ত্রয়োদশ অধ্যায় – ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ
বিভাগ যোগ
অর্জুন প্রকৃতি ও পুরুষ,
ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয়ে জানতে চাওয়ায় ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে এই ভোগায়তন শরীরকে ক্ষেত্র বলা হয় আর যিনি
এই শারীরিক বিষয় জানেন তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ| সকল ক্ষেত্রের দ্রষ্টা
এক এবং ক্ষেত্রজ্ঞ হতে পৃথক| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – আমাকেই
সেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলে জানবে| তিনি ক্ষেত্র কি তা বর্ণনা করলেন|
পঞ্চ সূক্ষ্ম মহাভূত, মহাভূতের কারণ অহংকার, অহংকারের কারণ
বুদ্ধি, বুদ্ধির কারণ মূলা প্রকৃতি অর্থাৎ অব্যাকৃত ব্রহ্মশক্তি,
দশ ইন্দ্রিয় ও মন, ইন্দ্রিয়ের বিষয় স্থূল পঞ্চভূত এবং ইচ্ছা,
দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, দেহ-সংঘাত ও দেহ-সংঘাতে অভিব্যক্ত চেতনা
ও ধৃতি - এই সকল হল সবিকার ক্ষেত্র বা বিকারযুক্ত ক্ষেত্র|
পরবর্তী কয়েকটি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি করে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ
বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায় সেই বিষয়ে শিক্ষা দিলেন| তিনি বললেন
যে উৎকর্ষ সত্ত্বেও আত্মশ্লাঘা-রহিত, দম্ভশুন্যতা, প্রাণীপিড়নে
অনিচ্ছা (অহিংসা), ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, বহিঃরন্তশৌচ, মোক্ষমার্গ
স্থিরতা, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে সংযত করে সন্মার্গে পরিচালনা,
ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুতে বিরক্তি, অভিমান-শূন্যতা, জন্ম, মৃত্যু,
জরা ও ব্যাধিরূপে পুনঃ পুনঃ দোষদর্শন, বিষয়ে বা কর্মে অনাসক্তি,
স্ত্রী, পুত্র ও গৃহাদিতে মমত্বের অভাব, শুভাশুভ প্রাপ্তিতে
সদা চিত্তের সাম্যভাব, ভগবানই একমাত্র গতি – এইসব নিশ্চিত
বুদ্ধির দ্বারা ‘আমাতে’ অচলা ভক্তি, নির্জন স্থানে বাস, প্রাকৃতজনের
সংসর্গ ত্যাগ, আত্মানাত্মবিবেক, জ্ঞানে নিষ্ঠা ও তত্ত্বজ্ঞানার্থ
দর্শন – এইগুলি হল আত্মজ্ঞানের সাধন|
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যাহা জ্ঞাতব্য অর্থাৎ যাহা জানিলে
অমৃতত্ব (মোক্ষ) লাভ হয় সেই বিষয়ে শিক্ষা দিলেন| পরব্রহ্ম
হলেন আদিহীন, সৎশব্দ ও সৎপ্রত্যয়ের অগোচর, অসৎশব্দ ও অসৎপ্রত্যয়েরও
অগোচর কারণ ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুই সৎ বা অসৎ শব্দ প্রত্যয়ের
গোচর হয়; কিন্তু ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়াতীত| ব্রহ্ম সমগ্র বিশ্বকে
ব্যাপ্ত করে বিরাজ করছেন| ব্রহ্ম সংশ্লেষরহিত, ত্রিগুণরহিত|
ব্রহ্ম অতি সূক্ষ্ম তাই অবিজ্ঞেয়| ব্রহ্ম সর্ব ভূতের পালক,
সংহারক ও স্রষ্টা| ব্রহ্ম জ্ঞান, জ্ঞেয় এবং জ্ঞানগম্যরূপে
সকলের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত|
প্রকৃতি ও পুরুষ সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে উভয়েই
অনাদি| বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়াদি, সুখ-দুঃখ, মোহ প্রভৃতি গুণসমূহ
এই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি হতেই উৎপন্ন হয়েছে| প্রকৃতি কার্য
এবং কারণের উৎপত্তির কারণ এবং পুরুষ সুখ ও দুঃখসমূহের উপলব্ধির
কারণ| পুরুষ (জীব, ভোক্তা, ক্ষেত্রজ্ঞ) প্রকৃতিতে অবস্থিত
হয়েই সুখ-দুঃখ-কার্য-করণ রূপে পরিণত ও মোহাকারে অভিব্যক্ত
প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন| যিনি দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি
প্রভৃতির সাক্ষী এবং অনুমোদন কর্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর
পরমাত্মা রূপেতে শ্রুতিতে উক্ত হন, সেই পুরুষোত্তমও এই দেহে
বর্তমান| যিনি পুরুষকে (ব্রহ্মকে) সাক্ষাৎ আত্মাভাবে জানেন
ও সকল বিকারে সহিত অবিদ্যারূপ প্রকৃতিকে মিথ্যা বলে জানেন
তিনি পুনর্বার জন্মগ্রহন করেন না| কেহ কেহ ধ্যানের দ্বারা,
কেহ কেহ জ্ঞানযোগের সাহায্যে, আবার কেহ কেহ গুরুদত্ত উপদেশ
নিষ্ঠার সহিত পালন করে এই জ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞাত হন, তারাই
পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন|
ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ
বিভাগ যোগ নামে ভগবত গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের সমাপ্তি|
চতুর্দশ অধ্যায় – গুণত্রয়
বিভাগ যোগ
এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
পুনরায় ব্রহ্মজ্ঞান সম্পর্কে অর্জুনকে শিক্ষা দিলেন| ব্রহ্মজ্ঞান
অতিশয় দুর্বোধ্য এবং সর্ব জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ| এই জ্ঞান লাভ করলেই
মোক্ষ লাভ হয়| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে তাঁর ত্রিগুণাত্মিকা
প্রকৃতি সর্বভূতের উৎপত্তির কারণ| সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ – এই
গুনত্রয় পরমার্থতঃ নিষ্ক্রিয় আত্মাকে দেহাভিমান দ্বারা শরীরে
আবদ্ধ করে| সত্ত্বঃগুণ স্ফটিকমণির ন্যায় নির্মল, স্বচ্ছ চৈতন্য
প্রতিবিম্ব গ্রহণে সমর্থ বলে নির্দোষ ও প্রকাশক| রজঃগুণ হল
রাগাত্মক| তৃষ্ণা ও আসক্তি এই গুণ হতেই উৎপন্ন হয়| দৃষ্ট ও
অদৃষ্ট ফলের নিমিত্ত কর্মে আসক্তি দ্বারা এটি আত্মাকে আবদ্ধ
করে অর্থাৎ ‘আমি করি’ এই অভিমান বা অহংকার দ্বারা কর্মে প্রবর্তিত
করে| তমঃগুণ আবরণশক্তি প্রধান প্রকৃতির অংশ হতে উৎপন্ন এবং
দেহধারীগণের মোহজনক| এটি প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা আত্মাকে
দেহবদ্ধ করে, নির্বিকার আত্মা বিকার প্রাপ্ত হয়| সত্ত্বঃগুণ
সাধ্য বিষয়ে ও রজঃগুণ সাধ্য কর্মে জীবকে আবদ্ধ করে আর তমঃগুণ
সত্ত্বঃগুণ কৃত বিবেককে আবৃত করে জীবকে প্রমাদ ও আলস্য প্রকৃতিতে
নিমজ্জিত করে| সত্ত্বঃগুণ রজঃ ও তমঃগুণকে অভিভূত করে প্রবল
হয় আর তমঃগুণ সত্ত্বঃ ও রজঃ গুণদ্বয়কে অভিভূত করে প্রবল হয়|
যখন এই ভোগায়তন দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ
দ্বারা উদ্ভাসিত হয় তখনই সত্ত্বঃগুণ বর্ধিত হয়, কেননা প্রসাদ,
লাঘব প্রভৃতি সত্ত্বঃগুণ বৃদ্ধির চিহ্ন| লোভ, কর্মে প্রবৃত্তি
ও প্রচেষ্টা, হর্ষ ও অনুরাগাদির স্পৃহা – এই সকল হল রজঃগুণ
বৃদ্ধির লক্ষণ| আর কর্তব্য বা অকর্তব্য বিবেকের অভাব, অনুদ্যম,
কর্তব্যে অবহেলা ও মূঢ়তা প্রভৃতি তমঃগুণ বৃদ্ধির চিহ্ন| সাত্বিক
কর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ আর তামসিক কর্মের
ফল মূঢ়তা, অজ্ঞানতা| সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি উর্দ্ধলোকে অর্থাৎ
স্বর্গাদি লোকে গমন করেন; রজঃ প্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ
ভূলোকে অবস্থান করেন আর তমঃগুণ প্রধান ব্যক্তিসমূহ অধোগামী
হন| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শিক্ষা দিলেন যে দেহ উৎপত্তির
কারণ এই গুণত্রয়; এই গুণত্রয়কে অতিক্রম করলেই জীব জন্ম-মৃত্যুরূপ
দুঃখ হতে জীবনকালেই বিমুক্ত হন এবং ব্রহ্মানন্দরূপ অমৃতত্ব
লাভ করেন|
অর্জুনের – গুণাতীতের লক্ষণ কি – এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ বললেন – গুণত্রয়ের কাজ হল প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ|
এই গুণত্রয়ের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও যিনি দ্বেষ করেন না এবং
এই সকলের নিবৃত্তিও আকাঙ্খা করেন না, তিনিই গুণাতীত| উদাসীন
ব্যক্তি যেমন কাহারও পক্ষ অবলম্বন করেন না, সেইরূপ যিনি গুণকার্যের
দ্বারা আত্মস্বরূপ দর্শনরূপ অবস্থা হতে বিচ্যুত হন না এবং
গুণসকল গুণে প্রবৃত্ত জেনেও কুটস্থ জ্ঞানেই অবিচলিত ভাবে অবস্থান
করেন ও আত্মস্বরূপে অবস্থিত, মৃৎপিণ্ড (মাটি), প্রস্তর ও সুবর্ণ
(সোনা) যার কাছে সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় তুল্যজ্ঞান করেন,
নিন্দা ও প্রশংসায় সমবুদ্ধি, তিনিই গুণাতীত| যিনি সম্মান ও
অপমানে নির্বিকার, যিনি শত্রুপক্ষে নিগ্রহ ও মিত্রপক্ষে অনুগ্রহ
করেন না, যিনি দৃষ্টাদৃষ্ট ফলার্থ সকল কর্ম ত্যাগ করে কেবল
মাত্র দেহধারন উপযোগী কর্মের অনুষ্ঠান করেন তিনিই গুণাতীত|
যিনি নিষ্কাম কর্মী ঐকান্তিক ভক্তির সঙ্গে ‘আমার’ উপাসনা করেন,
তিনিই গুণাতীত এবং ব্রহ্মত্ব লাভে সমর্থ হন|
গুণত্রয় বিভাগ যোগ নামে
ভগবত গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের সমাপ্তি|
অসীম
ভট্টাচার্য