। রাজবধূদেরই যখন এই দশা, তা হলে সাধারণ মেয়েরা দাঁড়ায় কোথায়? সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন,
“ভৃ ধাতুতে ন্যৎ প্রত্যয় দিলে স্ত্রীলিঙ্গে হয় ভার্যা্ব আর সেই ভৃ ধাতুতে ক্যপ প্রত্যয় দিলে পুংলিঙ্গে হয় ভৃত্য্ব । দু’জায়গাতেই মানে হল যাকে ভরণ করা হয়, অর্থাৎ অন্নের জন্য দাসী হল স্ত্রী, ভার্যা্ব আর অন্ন দিয়ে যাকে পোষণ করা হয় সে ভৃত্য৷ যেটি অনুচ্চারিত তা হল, উভয় ক্ষেত্রেই অন্নটাও উপার্জন করতে হয় কায়িক শ্রম দিয়েই...৷ বেদের অধিকাংশ জুড়ে নারীর যে অবনমন, তারই অনুরণন পরবর্তী সাহিত্যে৷ তাই নারী রয়ে গেল একটি ভোগ্যবস্তু হিসেবে, যাকে অনায়াসে পাওয়া যায় বিবাহসূত্রে এবং যাকে যে-কোনও অত্যাচার করা যায় শাস্ত্রের অনুমোদনসহ৷ ইদানিং বিষ, কন্ঠরোধ, ধর্ষণাম্তে অগ্নিসংযোগ, গণধর্ষণ ইত্যাদির মধ্যে নারীর সামাজিক অবস্হান ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷”
আমাদের সমাজে নারী শুধু নারী বলেই পুরুষের চেয়ে বেশি বিপন্ন। আমাদের সমাজে প্রতি মুহূর্তে নারীকে কোথাও না কোথাও লাঞ্ছিতা হতে হয়, ধর্ষিতা হতে হয়, আহত, অপমানিত হতে হয় হয়, বাইরে চাকরির পরও ঘরের সব দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করতে হয় কিংবা স্বীকৃতিবিহীন শ্রমে গৃহগত সীমানায় দিনাতিপাত করতে হয়। আমাদের এই সমাজে শিশুকন্যা, বালিকা কন্যারাও নিরাপদ নয়। এমনকি আন্তর্জাতিক নারীদিবসেও নারীত্বের আর মানবতার অবমাননা বিরল নয়।
সেই সমাজে দাঁড়িয়ে শুধু কয়েকটা নারীদিবস পালনের মধ্য দিয়ে লিঙ্গবৈষম্য আর নির্যাতনের অবসান ঘটবে এমনটা ভাবা অসম্ভব, কিন্তু নারীদিবসের গুরুত্ব থেকেই যায়। এইদিন হিংসার শিকার মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে বোঝাতে পারি, ধর্ষণ আর পাঁচটা অঘটনের মতোই একটা অঘটন মাত্র, জীবনে গুরুত্ব দেওয়ার মতো অন্য অনেক বড় ঘটনা থাকবে, ধর্ষণ নয়। পিছিয়ে থাকা একটি মেয়েকেও স্বাবলম্বী হতে, শিক্ষিত হতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। এইদিনে নারীহিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার শপথ তো করতে পারি!
পার্ক স্ট্রিট থেকে দিল্লির বসন্তবিহার- বড় যন্ত্রণার ইতিহাস। নৃশংস অত্যাচারের শিকার নির্ভয়া জ্যোতি নিভে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। দু’দিন আগে অসুস্থ হয়ে হারিয়ে গেলেন সুজেট জর্ডন। এই সুজেট আমাদের সমাজের প্রতিবাদের মুখ। টিভির পর্দায় একটা ওড়নায় ঢেকে রাখা মুখ হয়ে তিনি বাঁচতে চাননি। চেনা-অচেনা মুখগুলোর বিশ্বাসহীনতা দেখেও, রাজনৈতিক নেতাদের তাঁর গায়ে নিরন্তর কাদা ছোঁড়া সহ্য করেও, নিজের নামের সঙ্গে দেহ-ব্যবসার তকমা জুড়ে যাবার পরও (যেন দেহ-ব্যবসায়ীদের ধর্ষণটা সমাজ-স্বীকৃত!) হতাশায় হারিয়ে না গিয়ে প্রকাশ্যে এসেছেন, কাজে যোগ দিয়েছেন, প্রতিবাদের সোচ্চার হয়েছেন, পথে হেঁটেছেন। বলেছিলেন তিনি রেপ সার্ভাইভার, রেপ ভিক্টিম নন। তাঁর এভাবে এগিয়ে আসাটা যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার খুব বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। তাঁকে দেখে আরো অনেক নির্যাতিতা এগিয়ে এসেছে। সুজেটের লড়াইকে কুর্নিশ করতেই হয়।
গোটা বিশ্বজুড়ে একটা যুদ্ধ চলছে অহরহ। নারীহিংসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দেশ আর সমাজ নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে এ যুদ্ধের বিরাম নেই। মনে পড়ে, নির্যাতিত সুজেটের ঠাকুমা নাতনিকে সারাক্ষণ মনোবল জুগিয়ে পাশে থেকেছিলেন। কাটোয়ার ঘটনায় বর্ধমানের প্রত্যন্ত কেতুগ্রামের বৃদ্ধা শাশুড়ি দৃপ্ত উচ্চারণে ছেলেদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আমার পুত্রবধূ কোনও অন্যায় করেনি। তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।’ পুরনো প্রজন্মের হাত ধরে এভাবেই সুচেতনা আসুক। সমাজের অন্তর্জাগরণ ঘটুক। নির্যাতিত মেয়েদের অসহায়তা নয়, অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটাকে তুলে ধরুক মিডিয়া। পুরুষেরা পুরুষ থেকে মানুষ হয়ে ওঠুক, নতুন প্রত্যয়ে নারীরাও মানুষ হয়ে বাঁচুক।
ছবি - সুবীণ দাশের সৌজন্যে
লেখক পরিচিতি - কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে
আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে
বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে।
কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও
জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি
বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। অবসর-এর কয়েকটি বিশেষ সংখ্যার অতিথি সম্পাদক।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।