প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

জাগেশ্বর

“আপ অগর খুন করেঁ, হো সকতা হয় কি আপ বেল (Bail) পা যায়েঁ, লেকিন অগর এক দেওদার কী পেঁড় কাটে তো আপকো বেল নহি মিলেগা।“ উত্তরাখণ্ডের বৈজনাথ থেকে জাগেশ্বর যাবার পথে, জাগেশ্বরের কাছাকাছি এসে দেওদারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এই উক্তি আমাদের টেম্পো ট্র্যভলারের চালক, মোহনের।

আমি বেশ কয়েকটা জায়গায় অনেক দেওদার গাছ দেখেছি। যেমন উত্তরাখণ্ডেরই পাতাল ভুবনেশ্বরে এবং মুক্তেশ্বরে। এ পর্যন্ত এক সঙ্গে সব থেকে বেশি সংখ্যক দেখেছি ভ্যালি-অব-ফ্লাওয়ার্স ও লোকপাল-হেমকুণ্ড যাবার পথে ঘাঙরিয়া পৌঁছবার ঠিক আগেই প্রায় ৫/৭শ মিটার হাঁটা পথের ধারে। কিন্তু এই গাড়ি চলা পাকা রাস্তার ধারে বেশ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে যে গভীর বন দেওদারের, তা না দেখলে দুঃখের ব্যাপার হতো। সত্যই, এই গাছ কাটলে গর্হিত অপরাধ হওয়া উচিত। গাছ গুলো দেখলে কেমন লাগে, তা নিজের ভাষায় বর্ণনা না করে হিমালয় ভ্রমণের বর্ণনার গুরু উমাপ্রসাদবাবুর ভাষায় উদ্ধৃত করি,

“ঘাংরিয়া পৌঁছুবার আগে পথের শেষভাগে এক নিবিড় অরণ্য। চতুর্দিকে বিশাল বনস্পতি। অতিবৃদ্ধ বৃক্ষ সব। আদিম অরণ্যানী। যেন উদ্ভিদজগতে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্যস্বরূপ বিরাজ করছে। বিরাট-দেহ তরুশ্রেণী। বিপুল-বিস্তীর্ণ শাখা-বহুল। অঙ্গ ভরা প্রাচীনতার চিহ্ন। শুষ্ক শৈবালে আকীর্ণ। বার্ধক্য-জীর্ণ বল্কল। --- যেন চারিপাশে মহা-স্থবির ঋষিগন ধ্যানে বসেছেন। শুষ্ক লোল চর্ম। জটাজুটধারী।”

উমাপ্রসাদবাবু তাঁর এই বর্ণনার মাঝে কোথাও বলেননি যে এই বৃক্ষসকল দেওদার। কিন্তু আমি দেখেছি যে এইগুলি সমস্তই দেওদার। তবে এখানকার আর জাগেশ্বরের রাস্তার পাশে দেওদার-সারির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে-ঘাঙরিয়ার পথে হাঁটা হয় বৃক্ষগুলির নিচে দিয়েই আর জাগেশ্বরের ক্ষেত্রে গাছগুলি সরে গিয়ে পাকা রাস্তার জায়গা করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমি অনুভব করার চেষ্টা করলাম যে যদি এই পথে হাঁটতে হতো তবে কেমন লাগতো। পরে অবশ্য সেই এক্সপিরিয়েন্সও করে নিয়েছি, জাগেশ্বর মন্দির পরিসরের পিছনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এক অজানা গ্রামের দিকে কিছুটা পদচারণা করে।

প্রায় বিকেল বেলা আমরা ১৮৭০মি. উচ্চ জাগেশ্বর পৌঁছলাম। গাড়ির রাস্তা সোজা চলে এসে মন্দির পরিসরের অল্প আগেই দাঁড়ালো। বাস বা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড বলে আলাদা কোনও জায়গা নেই। আমাদের তাতে সুবিধেই হলো। গাড়ি দাঁড়াবার জায়গার পাশেই আমাদের রাত কাটাবার হোটেল পেয়ে গেলাম। রাস্তার বিপরীত দিকেই খাবার ছোট ছোট রেস্তোঁরা রয়েছে আর তার পিছন দিয়েই খুবই শীর্ণকায়া জটাগঙ্গা নদী বয়ে যাচ্ছে। নামেই নদী খল বললেই ঠিক ছিল। নদীর বিপরীত পার থেকেই দেওদারের জঙ্গল আরম্ভ আর তা ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। অবশ্য কিছুটা উঠেই, আমাদের হোটেল থেকে মনে হলো প্রায় সমতল হয়ে গেছে।

অন্ধকার হয়ে আসছিল বলে হোটেলে মাল-পত্র রেখেই বেরিয়ে পড়লাম, আশপাশে কি আছে দেখতে। অল্প এগোতেই রাস্তার ডান দিকে পাঁচিলে ঘেরা মন্দির পরিসর দেখতে পেলাম। শুনেছিলাম প্রায় শ’দেড়েক মন্দির আছে একই পরিসরে। পরিসরের ভিতরে ঢুকলাম। শুনলাম সামনেই পূর্ব-মুখি মহা-মৃত্যুঞ্জয় মন্দিরের মধ্যে থেকে ঢাক-শাঁখ-ঘণ্টা-কাঁসির শব্দ, নিশ্চয় আরতি হচ্ছে। মন্দিরের মধ্যে তাড়াতাড়ি প্রবেশ করলাম এবং বেশ কিছুক্ষণ আরতি দর্শন করলাম। আরতি দেখছিলেন অল্পই দর্শনার্থী। আরতি শেষ হলে দেখলাম তাঁদের মধ্যে পূজারি বা পাণ্ডার সংখ্যাই বেশি। মন্দিরের গর্ভগৃহ মন্দিরের আকার অনুযায়ী ছোট বলা যায় না। ঢোকার মুখেই নাট-মন্দির, বড়ই বলতে হবে। মন্দিরের গর্ভগৃহের উপর শিখর এবং শীর্ষে বিরাট আকারের পদ্ম, অনেকটা ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের মতো। শীর্ষের পদ্মটি লোহার স্ট্রাকচার করে বেঁধে রাখা হয়েছে, নিশ্চয় কালের প্রকোপ থেকে বাঁচাবার জন্যে। পরে লক্ষ করেছি যে এখানকার সবকটা একটু বড় মন্দিরের শীর্ষগুলো অমন করেই রক্ষা করা হয়েছে। নাট-মন্দিরের নিচু ছাদ টিনে ছাওয়া ও দোচালা, যদিও ভিতরে লক্ষ করেছিলাম যে অনেকগুলো থাম ছাদকে ধরে রেখেছে। তার মানে প্রাচীন ছাদ নিশ্চয় ভেঙ্গে ফেলে টিনের ছাদ তৈরি করা হয়েছে। অনেকটা অন্ধকার হয়ে আসা সত্যেও আমরা মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন শিল্প কলা দেখতে পেলাম, যা খুবই সূক্ষ্ম ও সুন্দর। মন্দিরের গঠন ‘নাগর’ শৈলীর, যদিও বৌদ্ধ শৈলীর পরিষ্কার ছাপ রয়েছে। হবারই কথা কেননা এই সমস্ত মন্দির কত্যুরি রাজাদের কালে ৮ থেকে ৯ শতাব্দীর মধ্যে গঠিত যখন সবে আদিগুরু শঙ্করাচার্য বৌদ্ধধর্মের প্রায় পরিসমাপ্তি করে সনাতনধর্মের পুনর্জাগরণ করেছেন। এই পরিসরের মধ্যে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্দির বৃহত্তম ও প্রাচীনতম। ইতিমধ্যে মন্দির ও মন্দির পরিসর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল বলে আমরা পরিসরের বাইরে চলে এলাম।


পরিসরের বাইরে দেখলাম যে আশপাশে মানুষ-জন প্রায় কেউ নেই আর দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে অথবা বন্ধ করা হচ্ছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এখানে বেশ ঠাণ্ডাও রয়েছে। আমরা তাই বাইরে আর না ঘুরে পরের দিনের জন্যে বাকি দর্শন মুলতুবি রেখে হোটেলে ফিরে এলাম।

পরের দিন ভোরে উঠে জটা-গঙ্গার শীর্ণ জল-ধারার উপরে গ্রামবাসীদের ফেলে রাখা পাথরের উপর দিয়ে অপর পারে গিয়ে দেওদারের বনের মধ্যে দিয়ে অনেকটা হাঁটার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম নতুন করে। কয়েক বছর আগেকার ঘাঙরিয়া পৌঁছোবার আগের দেওদারের শ্রেণীর মধ্যে দিয়ে হাঁটার সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল।

একটু বেলা বাড়লে মন্দির পরিসরে আবার হাজিরা দিলাম, ওখানকার বাকি মন্দির গুলো দেখার জন্যে। রাস্তার ধারে মন্দির পরিসরের বিপরীতে দেখতে পেলাম কিছুটা উঁচুতে কে.এম.ভি.এনের ট্যুরিস্ট লজ। বাড়িটা নতুন আর সুন্দর তার অবস্থান। সেখান থেকে মন্দির আর তার পিছনের দেওদার শ্রেণীর দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে। যাই হোক, মন্দির পরিসরের মধ্যে ছোট ও বড় মন্দির মিলিয়ে সংখ্যা ১২৪। ছোট এবং খুবই ছোট মন্দিরই প্রায় সব কটি। তিনটি মন্দির বড়, মহামৃত্যুঞ্জয়, জাগেশ্বর আর পুষ্টি দেবী বা পুষ্টি ভগবতী মাতা মন্দির। আর কয়েকটা মাঝারি মাপের।

পরিসরের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ মন্দির হলেও খ্যাতি সর্বাধিক জাগেশ্বর (বা নাগেশ) মন্দিরের। কারণ অনেকে বিশ্বাস করে থাকেন ১২ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অষ্টম এটিই। এই বিষয়ে কিছু কথা না বললে প্রসঙ্গটা ঠিক সম্পূর্ণ হবে না।
আদিগুরু শঙ্করাচার্যের জ্যোতির্লিঙ্গ সম্পর্কে স্তোত্রে অষ্টম জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে বলা আছে যে, “নাগেশং দারুকাবনে।” তবে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থিত শিব লিঙ্গ এই আখ্যায় ভূষিত হবার দাবি করে থাকে। একটি গুজরাটের গোমতী নদীর তীরে দ্বারকার ঈশান কোণে প্রায় ২০কিমি. দূরে নাগেশ্বর মহাদেব, দ্বিতীয়টি অন্ধ্রপ্রদেশের ঔরগ্রামে অবস্থিত শিবলিঙ্গ। আর তৃতীয়টি, অনেকেই উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুঁ অঞ্চলের আলমোড়া জেলার আলমোডার প্রায় ২২কিমি. পূর্বে জাগেশ বা জাগেশ্বর শিবলিঙ্গকে দারুকাবনের নাগেশ আখ্যা দিয়ে থাকেন। মনে হয় প্রথমটিই এই আখ্যা পাবার যোগ্য কেননা এই মন্দির ‘দারুকাবন’-এ, বর্তমান সৌরাষ্ট্র-এ (গুজরাটের) দ্বারকার কাছে অবস্থিত। আমার মনে হয়েছিল প্রাচীন দেওদার (দারু) মহিরূহ পরিবৃত হয়ে আছেন এই মহাদেব, তার থেকেই দারুকাবন কথা আসেনি তো? তবে যাঁরা এ বিষয়ে জানেন তাঁরা এ কথা বলেন না। তাছাড়া শিবপুরাণে এই বিষয়ে এক কাহিনির বর্ণনা আছে। সেই কাহিনির ভিত্তিতে আমার ধারণা যে ভুল, তা সহজেই বলা যায়।
যাই হোক, এই দেওদারের গহন বন এখনো দেখা যায় এখানে। আর প্রাচীন গ্রন্থ ‘প্রসাদমন্ডলম’-এ লিখিত,

"হিমাদ্রেরুত্তরে পার্শ্বে দেবদারুবন পরম্‌
পাবনং শঙ্করস্থানমং তত্র্‌ সর্বে শিবার্চিতা:”

এখনকার পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায় যে স্থানের বর্ণনা ঠিক মত করা আছে। এই বর্ণনার মধ্যে জৌতির্লিঙ্গের সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না থাকায় আমরা ধারণা করতেই পারি যে এই আখ্যার কথা পরবর্তীকালে যোগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে এত কথা লেখার প্রয়োজন এক মাত্র এখানকার পৌরাণিক ইতিহাস জানার জন্যেই করলাম, এর জ্যোতির্লিঙ্গ আখ্যা ঠিক কি বেঠিক, স্থানের সুন্দরতা তাতে কিছু মাত্র লঘু হয় না।

জাগেশ্বর মহাদেবের সম্পর্কে এখানে প্রচলিত এক সুন্দর গল্প আছে। এক সময়ে নাকি শিব এখানে এসে, স্থানের মনোরম পরিবেশের কারণে ভাল লাগে এবং যুবক সন্যাসীরূপে ধ্যানে বসেন। স্থানীয় অধিবাসী মহিলারা এই সংবাদ জানতে পেরে যে যার গৃহকর্ম ফেলে রেখে সেই সন্যাসী দর্শনে উপস্থিত হন। গ্রামের পুরুষেরা বাড়ি ফিরে তাদের স্ত্রীদের গৃহে পান না আর জানতে পারেন ঘটনার কথা। শিব মায়া বলে শিশুর আকার নেন। পুরুষেরা তাই দেখে নিশ্চিন্ত হন, আর তার পর থেকে এই জাগেশ্বর, শিশু জাগেশ্বর রূপে পূজিত হতে থাকেন। বৃদ্ধ জাগেশ্বর রূপেও শিব পূজিত হন, তবে এই মন্দির পরিসরে নয়, প্রায় ৩কিমি দূরে পাশেই এক পাহাড়ের উপর ‘বৃদ্ধ-জাগেশ্বর’ মন্দিরে। এখানকার মন্দির পরিসরের সামনের রাস্তা ধরেই সেখানে যাওয়া যায়। আমরা যখন তা জানতে পারি, তখন সময়াভাব, তাই আর সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

এই মন্দিরের শীর্ষ আর মহামৃত্যুঞ্জয় মন্দিরের শীর্ষের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে, এর শীর্ষে পদ্ম নেই, আছে ‘চন্দ্রাতপ’-ঠিক যেন একটা ছাতা মাথায় মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। এই ছাতা ঘিরে লোহার স্ট্রাক্‌চারও নেই। প্রধান দ্বারের দুপাশে প্রমাণ আকারের মানুষের থেকে বড় দুই বেলে পাথরের মূর্তি, নন্দি ও স্কন্দির, এবং ‘দারোয়ান’-এর মতোই হাতে অস্ত্র আছে। উত্তর ভারতে আর কোথাও নন্দির মূর্তি মানুষের শরীরের, আমার জানা নেই। দুই মূর্তির মধ্যে কোনটা নন্দি আমি বুঝতে পারিনি, তবে ডান পাশের মূর্তির চারটে হাত। এই মন্দিরের গর্ভ গৃহও মন্দিরের আকার অনুসারে ছোট বলা যায় না। যোনিপট্ট খুবই বড় ও গোলাকার এবং মেঝে থেকে বেশি উঁচুতে নয়, কেন্দ্র বিন্দুতে শিব লিঙ্গ বেশ ছোট আকারের। আমরা অবশ্য শিব লিঙ্গ বলতে দুটো মিলিয়েই বুঝি। শিব লিঙ্গের পিছনের দেয়ালে দীপচাঁদ ও ত্রিপলচাঁদ, চাঁদ বংশের দুই রাজার অষ্টধাতুতে তৈরি দাঁড়ানো মূর্তি। এও আমার কাছে নতুন, কোনও রাজার মূর্তি মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবতার মূর্তির প্রায় এক সঙ্গে থাকা।

মন্দির পরিসরে বেশ কয়েকটা শিলালিপি দেখতে পেলাম, গোটা কয়েকের লিপি সংস্কৃত মনে হলেও পড়া আমার জ্ঞানে কুলাল না। হিন্দি বা ইংরাজিতে ট্রান্সস্লেষন করে দেওয়া নেই। পরে শুনেছিলাম ওগুলো নাকি সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে স্থাপিত, এবং ডি.সি.সরকার তাঁর লেখা Epigraphica indica-য় এই লিপিগুলোর বর্ণনা করেছেন। পরিসরের এক কোনায় বিরাট এক দেওদার রয়েছে। এক দেওদার বলছি বটে তবে মনে হলো পাশাপাশি দুটো কাণ্ড রয়েছে। প্রত্যেক কাণ্ডের ব্যাস অন্তত তিন মিটার করে হবে। গাছের উচ্চতাও ৪০/৫০মিটারের কম নয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এর শোভা উপভোগ করলাম আমরা।

মন্দির পরিসর থেকে বেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে কিছু দূরে এগোতেই জটাগঙ্গা নদী দেখা গেল। ওপারে যাবার রাস্তাও চোখে পড়ল। পায়ে চলা রাস্তা, টিলার উপর উঠে যাচ্ছে, আর সেই দেওদার শ্রেণীর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে। সামনেই কুবের মন্দির। গঠন শৈলী একই রকম। মন্দিরের সামনে থেকে ফেলে আসা মন্দির-শ্রেণী দেখা যাচ্ছে। সুন্দর দৃশ্য (হতে পারতো), কিন্তু সামনেই গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্মিত শৌচালয় কুৎসিত ভাবে দৃষ্টিরোধ করছে। ছবি তুললাম, শৌচালয়ের বাধা দেওয়া জায়গা বাদ রেখে। তাই মন্দির পরিসরের যতটা সুন্দর ছবি হতে পারতো, তা হলো না। মন্দির চত্বর থেকে নেমে এসে পাকা রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে আবার এক টিলার দিকে পায়ে চলা পথে কিছুটা বেড়িয়ে এলাম, শুনলাম এই রাস্তা ধরেই প্রায় ৩কিমি. এগোলে বৃদ্ধ-জাগেশ্বর মন্দির।


ফেরার পথে মিউজিয়াম দেখতে ঢুকলাম। মন্দির পরিসর থাকে পাওয়া দেবী-দেবতাদের মূর্তি রাখা আছে। কয়েকটির সূক্ষ্মতা দেখবার মতো। নৃত্যরত মহাদেবের মূর্তি খুবই সুন্দর আর অভূতপূর্ব। আর কোথাও নৃত্যরত মহাদেবের মূর্তি আছে কি না শুনিনি। সাধারণত নৃত্যরত মহাদেবের মূর্তি মানেই নটরাজ, অর্থাৎ তাণ্ডব নৃত্যের ভঙিমা। এই মূর্তি নটরাজ নয়। হর-পার্বতীর মূর্তিও অপূর্ব। মিউজিয়াম দেখে ফিরে আসলাম হোটেলে।

থাকার জায়গা ও পথের নিশানা: আগেই বলেছি যে এখানে উত্তরাখণ্ডের পর্যটন বিভাগের লজ আছে। বিস্তারিত জানার জন্যে এদের ওয়েবসাইট দেখা উচিত, ঠিকান, http://www.kmvn.org। এই সাইটেই লজ বুক করতে পারেন। বর্তমানে এখানে দ্বিশয্যা বিশিষ্ট ঘর দিনপ্রতি ১১০০টাকা থেকে আরম্ভ। এ ছাড়া সাধারণ মানের অনেক ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউস ও লজ আছে, যেমন শুভম, রুদ্রাক্ষ, শিবালয় (+৯১৯৪১২১৬৫৯৮৩, +৯১৯৪১০৭২৬৮৩০), হরি ওঁ, জয় শ্রীরাম, জাগনাথ (+৯১৫৯৬২-২৬৩২১৩, +৯১৯৪১১৭৯৪৪৫৬), রাধা ট্যুরিস্ট লজ, ইত্যাদি। এগুলোতে দিন প্রতি দ্বি/ত্রি-শয্যা বিশিষ্ট ঘর, দিন প্রতি ২০০ টাকা থেকে আরম্ভ। অবশ্য যাত্রী আধিক্যে ভাড়া বেড়ে যায়।

এখানে সরাসরি আসতে গেলে সুবিধে কুমায়ুঁ পৌঁছবার রেলস্টেশন-ত্রয়, লালকুঁয়া, হলদোয়ানি বা কাঠগোদাম, এর যে কোনও একটা আপনার সুবিধা মতো পছন্দ করা। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। ১৪/১৫ আসনের গাড়ি এখন প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দিন প্রতি লাগবে। নৈনিতাল থেকে কোনও গাড়ি ঠিক করতে পারেন ফোন করে (যেমন, নৈনা ট্রাভল্‌স, +৯১৫৯৪২-২৩৩৪৪৪, +৯১৯৪১২০৮৪১৩৪), সেই গাড়ি আপনাকে উপরোক্ত তিনটি স্টেশনের যে কোনও একটা থেকে তুলে নেবে। কিছু ট্রাভল এজেন্টের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন, ইন্টারনেটে (http://www.trips2world.net/cars) সার্ফ করে। যদি এই ব্যবস্থা করতে অসমর্থ হন, হলদোয়ানি থেকে গাড়ির সহজেই পেতে পারেন। আর উত্তরাখণ্ডের রোডওয়েজ বাস তো আছেই, তবে সেক্ষেত্রে সময়ের সাশ্রয় না হলেও পয়সার সাশ্রয় হবেই। উত্তরাখণ্ডের পূর্ব দিক থেকে টনকপুর রেল স্টেশন হয়েও লোহাঘাটের দিক থেকে এই দিকে আসা সম্ভব। টনকপুর রেল স্টেশন থেকে গাড়ি পাবেন।

জাগেশ্বর আসার সময় সারা বছরই, তবে ভিড় এড়াবার জন্যে শিব পূজার বিশেষ সময় গুলো যেমন, শিবরাত্রি, চৈত্রসংক্রান্তি, সোমবার, বাদ দেওয়া ভাল। অবশ্য যাঁরা শিব পূজার জন্যেই আসবেন, তাঁদের এইদিন গুলোই বেশি পছন্দ হবে এখানে আসার।

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

 

 

 

 

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।