সপ্তদশ অধ্যায় – শ্রদ্ধাত্রয়
বিভাগ যোগ
অর্জুনের – শ্রদ্ধা
কাকে বলে – এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে শ্রদ্ধা
তিন প্রকারের – সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক| শ্রদ্ধা জন্মান্তরকৃত
ধর্মাদিসংস্কার হতে জাত| এই জন্যেই জীবের ত্রিবিধ স্বভাব হতে
জাত শ্রদ্ধাও তিন প্রকার – সাত্ত্বিকী, রাজসিকী ও তামসিকী|
সাত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক ব্যক্তিগণ যক্ষ
ও রাক্ষসগণের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভুতপ্রেতাদির
পূজা করেন| এমনকি এই তিন প্রকার ব্যক্তিগণের আহারাদিও গুণভেদে
তিন প্রকার| যে সকল আহার আয়ু, উদ্যম, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি
বৃদ্ধি করে, সরস, স্নিগ্ধ ও পুষ্টিকর এবং মনোরম সেইগুলিই সাত্ত্বিক
ব্যক্তিগণের প্রিয় হয়| যা সকল আহার দুঃখ, শোক ও রোগ সৃষ্টি
করে এবং অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি
তীক্ষ্ণ, অতি শুষ্ক এবং অতি প্রদাহকার সেইগুলিই রাজসিকগণের
প্রিয় হয়| আর কাঁচা, দুর্গন্ধময়, বাসী, উচ্ছিষ্ট ও যজ্ঞে নিষিদ্ধ
সেইসব আহারই তামসিকগণের প্রিয় হয়|
এইরূপ যজ্ঞও তিন প্রকার|
যজ্ঞ করাই কর্তব্য মনে করে ফলাকঙ্খাবিহীন ব্যক্তি শাস্ত্রবিহিত
যে যজ্ঞ করেন তাহাই সাত্ত্বিক যজ্ঞ| কিন্তু স্বর্গাদি ফল কামনা
করে দম্ভ প্রকাশের জন্য যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তা রাজসিক যজ্ঞ|
আর শাস্ত্রবিধিবর্জিত, অন্নদানশুন্য, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাবিহীন,
শ্রদ্ধারহিত যে যজ্ঞ তা তামসিক যজ্ঞ| অনুরূপভাবে তপস্যাও তিন
প্রকারের – সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক| দেবতা, ব্রাহ্মণ,
গুরুজন ও প্রাজ্ঞগণের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা,
অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয় ও হিতবাক্য এবং বেদাদি শাস্ত্র পাঠ,
মনের প্রসন্নতা, সৌম্যভাব, বাকসংযম, মনের নিরোধ, ব্যবহারে
ছলনারহিত, ফলাকাঙ্খাবিহীন সমাহিত ব্যক্তিগণ শ্রদ্ধাভরে যে
তপস্যা করেন তা হল সাত্ত্বিক তপস্যা| সম্মান ও পূজা পাবার
আশায় যে তপস্যা করা হয়, যা ইহলোকে কদাচিৎ ফলপ্রদ হয় সেই তপস্যা
হল রাজসিক তপস্যা| আর দুরাকঙ্খার বশবর্তী হয়ে দেহ ও ইন্দ্রিয়কে
কষ্ট দিয়ে বা অপরের তপস্যা বিনাশের জন্য যে তপস্যা করা হয়
তা হল তামসিক তপস্যা| দান করা কর্তব্য এইভাবে প্রত্যুপকারের
আশা না করে পুণ্যস্থানে, শুভ সময়ে ও উপযুক্ত পাত্রে যে দান
করা হয় তাকে সাত্ত্বিক দান বলে| যে দান প্রত্যুপকারের আশায়
ও কোন পারলৌকিক ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও করা
হয় তা রাজসিক দান| অশুচি স্থানে, অশুভ সময়ে ও অযোগ্য পাত্রে
অবজ্ঞাপূর্বক ও প্রিয়বচনাদি সৎকার-রহিত যে দান করা হয় তা হল
তামসিক দান|
বিহিত যজ্ঞ, দান ও তপস্যাদির
অনুষ্ঠানে বৈগুণ্য অবশ্যম্ভাবী এই শিক্ষা দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে বললেন – ওম্ তৎ সৎ - এই তিন বাক্য দ্বারা ব্রহ্মের
ত্রিবিধ নাম নির্দ্দিষ্ট হয়েছে| এই জন্য ‘ওম্’ এই ব্রহ্মবাচক
শব্দ উচ্চারণ করে শাস্ত্রবিধান অনুযায়ী যজ্ঞ-দান-তপস্যাদি
কর্মের অনুষ্ঠান করা হয়| ‘তৎ’ এই ব্রহ্মবাচক দ্বিতীয় শব্দ
উচ্চারণ পূর্বক ফলাকাঙ্খা না করে নানা যজ্ঞ-তপোদানাদি কর্মের
অনুষ্ঠান করা হয়| সদভাব ও সাধুভাব সম্পাদনার্থ ‘সৎ’ এই তৃতীয়
ব্রহ্মবাচক শব্দ সর্ব শুভ অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হয়| ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে উপদেশ দিলেন _ হে পার্থ, মনে রেখো যে শ্রদ্ধাশুন্য
হয়ে যে যজ্ঞ, দান বা তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং স্তুতি-নমস্কারাদি
যাহা কিছু করা হয় সে সকলই অসৎ| কারণ এই সকল যজ্ঞাদি সৎপ্রাপ্তি-সাধনমার্গের
বিপরীত| এই সকল যজ্ঞাদি বৈগুণ্যবশতঃ পরলোকে এবং ইহলোকেও নিস্ফল
হয়|
শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ
নামে ভগবত গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ের সমাপ্তি|
অসীম
ভট্টাচার্য