পাতাল
ভুবনেশ্বর
-১-
স্কন্দপুরাণের
মানসখণ্ডে আছে, যে পাতালমণ্ডলে মানুষ দর্শন
করতে আসবেন না যতদিন না বল্কল নামে একজন ভগবান
মহাদেবকে লোকসমক্ষে নিয়ে আসবেন। বল্কল দেবাদিদেবের
আরাধনা করার পরই এই গুহা সমস্ত মানুষের কাছে
প্রবেশযোগ্য হবে। আমরা জানি না যে বল্কল নামে
কোনও ব্যক্তি পাতাল ভুবনেশ্বরের এই গুহায় প্রথম
প্রবেশ করে মহাদেবের আরাধনা করছিলেন কি না।
আবার স্কন্দপুরাণের মানসখণ্ডেই বলা হয়েছে যে
অযোধ্যার রাজা ঋতুপর্ণ নাকি প্রথম এই গুহায়
প্রবেশ করেন। আমরা জানি যে পুরাণ আর ইতিহাস
এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে আছে যে সত্য কি, ঠিক
মত বলা খুবই কঠিন।
অযোধ্যায়
সূর্যবংশের কোনও রাজার নাম ঋতুপর্ণ ছিল না,
তবে এই বংশের শেষ রাজা সুমতির পর নন্দ বংশ প্রতিষ্ঠিত
হয় নন্দের দ্বারা, সেই নন্দ বংশে ঋতুপর্ণ নামে
এক রাজা এক সময়ে অযোধ্যায় রাজত্ব করেছিলেন।
ঋতুপর্ণের সঙ্গে নল ও দময়ন্তীর নাম কয়েকটি কারণে
জড়িয়ে আছে। সেই কাহিনি যদিও বেশ চিত্তাকর্ষক
তা হলেও পাতাল ভুবনেশ্বরের সঙ্গে এর কোনও সংযোগ
নেই তাই সে বিষয়ের আর কিছু বলার এখানে প্রয়োজন
নেই। তবে রাজা ঋতুপর্ণের এই গুহা আবিষ্কার সংক্রান্ত
যে কাহিনি প্রচলিত, তা সংক্ষেপে এখানে বলি।
এ কাহিনিও কম চিত্তাকর্ষক নয়।
ঋতুপর্ণ
কোনও এক সময়ে শিকার করতে গিয়ে এক হরিণের দেখা
পান। হরিণকে কিছুতেই তাঁর তিরের পাল্লার মধ্যে
সুবিধাজনক অবস্থায় পান না, কারণ মায়াবী হরিণের
মত সর্বদাই সে দূরে চলে যেতে থাকে। শিকার করার
জন্যে মরিয়া হয়ে হরিণকে ঋতুপর্ণ তাড়া করতে থাকেন।
শেষে হঠাৎ সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। হরিণ অদৃশ্য
হবার জায়গায় গিয়ে পাহাড়ের গায়ে এক গর্ত দেখতে
পেয়ে সেখান দিয়ে ঋতুপর্ণ পাহাড়ের গহ্বরে প্রবেশ
করেন। হরিণের খোঁজ না পেলেও সেই গুহার রক্ষাকর্তা
শেষনাগের দেখা পান। শেষনাগ ঋতুপর্ণকে তার ফণায়
বসিয়ে গুহার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে দেখায়। রাজাকে
প্রভূত শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে বলিয়ান করে
এবং প্রচুর ধনরত্ন দান করে (কেন? তা অবশ্য জানা
নেই)। গুহার বাইরে পৌঁছে দেবার আগে শেষনাগ ঋতুপর্ণের
শপথ আদায় করে নেয় যে তিনি তাঁর এই নতুন পাওয়া
গুণাবলি ও ধনরত্নের উৎসের কারণ কাউকেই জানাবেন
না। এমন কি গুহার কথাও কাউকেই বলবেন না। অন্যথায়
তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হবে।
রাজা
তাঁর প্রাসাদে ফিরে আসলেন প্রচুর ধনরত্ন সঙ্গে
করে আর তাঁর নতুন আহরিত শক্তির কথাও কিছুদিনের
মধ্যেই প্রকাশিত হতে থাকল। স্বাভাবিক ভাবেই
সকলের মনেই এর কারণ জানার জন্যে প্রশ্ন জাগতে
থাকল। অন্যান্যদের থেকে বাঁচতে পারলেও রানির
নাছোড়বান্দা জেরার সামনে শেষ পর্যন্ত তাঁকে
নতি স্বীকার করতেই হল এক সময়। ফল-মৃত্যু। রানি
সত্যই সাহসীনি, কিছুদিনের মধ্যেই রাজার দেওয়া
নির্দেশ অনুযায়ী গুহা খুঁজে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ
করলেন। ভিতরে যাতায়াতের পথ সুগম করলেন, নিচে
নামবার জন্যে গুহার গায়ে পাথর কেটে সিঁড়ি তৈরি
করালেন। এক কথায় গুহার আবিষ্কারক ও সংস্কারক
হলেন। তবে পুরাণে তাঁর নাম উল্লেখ নেই।
ইতিহাসে
পাওয়া যায় যে খ্রিষ্টীয় ৯ম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে
চাঁদ ও কত্যুরি বংশের রাজারা রাজত্ব করতেন এবং
তাঁদের বংশের কোনও রাজা এই গুহার আবিষ্কারক
ও এর বৈশিষ্ট্যতার প্রচারক। এই অঞ্চলের বর্তমান
নাম উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুঁ। উল্লেখ করা যেতে
পারে যে এখানে প্রথম বহিরাগত মানুষ যাদের ‘অসুর’
জাতি বলা হত, আসে ইউফ্রেটিস নদীর উৎসের কাছে
কুম্মু থেকে। কুম্মু থেকেই ‘কুমায়ুঁ’ নামের
উৎপত্তি বলা হয়ে থাকে।
-২-
তবে
কী প্রয়োজন, এই গুহা কে আবিষ্কার ও প্রথম প্রবেশ
করেছিল তা জানার? মানুষ যে এখন এই গুহায় প্রবেশ
করে এর অপরূপ বৈশিষ্ট্যতা উপভোগ করতে পারছে,
সেটাই হল প্রধান কথা। আসুন আমরাও এই গুহায় প্রবেশ
করার জন্যে যাত্রা করি।
এর
আগে আমি আপনাদের উত্তরাখণ্ডের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব
প্রান্তে নেপাল সীমান্তে পিথোরাগড় জেলার লোহাঘাটের
কাছে মায়াবতীর
পরিচয় দিয়েছিলাম। এই লোহাঘাট থেকেই উত্তরে গুপ্তুরি
নামে এক গ্রাম লোহাঘাট-ঘাট-গাংগোলিঘাট-বেরিনাগ-চকৌরি-বাগেশ্বর
রাস্তায়, বেরিনাগ থেকে ২৬কিমি আর গাংগোলিঘাট
থেকে ১৩কিমি দূরে অবস্থিত। এই গুপ্তুরি থেকে
এক ভিন্ন পথে ৯কিমি দূরে পাতাল-ভুবনেশ্বর গ্রাম।
গুহার প্রসিদ্ধির জন্যে গুহার নামেই গ্রামের
নাম। বলা বাহুল্য, নিজের ব্যবস্থাপনায় গাড়ি
না থাকলে এই গ্রামে পৌঁছানো একটু অসুবিধে আছে,
আমি যখন পাতাল-ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম, গুপ্তুরি
থেকে নিচে নামবার কোনও যানবাহন দেখিনি। তবে
প্রধান রাস্তায় যানবাহন চলাচল করে। রাস্তার
অবস্থা বেশ ভালই ছিল। অবশ্য উত্তরাখণ্ডের রাস্তা
ধসের কারণে খারাপ হয়ে গেলেও বেশ তাড়াতাড়ি তা
সারাবার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
একটু
আগে গুপ্তুরি থেকে নিচে নামবার কথা বলেছি। সত্যই
নিচে নামতে হবে, কেননা গুপ্তুরির উচ্চতা প্রায়
১৫০০মি. আর পাতাল-ভুবনেস্বরের ১৩৫০মি.। গাড়ি
এসে দাঁড়ায় এক সমতল জায়গায়। সেখান থেকেই আকাশ
যদি পরিষ্কার থাকে আপনি আপনার সামনে দিগন্ত
বিস্তৃত হিমালয়ের তুষার কিরীটের সারি দেখতে
পাবেন। তার মধ্যে বিখ্যাত ত্রিশূল, নন্দাদেবী,
পঞ্চচুল্লি ইত্যাদি মনে হবে আপনার নাগালের মধ্যেই।
যাঁরা কৌশানি গেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন যে
এই দৃশ্য, সেখানকার দৃশ্য থেকে বেশি ভাল। এ
ছাড়া এখান থেকে সামনের অর্থাৎ যাকে ফোরগ্রাউন্ড
বলা হয়, সেই দৃশ্য অনেক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দৃষ্টি
কিছুটা উত্তর দিকে নিয়ে গেলেই ঢেউ খেলানো চাষের
মাঠ আর তার ওধারেই ঘন সবুজ দেওদার আর পাইন-এ
ঢাকা ক্রমশঃ নীল ও কালো রং হয়ে গিয়ে হঠাৎ তুষার
শুভ্র বর্ণের গম্বুজের সারিতে পরিণত হয়ে গেছে।
কৌশানি থেকে উত্তর দিকে তুষার কিরীট ছাড়া আর
কোনও মন ভোলানো দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় না। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের
সময়ের কথা বলছেন? তা এখানেও সেই রকম দৃশ্য দেখতে
পাবেন।
গ্রামের
মধ্যে বেশ কয়েকটা প্রাচীন মন্দির আছে। মন্দিরগুলো
ছোট এবং মন্দির চত্বরও ছোট। জয় ও বিজয়ের বড়
মূর্তি রয়েছে আর আছে শিব ও পার্বতীর সুন্দর
দুই মূর্তি। অবশ্য মূর্তি ভাঙ্গা। অষ্টভুজা
দেবী চন্ডিকার মূর্তি এবং আরও কিছু মূর্তি সহ
মন্দিরও রয়েছে চত্বরে।
আপনাকে
এখানে থাকবার জায়গা দেখে নিতে হবে। সৌভাগ্যের
কথা, এখানে লোকে গুহা দেখতেই প্রধানত আসেন,
তাই তাঁরা কৌশানি বা চকৌরি থেকে অথবা আলমোড়া
বা নৈনীতাল থেকে গাড়িতে এসে গুহা দেখেই চলে
যান, এখানে রাত কাটাবার কথা চিন্তাও করেন না।
অতএব মোটামুটি সহজেই থাকবার জায়গা পাওয়া যায়,
যদিও থাকবার জায়গা সত্যই খুব বেশি নেই। মন্দির
কমিটির এক গেস্ট হাউস আছে, আমরা সেখানেই উঠেছিলাম।
ব্যবস্থাপনা ধর্মশালার থেকে কিছুটা ভাল। মন্দিরগুলি
এই গেস্ট হাউসের কাছেই। আর আছে কুমায়ুঁ মন্ডল
বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউস। বেশ ভাল ব্যবস্থা।
তবে
গেলেই যে পাবেন, তা হয়ত হবে না, কারণ বিদেশি
পর্যটক ভালই আসেন এখানে। নিগমের ওয়েবসাইটের
[http://www.kmvn.gov.in] সাহায্যে আগে থেকে
ব্যবস্থা করে নেওয়া ভাল।
-৩-
দেওদার
আর পাইনের বনে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট এক মন্দিরের
আকারের চত্বর।
তার মধ্যেই ছোট এক দরজা। সেই দরজাই গুহা-মুখ
ঢাকার জন্যে গঠিত। গুহা-মুখ থেকে প্রায় লম্ব
ভাবে নিচে নেমে গেছে বেশ
পিছলা পাহাড়ের গা, যার উপর সিঁড়ির মত ধাপ কাটা
আছে। দুপাশে লোহার শিকল লাগানো। দুহাতে সেই
শিকল দুটি ধরে নামতে লাগলাম। মনে হল যেন চিমনির
মধ্যে দিয়ে নামছি। বেশ কয়েকবার পিছলে গেলাম,
শিকল ধরে থাকবার কারণে নিচে পড়ে গেলাম না। আমার
পা দুটো অবশ্য নিচে নামবার সিঁড়িতেই ছিল, কিন্তু
সেগুলো প্রায় গোলাকার ও মসৃণ হয়ে গেছে। তার
উপর আবার বাঁ দিকের শিকলের বেশ কয়েকটা আঙটা
পাহাড়ের গা থেকে খুলে গেছে। আমরা ভাবতেই পারি
যে এত দিনে নিশ্চয় তা সংস্কার হয়েছে। যাই হোক,
মনে হল দশ বার মিটার নামবার পর বেশ বড়ই এবং
মোটামুটি কিছুটা উচ্চতাবিশিষ্ট এক সমতল চাতালে
এসে দাঁড়ালাম। দাঁড়াবার জায়গায় জল রয়েছে, রং
তার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। গুহার ভিতরটার রং, তাও একই।
শুনলাম বিদ্যুতের বাতি ব্যবহার করার ব্যবস্থার
আগে মশালের আলোয় গুহা দেখান হত, তাই ভিতরটা
ভুষো কালিতে কালো হয়ে গেছে। অবশ্য জানি না কেন,
দেয়ালে হাত ঘষলে হাতে বিশেষ কালি লাগছে না,
তা হলে জলের রং কি করে কালো হল। না কি কম আলোর
মধ্যে অমন মনে হচ্ছে? জেনারেটারের সাহায্যে
ভিতরটা এখন আলোকিত করা হয়েছে। তা হলেও কালো
রং থাকার জন্যে আলো তেমন ভাবে ছড়াচ্ছে না, অন্ধকার
অন্ধকার মতই লাগে বিশেষ করে বাইরে থেকে ভিতরে
নামার পর।
ভিতরটা প্রায় এক ঘন্টা ঘুরলাম। সঙ্গে গাইড ছিল।
আসলে পূজারি বলে এক গোষ্ঠী আছে, তাদেরই মধ্যে
থেকে
কয়েকজন গাইডের কাজ করে। কোনও সরকারি বন্দোবস্ত
নেই, তবে তাদের সকলকার ব্যবহার বেশ ভালই লেগেছে
আমাদের। আমরা আগেই তাদের ব্যবস্থাপনায় চালিত
গেস্ট হাউসে থাকবার ব্যবস্থা করেই এসেছিলাম
বলে হয়ত আমাদের প্রতি একটু বেশি সদয় ছিল তাও
হতে পারে।
গুহার মধ্যে পরপর ঠিক কি কি দেখেছিলাম তার বর্ণনা
করতে যাচ্ছি না, আর তার প্রয়োজনও নেই। প্রধান
দ্রষ্টব্যের কথাই বলছি। এক জায়গায় নিচে কিছুটা
নলের আকারে এক পিণ্ড, মুন্ড কাটা গনেশ। এর উপর
গুহার ছাদ থেকে একটি গোলাকার পাথর ঝুলছে যার
চারি পাশে মনে হয় যেন পদ্মের আটটি পাপড়ি রয়েছে।
তার থেকে, নিচের পিণ্ডের উপর ফোঁটা ফোঁটা জল
পড়ছে। গাইড আমাদের বোঝাল যে নিচে মুণ্ড কাটা
গণেশ আর উপর থেকে গণেশের ধড়ের উপর ওষুধ দেওয়া
হচ্ছে যতক্ষণ না পর্যন্ত ধড়ের উপর বসাবার জন্যে
আর একটি মাথা নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ কি না প্রিসার্ভেটিভ
দেওয়া হচ্ছে গণেশকে জীবিত রাখতে। এর সঙ্গে এই
ঘটনা ঘটার কারণের পৌরাণিক বিবরণ গাইড দিল। আর
এক জায়গায় বেশ কয়েকটা শঙ্কু বা লিঙাকার পিণ্ড
রয়েছে। এঁরা একজন বদরীনাথ, আর একজন পাথরের অমরনাথ,
আর একজন নাকি কেদারনাথ। আমি অবশ্য গাইডকে বললাম
না যে কেদারনাথ তো লিঙাকার নয়, তা হলে এখানে
কেন এমন হলেন। কয়েকটি অদ্ভুত প্রাকৃতিক ভাস্কর্য
দেখলাম, তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখ করার মত ‘কালভৈরব’-এর
জিভ। মানুষ হাঁ করলে তার মধ্যে ভিতর দিকে আলজিভ
দেখা যায়, হুবহু তেমনই দেখতে। কেবল মাত্র স্কেলের
তফাৎ, এটা বিরাটকার, হাঁয়ের ব্যাস প্রায় দুই
মিটার, আর আলজিভও ছোট নয়, প্রায় দেড় মিটার,
এবং ঝুলন্ত। আর একটি বিশেষ ভাস্কর্য, গুহার
দেয়ালে সাদা রাজহাঁস, গলার কাছ থেকে উলটো দিকে
ঘোরানো। সামনে ছোট ছোট কয়েকটি কুণ্ড। গাইডের
বক্তব্য, ব্রহ্মা এই হাঁসকে কুণ্ডের জল রক্ষা
করতে বলেছিলেন কিন্তু হাঁস নিজেই সেই জল পান
করে। তাই ব্রহ্মার অভিশাপে হাঁসের মুণ্ড বেঁকে
গেছে। সে যাই হোক, হাঁসের ‘মূর্তি’ খুবই পরিষ্কার।
যে কারণে গুহার মধ্যে প্রাকৃতিক ভাস্কর্য তিল
তিল করে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তৈরি হয়ে থাকে তা
থেকে এই দুটির ব্যাখ্যা দেওয়া বেশ কঠিন।
বেশ বড় আকারের এক হল ঘরের মতো জায়গা। সেখানে
লিঙ্গ আকারে স্ট্যালাগ্মাইট, যোনি-পট্ট সহ
তামায় বাঁধানো, শিব লিঙ্গের আকার দেওয়া হয়েছে।
উপরের স্ট্যালাক্টাইট থেকে বিন্দু বিন্দু ক্যালসিয়ামের
যৌগিক মেশানো জল পড়ছে লিঙ্গের মাথায়। লিঙ্গের
নাম দেওয়া হয়েছে ‘নর্মদেশ্বর মহাদেব।‘ বলা হয়
যে এই গুহায় আদিগুরু শঙ্করাচার্য এসেছিলেন এবং
তিনিই এই শিবলিঙ্গ তামায় বাঁধিয়ে দেন।
গুহার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা মোটা
মোটা থামের আকার, ‘ঐরাবত’-এর পা, ফুল-ফল ধরা
গাছের আকার গুহার দেয়ালে, স্বর্গের ‘পারিজাত
বৃক্ষ,’ ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত দেয়ালের অনেকটা
জায়গা জুড়ে সাদা ঢেউ খেলানো চুলের আকার, ‘মহাদেবের
জটা’ ইত্যাদি আরও প্রাকৃতিক কারুকার্য, দেখতে
ভালই লাগে।
পাঠকের যদি গুহার মধ্যেকার বিষয়ে আরও বেশি করে,
বিশেষ করে ধার্মিক দৃষ্টিকোণে জানবার ইচ্ছা
হয় তাহলে চেন্নাই-এর হিন্দু খবরের কাগজের এবং
আর একটি লেখার ওয়েবপেজের ঠিকানা দিচ্ছি, সেই
দুটো পড়ে দেখতে পারেন [http://www.thehindu.com/thehindu/fr/2003/05/23/stories/
2003052301451000.htm ও http://www.pilgrimagesofindia.com/patalhtml]।
-৪-
গুহা
সৃষ্টির কারণ থেকেই জানা যায় যে গুহা অনেক সময়েই
গোষ্ঠী আকারে হয়। গোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে
যোগাযোগ থাকা বিচিত্র নয়। পাতাল-ভুবনেশ্বরেও
একাধিক গুহা আছে। জানা নেই যে তাদের মধ্যে যোগাযোগ
আছে কি না। তবে থাকা বিচিত্র নয়, কেননা পাতাল-ভুবনেশ্বর
গুহার মধ্যে অনেক শাখা-প্রশাখা আছে যেগুলোয়
মানুষ যায় না। কাজেই সেইগুলোর মধ্যে দিয়ে যোগাযোগের
সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই সুযোগে বলি
যে যদি বিজ্ঞানীরা এই সমস্ত গুহা এক্সপ্লোর
করতেন তা হলে এই বিষয়ে অনেক কিছু জানার সম্ভাবনা
ছিল। এখানে যে তা হয়নি আমি এই কারণে বলছি যে
কয়েকজন এই বিষয়ের বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে কথা বলেছি,
তাঁরা এই গুহার নামই শোনেননি।
পাতাল-ভুবনেশ্বর
নামের গুহাই এখানে বিখ্যাত এবং কেবল মাত্র এই
গুহারই ভিতরে যাবার ব্যবস্থা আছে। অন্যান্য
গুহায় ভিতরে যাবার কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে,
তা সত্ত্বেও আমরা আরও একটি গুহায় ঢুকেছিলাম,
গ্রামে থাকবার এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সখ্যতা
গড়ার সুবাদে। স্থানীয় একজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে
আমরা ‘শিতলা গুহা’-য় টর্চ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে
ঢুকলাম, কারণ গুহামুখ মাত্র দেড় মিটার ব্যাস
যুক্ত। জমি থেকে কিছু উপরে এই মুখ। গুহার মধ্যে
কিছুটা এগোবার পর কোমর ঝুঁকিয়ে হাঁটতে পারা
গেল। মনে হলো প্রধান গুহা থেকেও এই গুহায় স্ট্যালেক্মাইট,
স্ট্যালেগ্মাইটের ভাস্কর্য আরও বৈচিত্রময়।
গাইডের বাধার জন্যে খুব অল্প দূর পর্যন্তই ঢুকলাম।
লোকজন না যাবার এবং ড্যাম্পের কারণে শ্যাওলা,
তা ছাড়া সাপের ভয় তো ছিলই। যা দেখলাম তার বর্ণনা
ভাষায় না করে কিছু ছবি রয়েছে, সেগুলোই নিজেদের
বর্ণনা করবে।
এই গুহার নাম ‘শিতলা গুহা’ হবার কারণ গাইডের
কথা অনুযায়ী গ্রামে ‘মায়ের দয়া’-র প্রাদুর্ভাব
আর এই গুহার মধ্যে দেয়ালে গুটির মত ইরাপশ্ন
দেখা দেওয়া নাকি একই সঙ্গে হয়। তবে প্রশ্নের
মুখে পড়ে গাইডের কথা, যে সে এই ব্যাপার কখনও
দেখেনি।
-৫-
গুহা সৃষ্টির কথা কিছু আগে উল্লেখ করেছিলাম।
সেই সূত্রেই বলি যে এই প্রকারের গুহা আরও আছে
কিনা জানবার চেষ্টা করলাম। সহজেই জানা গেল যে
এমন গুহা অসংখ্য আছে। তবে ‘এমন গুহা’ বলতে আমি
এই প্রকার বিশেষ প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের উপস্থিতির
কথা বলছি না। যদি তাই বলা হয়, তবে তার সংখ্যা
খুব বেশি নেই। শিতলা গুহার মত গুহা অবশ্য বেশ
কিছু আছে, যেমন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে মৌসমাই
গুহা আর উত্তরাখণ্ড রাজ্যের মেহেরগাঁও-এ মহাদেব
গুহা। পাতাল-ভুবনেশ্বর গুহার সঙ্গে কিছুটা মিল
পাওয়া যায় ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ‘বড়-গোহালি’
গুহায়। আর আমেরিকার যুক্তরাজ্যে নিউ মেক্সিকো
ও টেক্সাসে রাজ্যদ্বয়ের মাঝে ‘কার্লসবাড ট্যাভার্ন’-এর
[http://www.nps.gov/cave/index.htm] সঙ্গে
পাতাল-ভুবনেশ্বর গুহার মিল অনেকটাই, তবে ট্যাভার্নের
আকার বেশ কয়েকগুণ বেশি এর থেকে।
-৬-
আমরা দ্বিতীয় দিন ভোর বেলা উঠে বেশ মুষড়ে পড়লাম,
কারণ কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে আছে। তবে বেশ তাড়াতাড়ি
কুয়াশা কেটে যেতে থাকল। আর তার সঙ্গেই এক অভূতপূর্ব
দৃশ্য দেখতে পেলাম। আগেই বলেছি গ্রামের মাঝে
ঢেউ খেলানো
চাষের
মাঠ, তার মাঝেই এক ছোট্ট পাহাড়। এর পর জমি ক্রমশ
নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। দূরে সবুজ থেকে নীলে
এবং তার পর কালোয় ঘিরে ধরে আছে আমাদের। তার
মধ্যে থেকে মাথা চাড়া দিয়ে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে
তুষার কিরীটের সারি। সেই অন্ধকারের দিক থেকে
আমাদের সামনে দিয়ে শ্বেত শুভ্র কুয়াশার বেগবতী
নদী আমাদের বাঁ দিক থেকে ডান দিকে ছুটে চলে
যাচ্ছে। আমরা সেই নদীর তলের উপরে দাঁড়িয়ে আছি।
মাঝে মাঝে নদীর চরের মত নিচের সবুজ দেখা দিচ্ছে
আর তার মধ্যে পূর্বাকাশ থেকে সূর্য রশ্মি কেমন
করে পথ করে নিয়ে সেই সবুজ চর জায়গায় জায়গায়
আলোকিত করছে। তবে চরও স্থির নয়, আপাত বেগময়,
কুয়াশার বেগের কারণে। সেই বেগময় চরের মাঝে হঠাৎ
কোনও চলন্ত গাড়ির চকিত চপল চাহনি, সূর্যকিরণের
বদান্যতায়। ইতিমধ্যে নদীর ক্ষণিক উপস্থিতির
অন্ত হয়ে গেছে, যেন কুহকিনী তার খেলা শেষ করে
রঙ্গমঞ্চ পরবর্তী অভিনেতার জন্যে ছেড়ে দিয়েছে।
এবং সত্যই সুনীল মেঘহীন আকাশ রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত
হয়েছে তার মায়াজাল বিস্তার করে। এর সঙ্গে প্রায়
দিক্চক্রবালের কাছে প্রকৃতি দেবীর সবুজ শাড়ির
রুপালি পাড়ের মত ‘রামগঙ্গা’-র দর্শন, আর কী
চাই?
ড.
শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী