৩রা
অক্টোবর গৌরীপুরের জমিদার বংশে প্রমথেশের জন্ম হয়। ছেলেবেলায়
শিকারের সখ ছিল - সেকালে রাজা-জমিদারদের যেমন থাকতো। তবে পড়াশুনোতেও
ভালো ছিলেন। গৌরীপুরে স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি এসে হেয়ার স্কুলে
ভর্তি হন। পরে প্রেসিডেন্সী কলেজে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বি.এসসি
পাশ করেন।
বরাবরই প্রমথেশের নাটকের প্রতি ঝোঁক ছিল। গৌরীপুরে তিনি একটি
নাটকের দল গড়েছিলেন - যেখানে পরিচালনা, আলোকসম্পাত, সঙ্গীত সব
কিছুর দায়িত্বই তিনি নিতেন। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি বিনোদনের
নতুন মাধ্যম - চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই সময়ে মাত্র ১৮
বছর বয়সে মায়ের ইচ্ছায় তিনি বাগবাজারের বীরেন্দ্রনাথ মিত্রের
জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতাকে বিয়ে করেন। পরে প্রমথেশ বড়ুয়া আরও
দুবার বিয়ে করেন (তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন দেবদাসের নায়িকা যমুনা
বড়ুয়া)।
বাবার মৃত্যুর পর প্রমথেশ
জমিদারীর ভার ছোটভাইকে দিয়ে প্যারিসের ফক্স স্টুডিওতে ক্যামেরা
ও আলোকসম্পাতের কলাকৌশল শিখতে যান। এ ব্যাপারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের
সুপারিশ তাঁকে সাহায্য করে। নতুন লাইটিং টেকনিক শিখে প্রমথেশ
দেশে ফিরে সেটি কাজে লাগালেন। তার নিজের প্রতিষ্ঠিত বড়ুয়া ফিল্ম
ইউনিট-এ ১৯৩০ সালে তৈরী হল নির্বাক চিত্র 'অপরাধী'। আগে শুধু
সূর্যের আলো ও রিফ্লেকটারের উপর নির্ভর করে ছবি তোলা হত। প্রমথেশ
সেটে কৃত্রিম উপায়ে ৪০ হাজার ওয়াটের লাইট ব্যবহার করে ছবি তুলে
ভারতীয় সিনেমাকে একটি নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। ছবিটির পরিচালক
ছিলেন দেবকি বসু, নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়া স্বয়ং। এটিই প্রমথেশের
প্রথম একক ফিল্ম প্রযোজনা। এর আগে যে আটটি ছবির প্রযোজনা তিনি
করেছিলেন, সেগুলি করেছিলেন ধীরেন গাঙ্গুলির (ডিজি) সংস্থা দ্য
ব্রিটিশ ডমিনিয়ান ফিল্ম লিমিটেড-এর মাধ্যমে। অভিনেতা হিসেবেও
চলচ্চিত্র জগতে ওঁর প্রবেশ ঐ কোম্পানীরই পঞ্চশর ছবিতে - ১৯২৯
সালে ।
'অপরাধী' ছবি শেষ হবার
সময়েই ১৯৩০ সালে তিনি অসম বিধান পরিষদে নির্বাচিত হন। সেখানে
স্বরাজ পার্টির মুখ্য সঞ্চালক হিসেবে কিছুদিন কাজ করে আবার ফিল্ম
জগতেই পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৩ সালে বীরেন সরকারের আমন্ত্রণে
তিনি নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন। সেখানেই তিনি তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন
'দেবদাস'কে চিত্রায়িত করেন। সুদর্শন প্রমথেশ ছিলেন একাধারে ছবির
নায়ক ও পরিচালক।* সিনেমার ইতিহাসে 'দেবদাস' বিখ্যাত হয়ে থাকবে
শুধু সামাজিক সমস্যার সুন্দর উপস্থাপনার জন্য নয়, চলচ্চিত্রের
যে ভাষা - সেটির উপর সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যেও। সময়মত কাট
করে নাটকীয় মুহুর্তের সৃষ্টি করা, ক্লোজ-আপের উপযুক্ত ব্যবহার,
মণ্টাজের সুপ্রয়োগ - সব কিছু মিলে 'দেবদাস' প্রমথেশের একটি অপূর্ব
কীর্তি। অভিনেতা হিসেবেও প্রমথেশ এই সময় খ্যাতির তুঙ্গে ওঠেন।
প্রমথেশের এই সময়কার অন্যান্য বিখ্যাত ছবি হল, রূপলেখা, গৃহদাহ,
মুক্তি, ইত্যাদি। ১৯৩৯ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে
দেন। এর পরে প্রমথেশ কৃষ্ণা মুভিটোন, এম পি প্রডাকশনস ইত্যাদি
সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এই সময়ে ওঁর তোলা ছবিগুলির মধ্যে
১৯৪২ সালে তোলা শেষ উত্তর (জবাব) উল্লেখের দাবী রাখে। শেষ উত্তরের
হিন্দী সংস্করণ জবাব-এ কাননদেবীর 'তুফানমেল' গানটি সারা ভারতেই
জনপ্রিয় হয়েছিল। ইউরোপের র্যা ঙ্ক অর্গানাইজেশনের জন্য প্রমথেশ
কিছু শিক্ষামূলক ডকুমেণ্টারি শুরু করেছিলেন, কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের
জন্য সেগুলি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি।
ওঁর জীবনের শেষদিনগুলি
কেটেছিল বিষণ্ণতায়। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল, মদ্যপানও অতিরিক্ত
করতেন। কমার্শিয়াল সিনেমা সম্পর্কে বোধহয় খানিকটা বীতশ্রদ্ধও
হয়েছিলেন। । ১৯৫১ সালে যেদিন ওঁর মৃত্যু হয়, তার আগের দিন অভিনেতা
প্রভাত মুখোপাধ্যায় (পরে চিত্র পরিচালক) ওঁর সঙ্গে দেখা করতে
গিয়েছিলেন। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। প্রমথেশ প্রভাতকে প্রশ্ন
করলেন, "কি দেখবে কালকে? পুরনো দিনে নতুন সূর্য? না নতুন
দিনে পুরনো সূর্য?"
"হয়তো, নতুন দিনে নতুন সূর্য," প্রভাত উত্তর দিয়েছিলেন।
"আমিও তাই ভাবতাম", বলেছিলেন প্রমথেশ ঠাণ্ডা স্বরে।
" তোমার মত যখন আমার বয়স ছিল, উদ্দীপনায় যখন ছটফট করতাম
সেই আলো আর ছায়ার জগতে ঢোকার মুখে । হ্যাঁ, সেই মেকী সস্তা মেক-বিলিফের
জগতে"। তারপর একটু থেমে বললেন, "ফিল্মের জগতে!"**
* হিন্দী ভাষান্তরে নায়ক করা
হয়েছিল সাইগলকে। দুই ছবিতেই নায়িকা ছিলেন যমুনা বড়ুয়া।
** প্রভাত মুখোপাধ্যায় '70 Years of Indian Cinema' বইয়ে ইংরেজিতে
ঘটনাটা লিখেছেন। বাংলায় ঠিক তিনি কি বলেছিলেন, সেটা জানা নেই।
অনুবাদে কিছু ভুল-ত্রুটি হতে পারে।