শিশিরকুমার
ভাদুড়ী (১৮৮৯ - ১৯৫৯)
শিশিরকুমার
তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপক হিসাবে। ১৯১৩ সালে ইংরেজিতে
এম.এ পাশ করার পর তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক
হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু নাটকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল ছাত্রাবস্থা
থেকেই। কলেজে পড়ার সময়ে নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক থাকাকালীনও
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট, ওল্ড ক্লাব ইত্যাদি সংস্থার আয়োজিত
নাটকে শিশিরকুমারকে দেখা যেতো। তাঁর অভিনয় প্রতিভার খ্যাতি এতো
ছড়িয়ে পড়েছিল যে, বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানীর রুস্তমজী ধোতিওয়ালা
ওঁকে অধ্যাপনা ছেড়ে থিয়েটার কোম্পানীতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান।
প্রসঙ্গতঃ, বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানী ছিলো বিখ্যাত চলচ্চিত্র
ব্যবসায়ী জে.এফ ম্যাডানের প্রতিষ্ঠান। ধোতিওয়ালা ছিলেন ম্যাডানের
জামাতা। রুস্তমজীর আমন্ত্রণ শিশিরকুমার উপক্ষো করতে পারলেন না।
১৯২১ সালে অধ্যাপনার কাজে ইতি দিয়ে নাটকের কাজেই পুরোপুরি মনোনিবেশ
করলেন।
পেশাদারী জীবনের ওঁর প্রথম
নাটক ছিল ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের 'আলমগীর'। ১৯২১ সালের
শেষদিকে এই নাটকটি যখন তিনি মঞ্চস্থ করলেন তখন সেটি অত্যন্ত
জনপ্রিয় হল। এই নাটকের অভিনয়, রূপসজ্জা, আলোক-সম্পাত, দৃশ্যপট
পরিকল্পনা - সব কিছুতে এত অভিনবত্ব ছিল যে, বাংলা নাটককে তিনি
এক লহমাতে অন্য একটি স্তরে নিয়ে স্থাপিত করলেন। তবে রুস্তমজীর
সঙ্গে তাঁর বনিবনা হল না। বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানীর সঙ্গে
সম্পর্ক চুকিয়ে তিনি নিজেই নাট্য-প্রযোজনা শুরু করলেন। ১৯২৩
সালে তিনি ডি.এল রায়ের 'সীতা' মঞ্চস্থ করেন। ইডেন গার্ডেন্স-এর
চাররাত্রি ধরে এটি চলে এবং দর্শক ও সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা
কুড়ায়। কিন্তু ইচ্ছা সত্বেও নিয়মিত ভাবে সীতা মঞ্চস্থ করা ওঁর
পক্ষে সম্ভব হয় না, কারণ সীতার অভিনয়-সত্ব অন্য একটি কোম্পানী
ইতিমধ্যে গোপনে কিনে নেয়। তবে শিশিরকুমার দমলেন না। যোগেশ চন্দ্র
চৌধুরীকে দিয়ে সীতা নাটক নতুন করে রচনা করালেন। ১৯২৪ সালে যোগেশচন্দ্রের
সীতা শিশিরকুমার প্রতিষ্ঠিত মনমোহন নাট্যমন্দিরে মঞ্চস্থ হল।
এর পর শিশিরকুমার একের পর এক বহু নাটক মঞ্চস্থ করেন। ১৯৩০ সাল
পর্যন্ত নাট্যমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল - তবে শেষ কয়েকটি বছর নাটক
মঞ্চস্থ করা হত কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে - বর্তমানে যেখানে শ্রীসিনেমা।
১৯৩১ সালে শিশিরকুমার আমেরিকাতে
যান সীতা নাটক মঞ্চস্থ করতে। ফিরে এসে কিছুদিন রঙমহল, স্টার
থিয়েটার ইত্যাদিতে অভিনয় করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি নবনাট্যমন্দির
স্থাপন করেন। কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে নবনাট্যমন্দির সাফল্য
লাভ করল না। ১৯৪১ সালে নাট্যনিকেতনের মঞ্চে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন
শ্রীরঙ্গম। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত শ্রীরঙ্গমে বহু ভালো ভালো নাটক
মঞ্চস্থ করে অবশেষে অর্থাভাবে এটিকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
এ প্রসঙ্গে নাট্যকার ও সমালোচক দেবনারায়ণ গুপ্ত এক জায়গায় লিখেছিলেন,
"ব্যবসায়িক থিয়েটার পরিচালনা করে গেছেন তিনি সারাজীবন,
কিন্তু অর্থের মোহে শিল্পকে তিনি পণ্য করতে পারেন নি।"
শিশিরকুমার সারা জীবন চেয়েছিলেন
জাতীয় নাট্যশালা গড়ে তুলতে। যেখানে গ্রাম-বাংলা তথা ভারতের নিজস্ব
নাট্যরূপ 'যাত্রা'কে কালোপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু তার
সে চেষ্টা সফল হয় নি। জীবনের সায়াহ্নে যখন শিশিরকুমারকে ভারত
সরকার পদ্মভূষণে সন্মানিত করতে চেয়েছিল, তখন শিশিরকুমার সেটি
প্রত্যাখ্যান করে লেখেন, I have a personal reason, besides
the one of principle, for not wishing to be conferred the
honour. By accepting this I shall mislead the lovers of the
theatre into believing that Government are awake of the importance
of drama in the life of the nation.
১৯৫৯ সালে শিশিরকুমারের
মৃত্যু হয়।