প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভগবত গীতার শিক্ষা ও প্রতিটি অধ্যায়ের সারাংশ সূচী

দ্বিতীয় অধ্যায় – সাংখ্য যোগ

প্রথমেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তিরস্কার করলেন - হে অর্জুন, এই সঙ্কটকালে আর্যগণের অযোগ্য স্বর্গগতির প্রতিবন্ধক ও অযশস্কর এই মোহ তোমাতে কোথা হতে এল| অর্জুন, ক্লীবভাব আশ্রয় কোরো না| এই কাপুরুষতা তোমার শোভা পায় না| হৃদয়ের এই তুচ্ছ দুর্বলতা ত্যাগ করে যুদ্ধার্থ উত্থিত হও|
কিন্তু তিরস্কারে অর্জুনের মোহভঙ্গ হল না| তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে বললেন – আমার চিত্ত স্বধর্ম বিষয়ে বিমূঢ় হয়েছে| আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, আমার পক্ষে যা মঙ্গলকর তা নিশ্চয়পূর্বক বল| আমি তোমার শিষ্য, আমি তোমার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে আত্মতত্ত্বের শিক্ষা দিলেন| বললেন – যাদের জন্য শোক করা উচিত নয় তাদের জন্য তুমি কেন শোক করছ| পূর্বে আমি কখনও ছিলাম না এমন নয়, তুমি কখনও ছিলে না এমনও নয়| এই দেহধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মরূপে বিদ্যমান ছিলাম| এই দেহ ত্যাগের পরও আমরা থাকব না এমন নয়| বর্তমানে আমরা যেমন নিত্য আত্মরূপে বিদ্যমান আছি, দেহান্তেও নিত্য আত্মরূপে বিরাজমান থাকব| মৃত্যু দৈহিক বিকার মাত্র|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মা বা ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা করলেন – যিনি এই জগৎ পরিব্যাপ্ত করে আছেন তিনিই অবিনাশী আত্মা বা ব্রহ্ম| কেহই এই অব্যয় আত্মার বিনাশ করতে সমর্থ হয় না| আত্মা জন্ম-মৃত্যু রহিত, অপক্ষয়হীন এবং বুদ্ধিশুন্য| এই দেহ নষ্ট হলেও আত্মা বিনষ্ট হয় না| মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে সেইরূপ আত্মা জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে| কোন অস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করতে পারে না, অগ্নি একে দগ্ধ করতে পারে না, জল একে আদ্র করতে পারে না এবং বায়ু একে শুষ্ক করতে পারে না| আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল ও সনাতন| আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী|
তিনি আরও বললেন – জাত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত এবং স্বীয় কর্ম অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির পুনর্জন্ম অবশ্যম্ভাবী|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্বধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিলেন| বললেন – স্বধর্ম অনুযায়ী তোমার ভীত হওয়া উচিত নয়| তুমি ক্ষত্রিয়, ধর্ম যুদ্ধ করাই তোমার স্বধর্ম| সুখ-অনুরাগ, দুঃখ-দ্বেষ না করে লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সমতুল্য জ্ঞান করে ধর্মযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও|
এরপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্মযোগ সম্পর্কে শিক্ষা দিলেন| বললেন – নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠানেই জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসারের মহাভয় হতে পরিত্রাণ লাভ করে মোক্ষলাভ হয়| এই নিষ্কাম কর্মযোগে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ হয়| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন – তুমি নিষ্কাম হও এবং ভগবানের জন্য কাজ কর| তিনি অর্জুনকে বললেন –

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন|
মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি|| (২:৪৭)

অর্থাৎ কর্মে তোমার অধিকার, কর্মফলে নয়| অতএব কর্ম কর, কর্মফলে যেন তোমার কখনও আসক্তি না হয়|
স্থিতপ্রজ্ঞ সম্পর্কে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখনই তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ হন| তিনি আরও বলেন – যিনি দুঃখে উদ্বেগহীন, সুখে নিঃস্পৃহ এবং আসক্তিশুন্য, যাঁর ভয় ও ক্রোধ নিবৃত্ত হয়েছে, যিনি সকল বস্তু ও ব্যক্তিতে স্নেহবর্জিত এবং প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়েও যিনি আনন্দিত বা দুঃখিত হন না তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ| ইনি ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত করে সমাহিত আত্ম্স্থ অবস্থায় অবস্থান করেন কেননা যাঁহার ইন্দ্রিয়সকল বশীভূত হয়েছে তাঁরই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্থাৎ তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন যিনি নিঃশেষরূপে সমস্ত বাসনা পরিত্যাগ করেন, শরীর ধারণার্থ প্রয়োজনীয় বিষয়েও মমত্ব-ভাব বর্জিত ও বিদ্যাবত্তাদি অহংকাররহিত হন এবং শরীরে ও জীবনে স্পৃহাশুন্য এবং জীবনধারণ মাত্র চেষ্টাযুক্ত হয়ে পর্যটন করেন, তিনি সকল সংসার দুঃখের নিবৃত্তিরূপ পরম শান্তি অর্থাৎ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হন| এই অবস্থাই ব্রাহ্মীস্থিতি| এই অবস্থা লাভ করলে আর কেহ মোহগ্রস্ত হয় না| তিনি ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হন|
সাংখ্য যোগ নামে ভগবত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি|

তৃতীয় অধ্যায় – কর্মযোগ

প্রথমেই অর্জুন প্রশ্ন করলেন – হে জনার্দন, যদি তোমার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, তবে আমাকে এই হিংসাত্মক কর্মে, এই যুদ্ধে কেন নিযুক্ত করছ?
উত্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে অর্জুন, ইহলোকে যাঁরা জ্ঞানী তাঁদের জন্য জ্ঞানযোগ এবং নিষ্কাম কর্মিগণের জন্য কর্মযোগ| কর্মানুষ্ঠান না করে কেহ নৈষ্কর্ম বা নিষ্কৃয় আত্মারূপে অবস্থিতি অর্থাৎ মোক্ষলাভ করতে পারে না| কর্মযোগে চিত্তশুদ্ধি ও আত্মবিবেক না হলে নৈষ্কর্ম সিদ্ধি হয় না| কেবলমাত্র জ্ঞানশুন্য কর্মত্যাগ দ্বারা মোক্ষলাভ অসম্ভব| তিনি আরও বললেন – কর্ম না করে কেহই ক্ষণকালও থাকতে পারে না| প্রকৃতির গুণে অর্থাৎ সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রভাবে সকলেই কর্ম করতে বাধ্য হয়| ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম ব্যতীত অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ হয়| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন – তুমি অনাসক্ত হয়ে কর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান কর| কামনাশুন্য হয়ে কর্ম করলে মানুষ নিশ্চয়ই মুক্তি লাভ করে|
অহংকার দ্বারা যার চিত্ত বিমূঢ় হয়েছে তিনিই – আমি কর্তা – এইরূপ মনে করেন| কিন্তু সত্য হচ্ছে যে আমাদের প্রকৃতি গুণত্রয়ের অর্থাৎ সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ প্রভাবে সব কর্ম, লৌকিক এবং বৈদিক কর্ম, সম্পাদন করে| কাজেই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমাদের মধ্যে অবস্থিত প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা| মানুষের মন ও বুদ্ধি মানুষকে তার জ্ঞানমার্গের পথ থেকে বিচ্যুত করে| এই মন ও বুদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করেই চিত্তশুদ্ধি হয়| চিত্তশুদ্ধি হলেই হয় বিবেকের উন্মোচন| আর বিবেকের উন্মোচন হলেই ব্রহ্মলাভ সম্ভব| মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ দেহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, মন ইন্দ্রিয়সমূহ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, মন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হল বুদ্ধি আর যা বুদ্ধি অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ তা হল আত্মা| এইরূপ শিক্ষা দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন – সব কর্ম ‘আমাতে’ সমর্পণ করে ফল অভিসন্ধি-রহিত হয়ে, মমত্ব ও শোকশুন্য হয়ে যুদ্ধ কর|
অর্জুন জানতে চাইলেন পাপ কি এবং মানুষ পাপ করে কেন| এর উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – রজোগুণজাত কাম এবং ক্রোধ এই দুই হল পাপ| সংসারে এদুটিকেই মহাশত্রু বলে জানবে|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শিক্ষা দিলেন যে এই কাম ও ক্রোধের বশবর্তী হয়েই মানুষ পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয়| কেননা কাম ও ক্রোধ মানুষের বিবেকবুদ্ধিকে আবৃত করে রাখে ও মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে| তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন যে ইন্দ্রিয়সমূহকে বশীভূত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক কাম ও ক্রোধকে পরিহার করতে| তাঁর উপদেশ হল – শুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা মনকে সমাহিত করে পরমাত্মা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে অজ্ঞানমূলক দুর্জয় কাম ও ক্রোধকে জ্ঞান দ্বারা মূলোচ্ছেদ পূর্বক বিনাশ করা|
কর্মযোগ নামক ভগবত গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি|

চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ

এই অধ্যায়ের প্রথমেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অবতার তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দিলেন| তিনি বললেন –

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত|
অভ্যূত্থানধর্মস্য তদাত্মানং সৃজম্যহম্|| (৪:৭)
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্|
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে|| (৪:৮)

অর্থাৎ হে ভারত, যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় তখনই অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আর তখনই আমি স্বীয় মায়া বলে মানুষের দেহ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হই যুগে যুগে সাধুদিগকে রক্ষার জন্য, আর দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – যিনি আমার এই অলৌকিক দিব্য জন্ম ও সাধুপরিত্রাণাদি অপ্রাকৃত কর্মতত্ত্ব জানেন তিনিই আমাকে লাভ করেন এবং দেহান্তে আর পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না| আসক্তিরহিত, ভয়শুন্য ও ক্রোধবর্জিত, মদগতচিত্ত ও আমারই শরণাগত ব্যক্তি জ্ঞান রূপ তপস্যা দ্বারা শুদ্ধি লাভ করে ব্রহ্মভাব (মোক্ষ) প্রাপ্ত হন| তিনি আরও বললেন – যিনি যে প্রকারে আমার উপাসনা করেন আমি তাকে সেরূপ ফলপ্রদান দ্বারাই অনুগৃহীত করি; ধর্মনিষ্ঠ মানুষ সকল প্রকারেই আমারই পথের অনুসরণ করেন|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জানালেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এই চার বর্ণ তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষের সত্ত্বাদিগুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে| এই বর্ণ বিভাগ কেবলমাত্র মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্টই বর্ণনা করে| কোন এক বর্ণ আর এক বর্ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন যে এখন তিনি কর্ম কি এবং অকর্ম অর্থাৎ কর্মের অভাব কি এই বিষয়ে আলোচনা করবেন কেননা শাস্ত্রবিহিত কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম ও অকর্মের তত্ত্ব অবগত হওয়া একান্ত প্রয়োজন| শাস্ত্রবিহিত কর্ম, অকর্ম ও নিষিদ্ধ কর্মের স্বরূপ বা তত্ত্ব অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয়| তিনি বললেন যে যিনি কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দর্শন করেন তিনিই মানুষের মধ্যে জ্ঞানী এবং সর্ব কর্মের কর্তা| ইহাই কর্ম ও অকর্মের বোধব্য রহস্য| এই জ্ঞানেই মুক্তি লাভ হয়| অহংকার ও কর্মফলের আকাঙ্খা না করে যিনি কর্ম করেন তিনি সেই কর্মের জন্য আবদ্ধ হন না| আত্মজ্ঞ পুরুষ অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন কর্মের জন্য কর্মফলের জন্য নয়| তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন – অজ্ঞানজাত বুদ্ধিস্থিত, আত্মবিষয়ক এই সংশয়কে জ্ঞানরূপ অসি দ্বারা ছেদন করে ব্রহ্মদর্শনের শ্রেষ্ঠ মার্গ নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর ও যুদ্ধার্থ উত্থিত হও|
জ্ঞানযোগ নামে ভগবত গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সমাপ্তি|

অসীম ভট্টাচার্য

( ক্রমশঃ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ