সাংখ্য
ঋষি কপিল
এই দর্শনের প্রবক্তা| পন্ডিতগণ মনে করেন যে ঋষি
কপিল বুদ্ধেরও আগে| পন্ডিতগণ আরও মনে করেন যে
তত্ত্বসমাস ও সাংখ্য প্রবচন এই দুই গ্রন্থ ঋষি
কপিল রচিত| তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত ঈশ্বরকৃষ্ণের
সাংখ্যকারিকা সাংখ্য দর্শনের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ|
গৌড়পাদ রচিত সাংখ্যকারিকা ভাষ্য, বাচস্পতি রচিত
তত্ত্বকৌমুদী এবং অনিরুদ্ধ রচিত সাংখ্য প্রবচন
সূত্রবৃত্তি সাংখ্য দর্শনের প্রধান গ্রন্থসমূহের
মধ্যে পড়ে|
সাংখ্য দর্শনের
মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘দুঃখ নিবৃত্তি’ অর্থাৎ
মানুষের জীবনে দুঃখের অবসান ঘটাতে হবে| সাংখ্য
মতে দুঃখ তিন প্রকারের – ১)আধ্যাত্মিকা – রোগ
হতে উৎপন্ন এই দেহের ও মনের কষ্টসমূহ ২)আদিভৌতিক
– বর্হিজগৎ হতে উৎপন্ন দুঃখসমূহ এবং ৩) আদিদৈবিক
– গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতির কোপ হতে উৎপন্ন দুঃখসমূহ|
সাংখ্য দর্শন মতে সঠিক জ্ঞান লাভ হলে অর্থাৎ যখন
প্রকৃতি ও পুরুষ সম্পর্কে সম্যক্ জ্ঞান লাভ হয়
তখনই এই সকল দুঃখ দূর হয়|
সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতি তত্ত্ব প্রধানতঃ সৎকার্যবাদের
ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত| এই সৎকার্যবাদের শিক্ষা
হল যে সব কিছুর ফল তা বস্তুর মধ্যেই নিহিত থাকে|
যেমন দুধের মধ্যেই ছানা অবস্হান করে| সৎকার্যবাদের
মধ্যে দুটি ভাগ আছে – পরিণামবাদ ও বির্বতবাদ|
পরিণামবাদের মতে যাহা হতে কোন ফল উৎপন্ন হয় তখন
তাহাও পরিবর্তিত হয়, যেমন দুধ থেকে ছানা প্রস্তুত
করলে দুধেরও পরিবর্তন হয়| বির্বতবাদ শিক্ষা দেয়
যে ফলের উৎপত্তি হলেও যাহা হতে ফলের উৎপন্ন হল
তাহার পরিবর্তন আপাত দৃষ্টিতে পরিবর্তিত হয়েছে
বলে মনে হয়| যেমন রজ্জুতে সর্প ভ্রম| এস্হলে রজ্জুর
কোন পরিবর্তন হয় না অর্থাৎ রজ্জু সর্পে পরিণত
হয় না| রজ্জুটিকে আপাতদৃষ্টিতে কেবলমাত্র সর্প
বলে মনে হয়| সেইরূপ, ব্রহ্ম হতে বিশ্বসৃষ্টি হলেও
ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন হয় না কিন্তু আমরা মনে
করি যে ব্রহ্মই পরিবর্তিত হয়ে বিশ্বজগতে পরিণত
হয়েছেন|
সাংখ্য
দর্শন দ্বৈতবাদী কেননা এই দর্শনে দুটি তত্ত্ব
আছে, যথা – পুরুষ ও প্রকৃতি| সাংখ্য দর্শনের মতে
পুরুষ প্রকৃতি হতে স্বাধীন, নিষ্ক্রিয় চৈতন্য,
অপরিবর্তনশীল এবং গুণত্রয়ের ঊর্দ্ধে| পুরুষ হল
চেতন, র্নিগুণ, অপরিণামী, অকর্তা, উদাসীন ও সাক্ষিমাত্র|
পুরুষ হল বিশ্বনিয়ন্ত্রা এবং বিশ্বসৃস্টির প্রথম
ও প্রধান কারণ| বিশ্বনিয়ন্ত্রা হিসাবে পুরুষ এই
বিশ্বের সব কিছু পরিবর্তন ঘটান কিন্তু তাতে পুরুষের
কোন পরিবর্তন হয় না| গুণত্রয়ের প্রভাবই বিশ্বের
পরিবর্তনের মূল| পুরুষ সদা মুক্ত এবং কাল (সময়),
স্হান ও কারণের ঊর্দ্ধে| পুরুষের আরম্ভও নেই তেমন
শেষও নেই, পুরুষ চিরস্হায়ী| পুরুষ হল শুদ্ধ, বুদ্ধ
ও মুক্ত|
সাংখ্য
দর্শনের পুরুষ এবং বেদান্তের আত্মার মধ্যে অনেক
মিল আছে| কিন্তু প্রধান পার্থক্য হল যে বেদান্তের
আত্মা অপরিবর্তনশীল এবং ব্রহ্মের সহিত কোন প্রভেদ
নেই কিন্তু সাংখ্যের পুরুষ হল বহু|
অপরপক্ষে, সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতির মধ্যেই বিশ্বজগতের
সমূ্হ বস্তু অবস্হান করে| প্রকৃতি অত্যন্ত সক্রিয়
এবং তা হতেই বিশ্বজগতের সব কিছু উৎপন্ন হয়| যদিও
প্রকৃতিই বিশ্বজগতের সমূ্হ বস্তুর উৎপত্তির কারণ
কিন্তু প্রকৃতির উৎপত্তির নিজস্ব কোন কারণ নেই|
প্রকৃতি হল জড়া, গুণময়ী, পরিণামিনী, প্রসবধর্মী
অর্থাৎ সৃষ্টিসমর্থা| প্রকৃতি অসাধারণ শক্তিময়ী
এবং চক্রানুক্রমে বিশ্বসৃষ্টি ও ধ্বংসের কারণ|
পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগেই সৃষ্টি হয় এই সংসার|
প্রকৃতি গুণত্রয়ের অর্থাৎ সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ
এই তিন গুণের সমন্বয়ে গঠিত| প্রকৃতিতে তিনটি গুণই
সমাবস্হায় অবস্হিত| সত্ত্বগুণের চরিত্র হল সুখ
বা আনন্দ এবং উজ্জ্বল| সত্ত্বগুণের প্রভাবে মানুষের
মনে আনন্দ, পরমসুখ ইত্যাদির উদয় হয়| রজঃ গুণের
চরিত্র হল সদা কার্য্যতৎপরতা বা কর্মশীলতা অর্থাৎ
সর্বদা কর্মে নিযুক্ত থাকা| রজঃ গুণ হতেই মানুষের
সব দুঃখের উৎপত্তি| তমঃ গুণের চরিত্র হল নিষ্ক্রিয়তা
বা আলস্য| তমঃ গুণের প্রভাবে মানুষ আলস্যপরায়ণ
হয়, সদা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে এবং বিষাদে ভোগে|
এই গুণত্রয়
সর্বদাই একত্রে অবস্হান করে তবে সময় বিশেষে একটির
প্রাধান্য প্রকাশ পায়| যখন তমঃ গুণ প্রভাবশালী
হয় তখন মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে| আবার যখন রজঃ
গুণ প্রভাবশালী হয় তখন মানুষ অনবরত কর্মে নিযুক্ত
থাকে| সত্ত্বঃ গুণ প্রভাবশালী মানুষ পরমসুখে আনন্দে
দিন অতিবাহিত করে| এই গুণত্রয় সর্বদাই পরিবর্তনশীল|
সর্বদাই একে অপরকে অতিক্রান্ত করবার চেষ্টায় নিযুক্ত|
বস্তুর চরিত্র নির্ভর করে কোন গুণটি সেই বস্তুতে
সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী |
সাংখ্য দর্শন মতে এই গুণত্রয় দুরকম ভাবে পরিবর্তিত
হয় – ১) স্বরূপ পরিণাম এবং ২) বিরূপ পরিণাম| পূর্বেই
বলা হয়েছে যে গুণত্রয় সদা পরিবর্তনশীল| সময় সময়
এই পরিবর্তনের সময় গুণগুলি শুধুমাত্র নিজেদের
মধ্যেই পরিবর্তিত হয়; অন্য গুণকে প্রভাবিত করে
না| এর ফলে এই পরিবর্তনের সময় গুণত্রয় কোন কিছু
সৃষ্টি করে না| সৃষ্টির পূর্বে গুণত্রয় এইরূপ
অবস্হায় থাকে; এই অবস্হাকে বলা হয় সমাবস্হা| গুণত্রয়ের
এই সমাবস্হাকেই সাংখ্য দর্শন নাম দিয়েছে ‘প্রকৃতি’|
গুণত্রয়ের দ্বিতীয় পরিবর্তন বিরূপ পরিণাম| এই
পরিবর্তনের সময় একটি গুণ অন্য দুটিকে প্রভাবিত
করে যাতে সেই গুণটি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়| এরূপ
পরিবর্তনের সময়ই হল সৃষ্টির সময় বা শুরু| এই সময়
প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ঘটে আর এই সংযোগের ফলেই
বিশ্বের সৃষ্টি| এই সৃষ্টির প্রথমেই যা উৎপন্ন
হয় তাকে বলা হয় ‘মহৎ’ অর্থাৎ মহাজাগতিক বুদ্ধি|
এরপর সৃষ্টি হয় বুদ্ধি; যে বুদ্ধির সাহায্যে আমাদের
বিচক্ষণতা প্রকাশ পায়, বস্তুর মধ্যে পার্থক্য
সম্পর্কে আমাদের অবহিত করতে সাহায্য করে| যেহেতু
বুদ্ধির উৎপত্তি প্রকৃতি হতে সেহেতু বুদ্ধিতে
গুণত্রয় অবস্হান করে| কাজেই যখন সত্ত্বগুণ প্রভাবশালী
হয় তখন বুদ্ধির অধিকারী মানুষ সৎ, শান্ত ও ধার্মিক
হয়| রজঃ গুণ প্রভাবশালী হলে মানুষ চঞ্চল, অস্হির
হয়| আর তমঃ গুণ প্রভাবশালী হলে মানুষ আলস্যতায়
ভোগে| সৃষ্টির তৃতীয় উৎপন্ন বস্তু হল অহংকার বা
আত্মবোধ| এই অহংকার বা আত্মবোধ আমাদের মনে আমি-আমি
বা আমার-আমার বা আমি করিয়াছি এইরূপ বোধের সৃষ্টি
করে| অহংকারই মানুষের মনে অহং বা মম বোধের কারণ|
তিনটি গুণের মধ্যে কোনটি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে
তার উপর নির্ভর করে অহংকার তিন প্রকার হতে পারে
- ১) বৈকারিক, যখন সত্ত্বঃ গুণ প্রধান গুণ হিসাবে
প্রকাশিত হয়; ২) তৈজস, যখন রজঃ গুণের আধিপত্য;
আর ৩) ভূতাদি, যখন তমঃ গুণের আধিপত্য| বৈকারিক
বা সাত্ত্বিক অহংকার হতে উৎপন্ন হয় এগারটি অঙ্গের
– পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, যথা দৃষ্টি, শ্রবণ, গন্ধ,
আস্বাদ ও স্পর্শ; পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, যথা মুখ,
হস্তদ্বয়, পদদ্বয়, দেহ হতে নির্গমনকারী যন্ত্রসমূহ,
জননেন্দ্রিয়সমূ্হ এবং মনস্| মনস্ হল মানুষের মন
যার সাহায্যে মানুষ উপরিউক্ত অঙ্গসমূহের কার্য্য
নির্বাহ করতে পারে| মনস্, অহংকার এবং বুদ্ধি এই
তিনটিকে একত্রে বলা হয় ‘অন্তঃকরণ’| অপরপক্ষে,
দৃষ্টি, শ্রবণ, গন্ধ, আস্বাদ ও স্পর্শ এই পাঁচটি
জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মুখ, হস্তদ্বয়, পদদ্বয়, দেহ
হতে নির্গমনকারী যন্ত্রসমূহ ও জননেন্দ্রিয়সমূ্হ
এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়কে একত্রে ‘বাহ্যকরণ’ বলা
হয়| ভূতাদি বা তামস অহংকার থেকে উৎপন্ন হয় পাঁচটি
তন্মাত্রা – শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ| তৈজস
অহংকার উপরিউক্ত বৈকারিক এবং ভূতাদি হতে উৎপন্ন
বিভিন্ন বস্তুসমূহের উৎপাদনে যে শক্তির প্রয়োজন
তা সরবরাহ করে|
পাঁচটি তন্মাত্রা, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ,
থেকে উৎপন্ন হয় আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ (জল), এবং
পৃথিবী| শব্দ তন্মাত্রা থেকে আকাশ, স্পর্শ তন্মাত্রা
থেকে শব্দের স্পর্শে বায়ু, রূপ তন্মাত্রা থেকে
শব্দ ও স্পর্শের সংস্পর্শে অগ্নি, রস তন্মাত্রা
থেকে শব্দ, স্পর্শ ও রূপের সংস্পর্শে অপ বা জল,
গন্ধ তন্মাত্রা থেকে শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রসের
সংস্পর্শে পৃথিবী উৎপন্ন হয়| এই পাঁচটি তন্মাত্রাকে
‘অবিশেষ’ বলা হয কেননা এগুলির ধর্ম বা গুণ মানুষের
বোধগম্য জ্ঞানের ঊর্দ্ধে| তন্মাত্রাগুলির প্রাকৃতিক
উপাদানগুলিকে ‘বিশেষ’ বলা হয় কেননা এগুলির বিশিষ্ট
ধর্ম আছে| এই বিশেষগুলিকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে
– ১) স্হূল শরীর এবং ২) সূক্ষ্ম বা লিঙ্গ শরীর|
স্হূল শরীর হল মানুষের দেহ আর সূক্ষ্ম শরীর হল
অন্তঃকরণ, বাহ্যকরণ ও পঞ্চ তন্মাত্রার সমষ্টি|
সাংখ্য
দর্শন মতে প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ফলেই মানুষ তার
ভাল বা মন্দ কর্ম অনুযায়ী সুখ বা দুঃখ ভোগ করে|
কিন্তু মানুষের চরম লক্ষ্য হল তার আত্মার মুক্তি
বা মোক্ষ| এই মুক্তি বা মোক্ষ লাভ হলেই মানুষের
সব দুঃখের অবসান ঘটে| এই সকল দুঃখসমূ্হের প্রধান
কারণ হল অজ্ঞানতা, অবিবেচকতা| কাজেই বিবেক-জ্ঞান
হলেই এই অজ্ঞানতা বা অবিবেচকতার অবসান ঘটে| এই
বিবেক-জ্ঞান হল সম্যক্-ভাবে উপলব্ধি করা যে এই
দেহ ও আত্মা এক নয়, এমনকি এই মনস্, বুদ্ধিও আত্মা
নয়| আত্মা হল অজন্মেয় অর্থাৎ যার জন্ম নেই, অমর
অর্থাৎ যার মৃত্যু নেই, অবিনশ্বর অর্থাৎ যা নষ্ট
হয় না| আত্মা হল পুরুষ যা প্রকৃতি হতে স্বাধীন
এই উপলব্ধি হলেই মানুষ নিজের স্বরূপ বুঝতে পারে|
তখনই মানুষ সব দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করে|
যোগ
ঋষি পাতঞ্জলি
হলেন যোগ দর্শনের প্রবক্তা| যোগসূত্র তাঁর রচিত
এবং যোগদর্শনের মূখ্যগ্রন্থ| ঋষি ব্যাস এই যোগসূত্রের
উপর একটি ভাষ্য লেখেন, তা যোগভাষ্য বা ব্যাসভাষ্য
নামে প্রচলিত| ভোজরাজের ভিত্তি এবং যোগমণিপ্রভা,
বিজ্ঞানভিক্ষুর যোগভর্তিকা এবং যোগসারসংগ্রহ যোগদর্শনের
অন্য প্রধান গ্রন্থসমূহ|
পাতঞ্জলির
যোগদর্শন বা যোগসূত্র চার পাদে বা ভাগে বিভক্ত|
প্রথম পাদের নাম সমাধি পাদ| এই পাদ শিক্ষা দেয়
বিভিন্ন রকমের যোগ সম্পর্কে, চিত্ত বা মনকে কি
ভাবে সংযত করা যায় এবং বিভিন্ন যোগ প্রণালী| দ্বিতীয়
পাদ হল ক্রিয়াযোগ| এটি শিক্ষা দেয় কি প্রকারে
সমাধি লাভ করা যায়, ক্লেশ বা মানসিক দুঃখের কারণসমূ্হ
কি এবং কিভাবে সেগুলির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া
যায়, কর্মফলই বা কি| তৃতীয় পাদের নাম বিভূতিযোগ|
এই পাদ যোগের অর্ন্তনিহিত ভাবের সম্পর্ক এবং যোগ
সাধনার ফলে যেসব আধ্যাত্মিক শক্তির প্রাপ্তি ঘটে
সেই সম্পর্কে শিক্ষা দেয়| চতুর্থ পাদের নাম কৈবল্যপাদ|
এই পাদে মুক্তি কি, মুক্তিলাভ হলে মানুষের কি
পরিবর্তন হয় ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ
আছে|
যোগসূত্র হল মুক্তি বা মোক্ষ লাভের পথনির্দেশ|
যোগ শিক্ষা দেয় যে সম্যক্ আত্মজ্ঞান হলেই মুক্তি
লাভ হয়| আর এই সম্যক্ জ্ঞান হল যে আত্মা দেহ,
মন ও অহংকার অর্থাৎ এই শারীরিক দেহ হতে পৃথক|
এই জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় হল যদি আমরা আমাদের
দেহ, ইন্দ্রিয়সমূহের, মনের ও বুদ্ধির সমস্ত কার্য্যকলাপ
এবং সর্বশেষে অহংকার সংযত বা বশ করতে পারি| এই
সংযমের ফলেই আমরা পুরুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ
করব এবং উপলব্ধি করব যে আত্মা আমাদের দেহ-মন,
ইন্দ্রিয়াদি, বুদ্ধি এবং অহংকার বা আমিত্ববোধ
হতে পৃথক এবং উর্দ্ধে| আমরা উপলব্ধি করব যে আত্মা
হল মুক্ত, অমর এবং অবিনশ্বর| এই উপলব্ধিই হল সব
দুঃখ-কষ্ট হতে মুক্তি বা মোক্ষলাভ|
সাংখ্য
এবং যোগ দর্শন মতে আত্মা মুক্ত হলেও মানুষের দেহের
সঙ্গী| এই আত্মা আরও ঘনিষ্টভাবে জড়িত সূক্ষ্ম
বা লিঙ্গ শরীরের(ইন্দ্রিয়াদি, মন, বুদ্ধি ও অহংকারের
সমষ্টি) সহিত| আত্মার নিজস্ব স্বরূপ হল শুদ্ধ
চৈতন্য, দেহ-মন-ইন্দ্রিয়াদি, বুদ্ধি হতে পৃথক
এবং মুক্ত| আমরা ভ্রমবশতঃ আত্মাকে আমাদের দেহ-মন-ইন্দ্রিয়াদি-বুদ্ধির
সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত করি| যোগ আমাদের এই
ভুল সংশোধন করবারই শিক্ষা দেয়| যোগ শিক্ষা দেয়
চিত্তবৃত্তিনিরোধ অর্থাৎ কি উপায়ে আমরা আমাদের
এই ভুল শুধরাইতে পারব| চিত্তবৃত্তিনিরোধ হল মনের
সংযমতা এবং সব চিন্তার অবসান|
যোগসূত্র
বলে যে মানুষের মনে বিভিন্ন স্তর আছে| সেইজন্য
সব মানুষের পক্ষে যোগ কার্য্যকরী নাও হতে পারে|
যোগসূত্রের মতে মানুষের মন যখন এক একাগ্র স্তরে
পৌঁছয় তখনই সত্ত্বগুণ প্রভাবশালী হয়| তখনই মানুষ
কোন একটি বিষয়ের বা বস্তুর উপর একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ
করতে সক্ষম হয়| তখন তার মন প্রস্তুত হয় মনের সব
চিন্তার অবসান ঘটাতে| মনের এই একাগ্রতা স্হাপিত
হলে অর্থাৎ মন যখন একটি বিষয়ের ওপরই মনোনিবেশ
করে সেই অবস্হাকে ‘সমপ্রজ্ঞাত সমাধি’ বলে| এই
অবস্হায় মন তখন একটি বিষয়ের ওপরই মনোনিবেশ করে
থাকে তাই মনের সব চিন্তার অবসান ঘটে না| কিন্তু
যখন মানুষের মন হতে সব চিন্তার অবসান ঘটে তখন
মানুষের মন কোন একটি বিষয বা বস্তুর ওপর মনোনিবেশ
করে না অর্থাৎ মানুষের মন তখন এক নিরুদ্ধ স্তরে
পৌঁছয়, সেই অবস্হাকে বলা হয় ‘অসমপ্রজ্ঞাত সমাধি’|
এই সমাধি অবস্হায় মানুষের মন তার মৌলিক অবস্হার
শান্তভাবে আচ্ছন্ন হয়| এই অবস্হায় পৌঁছলেই মানুষ
তার জীবনের চরম লক্ষ্যে পৌঁছয় অর্থাৎ মুক্তি বা
মোক্ষলাভ করে জীবনের সব দুঃখ, অশান্তির অবসান
ঘটায়| এই অবস্হায় মানুষ উপলব্ধি করে যে আত্মা
এই দেহ-মন-ইন্দ্রিয়াদি-বুদ্ধি হতে পৃথক; আত্মা
অজন্মেয়, অমর, এবং অবিনশ্বর|
যোগের প্রধান
অঙ্গ আটটি, সেইজন্য অনেকসময় এই যোগ প্রণালীকে
‘অষ্টাঙ্গ যোগ’ নামেও অভিহিত করা হয়| যোগের এই
অঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ | এইটি সারা জীবনকে
নিয়ন্ত্রিত করে| যোগের আটটি অঙ্গ হল – ১) যম ২)
নিয়ম ৩) আসন ৪) প্রাণায়াম ৫) প্রত্যাহার ৬) ধারণা
৭) ধ্যান ৮) সমাধি| প্রথম অঙ্গ হল যম - অহিংসা,
সত্য, অজ্ঞেয় (অচৌর্য্য), ব্রহ্মচর্য্য ও অপরিগ্রহ|
দ্বিতীয় অঙ্গ হল নিয়ম - শৌচ (শরীরের যত্ন, স্নান,
পরিমিত আহার, ইত্যাদি), সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায়
(অধ্যাত্ম শাস্ত্র পাঠ) ও ঈশ্বর প্রণিধান বা ঈশ্বরে
আত্মসমর্পণ| তৃতীয় অঙ্গ হল - আসন| মেরুদন্ডের
উপর জোর না দিয়ে কটিদেশ (কোমর), স্কন্ধ (কাঁধ)
ও মাথা ঋজু ভাবে রাখা| চতুর্থ অঙ্গ হল – প্রাণায়াম
| প্রাণবায়ুকে আয়ত্ত করবার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের
সংযম| পঞ্চম অঙ্গ হল - প্রত্যাহার অর্থাৎ মনের
বিষয় অভিমুখী গতি ফিরিয়ে তাকে অর্ন্তমুখী করা|
ষষ্ঠ অঙ্গ হল – ধারণা অর্থাৎ কোন এক বিষয়ে মনকে
একাগ্র করে মনের শক্তি সঞ্চয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি
করা| সপ্তম অঙ্গ হল – ধ্যান বা ঈশ্বর প্রণিধান
অর্থাৎ কোন এক বিষয়ে মনের অবিচ্ছিন্ন চিন্তা|
অষ্টম অঙ্গ হল – সমাধি বা অতিচেতন বা জ্ঞানাতীত
অবস্হা প্রাপ্তি| এই সমাধি লাভ হলেই মানুষ সম্যক
জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়| এই জ্ঞান লাভ করাই আমাদের
সাধনার চরম লক্ষ্য|
প্রথম দুটি
অঙ্গ, যম ও নিয়ম, সারা জীবন ধরে অভ্যাস করতে হয়|
তৃতীয় অঙ্গ আসন| এর প্রধান উদ্দেশ্য হল দৈহিক
অর্থাৎ শারীরিক উন্নতি| প্রত্যহ নিয়মিত আসন করা
প্রয়োজন| যার যে আসনে বসলে সুবিধা হয় তেমন আসনের
অভ্যাস করা উচিত| এই অভ্যাস করার ফলে একজনের দীর্ঘকাল
একভাবে বসে চিন্তা এবং মনোসংযোগ করা সহজ হয়| চতুর্থ
অঙ্গ প্রাণায়াম হল প্রাণের নিয়ন্ত্রণ| প্রাণবায়ু
বা শ্বাস-প্রশ্বাস হল সমগ্র দেহের নিয়ামক মূল
চক্র| প্রাণবায়ুই চিত্তভূমির মধ্য দিয়ে আমাদের
আধ্যাত্মিক রাজ্যে নিয়ে যায়| প্রাণায়ামের তিনটি
অঙ্গ – প্রথম, পূরক বা শ্বাসগ্রহণ; দ্বিতীয়, কুম্ভক
বা শ্বাসরোধ; এবং তৃতীয়, রেচক বা শ্বাসত্যাগ|
সঠিকভাবে প্রাণায়াম শিক্ষা করবার জন্য গুরু বা
শিক্ষকের প্রয়োজন| প্রাণায়ামের পরের দুটি অঙ্গ
হল প্রত্যাহার ও ধারণা| প্রত্যাহার হল মনকে গুটিয়ে
এনে ঈপ্সিত এক বস্তুতে কেন্দ্রীভূত করবার চেষ্টা|
এর প্রথম ধাপ হল মনকে ছেড়ে দিয়ে তার ওপর শুধু
নজর রাখা এবং দেখা যে মন কি ভাবে, কি চিন্তা করে
ইত্যাদি| চিন্তাগুলিকে জোর করে বন্ধ করার চেষ্টা
করে কোন লাভ হয় না| চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়|
ধারণা হল সেই চিন্তা যে আমি আর ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন|
এই ধারণাই হল ধ্যানের মূল| এইরূপ ধ্যানের ফলে
যখন আমরা আমাদের মন থেকে আত্মাকে পৃথক করতে পারব,
যখন আমরা বুঝতে পারব যে আমরা ও আমাদের চিন্তা
সম্পূর্ণ আলাদা, তখনই আমরা ধ্যানস্হ অবস্হায় পৌঁছব|
সেই অবস্হাই হল অতিচেতন বা সমাধি|
যোগের শেষোক্ত
তিনটি অঙ্গ, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি, একত্রে অন্তরঙ্গ
সাধনা নামে অভিহিত হয় এবং অনেক সময় একে সংযমও
বলা হয়| এই তিনটি অঙ্গ সমাধি যোগের পক্ষে অতি
আবশ্যক|