প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো অবসর থেকে

মার্চ ১, ২০১৭

 

বিংশ শতাব্দীর আগে বাঙালী থিয়েটারে নারী

১৭৯৫ সালে গেরাসিম স্তেপানোভিচ লিয়েবেদেফ তাঁর বেঙ্গলি থিয়েটারে 'কাল্পনিক সংবদল' নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। বাংলার পাবলিক থিয়েটারে মহিলা শিল্পীদের অংশ গ্রহণ এই প্রথম ঘটল। লিয়েবেদেফকে গভর্নর জন শোরের কাছ থেকে তার জন্য অনুমতি নিতে হয়েছিল। মহিলা শিল্পীদের জোগাড় করেছিলেন পণ্ডিত গোলকনাথ দাস। কিন্তু কি ভাবে বা কোথা থেকে তিনি এই মহিলা শিল্পীদের জোগাড় করেছিলেন - সেটা এখন অনুমান সাপেক্ষ। পতিতাপল্লী থেকে সম্ভবত নয়, কারণ সেক্ষেত্রে তা নিয়ে সেকালের রুচিবাগীশের দল অনেক হৈ চৈ করতেন। নাট্যাচার্য অহীন্দ্র চৌধুরীর অনুমান - যেটি অনেকেই পরে সমর্থন করেছেন - সেটি হল, এঁদের সংগ্রহ করা হয়েছিল গ্রাম্য লোকসংস্কৃতির অঙ্গন থেকে। অসম্ভব নয়, কারণ বাঙালী জনজীবনে প্রচলিত ঝুমুর যাত্রা প্রভৃতি প্রদর্শ শিল্পের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল। আবার অনেকের বিশ্বাস গ্রামাঞ্চল নয় কলকাতারই কোনো ঢপকীর্তনের দল থেকে শিল্পীদের জোগাড় করেছিলেন গোলকনাথ দাস। সে-যুগে ঢপকীর্তন গায়িকারা প্রকাশ্যে অনুষ্ঠান করতেন পুরুষদের মত। ঢপকীর্তনে শুধু গান থাকতো না তাতে সরস কৌতুক ও কথকতাও থাকতো। সুতরাং জনসমক্ষে সপ্রতিভ ভাবে গান গেয়ে কথা বলে সাধারণদের আনন্দদান করার ক্ষমতা এঁদের ছিলো। দুর্ভাগ্যবশতঃ, কাল্পনিক সংবদল-এর নায়িকা সুখময় ও সহচরী ভাগ্যবতীর ভূমিকায় অভিনয় করে যাঁরা বাংলা নাট্যজগতে একটা নতুন নজির সৃষ্টি করলেন - তাঁদের নাম আমরা কেউ আর জানি না!।

এর পর থিয়েটারে আবার নারীদের আগমন হল ৪০ বছর পরে ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে - যখন নবীনচন্দ্র বসুর থিয়েটারে বিদ্যাসুন্দর নাটকটি দেখানো হল। এই নাটকেই আমরা প্রথম অভিনেত্রীদের নাম জানলাম - রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারী ও বৌহরো ম্যাথরানী। আরও জানলাম যে, এঁদের সবাইকে পতিতালয় থেকেই অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছিল। পতিতা মেয়েদের নিয়ে থিয়েটার করানোর ব্যাপারে বহু সমাজপতি বিরূপ মন্তব্য করলেও তার সপক্ষেও কয়েকজন সোচ্চর ছিলেন।

হিন্দু পায়ওনিয়ার পত্রিকার সমালোচক এই অশিক্ষিতা সমাজ পরিত্যক্তা নারীদের সপ্রতিভ সাবলীল অভিনয় দেখে যা লিখলেন - সেটি ছোট করে লিখলে দাঁড়ায়, পড়াশুনো না জানা নারীরা শুধু কণ্ঠস্থ করে এত সুন্দর অভিনয় করেছে, তারা যদি শিক্ষিত হত তাহলে কি তাদের প্রতিভার স্ফুরণ আরও বেশি হত না? এই লেখায় স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে অনেক কথা ছিলো। কিন্তু আরেকটি ব্যাপারও সমালোচকের দৃষ্টি এড়ায়নি। নবীনচন্দ্র বসুর এই নাট্যপ্রয়াসের মধ্যে ভ্রমে পতিত স্ত্রীলোকদের একটি চারিত্রিক উন্নতির চেষ্টা রয়েছে - সেটি তিনি উল্লেখ করেছিলেন। নারী চরিত্রের স্বভাব-সৌন্দর্য প্রদর্শনের যে সুযোগ অভিনেত্রীদের নবীনবাবু দিয়েছেন অন্যান্য বড়লোকরাও তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন - এই ছিলো সমালোচকের অনুরোধ।

সেই যুগে এই রকম একটি সমালোচনা যে লেখা হয়েছিল - সেটা ভাবতে অতটা বিস্ময় জাগবে না যদি আমরা মনে রাখি যে, রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে নারী জাগরণের প্রথম অধ্যায়ে সতীদাহ প্রথা ইতিমধ্যেই (১৯২৯) বন্ধ হয়ে গেছে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে ও তার সুফলগুলো বাঙালী চিন্তাশীলদের মধ্যে একটু একটু করে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পরিশেষে ডিরোজিওর নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গলের উত্থানও এর মধ্যে শুরু (১৯৩৩) হয়েছে। কিন্তু এগুলির কোনোটাই যথেষ্ট ছিলো না। নবীনচন্দ্র বসু উদ্যোগ নিয়েছিলেন পতিতা সমাজের কিছু মেয়েদের যদি একটি সন্মানের সঙ্গে বাঁচার পথ খুঁজে দেওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়কার সাধারণ বাঙালী মানসিকতায় থিয়েটারে নারীদের তখনো স্থান নেই। অন্তঃপুরের নারীদের স্টেজে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। পতিতারা যদি আসে, তাহলে তাদের সংস্পর্শে থিয়েটার কলুষিত হবে। নবীনবাবুর থিয়েটার বেশি দিন চলল না। থিয়েটারে অভিনেত্রী নেওয়া বন্ধ হল - জয় হল রক্ষণশীলতার।

নবীনবাবুর সেই উদ্যোগের ৩৮ বছর পরে, ১৮৭৩ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বেঙ্গল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা শরচ্চন্দ্র ঘোষকে পরামর্শ দিলেন অভিনেত্রী গ্রহণ করতে। মাইকেলের নাটক শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের উদ্বোধন হল ১৬ ই অগাস্ট, ১৮৭৩ সালে। মঞ্চে এলেন এলোকেশী, জগত্তারিণী, গোলাপ ও শ্যামা।

রক্ষণশীল সমাজ চুপ করে রইলো না। সুলভ সমাচার পত্রিকায় লেখা হল:

সিমলার কতগুলি ভদ্রসন্তান বেঙ্গল থিয়েটার নাম দিয়া আর একটি থিয়েটার খুলিতেছে। ....যে যে স্থানে পুরুষদের মেয়ে সাজাইয়া অভিনয় করতে হয়, সেই স্থানে আসল একেবারে সত্যিকারের মেয়ে মানুষ আনিয়া নাটক করিলে অনেক টাকা হবে - এই লোভে পড়িয়া তাঁহারা কতগুলি নটীর অনুসন্ধানে আছেন।....মেয়ে নটী আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রীলোক আনিতেই হইবে, সুতরাং তাহা হইলে শ্রাদ্ধ অনেক দূর গড়াইবে। কিন্তু দেশের পক্ষে তাহা নিতান্ত অনিষ্টের হেতু হইবে।

সেকালের অনেক বড় বড় ব্যক্তিই 'মন্দ' স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে সর্বসমক্ষে ভদ্রসন্তানদের অভিনয় করাটা সমর্থন করেন নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বেঙ্গল থিয়েটার্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, বেঙ্গল থিয়েটার তাতে পিছিয়ে যায় নি। এই সময়ে সামাজিক সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু ভালো ভালো নাটক - যেমন, রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকুল সর্বস্ব (১৮৫৪), মাইকেল মধুসূদনের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) ও একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), রাধামাধব হালদারের বেশ্যানুরক্তি বিষম বিপত্তি (১৯৬৩), দীনবন্ধì মিত্রের সধবার একাদশী (১৮৬৬) ইত্যাদি মঞ্চস্থ হয়েছিল। আর নারীচরিত্রে অভিনয় করতে এসে এই সব 'মন্দ' নারীরা প্রমাণ করলেন যে, তাঁরা শুধু ভোগের পণ্য নন - তাঁরা সৃষ্টিশীল শিল্পী। তাঁদের সমাজ-অভিজ্ঞতা, সংবেদনশীলতা এবং জীবনকে নতুন করে ফিরে পাবার প্রবল বাসনা - সব কিছুই কাজ করল শিল্প-জীবনে তাঁদের উত্তরণে। বাংলা থিয়েটারের পূর্ণতা পেলো - এই সব সমাজ-ভ্রষ্টা নারীদের সাধনা ও সংগ্রামে। এঁদেরই অমূল্য সাহায্যে বাংলা থিয়েটার সমর্থ হল জনগণের মধ্যে সমাজ-সচেতনতা বাড়াতে।

গোলাপসুন্দরী (সুকুমারী)

বেঙ্গল থিয়েটারের অভিনেত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাময়ী ছিলেন গোলাপ (বা গোলাপসুন্দরী)। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির কাছে অভিনয় শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল গোলাপসুন্দরীর। ১৯৭৫ সালে উপেন্দ্র দাসের শরত্ সরোজিনী নাটকে সুকুমারীর ভূমিকায় এতো অপূর্ব অভিনয় করেন তিনি যে, সুকুমারী নামেই পরে লোকে ওঁকে চিনতো। উপেন্দ্র দাস সেই সময়ে একটি কাজ করলেন যেটি তত্কালীন বঙ্গসমাজে অভাবনীয়। তিনি উদ্যোগে নিয়ে এক তরুণ অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে সুকুমারীর বিয়ে দিলেন। বলাবাহুল্য যে, সমাজ এই বিবাহকে সুনজরে দেখলো না। তার জের চলেছিলো বেশ কিছুদিন। সুকুমারীর সবচেয়ে বড় সহায় - উপেন্দ্র দাস দেশ ছাড়লেন। সমাজের প্রতিবন্ধকতায় সুকুমারীর বিবাহিত জীবনও সুখের হল না। সুকুমারীর স্বামী ওঁকে রেখে জাহাজের খালাসী হয়ে চলে গেলেন। এক কন্যার জননী সুকুমারী অভিনয় জীবনকেই আঁকড়ে রইলেন। নিজের বেশ্যাজীবনকে ভিত্তি করে লিখলেন একটি নাটক অপূর্বসতী। ১৮৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু ফিমেল থিয়েটার। সেখানে এই নাটকটি প্রযোজনা করে দেখালেন পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর সামাজিক উত্তরণের বাধা কতটা কঠিন ।

বিনোদিনী

সুকুমারীর সময়কালেই ছিলেন বিনোদিনী - নাট্যজগতের এক অসামান্য অভিনেত্রী। তিনিও এসেছিলেন নিষিদ্ধপল্লী থেকে। গিরিশ চন্দ্র ঘোষের শিক্ষা নিশ্চয় ওঁর প্রতিভা স্ফুরণে সাহায্য করেছিল। কিন্তু গিরিশ গোষ নিজেই স্বীকার করেছিলেন, "রঙ্গালয়ে বিনোদিনীর উত্কর্ষ আমার শিক্ষা অপেক্ষা তাহার নিজগুণে অধিক "।
বিনোদিনী অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি ও সন্মান দুটোই পেয়েছিলেন। কিন্তু সামাজিক অধিকার পান নি। শিক্ষার মূল্য তিনি বুঝেছিলেন। কিন্তু তাঁর একমাত্র কন্যার বিদ্যাশিক্ষার জন্য কোনো বিদ্যালয় তিনি খুঁজে পেলেন না, যার কর্তৃপক্ষ তাঁর কন্যাকে নিতে প্রস্তুত। থিয়েটারের জন্য নিজেকে বিক্রি করলেন, কিন্তু যে সব পুরুষদের আপনজন বলে জানতেন - তাঁরাই ওঁকে বঞ্চিত করলেন তাঁর শ্রমের উৎপাদনের স্বত্ব থেকে। বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী 'আমার কথা' ও 'আমার অভিনেত্রী জীবন' বই দুটিতে তাঁর সেই ক্ষোভের কথা লিখে গেছেন। আর তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন দুটি কাব্যগ্রন্থ 'বাসনা' এবং 'কনক ও নলিনী'। প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে নবীনচন্দ্র দাসের সেই উদ্যোগ একেবারে নিস্ফল হয় নি!

পাবলিক থিয়েটারে অন্তঃপুরের নারীরা পুরুষদের সঙ্গে অভিনয় না করলেও উনবিংশ শতাব্দীতেও ঘরোয়া পরিবেশে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। ১৮৭৭ সালে জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়িতে ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে অলীকবাবুতে অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম তাঁর বাল্মিকী প্রতিভা অভিনয় করালেন, তখন বালিকা ও সরস্বতীর যু±ম ভূমিকায় ছিল তাঁর ভাগ্নী সুশীলা। এর কিছুকাল পরে এই চরিত্রে করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথের রাজা ও রানী নাটকের অভিনয়ে বাস্তবজীবনের ভাসুর-ভাদ্রবৌ নাটকে সাজলেন বৌদি-দেবর। নীতিবাগীশরা অবশ্য চুপ করে থাকেন নি। বঙ্গবাসী পত্রিকায় সেই নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হয়েছিলো 'ঠাকুরবাড়ির নতুন ঠাট' বলে। নিতান্ত ঠাকুরবাড়ি বলে সে বাড়ির মেয়েদের স্কুলে যাওয়াটা কেউ বন্ধ করতে পারেন নি।

সহায়িকা: পশ্চিমবঙ্গে কর্মী নারীর বিবর্তন, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, আকাদেমি পত্রিকা, জুলাই, ১৯৯৫।


 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।