সপ্তম
অধ্যায় – জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ে
ভগবত তত্ত্ব কি, কিরূপে তদগতচিত্ত হয়ে ভগবানকে নিশংসয়ে জানতে
পারা যাবে সেই বিষয়ে অর্জুনকে শিক্ষা দিয়ে বললেন – হে পার্থ,
যে সর্বতোভাবে আমার শরণাগত হয়ে (অর্থাৎ অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ,
দান বা তপস্যাদি কর্মের ফল আশ্রয় না করে) আমাতে মনোনিবেশ পূর্বক
যোগাভ্যাস করেন তিনি বিভূতি, বল, শক্তি ও ঐশ্বর্যাদিসম্পন্ন
পূর্ণস্বরূপে (অর্থাৎ সগুণ ও নির্গুণরূপে) আমাকে নিঃসংশয়ে
জানতে পারবেন| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অপরোক্ষ অনুভূতির সহিত ‘মদ’বিষয়ক
এই জ্ঞান সম্পর্কে উপদেশ দিলেন| তিনি বললেন এই জ্ঞান লাভ করলে
সংসারে আর অন্য কিছু জ্ঞাতব্য অবশিষ্ট থাকবে না| কেননা এই
জ্ঞান হল বিজ্ঞান বা পরাবিদ্যা অর্থাৎ সম্যক জ্ঞান| আর যে
জ্ঞান মানুষ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির সাহায্যে লাভ করে তা হল
অপরা বিদ্যা| তিনি জানালেন যে সহস্র সহস্র মানুষের মধ্যে কদাচিৎ
কেহ এই আত্মজ্ঞান লাভের প্রযত্ন করেন, আর প্রযত্নশীল মুমুক্ষুগণের
মধ্যেও কচিৎ কেহ ‘আমাকে’ স্বরূপতঃ অর্থাৎ স্বীয় আত্মারূপে
জানতে পারেন কেননা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ অতিশয় দুর্লভ|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জানালেন যে তাঁর দুটি প্রকৃতি –
অপরা প্রকৃতি ও পরা প্রকৃতি| অপরা প্রকৃতি হল নিম্নস্তরের
যথা ভূমি, জল, অপ (জল), বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং
অহংকার – এই আট প্রকারে তাঁর ঐশ্বরী মায়াশক্তি বিভক্ত| কিন্তু
ইহা হতে অত্যন্ত স্বতন্ত্র্য তাঁর প্রকৃষ্ট বা উচ্চস্তরের
প্রকৃতি হল জীবভূতা প্রকৃতি যা জগতের অন্তঃপ্রবিষ্ট এবং এই
জগৎপ্রপঞ্চ ধারণ করে আছে| তিনি বললেন – আমার এই উভয় প্রকৃতি
হতেই জড় ও চেতন সর্বভূত উৎপন্ন হয়েছে| অতএব আমি সমগ্র জগতের
সৃষ্টি ও প্রলয়রূপ অর্থাৎ উক্ত প্রকৃতিদ্বয় দ্বারা আমি জগতের
কারণস্বরূপ| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে কৌন্তেয়, সর্ব বেদে
(চার বেদে) আমিই প্রণব অর্থাৎ ওম্| তিনি আরও বললেন – হে ধনঞ্জয়,
আমা অপেক্ষা জগতের অন্য কোন শ্রেষ্ঠ কারণ নেই| প্রাণিগণের
যে সকল সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাব স্বকর্মফলে উৎপন্ন
হয় তা সবই আমা হতেই উৎপন্ন| যদিও তারা আমা হতেই উৎপন্ন তথাপি
জীবের ন্যায় আমি সেই সকল ভাবের অধীন নই; কিন্তু সকল ভাব আমার
অধীন| ত্রিগুণজাত সুখ-দুঃখ-মোহাদি ভাব দ্বারা জগতের প্রাণিসমূহ
ভ্রান্ত হয়ে এই সকল ভাবের অতীত আমার অব্যয় নিরুপার্থিক স্বরূপ
জানতে পারে না| কারণ আমার এই ত্রিগুণাত্মিকা অঘটন-ঘটন পটিয়সী
মায়া অতিক্রম করা অতিশয় কষ্টকর| কিন্তু যাঁরা ধর্মাধর্ম পরিত্যাগ
পূর্বক আমার ভজনা করে আমাকে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাঁরাই কেবল
আমার এই দুস্তর মায়া উর্ত্তীণ হতে পারেন অর্থাৎ সংসার বন্ধন
হতে মুক্ত হন|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানালেন যে আর্তিযুক্ত অর্থাৎ ভীত, তত্ত্বজিজ্ঞাসু,
অর্থকামী ও তত্ত্বজ্ঞানী এই চার প্রকার ব্যক্তিগণ তাঁর ভজনা
করেন| যদিও কোন ভক্তই তাঁর অপ্রিয় নন কিন্তু একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই
তাঁর একান্ত প্রিয়| কারণ জ্ঞানী হলেন তাঁর আত্মস্বরূপ| জ্ঞানীব্যক্তি
অতিশয় দুর্লভ| তিনি অর্জুনকে বললেন যে ত্রিগুণাত্মিকা মায়া
দ্বারা আবৃত বলে তিনি সকলের নিকট প্রকাশিত হন না| তিনি বললেন
– হে অর্জুন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিন কালের সমস্ত
ভূতকেই আমি জানি কিন্তু আমার শরণাগত ভক্ত ব্যতীত আর কেহ আমাকে
জানতে পারে না| যাঁরা অধিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞের সঙ্গে আমার
উপাসনা করেন সেই সকল সমাহিতচিত্ত ব্যক্তিই মৃত্যুকালেও আমাকে
বিস্মৃত হন না|
জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ নামে ভগবত গীতার সপ্তম অধ্যায়ের সমাপ্তি|
অষ্টম
অধ্যায় – অক্ষরব্রহ্ম যোগ
প্রথমেই অর্জুন প্রশ্ন
করলেন – হে পুরুষোত্তম, ব্রহ্ম কি, অধ্যাত্ম কি, অধিভূত এবং
অধিদৈবই বা কাকে বলে? অধিযজ্ঞ কে? মৃত্যুকালে ব্যক্তি কিরূপে
তোমাকে জানতে পারে?
উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – অক্ষরব্রহ্ম হল পরব্রহ্ম|
স্বভাব অর্থাৎ প্রতি দেহে সেই ব্রহ্মের আত্মাভাবে অবস্থিতিকে
অধ্যাত্ম বলে| ভূতগণের উৎপত্তিকারক যে দ্রব্য দেব উদ্দেশ্যে
ত্যাগরূপ যজ্ঞকে কর্ম বলে| দেহাদি বিনাশশীল পদার্থই অধিভূত,
পুরুষ (হিরণ্যগর্ভ) অধিদৈব এবং আমিই এই দেহে অধিযজ্ঞ| তিনি
অর্জুনকে বললেন – মৃত্যকালে কেহ আমাকে স্মরণ করলে তিনি আমাকে
লাভ করেন| অতএব হে অর্জুন, সর্বদা আমাকে স্মরণ কর এবং স্বীয়
ক্ষাত্রধর্ম পালন হেতু যুদ্ধ কর| আমাতে মন ও বুদ্ধি সমর্পন
করলেই আমাকেই লাভ করতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই|
পরের কয়েকটি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরব্রহ্মের প্রাপ্তির
উপায় যোগ সাধনার সহিত ওমকারের উপাসনা সম্বন্ধে শিক্ষাদান করলেন|
তিনি বললেন – যিনি একাগ্র মনে আমাকে যাবজ্জীবন নিরন্তর স্মরণ
করেন, সেই সদা স্মরণশীল যোগীর সহজলভ্য আমি| আমাকে লাভ করলে
আর পুনর্জন্ম হয় না অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে| পৃথিবী হতে
ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সপ্তলোকই পরিবর্তনশীল| কাজেই ব্রহ্মলোকাদি
থেকে মানুষ সংসারে প্রত্যাবর্তন করে না| মৃত্যুর পর আত্মা
দুই পথে গমন করে – দেবযান ও পিতৃযান| দেবযানে আত্মার গতি হলে
মুক্তি লাভ হয় এবং পিতৃযানে আত্মা গমন করলে পুনরায় তাকে দেহ
ধারণ করতে হয় অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই অর্জুনকে
উপদেশ দিলেন – হে অর্জুন, তুমি সর্বদা ব্রহ্মধ্যানে সমাহিত
হও|
অক্ষরব্রহ্ম যোগ নামে ভগবত গীতার অষ্টম অধ্যায়ের সমাপ্ত|
অসীম
ভট্টাচার্য