পঞ্চম
অধ্যায় – সন্ন্যাসযোগ
এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত করলেন| অর্জুন প্রশ্ন
করলেন – শাস্ত্রীয় কর্মের ত্যাগ (সাংখ্য যোগ) ও শাস্ত্রীয়কর্মের
অনুষ্ঠানের (কর্মযোগের) মধ্যে কোনটি মোক্ষদায়ক| উত্তরে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে উভয়ই অর্থাৎ কর্মের ত্যাগ ও কর্মের অনুষ্ঠান
হচ্ছে মুক্তিমার্গ| কিন্তু তাদের মধ্যে জ্ঞানহীন কর্মসন্ন্যাস
অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান উৎকৃষ্টতর| সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগের
ফল একই – মোক্ষলাভ; তাই উভয়কে যিনি অভিন্ন দেখেন, তিনিই যথার্থদর্শী,
সম্যক জ্ঞানী| নিষ্কাম কর্মযোগ ব্যতীত জ্ঞানযুক্ত পরমার্থ
সন্ন্যাস লাভ করা অসম্ভব| নিষ্কাম কর্মযোগী সন্ন্যাসী হয়ে
অচিরেই পরব্রহ্ম প্রাপ্ত হন|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যোগীর
বর্ণনা দিয়ে বললেন যে এই জীবনে যিনি আমরণ কাম ও ক্রোধ সংযত
করতে পারেন, তিনিই যোগী, তিনিই সুখী| তিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব
করেন বাহ্যবিষয়ে নয়, তিনি অন্তর্জ্যোতি ও ব্রহ্মস্বরূপ| তিনি
ইহজীবনেই ব্রহ্ম আনন্দ লাভ করেন| যোগী কর্ম করেন তা চিত্তশুদ্ধির
জন্য, কোন কর্মফল লাভের জন্য নয় অর্থাৎ যোগীর কর্ম হল নিষ্কাম
কমর্যোগ| যোগী নিষ্কাম কর্ম দ্বারা, শ্রবণ ও মনন দ্বারা, নিদিধ্যাসন
দ্বারা সংশয়রহিত জিতেন্দ্রিয় হয়ে সকল জীবের কল্যাণে নিয়ত থেকে
আনন্দ লাভ করেন| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – মন হতে বাহ্যবিষয়
বার করে দৃষ্টি ভ্রুযুগলের মধ্যে স্থির করে, নাসিকার মধ্যে
বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুর উর্দ্ধ ও অধোগতি সমান বোধ করে
এবং ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযমপূর্বক ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধশুন্য
হয়ে যে যোগী সর্বদা বিরাজ করেন, তিনিই জীবন-মুক্ত হন| ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন – কর্তা ও দেবতারূপে আমি যজ্ঞ ও
তপস্যার ভোক্তা, সর্ব লোকের মহেশ্বর এবং সকলের সুহৃদ এই প্রকারে
আমাকে স্বীয় আত্মারূপে জেনে যোগী পরম শান্তি (মোক্ষ) লাভ করেন|
সন্ন্যাসযোগ নামে ভগবত গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের সমাপ্তি|
ষষ্ঠ
অধ্যায় – ধ্যানযোগ (অভ্যাসযোগ)
এই অধ্যায়ের প্রথমেই
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুকে শিক্ষা দিলেন যে কর্মফলের আশা না
করে যিনি কর্তব্য অনুযায়ী নিত্য কর্ম অর্থাৎ অগ্নিহোত্রাদি
করেন তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই কর্মযোগী| অগ্নিহোত্রাদি শ্রৌত
এবং তপস্যা ও দানাদি স্মার্ত কর্ম যিনি ত্যাগ করেছেন তিনি
সন্ন্যাসী বা যোগী নন| কারণ সংকল্পশুন্য না হলে অর্থাৎ কর্মফলের
বাসনা ত্যাগ না করলে কেহ কর্মযোগী হতে পারেন না| যখন চিত্ত-সমাধান-অভ্যাসকারী
যোগী ঐহিক ও পারত্রিক বিষয়ে সকল সংকল্প ত্যাগ করে শব্দস্পর্শাদি
ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে ও নিত্যনৈমিত্তিকাদি কর্মে আসক্ত হন না,
তখনই তাঁকে যোগারূঢ় বলা হয়| তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে
শিক্ষা দিলেন – মানুষ বিবেকযুক্ত মন দ্বারা আপনিই আপনাকে সংসার
হতে উদ্ধার করবে অর্থাৎ যোগারূঢ় হবে; কখনও নিজেকে বিষয়াসক্ত
করবে না| কারণ শুদ্ধ মনই মানুষের প্রকৃত হিতকারী, মুক্তির
হেতু| বিষয়াসক্ত মন মানুষের পরম শত্রু, বন্ধনের কারণ| যে বিবেকযুক্ত
মন দ্বারা দেহ-ইন্দ্রিয়াদি বশীভূত হয়েছে সেই সংযত মনই আত্মার
বন্ধু, কারণ উচ্ছৃঙ্খল-রহিত সেই মনই মুক্তির সহায়ক| বিবেকশুন্য
মন, উচ্ছৃঙ্খল মন প্রবৃত্তি বশে শত্রুর ন্যায় স্বীয় অনিষ্ট
সাধনে প্রবৃত্ত হয়|
পরবর্তী কয়েকটি শ্লোকে
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যোগারূঢ় অবস্থা প্রাপ্তির উপায় বর্ণনা করলেন|
নির্জন স্থানে যোগী একাকী নিঃসঙ্গ, নিরাকাঙ্খা ও পরিগ্রহশুন্য
হয়ে দেহ ও মন সংযমপূর্বক অন্তঃকরণ সততঃ সমাহিত করবেন| শুদ্ধ
স্থানে যোগী প্রথমে কুশ, তার উপরে যথাক্রমে মৃগচর্ম ও বস্ত্র
দ্বারা নাতি উচ্চ বা নাতি নিম্ন আসন স্থাপন করবেন| যোগী সেই
আসনে বসে বাহ্য ও অন্তর ইন্দ্রিয়সমূহের কার্য সংযম পূর্বক
চিত্তশুদ্ধির জন্য একাগ্র মনে যোগাভ্যাস করবেন| মেরুদণ্ড,
গ্রীবা ও মস্তক সরল ও নিশ্চলভাবে ধারণপূর্বক স্থির হয়ে এবং
কোন দিকে না তাকিয়ে স্বীয় নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন|
প্রশান্ত চিত্ত, ভয়রহিত, ব্রহ্মচর্য পালন ও গুরুসেবাদি ব্রতে
স্থিত, মদগতচিত্ত ও মৎপরায়ণ যোগী মন একাগ্র করে নিত্য ধ্যানাভ্যাস
করবেন| যোগী এইরূপে সদা সংযত ভাবে মন সমাহিত করে ‘আমার’ স্বরূপভূত
মোক্ষপ্রদ পরম শান্তি প্রাপ্ত হন| যখন যোগী সকল কামনা-মুক্ত
হন এবং তাঁর চিত্ত বাহ্য চিন্তা পরিত্যাগ পূর্বক আত্মাতে অবস্থান
করেন তখন তাঁর সমাধি হয়| সর্বকামনাশুন্য নির্বেদশুন্য চিত্তে
অধ্যবসায় সহকারে এই সমাধি অভ্যাস করা উচিত| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে বললেন তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী যিনি সকল ভূতের সুখ ও দুঃখ
নিজের সুখ ও দুঃখ বলে অনুভব করেন| তিনিই সর্বত্র সমদর্শী হয়ে
আত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করে থাকেন|
অর্জুন বললেন – হে কৃষ্ণ, মন অতি চঞ্চল, প্রবল এবং শরীর ও
ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষেপ-উৎপাদক| একে বিষয়-বাসনা হতে নিবৃত করা
অতিশয় কঠিন|
উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – এ কথা খুবই সত্য| মন যে দুর্নিরোধ
ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই| কিন্তু ধ্যান অভ্যাস এবং দৈহিক
ও পারলৌকিক বিষয়ভোগে বিতৃষ্ণা সাধন দ্বারা অর্থাৎ বৈরাগ্য
দ্বারা মনকে সংযত ও বশীভূত করা যায়| অসংযত ব্যক্তির পক্ষে
সমাধি লাভ করা অসম্ভব; কিন্তু পুনঃ পুনঃ যত্নশীল ও জিতেন্দ্রিয়
ব্যক্তি ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্য সাধন দ্বারা এই সমাধি লাভ পারেন|
অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন – যোগী যোগে সিদ্ধি লাভ না করতে পারলে
তিনি কোন মার্গে গমন করেন বা তিনি কি বিনষ্ট হন|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আশ্বাস দিয়ে বললেন যে বৈদিক কর্ম
ত্যাগ করা সত্ত্বেও যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পতিত বা নিন্দিত হন
না, পরলোকেও নিকৃষ্ট শরীর প্রাপ্ত হন না| কেননা কল্যাণকারীর
কখনও অধিগতি হয় না| যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা
অধিকতর যত্ন করে পাপমুক্ত হয়ে পূর্বজন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার
দ্বারা সিদ্ধিলাভ করে মোক্ষপ্রাপ্ত হন| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে
বললেন – হে অর্জুন, তুমি যোগী হও| যিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে মদগতচিত্তে
আমার ভজনা করেন, তিনি দেবতাদি তথা সকল যোগীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা
শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার অভিমত|
ধ্যানযোগ (অভ্যাসযোগ)
নামে ভগবত গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের সমাপ্তি|