বি
এন সরকার (১৯০১ - ১৯৮০)

অ্যাডভোকেট
জেনারেল শ্রী এন এন সরকারের দ্বিতীয় পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন
লণ্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বি
এন সরকার ইঞ্জিনিয়ারিং কন্ট্রাক্টর হিসেবেই কাজ শুরু করেছিলেন,
কিন্তু একটা সিনেমা থিয়েটার তৈরী করার সময় তাঁর চলচ্চিত্র সম্পর্কে
উত্সাহ জাগে। ১৯৩০ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়েসে চিত্রা আর নিউ সিনেমা
নামে দুটো সিনেমা হল খুললেন। সিনমা হল তো খুললেন, কিন্তু সেখানে
দেখাবার জন্য ভালো ছবিও চাই। ১৯৩০ সালের শেষাশেষি পি এন রায়কে
উদ্বুদ্ধ করে দুজনে মিলে স্থাপন করলেন ইণ্টারন্যাশেনাল ফিল্মক্রাফট
কোম্পানী। সেই একই বছর আরেকটি ফিল্ম প্রডাকশন কোম্পানীও কলকাতায়
খুলেছিল - সেটি ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট। প্রমথেশ
বড়ুয়া তাঁর প্রথম নির্বাক ছবি 'অপরাধী'তে সেটের মধ্যে কৃত্রিম
আলো ব্যবহার করে ভারতীয় সিনেমাতে এক নতুন যুগের সূচনা করলেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে সবাক চিত্র এসে গেছে। নতুন সময়ের সঙ্গে তাল
রেখে বি এন সরকার (বীরেন্দ্র নাথ সরকার, কিন্তু বি. এন. সরকার
বলেই বেশি পরিচিত) তাঁর কোম্পানীর নাম পাল্টে রাখলেন নিউ থিয়েটার্স।
নিউ থিয়েটার্সে তৈরী হল বাংলার দ্বিতীয়* সবাক চিত্র শরত্ চন্দ্রের
'দেনাপাওনা' - ছবির পরিচালনায় ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তার
পরে পরেই আরও দুটি ছবি নিউ থিয়েটার্সে তৈরী হল - 'চিরকুমার সভা'
এবং 'পল্লীসমাজ'। পল্লীসমাজের পরিচালক ছিলেন স্বনামধন্য শিশির
ভাদুরী। তা সত্বেও ছবিগুলি তেমন চলল না। ১৯৩২ সালে নিউ থিয়েটার্সে
আমন্ত্রণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এসে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের
দিয়ে 'নটীর পূজা' করালেন। সেই নৃত্যনাট্যটিকে ক্যামেরায় ধরে
রাখা হল। কিন্তু সিনেমার ভাষা সেখানে ছিলো না - ছিল শুধু নৃত্যনাট্যের
চলন্ত ছবি।
সিনেমা
জগতে নিউ থিয়েটার্সের প্রথম বড় অবদান হল কাব্যধর্মী ছবি 'চণ্ডীদাস'।
১৯৩২ সালে চিত্রাতে ছবিটি মুক্তি পায়। দেবকী বসু ছিলেন এর পরিচালক।
উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে সোচ্চর এই ছবিতে দেবকী
বসু আবহসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন - যেটি আগে করা হয় নি। এছাড়া
সুপারইম্পোজিশন শটও এই ছবিতে ছিল।
নিউ থিয়েটার্সের আরেকটি
বিখ্যাত ছবি হল প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ১৯৩৫ সালের ছবি 'দেবদাস'।
এর বাংলা ছবিতে নায়ক ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, হিন্দী ভাষান্তরে
নায়ক করা হয়েছিল সাইগলকে। নায়িকা দুই ছবিতেই যমুনা বড়ুয়া। সিনেমার
ইতিহাসে 'দেবদাস'
বিখ্যাত
হয়ে থাকবে শুধু সামাজিক সমস্যার সুন্দর উপস্থাপনার জন্য নয়,
চলচ্চিত্রের যে ভাষা - সেটির উপর সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যেও।
সময়মত কাট করে নাটকীয় মুহুর্তের সৃষ্টি করা, ক্লোজ-আপের উপযুক্ত
ব্যবহার, মণ্টাজের সুপ্রয়োগ - সব কিছু মিলে 'দেবদাস' প্রমথেশের
একটি অপূর্ব কীর্তি। 'দেবদাস' ছবিতে ক্যামেরাম্যানের কাজ করেছিলেন
বিমল রায়, যিনি পরে বিখ্যাত পরিচালক হিসাবে সর্বভারতীয় স্বীকৃতি
পান।
সেই একই বছরে নিউ থেয়েটার্সের
'ভাগ্যচক্র' ছবিতে পরিচালক নীতিন বসু প্রথম প্লেব্যাক গান ব্যবহার
করা শুরু করলেন। তারপর থেকে ভারতীয় ছবির ইতিহাসই পাল্টে গেল।
কোনো সিনেমা প্রডাকশন কোম্পানীর
সাফল্যের মূলে থাকে বহু লোকের অবদান - ভালো গল্প, তার স্ত্রিïপ্ট
থেকে শুরু করে, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, অভিনেতা, অভিনেত্রী,
মিউজিক ডিরেক্টর, সাউণ্ড-লাইট ইত্যাদির কলাকুশলী ছাড়াও আরো কত
লোক। এদের সবাইকে খুঁজে বার করা, একত্র করা, পারিশ্রমিকের বন্দোবস্ত
করা খুব একটা ছোটখাটো কাজ নয়। বি.এন সরকার সেই কাজে যে দক্ষতা
দেখিয়েছেন সেটা ভারতীয় সিনেমায় বিরল। ১৯৭০ সালে ওঁকে দাদা সাহেব
ফালকে পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে উনি
পদ্মভূষণ লাভ করেন।
* প্রথম
সবাক ছবিটি ছিল জে. এফ. ম্যাডনের তৈরী জামাইষষ্ঠী।