এখনকার
পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায় যে স্থানের বর্ণনা
ঠিক মত করা আছে। এই বর্ণনার মধ্যে জৌতির্লিঙ্গের
সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না থাকায় আমরা ধারণা
করতেই পারি যে এই আখ্যার কথা পরবর্তীকালে
যোগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে এত কথা লেখার
প্রয়োজন এক মাত্র এখানকার পৌরাণিক ইতিহাস
জানার জন্যেই করলাম, এর জ্যোতির্লিঙ্গ
আখ্যা ঠিক কি বেঠিক, স্থানের সুন্দরতা
তাতে কিছু মাত্র লঘু হয় না।
জাগেশ্বর
মহাদেবের সম্পর্কে এখানে প্রচলিত এক সুন্দর
গল্প আছে। এক সময়ে নাকি শিব এখানে এসে,
স্থানের মনোরম পরিবেশের কারণে ভাল লাগে
এবং যুবক সন্যাসীরূপে ধ্যানে বসেন। স্থানীয়
অধিবাসী মহিলারা এই সংবাদ জানতে পেরে
যে যার গৃহকর্ম ফেলে রেখে সেই সন্যাসী
দর্শনে উপস্থিত হন। গ্রামের পুরুষেরা
বাড়ি ফিরে তাদের স্ত্রীদের গৃহে পান না
আর জানতে পারেন ঘটনার কথা। শিব মায়া বলে
শিশুর আকার নেন। পুরুষেরা তাই দেখে নিশ্চিন্ত
হন, আর তার পর থেকে এই জাগেশ্বর, শিশু
জাগেশ্বর রূপে পূজিত হতে থাকেন। বৃদ্ধ
জাগেশ্বর রূপেও শিব পূজিত হন, তবে এই
মন্দির পরিসরে নয়, প্রায় ৩কিমি দূরে পাশেই
এক পাহাড়ের উপর ‘বৃদ্ধ-জাগেশ্বর’ মন্দিরে।
এখানকার মন্দির পরিসরের সামনের রাস্তা
ধরেই সেখানে যাওয়া যায়। আমরা যখন তা জানতে
পারি, তখন সময়াভাব, তাই আর সেখানে যাওয়া
সম্ভব হয়নি।
এই
মন্দিরের শীর্ষ আর মহামৃত্যুঞ্জয় মন্দিরের
শীর্ষের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে, এর
শীর্ষে পদ্ম নেই, আছে ‘চন্দ্রাতপ’-ঠিক
যেন একটা ছাতা মাথায় মন্দির দাঁড়িয়ে আছে।
এই ছাতা ঘিরে লোহার স্ট্রাক্চারও নেই।
প্রধান দ্বারের দুপাশে প্রমাণ আকারের
মানুষের থেকে বড় দুই বেলে পাথরের মূর্তি,
নন্দি ও স্কন্দির, এবং ‘দারোয়ান’-এর মতোই
হাতে অস্ত্র আছে। উত্তর ভারতে আর কোথাও
নন্দির মূর্তি মানুষের শরীরের, আমার জানা
নেই। দুই মূর্তির মধ্যে কোনটা নন্দি আমি
বুঝতে পারিনি, তবে ডান পাশের মূর্তির
চারটে হাত। এই মন্দিরের গর্ভ গৃহও মন্দিরের
আকার অনুসারে ছোট বলা যায় না। যোনিপট্ট
খুবই বড় ও গোলাকার এবং মেঝে থেকে বেশি
উঁচুতে নয়, কেন্দ্র বিন্দুতে শিব লিঙ্গ
বেশ ছোট আকারের। আমরা অবশ্য শিব লিঙ্গ
বলতে দুটো মিলিয়েই বুঝি। শিব লিঙ্গের
পিছনের দেয়ালে দীপচাঁদ ও ত্রিপলচাঁদ,
চাঁদ বংশের দুই রাজার অষ্টধাতুতে তৈরি
দাঁড়ানো মূর্তি। এও আমার কাছে নতুন, কোনও
রাজার মূর্তি মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবতার
মূর্তির প্রায় এক সঙ্গে থাকা।
মন্দির
পরিসরে বেশ কয়েকটা শিলালিপি দেখতে পেলাম,
গোটা কয়েকের লিপি সংস্কৃত মনে হলেও পড়া
আমার জ্ঞানে কুলাল না। হিন্দি বা ইংরাজিতে
ট্রান্সস্লেষন করে দেওয়া নেই। পরে শুনেছিলাম
ওগুলো নাকি সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে
স্থাপিত, এবং ডি.সি.সরকার তাঁর লেখা Epigraphica
indica-য় এই লিপিগুলোর বর্ণনা করেছেন।
পরিসরের এক কোনায় বিরাট এক দেওদার রয়েছে।
এক দেওদার বলছি বটে তবে মনে হলো পাশাপাশি
দুটো কাণ্ড রয়েছে। প্রত্যেক কাণ্ডের ব্যাস
অন্তত তিন মিটার করে হবে। গাছের উচ্চতাও
৪০/৫০মিটারের কম নয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে
এর শোভা উপভোগ করলাম আমরা।
মন্দির
পরিসর থেকে বেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে কিছু
দূরে এগোতেই জটাগঙ্গা নদী দেখা গেল। ওপারে
যাবার রাস্তাও চোখে পড়ল। পায়ে চলা রাস্তা,
টিলার উপর উঠে যাচ্ছে, আর সেই দেওদার
শ্রেণীর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে। সামনেই
কুবের মন্দির। গঠন শৈলী একই রকম। মন্দিরের
সামনে থেকে ফেলে আসা মন্দির-শ্রেণী দেখা
যাচ্ছে। সুন্দর দৃশ্য (হতে পারতো), কিন্তু
সামনেই গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্মিত শৌচালয়
কুৎসিত ভাবে দৃষ্টিরোধ করছে। ছবি তুললাম,
শৌচালয়ের বাধা দেওয়া জায়গা বাদ রেখে।
তাই মন্দির পরিসরের যতটা সুন্দর ছবি হতে
পারতো, তা হলো না। মন্দির চত্বর থেকে
নেমে এসে পাকা রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে
আবার এক টিলার দিকে পায়ে চলা পথে কিছুটা
বেড়িয়ে এলাম, শুনলাম এই রাস্তা ধরেই প্রায়
৩কিমি. এগোলে বৃদ্ধ-জাগেশ্বর মন্দির।
ফেরার পথে মিউজিয়াম দেখতে ঢুকলাম। মন্দির
পরিসর থাকে পাওয়া দেবী-দেবতাদের মূর্তি
রাখা আছে। কয়েকটির সূক্ষ্মতা দেখবার মতো।
নৃত্যরত মহাদেবের মূর্তি খুবই সুন্দর
আর অভূতপূর্ব। আর কোথাও নৃত্যরত মহাদেবের
মূর্তি আছে কি না শুনিনি। সাধারণত নৃত্যরত
মহাদেবের মূর্তি মানেই নটরাজ, অর্থাৎ
তাণ্ডব নৃত্যের ভঙিমা। এই মূর্তি নটরাজ
নয়। হর-পার্বতীর মূর্তিও অপূর্ব। মিউজিয়াম
দেখে ফিরে আসলাম হোটেলে।
থাকার
জায়গা ও পথের নিশানা: আগেই বলেছি যে এখানে
উত্তরাখণ্ডের পর্যটন বিভাগের লজ আছে।
বিস্তারিত জানার জন্যে এদের ওয়েবসাইট
দেখা উচিত, ঠিকান, http://www.kmvn.org।
এই সাইটেই লজ বুক করতে পারেন। বর্তমানে
এখানে দ্বিশয্যা বিশিষ্ট ঘর দিনপ্রতি
১১০০টাকা থেকে আরম্ভ। এ ছাড়া সাধারণ মানের
অনেক ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউস ও লজ আছে,
যেমন শুভম, রুদ্রাক্ষ, শিবালয় (+৯১৯৪১২১৬৫৯৮৩,
+৯১৯৪১০৭২৬৮৩০), হরি ওঁ, জয় শ্রীরাম,
জাগনাথ (+৯১৫৯৬২-২৬৩২১৩, +৯১৯৪১১৭৯৪৪৫৬),
রাধা ট্যুরিস্ট লজ, ইত্যাদি। এগুলোতে
দিন প্রতি দ্বি/ত্রি-শয্যা বিশিষ্ট ঘর,
দিন প্রতি ২০০ টাকা থেকে আরম্ভ। অবশ্য
যাত্রী আধিক্যে ভাড়া বেড়ে যায়।
এখানে সরাসরি আসতে গেলে সুবিধে কুমায়ুঁ
পৌঁছবার রেলস্টেশন-ত্রয়, লালকুঁয়া, হলদোয়ানি
বা কাঠগোদাম, এর যে কোনও একটা আপনার সুবিধা
মতো পছন্দ করা। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া
করতে পারেন। ১৪/১৫ আসনের গাড়ি এখন প্রায়
৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দিন প্রতি লাগবে।
নৈনিতাল থেকে কোনও গাড়ি ঠিক করতে পারেন
ফোন করে (যেমন, নৈনা ট্রাভল্স, +৯১৫৯৪২-২৩৩৪৪৪,
+৯১৯৪১২০৮৪১৩৪), সেই গাড়ি আপনাকে উপরোক্ত
তিনটি স্টেশনের যে কোনও একটা থেকে তুলে
নেবে। কিছু ট্রাভল এজেন্টের সঙ্গেও যোগাযোগ
করতে পারেন, ইন্টারনেটে (http://www.trips2world.net/cars)
সার্ফ করে। যদি এই ব্যবস্থা করতে অসমর্থ
হন, হলদোয়ানি থেকে গাড়ির সহজেই পেতে পারেন।
আর উত্তরাখণ্ডের রোডওয়েজ বাস তো আছেই,
তবে সেক্ষেত্রে সময়ের সাশ্রয় না হলেও
পয়সার সাশ্রয় হবেই। উত্তরাখণ্ডের পূর্ব
দিক থেকে টনকপুর রেল স্টেশন হয়েও লোহাঘাটের
দিক থেকে এই দিকে আসা সম্ভব। টনকপুর রেল
স্টেশন থেকে গাড়ি পাবেন।
জাগেশ্বর
আসার সময় সারা বছরই, তবে ভিড় এড়াবার জন্যে
শিব পূজার বিশেষ সময় গুলো যেমন, শিবরাত্রি,
চৈত্রসংক্রান্তি, সোমবার, বাদ দেওয়া ভাল।
অবশ্য যাঁরা শিব পূজার জন্যেই আসবেন,
তাঁদের এইদিন গুলোই বেশি পছন্দ হবে এখানে
আসার।
ড.
শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী