বৈদিক বা
হিন্দু দর্শনের মূল উৎস হল বেদ| দর্শন শব্দটি
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল দেখা বা অভিজ্ঞতা| সত্যকে
জানাই হল এর মূল উদ্দেশ্য| বৈদিক দর্শনের একটি
প্রধান বৈশিষ্ট হল মোক্ষলাভের উপায় বলে দেওয়া|
ছয়টি তত্ত্বে
বৈদিক দর্শন বিভক্ত| যে তত্ত্বগুলি বেদের শিক্ষার
উপর ভিত্তি করে আলোচিত হয়েছে সেগুলিকে আস্তিক
বলা হয় এবং সেগুলি হল – ১) ঋষি গোতমের ন্যায় ২)
ঋষি কণাদের বৈশেষিক ৩)ঋষি জৈমিনির পূর্ব মিমাংসা
৪) ঋষি কপিলের সাংখ্য ৫) ঋষি পাতঞ্জলির যোগ এবং
৬) ঋষি ব্যাসের বেদান্ত| এদের মধ্যে সাংখ্য ও
পূর্ব মিমাংসা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না|
পন্ডিতগণের মতে এই তত্ত্বগুলি খৃষ্টপূর্ব ৬০০
থেকে ২০০ বছর পূর্বে প্রচলিত হয়েছিল|
যদিও বৈদিক দর্শনে ছয়টি তত্ত্ব আছে কিন্তু তারা
পরস্পর বিরোধী নয়| পন্ডিতগণ মনে করেন যে এই ছয়টি
তত্ত্বের মধ্যে একটি সমন্বয়ভাব আছে| এক একটি তত্ত্ব
ধাপে ধাপে সত্য থেকে উচ্চতর সত্যে, উচ্চতর সত্য
থেকে উচ্চতম সত্যে পৌঁছতে সাহায্য করে| ন্যায়
ও বৈশেষিক তত্ত্ব মানুষের মনকে প্রস্তুত করে দর্শন
তত্ত্ব বুঝতে, মিমাংসা, সাংখ্য এবং যোগ এই তিনটি
তত্ত্ব মানুষের মনকে আরও উচ্চমানের দর্শন তত্ত্ব
শিক্ষা দেয়, সর্বশেষে আসে বেদান্ত, যা আরও উচ্চস্তরের
দর্শন| বর্তমানে বৈশেষিকীর প্রাধান্য খুবই কম,
ন্যায় যুক্তিতত্ত্বের বিশেষ অঙ্গ হিসাবে আলোচিত
হয়, মিমাংসা সমাজের আইনগত নীতি সহায়ক, সাংখ্য
আলোচিত হয় বেদান্ত দর্শনের অঙ্গ হিসাবে| যোগ এবং
বেদান্ত এই দুটিকেই বর্তমানে প্রাধান্য দেওয়া
হয়| যোগ মোক্ষলাভের পথ ও উপায় প্রসঙ্গে আলোচিত
হয়| বেদান্ত দর্শনই হিন্দু ধর্মের মুখ্য দর্শন
হিসাবে গণ্য হয়|
ন্যায়
ঋষি গোতম
(গৌতম) ন্যায় দর্শনের প্রবর্তক| তাঁর রচিত ‘ন্যায়-সূত্র’
পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং প্রতি অধ্যায়ে দুইটি
করে আহ্নিক বা ভাগ আছে| এই সূত্রটির প্রধান উদ্দেশ্য
হল যথাযথ ভাবে চিন্তার সাহায্যে সত্যকার জ্ঞান
লাভ করা| কেননা সত্য জ্ঞান লাভ হলেই এই জীবনে
মুক্তি বা মোক্ষলাভ করা সম্ভব তাহলেই মানুষ জীবনের
সব ব্যথা ও দুঃখের থেকে মুক্তিলাভ হবে|
এই তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয় হল যে মোক্ষলাভই
মানুষের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য| এই দর্শন শিক্ষা
দেয় যে জ্ঞানহীনতা বা অজ্ঞানতাই মানুষের জীবনে
দুঃখের কারণ এবং মোক্ষলাভ হলেই সেই দুঃখের নিবৃত্তি
হয়| মোক্ষলাভ তখনই সম্ভব যখন মানুষ পরম ব্রহ্মের
জ্ঞান প্রাপ্ত হয়| সুখ এবং দুঃখ মানুষের আত্মার
প্রকৃতি নয়, তারা আত্মার বৈশিষ্ট| এই সুখ-দুঃখ
থেকে মুক্তিলাভ হল অপবর্গ বা মোক্ষলাভ| এই মতবাদ
স্বীকার করে যে মৃত্যুর পরে মুক্ত মানুষের কোন
চিন্তা বা ইচ্ছা থাকে না| আত্মা যখন এই দেহ ও
মনের সহিত সংযুক্ত হয় তখনই দুঃখের উৎপত্তি হয়|
মৃত্যুতে মানুষের দেহই কেবল নষ্ট হয়, আত্মার কোন
পরিবর্তন হয় না| আত্মা শুধুমাত্র আর এক মনুষ্য
দেহ অবলম্বন করে| মন আত্মার সংস্পর্শে থাকে| মানুষের
সম্যক জ্ঞানহীনতাই অন্তরের আত্মার সঙ্গে দেহ ও
মনের সম্পর্ক গড়ে তোলে যদিও আত্মার কাছে এর কোন
প্রয়োজন নেই| সত্যকারের জ্ঞান লাভ হলেই এই সম্পর্ক
ছিন্ন হয়|
বৈশেষিক
ঋষি কণাদ
(বা ঋষি উলুক) বৈশেষিক দর্শনের প্রবর্তক| তাঁর
রচিত বৈশেষিক-সূত্র গ্রন্থে দশটি অধ্যায় আছে এবং
প্রতিটি অধ্যায়ে দুটি করে আহ্নিক বা ভাগ আছে|
ঋষি গোতমের ‘ন্যায়’ এবং ঋষি কণাদের ‘বৈশেষিক’
এই দুই দর্শন তত্ত্বের মধ্যে অনেক মিল পাওয়া যায়|
দুটি তত্ত্বেরই প্রতিপাদ্য বিষয় হল যে মোক্ষলাভই
মানুষের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য|
ঋষি গোতমের ন্যায় দর্শনের মত ঋষি কণাদের বৈশেষিক
দর্শনও শিক্ষা দেয় যে জ্ঞানহীনতা বা অজ্ঞানতাই
মানুষের জীবনে দুঃখের কারণ এবং মোক্ষলাভ হলেই
সেই দুঃখের নিবৃত্তি হয়| মোক্ষলাভ তখনই সম্ভব
যখন মানুষ পরম ব্রহ্মের জ্ঞান প্রাপ্ত হয়| বৈশেষিক
মতবাদেরও শিক্ষা হল যে সুখ এবং দুঃখ মানুষের আত্মার
প্রকৃতি নয়, তারা আত্মার বৈশিষ্ট| এই সুখ-দুঃখ
থেকে মুক্তিলাভ হল অপবর্গ বা মোক্ষলাভ| এই মতবাদ
স্বীকার করে যে মৃত্যুর পরে মুক্ত মানুষের কোন
চিন্তা বা ইচ্ছা থাকে না| আত্মা যখন এই দেহ ও
মনের সহিত সংযুক্ত হয় তখনই দুঃখের উৎপত্তি হয়|
মৃত্যুতে মানুষের দেহই কেবল নষ্ট হয়, আত্মার কোন
পরিবর্তন হয় না| আত্মা শুধুমাত্র আর এক মনুষ্য
দেহ অবলম্বন করে| মন আত্মার সংস্পর্শে থাকে| মানুষের
সম্যক জ্ঞানহীনতাই অন্তরের আত্মার সঙ্গে দেহ ও
মনের সম্পর্ক গড়ে তোলে যদিও আত্মার কাছে এর কোন
প্রয়োজন নেই| সত্যকারের জ্ঞান লাভ হলেই এই সম্পর্ক
ছিন্ন হয়|
পূর্ব মিমাংসা
ঋষি জৈমিনী
হলেন পূর্ব মিমাংসা দর্শনের প্রবক্তা এবং তাঁর
রচিত মিমাংসা সূত্র গ্রন্থে এই দর্শনের বিস্তারিত
আলোচনা পাওয়া যায়| পরে কুমারিলভট্ট ও প্রভাকর
এই দর্শন আলোচনা করে গ্রন্থ লিখেছেন| মিমাংসা
শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল গভীর চিন্তা এবং
পুংখানুপুংখ ভাবে বিচার করে কোন প্রশ্নের বা সমস্যার
সমাধান করা|
মিমাংসা
দর্শন প্রধানতঃ বেদের যাগযজ্ঞাদি কর্মকান্ডের
ন্যায্যতা সমর্থন করে| দুটি ভাবে এটি করা হয়েছে
– প্রথমতঃ বেদের যাগযজ্ঞাদি পদ্ধতির ব্যাখ্যা
দেওয়া হয়েছে যাতে সেই সব কঠিন পদ্ধতিসমূহ সহজভাবে
বুঝতে পারা যায় এবং দ্বিতীয়তঃ বেদের যাগযজ্ঞাদি
যেসব বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয় সেইগুলির
দার্শনিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে| এক কথায় মিমাংসা
দর্শন বৈদিক যাগযজ্ঞের সমর্থনকারী দর্শন|
মিমাংসা
দর্শন জ্ঞানের উৎপত্তি, চরিত্র ও বৈধতা নিয়ে বিস্তারিত
আলোচনা করেছে| এই দর্শন বলে যে জ্ঞানের উৎস হল
দুটি, প্রত্যক্ষ এবং কারও মাধ্যমে| প্রত্যক্ষ
জ্ঞান হল যা আছে বা ছিল অর্থাৎ সৎ| জ্ঞানের দ্বিতীয়
উৎস হল যখন জ্ঞান মানুষের মনের উপলব্ধির মাধ্যমে
আহরিত হয়| জ্ঞান আহরণ করার পাঁচটি উপায় মিমাংসা
দর্শনে বলা হয়েছে, যথা ১) অনুমান ২) উপমান ৩)
শব্দ ৪) অর্থাপত্তি এবং ৫) অনুপলব্ধি| জ্ঞানের
বৈধতা সম্বন্ধে আলোচনায় মিমাংসা দর্শন শিক্ষা
দেয় যা প্রথমতঃ জ্ঞানের প্রকৃত উৎসই তার বৈধতা
স্হাপন করে এবং দ্বিতীয়তঃ জ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্রই
তা বিশ্বাসে পরিগণিত হয়| জ্ঞানের বৈধতা সম্পর্কে
এই দ্বৈত মত স্বতঃ প্রামাণ্যবাদ বলে পরিচিত|
মিমাংসা
দর্শন বিশ্বাস করে যে বিশ্বজগৎ সত্য| এই দর্শন
বিশ্বাস করে যে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি নেই,
সম্পূর্ণ ধ্বংসও নেই| এই বিশ্বজগতের কোন সৃষ্টিকর্তা
নেই| এই দর্শনের মতে আত্মা চিরস্হায়ী, অবিনশ্বর
ও অমর এবং মানুষের দেহের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে
জড়িত| আত্মার মৃত্যু নেই এবং আত্মা মানুষ জীবনের
কার্য্যের ফলাফল ভোগ করে| মিমাংসা দর্শন বলে আত্মা
অনেক অর্থাৎ যত মানুষ তত আত্মা| এই আত্মা জীবদেহে
বদ্ধ কিন্তু মুক্তি বা মোক্ষলাভে সমর্থ|
পূর্বেই বলা হয়েছে যে মিমাংসা দর্শনের মূখ্য উদ্দেশ্য
হল বেদের যাগযজ্ঞের ন্যায্যতা স্হাপন করা| তাই
এই দর্শন বলে যে মানব-আত্মা এই বিশ্বে অনুষ্ঠিত
যাগযজ্ঞাদির ফল ভোগ করে অর্থাৎ যখন উপযুক্ত সময়
আসে তখনই মানুষ যজ্ঞফল ভোগ করে| এই মত যা অপূর্ব
নামে অভিহিত হয় তা ব্যাখ্যা করে কি ভাবে মানুষ
এক জন্মে কৃত যজ্ঞফল আর এক জন্মে ভোগ করার সুযোগ
পায়| এইজন্য মিমাংসা দর্শন শিক্ষা দেয় যে বৈদিক
যাগযজ্ঞাদি যেভাবে বেদে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেই
ভাবে সম্পন্ন করা উচিত এবং প্রয়োজন| কেননা এগুলির
প্রয়োজন এই অর্থে যে এগুলি বৈদিক ধর্ম পালনের
অঙ্গ এবং বেদের, যা হল অপৌরষেয়, নির্দেশ ও আদেশ|
মিমাংসা
দর্শন মতে বিভিন্ন মানব দেহে আত্মা বিভিন্ন যদিও
আত্মা অবিনশ্বর ও অমর| আত্মার দুই অংশ – একটি
আধ্যাত্মিক এবং অপরটি জৈবিক| আধ্যাত্মিক আত্মা
মানুষের সব অভিজ্ঞতার দর্শক বা সাক্ষী| প্রকৃত
জ্ঞান লাভ করলেই এই আত্মাকে জানতে পারা যায় অর্থাৎ
আত্মোপলব্ধি হয়| জৈবিক আত্মা মানুষের সুখ-দুঃখ,
কষ্ট ইত্যাদি অনুভব করে কেননা এইসব অনুভূতি মানুষের
মনের প্রকৃত দশা বা অবস্হা নয়, এগুলি হল জৈবিক
আত্মার রূপান্তরিত ভাব| মিমাংসা দর্শন বলে যে
এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের শুরু বা শেষ নেই অর্থাৎ
এই বিশ্বব্রহ্মান্ড চিরন্তন; যদিও মানুষ এই বিশ্বে
আবির্ভূত হবে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে এবং শেষে বিনষ্ট
হয়ে যাবে অর্থাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হবে| পূর্ব মিমাংসা
সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে না যেমন সাংখ্য দর্শনও
করে না|