বেশ কিছু বছর আগে উমাপ্রসাদ
মুখোপাধ্যায়ের লেখা “মুক্তিনাথ” পড়ে এই জায়গা আর মন্দিরের
কথা জানতে পারি আর ওখানে যাবার আগ্রহ হয়। অনেক বছর কেটে
যায় আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুতে বাত ধরে যায়। তা হলেও
ওখানে যাবার আশা মনে মনে পোষন করে রাখি। তবে বছর তিনেক আগে
শ্রীঅশোক রায়ের লেখা “শালগ্রাম শিলার উৎস সন্ধানে” পড়ে আর
কয়েক মাস আগে অনেক বছর আগের লেখা হলেও বৈতালিকের “মুক্তিতীর্থ
মুক্তিনাথ” পড়ে ওখানে যাবার আশা ত্যাগ করি।
যাঁরা মুক্তিনাথ যাবার ব্যাপারটা জানেন তাঁরা নিশ্চয় চিন্তা
করবেন যে তবে কি এখন প্লেন মুক্তিনাথের কাছাকাছি পর্যন্ত
আর যাচ্ছে না? হ্যাঁ, প্লেন যাচ্ছে তবে আমার পক্ষে প্লেনে
যাবার খরচ বহন করা সম্ভব নয় (পরে অবশ্য জেনে ছিলাম যে প্লেনের
খরচ যে অনেক তা কিন্তু নয়)। তার মানে ওখানে যেতে গেলে হাঁটতেই
হবে এবং পোখরা থেকে মুক্তিনাথ দেখে পোখরায় ফিরতে গেলে ১২
দিনের কাছাকাছি লাগবে। মোট পথ প্রায় ২৬০কিমি। আর এই হাঁটা
আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
ট্রেকিং পারদর্শী আমার এক প্রতিবেশীকে মুক্তিনাথ গিয়েছেন
কি না কিছু দিন আগে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন যে বেশ কিছু
বছর আগে মুক্তিনাথ যেতে তাঁর কষ্টই হয়েছিল তবে ইদানিং ওখানে
যাবার আর কোনও অসুবিধা নেই। কারণ, প্রায় সমস্ত পথেই হয় মিনিবাস
আর নয় জিপ চলছে। অবশ্য প্রায় সমস্ত পথটাই এখনও পাকা হয়নি।
তাঁরই এক বন্ধু অল্প দিন আগেই সেখানে ঘুরে এসেছেন। ওনার
কথা শুনেই আমার আশা জাগলো যে আমি হয়তো আমার মুক্তিনাথ যাবার
ইচ্ছা পুরণ করতে পারবো। সেই মুহূর্তেই তাঁর সেই বন্ধুর ফোন
নম্বর নিয়ে কথা বলে পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করি আর মুক্তিনাথ
যাবার গাড়ি-পথের ব্যাপার জেনে সেখানে যাবার ব্যবস্থা করতে
আরম্ভ করে দিই।
-২-
চিত্র-১,
পোখরা-মুক্তিনাথ ও অন্নপূর্ণা পরিক্রমা পথের মানচিত্র
বড়
করে দেখার জন্যে ছবির ওপর ক্লিক করুন
মুক্তিনাথ নেপালের
উত্তরে মুস্তাঙ জেলায় অবস্থিত (চিত্র-১, পোখরা-মুক্তিনাথ
ও অন্নপূর্ণা পরিক্রমা পথের মানচিত্র)। জেলার নাম, মুস্তাঙ
উপত্যকার নামানুসারে হয়েছে। এখানকার ভূমির গঠন প্রধানত ভারতের
জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলের মত, বনভূমির অভাব, ঊষর। তবে
মুক্তিনাথের আশেপাশে বৃষ্টি বেশ ভালই হয় আর কালী-গণ্ডকী
ও তার কিছু শাখা নদী রয়েছে এবং সেই অঞ্চলগুলোয় বেশ গাছপালা
আছে ও কিছু চাষ-আবাদও হয়ে থাকে। এই জেলার উত্তরে চীনের স্বশাসিত
অঞ্চল, তিব্বত। আর দক্ষিণে নেপালের পাহাড় অধ্যুষিত জেলা,
ম্যাগ্দি। ম্যাগ্দি জেলায় এবং এর পূর্ব ও পশ্চিমে বেশ
কয়েকটা সুউচ্চ পর্বত শীর্ষ রয়েছে, যেমন, পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চতম
শিখর ধৌলাগিরি (৮১৬৭মি.), পৃথিবীর ১০ম উচ্চতম শিখর অন্নপূর্ণা
১ (৮০৯১মি.), অন্নপূর্ণা দক্ষিণ (৭২১৯মি.), তিলিচো (৭১৩৪মি.)
এবং নীলগিরি হিমাল (৬৯৪০মি.)।
মুক্তিনাথ আসতে গেলে পোখরা (৭৮০মি.) থেকে যাত্রা আরম্ভ করাই
সুবিধা। অনেকে অবশ্য কাঠমান্ডু থেকেও যাত্রা শুরু করেন।
পোখরা ও কাঠমান্ডু, দুই জায়গা থেকেই প্লেনে মুক্তিনাথের
প্রায় ২০কিমি আর প্রায় ১০০০মি. নিচে অবস্থিত জোমসোম (২৭০০মি.)
আসা যায়। কাঠমান্ডু-জোমসোম আকাশ-পথ, পোখরা-জোমসোম আকাশ-পথ
থেকে যদিও বেশ কিছুটা বেশি, তা হলেও দুই পথেরই প্লেন ভাড়া
বর্তমানে (২০১০) ভারতীয় টাকায় ২৬০০। পোখরা থেকে হাঁটা পথে
মুক্তিনাথ প্রায় ১২০কিমি. তবে গাড়ি চলে যে পথে তার দূরত্ব
প্রায় ২০কিমি বেশি। কারণ? পরে এই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
আপাতত আমাদের যাত্রা আরম্ভের কথা হোক।
-৩-
পোখরা আসার জন্যে আমরা
গোরক্ষপুর-সোনাউলি-ভৈরবা পথ পছন্দ করলাম। কারণ, খালি রথ
দেখলেই হবে, মেলা দেখবো না? কলা বেচা অবশ্য আমাদের সম্ভব
নয়। ভৈরবা থেকে মাত্র ৩০কিমি. দূরে ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান,
লুম্বিনি দেখা আমাদের মেলা দেখা, উপরিও আছে, চিতওয়ান ন্যাশানাল
পার্ক (নেপালের জগদ্বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান) দেখা। এই দুই
জায়গা দেখা এই পথে এলেই সহজ হবে তাই এই পথে আসা ঠিক করলাম
আমরা ২০ জন মহিলা-পুরুষ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের দল,
সকলেই পূর্ণ বয়সের আর তার মধ্যে ষাটোর্ধ বেশ কয়েকজন।
আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা ২৮ এপ্রিল বিকেলে কোলকাতা-গোরক্ষপুর
এক্সপ্রেসে চেপে পরের দিন দুপুর প্রায় ১১টার সময় ঘন্টা দেড়েক
লেট করে গোরক্ষপুর পৌঁছলাম। স্টেশনের বিশ্রামাগারে স্নানাদি
সেরে এবং বাইরের হোটেলে দুপুরের আহার সমাধা করে নেওয়া হল।
একটা মিনি বাস স্টেশনের বাইরের বাস-স্ট্যান্ড থেকে ব্যবস্থা
করা হল মোট ২৮০০ টাকায়। এই বাসে আমরা পথে গোরক্ষনাথের মন্দির
দর্শন করে বিকেলে ভারতের সোনাউলি পৌঁছলাম। সেখান থেকে সঙ্গে
প্রচুর বাক্স-ব্যাগ থাকার জন্যে মাত্র তিন/চার ’শ মিটার
পথ হলেও রিক্সা চেপে নেপালের সোনাউলির এক হোটেল, জয়-বিজয়ে
উঠলাম। আশপাশে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। ভারতের সোনাউলিতেও
থাকার হোটেল বেশ কিছু আছে। অনেকে সেখানেই থাকা পছন্দ করেন।
ওখানে নাকি খাবার বেশি পছন্দের হয়ে থাকে।
আমাদের প্রোগ্রাম ছিল যে আমরা ৩০ এপ্রিল লুম্বিনি দেখে বিকেলের
মধ্যে চিতওয়ানের থাকার জায়গায় রাত কাটাবো। তার পরের দিন
জঙ্গলে ঘুরে ২রা মে পোখরায় চলে যাবো। আমরা বাড়ি থেকে বেরোবার
আগের দিন জানতে পারলাম যে নেপালের (তখনকার) প্রধান বিরোধী
দল, মাওবাদীরা ২রা মে থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ‘বন্ধ’
ডেকেছে। অনেকে আমাদের যাত্রা স্থগিত রাখতে পরামর্শ দেন।
আমরা তা না মেনে যাত্রা শুরু করে দিই। এবার নেপালের সোনাউলি
পৌঁছে জানতে পারি যে ১লা মেও কার্যত বন্ধ থাকবে নেপালের
যান-বাহন আর দোকান-বাজার। আমরা তাই আমাদের প্রোগ্রাম কিছুটা
পরিবর্তন করে এপ্রিলের ৩০ তারিখে সকালে লুম্বিনির প্রধান
দ্রষ্টব্য মায়াদেবীর মন্দির, অর্থাৎ সিদ্ধর্থের জন্ম স্থান,
সংলগ্ন সরোবর আর বাগান দেখেই তাড়াতাড়ি করে পোখরায় চলে গেলাম।
আমাদের উদ্দেশ্য হলো যে ১লা ভোর বেলাই মুক্তিনাথের পথে এগিয়ে
যাব, আশা যে পাহাড়ের অন্দরমহলে ‘বন্ধ’ তেমন ভাবে কার্যকরী
হবে না।
একটা খবর অবশ্য আমি অনেক পরে জেনেছিলাম যে আমরা যে পথে পরবর্তী
সময় যাব, সেই পথেই পড়বে নেপালের মাওবাদীদের সবথেকে জোরদার
ঘাঁটি। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাওবাদীরা ম্যাগ্দি
জেলার সদর, বেনিতেই পুলিসের প্রধান কার্যালয় ঘিরে রেখে প্রচুর
ক্ষতি করেছিল। মনে হয়, না জেনে ভালই হয়েছিল, কেননা আমরা
ওই অঞ্চল নির্বিঘ্নেই পার হয়ে গিয়েছিলাম। ওই খবর জানা থাকলে
হয়তো ওপথে এগোতে সাহস পেতাম না। পোখরায় থেকে গেলে সম্ভবত
আমরা পরের ছয় দিন মুক্তিনাথের পথে এগোতে পারতাম না। শুধু
তাই নয় পোখরাতেই পড়ে থাকতে হতো।
পোখরায় আমরা পৌঁছলাম অন্ধকারে। যদিও তখন আমাদের ঘড়িতে ৭:১৫
আর নেপালের সময় ৭:৩০, পোখরার প্রধান এক চৌমাথা, পৃথ্বী-চক
বা লক্ষ্মণ-চকে দোকান বন্ধ হয়ে গেছে অথবা বন্ধ করা হচ্ছে।
কারণ সম্ভবত বিদ্যুত না থাকা। এই চকের কাছের বাস-স্ট্যান্ডেই
আমাদের বাস দাঁড়ালো। শুনলাম পোখরা ও কাঠমান্ডুতে প্রতি দিন
নিয়ম করে ১২ ঘন্টা বিদ্যুত থাকে না তার মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা
থেকে রাত ১০:৩০ পর্যন্ত নিশ্চয় থাকবে না। সেই অন্ধকারে পছন্দমতো
হোটেল পেতে প্রায় রাত ১০টা হয়ে গেল। তাই পরের দিন ভোর বেলা
বেরোবার ব্যবস্থা করে ওঠা সম্ভব হলো না। এর গুনাগার আমাদের
ভালই দিতে হল, এই কাহিনিতেই তার খতিয়ান পাবেন। এর মধ্যে
আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে পরের দিন ১লা মে থেকেই কার্যত
‘বন্ধ’ শুরু হচ্ছে। আমাদের দলের বেশির ভাগ সদস্য ইতি মধ্যেই
রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছেন। আমরা যারা হোটেল খোঁজা আর পছন্দ
করায় ব্যস্ত ছিলাম, তাদের খাওয়া একটু অসুবিধে হল কারণ খাবারের
জায়গাও প্রায় সমস্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এর মধ্যেই।
১ মে ভোর বেলা থেকেই আমরা গাড়ির ব্যবস্থা করতে চেষ্টা আরম্ভ
করে দিলাম আর অন্যান্যদের মধ্যে কয়েকজন সেই সময়ে দূরে না
যেতে বলা সত্ত্বেও পোখরার প্রধান দ্রষ্টব্য, ফেওয়া লেক,
যা প্রায় ৩কিমি দূর পৃথ্বী-চক থেকে, সেখানে চলে গেলেন। গাড়ি
চলা বন্ধ, তাই হেঁটেই সেখানে যেতে হল তাঁদের। প্রথমে ছোট
মতো এক মিছিল, নেপালি কংগ্রেসের মে দিবস উপলক্ষে হোটেলের
সামনে দিয়েই যেতে দেখলাম। তার পর, মাওবাদীদের এক বিরাট মিছিল
একই কারণে পৃথ্বী-চক পার হতে দেখা গেল।
যাই হোক অনেক ঘোরা-ঘুরির
পর এক মিনি বাসের মালিক রাজি হল আমাদের নিয়ে বেরোতে এই শর্তে
যে ১ঘন্টার মধ্যেই যাত্রা আরম্ভ করতে হবে, তখন সকাল ১০টা।
আমরা মানতে বাধ্য, যদিও যাঁরা দূরে গেছেন তাঁদের বিষয়ে চিন্তা
থেকেই গেল। ভাড়া? সে কথা বলতে গেলে মুক্তিনাথ যাবার গাড়ি-পথের
কথা একটু জানলে বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রথম দিকে গাড়ির রাস্তা আর হাঁটার রাস্তা এক নয়। হাঁটার
রাস্তা স্বাভাবিক ভাবে কিছুটা কম তবে অনেক উঁচুতে উঠতে হয়।
এই রাস্তার বিষয়ে বলা উচিত এর বৈশিষ্ট্যতার জন্যে, তবে তা
পরে হবে। আপাতত গাড়ি-চলা রাস্তার কথাই হোক। বর্তমানে চারটি
ধাপে গাড়ি চলে। একেবারে শেষ প্রান্তে, অর্থাৎ মুক্তিনাথ
মন্দিরের প্রায় ৫০০মি. আগে হয় মোটর সাইকেলের পিনিওন রাইড
করে না হয় হেঁটে যেতে হয়। পিনিওন রাইড করলেও প্রায় শ’খানেক
সিঁড়ি পায়ে হেঁটেই উঠতে হয়। আমরা এই জেনেই যাত্রা আরম্ভ
করেছিলাম। পথে কি পেয়েছিলাম, সে কথা ক্রমশ হবে। প্রথম ধাপে
৭৬কিমি রাস্তার ৬৬কিমি পাকা ও শেষ ১০কিমি কাঁচা রাস্তায়
বেনি পর্যন্ত গাড়ি যায়। বাকি তিন ধাপের কথা সময় মতো বলা
যাবে। বেনি পর্যন্ত মিনি বাসের ভাড়া জন প্রতি ২০০ নেপালি
টাকা (বর্তমানে ১০০ ভারতীয় টাকা=১৬০ নেপালি টাকা)। আমাদের
ঠিক করা গাড়ি নিল জন প্রতি ৬৪০ নেপালি টাকা! আমরা বাধ্য
হলাম তাই দিতে, এর থেকে বেশি সুবিধাজনক ব্যবস্থার অভাবে।
-৪-
ফেওয়া লেক থেকে আমাদের
কয়েকজনের সাথীদের দেরি করে ফেরার কারণে আমাদের কিছুটা দেরি
হলো বাস ছাড়তে। শেষ পর্যন্ত ১১:৪৫ মিনিট নাগাদ আমাদের বাস
ছাড়তে পারলো। কিছুক্ষণের মধ্যে পোখরার পৌর এলাকা ছাড়িয়ে
এলাম। রাস্তায় মানুষজন খুবই কম রয়েছে। আমরা পথে কোনও জায়গায়
অবরোধ বা বাধা পেলাম না। ক্রমশ পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়লাম।
পোখরা থেকে সমানে পশ্চিম দিকে এগোচ্ছি। বসতি ঘন নয়। অল্প
দূরে দূরেই বাড়ি রয়েছে। একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়লো যে
অন্তত প্রথম দিকে বেশির ভাগ বাড়িই বেশ নতুন এবং আধুনিক শৈলীর।
মালিকের সচ্ছলতার পরিচয় দেয়। ভারতের শহরের বাইরের পাহাড়ি
অঞ্চলে এমন অবস্থা বিশেষ দেখা যায় না। যাত্রা আরম্ভের কিছু
পর থেকেই রাস্তা এক নদীর ধার দিয়ে চলেছে, নাম শুনলাম স্বেতি।
নদীর খাত অনেক জায়গায়
খুবই বেশি। জলের গভীরতা কিন্তু খুব একটা বেশি বলে মনে হলো
না। ছোট বড় পাথরে ভরা, তাই জল-স্রোতের উচ্ছলতা ভালই (চিত্র-২)।
চিত্র
২ পোখরা-বেনি পথের ধারের দৃশ্য। ছবি - লেখক
কিছুদূর অন্তর ছোট
বড় গ্রাম। এক জায়গায় গাড়িতে তেল ভরা হলো। পেট্রল-পাম্পে
মহিলা গাড়িতে পেট্রল দিল। ভারতের অনেক পাহাড়ি জায়গার মতো
নেপালেও প্রধানত মহিলারাই বাড়ির ও বাইরের সমস্ত কাজ করেন
আর পুরুষেরা অলস ভাবে ঘুমিয়ে, নেশা করে আর জুয়া খেলে সময়
কাটান। আজকাল অবশ্য অবস্থার অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। কুসমা
গ্রামের কিছু আগে থেকে একটু একটু করে আমাদের পথ উত্তর দিকে
বাঁক নিচ্ছে। কিছুটা যাবার পর রাস্তার একপাশে এক তোরণ, তাতে
লেখা আছে ‘গলেশ্বর শিবালয় নিবাস স্থান’। এখান থেকে নাকি
অল্প দূরেই। তবে সেই মন্দির দেখতে যাবার কোন চিন্তাই করলাম
না। প্রায় সমস্ত পাহাড়ি পথের ধারে পাহাড়ের গায়ে যেখানে চাষ
হয়ে থাকে, তা সিঁড়ির ধাপের মত পাহাড়ের গা কেটে করা হয়, এই
ব্যবস্থাকে Terraced Cultivation বলা হয়ে থাকে, তা এখানেও
আছে (চিত্র-৩)।
চিত্রে
৩ পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ। ছবি - লেখক
দেখতে দেখতে পিচের
রাস্তা শেষ হল, কাঁচা রাস্তায় বাস আমাদের দোলা দিতে দিতে
নিয়ে চললো। শুনেছি পরবর্তী রাস্তা সবটাই কাঁচা, তাই এই ১০কিমি
রাস্তা আমাদের বাকি রাস্তায় গাড়ি চাপার মহড়া হিসাবে ভাবতে
লাগলাম। শেষে প্রায় সওয়া তিন ঘন্টা পরে ২:৩০ নাগাদ আমরা
আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য বেনি পৌঁছলাম।
চিত্র
৪ বেনি বাস স্ট্যান্ড। ছবি - শ্রী অজয় মান্না
বেনি বাস স্ট্যান্ড
বেশ বড় এক অমসৃণ মাঠ, পাথরের ছোট বড় টুকরোয় ভরা (চিত্র-৪)।
কোনও শেড বলে কিছু নেই। প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে, তবে খুব
ঠান্ডা নয়। বাতাসের বেগ এমন যে পাথরের ছোট কুচি যেগুলোকে
আমরা মোটা দানা বালি বলতে অভ্যস্ত, তাও বাতাসে উড়ছে আর চোখে-মুখে
তীরের ফলার মতো এসে লাগছে। বইএ পড়েছি এই রকম বাতাসের বেগের
কথা যা নাকি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয় রোদের তাপ
বাড়ার কারণে। তবে সে তো এখানে নয় আর এখন তো রোদ নেই। তা
হলে? আকাশ বৃষ্টির মেঘে ঢাকা। মনে হলো কিছু আগেই বৃষ্টি
হয়েছে। স্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে কালী-গন্ডকী নদী প্রচন্ড গর্জন
সহ বয়ে যাচ্ছে, কখন যে স্বেতি নদী ছেড়ে এসেছি বুঝতেই পারিনি
।
নদীর আশ-পাশ দেখে
মনে হলো যে নিশ্চয় উপরে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। পরে তার প্রমাণ
আমরা ভালই পেয়েছিলাম। স্ট্যান্ডের এক কোনে টিনের এক ছোট
ঘর, টিকিট-কাউন্টার (চিত্র-৫)।
চিত্র
৫ বেনি বাস স্ট্যান্ডে টিকিট কাউন্টার। ছবি - শ্রী অজয় মান্না
অনেক বাস এদিক সেদিক
দাঁড়িয়ে আছে। বাস চলার লক্ষণ দেখলাম না, অর্থাৎ নিশ্চয় ‘বন্ধ’।
তবে খোঁজ করে জানতে পারলাম, না, বন্ধ নয়, যাত্রীর অভাবে
বাস চলছে না। যাত্রী এলেই বাস ছাড়বে। আমরা বেনি থেকে উপরে
যেতে চাই জানতে পেরে টিকিট কাউন্টার থেকে আমাদের টিকিট দিলো।
আমরা জানতাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঘাসা (২০১০মি.), প্রায়
৩৮কিমি দূরে। কিন্তু এখানে শুনলাম এখন ঘাসার কাছাকাছি রাস্তা
ভেঙ্গে যাবার কারণে ঘাসার প্রায় ৮কিমি আগে টিটার বলে এক
জায়গা পর্যন্তই বাস যাচ্ছে। টিটার থেকে দু-ঘন্টার মতো হেঁটে
ঘাসা যেতে হবে এবং সেখান থেকে আবার বাস ধরতে হবে। আমরা বুঝলাম
ওরা দু ঘন্টা হাঁটা বলছে কাজেই আমাদের অন্তত চার ঘন্টা লাগবে
৮ কিমি এই রকম পাহাড়ি পথে হাঁটতে। তা ছাড়া আমরা একেবারে
ভয়ে সিটিয়ে গেলাম আমাদের প্রচুর মালপত্রের কথা ভেবে। হাঁটার
ব্যাপারটা একদম শেষে আছে জানতাম, তাই সঙ্গে সমস্ত মালপত্র
নিয়ে এসেছি। এই পথে অনেকেই পোখরাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যাগ ইত্যাদি
রেখে যায়। যাই হোক, কি আর করা যায়, অগত্যা ....।
এখান থেকে টিটার পর্যন্ত ভাড়া জন প্রতি ১৮৫ নেপালি টাকা।
পোখরা-বেনি বাস ভাড়ার তুলনায় দূরত্ব বিচার করলে এই ভাড়া
বেশ বেশি (অবশ্য আমরা যা দিয়েছি তা এখানে বিচার্য নয়), কারণ
মনে হয় রাস্তা অনেক বেশি উঁচুতে উঠছে আর নিশ্চয়ই খুব খারাপ।
বাস-স্ট্যান্ডে যাত্রীর অভাবের কারনে জায়গা ফাঁকা, তাই আমাদের
এখানে আসার বাসের পাশাপাশি যাবার বাস দাঁড় করালো যাতে মাল-প্ত্র
আগের বাসের মাথা থেকে নতুন পথের বাসের মাথায় সোজাসুজি রাখা
যেতে পারে। ৩:১৫ মিনিটেই আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। যেতে যেতে
আমি চিন্তা করলাম যে দূরত্ব ও উচ্চতা বিচার করলে এই পথ যেতে
বাসের আড়াই ঘন্টা লাগবে, অর্থাৎ আমরা টিটার ৩:৪৫ মিনিটের
আগে পৌঁছাতে পারছি না। তার পর চার ঘন্টা হাঁটা, মানে অন্ধকার
হয়ে যাবে। তা হলে আর না এগিয়ে আমাদের টিটারেই থেকে যেতে
হবে। আমার ভাই এবং এই বেড়ানোর ব্যাপারে আমার ডান হাত, কল্যাণ,
তাকে ব্যাপারটা বললাম। কল্যাণ বলল যে সেও এই রকমই চিন্তা
করেছে।
বেনি, ম্যাগ্দি জেলার সদর। মোটামুটি বড় জায়গা, এখানকার
মাপকাঠিতে শহর বলাই যায়। জানিনা ‘বন্ধ’-এর জন্যে বা মোটামুটি
দুপুর বলে দোকান-পাট প্রায় সনস্ত বন্ধ। কিছুটা এগোবার পর
রাস্তার ধারে এক দোকানে পাঁউরুটি, শশা ইত্যাদি বিক্রি হতে
দেখলাম। কিছু কেনা হলো পাথেয় হিসাবে বেশ ব্যস্ত হয়ে ।
সব সময় মনে হচ্ছে
যে অনির্দিষ্ট কাল বন্ধ, খাবার ঠিক মতো পাওয়া যাবে তো? পোখরাতেও
দেখেছিলাম, রিং-এর মতো পাঁউরুটি, শুনলাম এগুলোকে ডো-নাট
বলে। এখানেও বিক্রি হচ্ছে সেই রকম। কয়েকটা কেনা হলো ভয়ে
ভয়ে, ভাল বা টাটকা হবে তো? পরে খেয়ে দেখা হলো। ভালই লাগলো,
প্রধান কথা সেগুলো বেশ টাটকা। এই পাহাড়ি শহরের মধ্যে দিয়ে
বাস এগিয়ে ক্রমে ফাঁকা রাস্তায় পড়ল। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি কাঁচা
রাস্তায় কালী-গণ্ডকী নদীর ধার দিয়ে বাস এগোচ্ছে আমাদের ঝাঁকানি
দিতে দিতে। এখন আর দোলা বলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছিল
বোধ হয় হেঁটে যাবার শারীরিক সক্ষমতা থাকলে তাই যাওয়াই ভাল।
এই আঁকা-বাঁকা রাস্তার মাঝে এক জায়গায় পেলাম দুপাশেই খাড়া
পাহাড়ের দেয়াল যেন আমরা উত্তর কলকাতার কোনও ঘিঞ্ঝি এলাকার
সরু গলিপথের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আর সেই পথ কেবলিই এদিক ওদিক
বেঁকে যাচ্ছে বলে বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না ।
প্রায় বিকাল ৪:০০,
আমাদের বাস ঘর্খোলা (১০৫০মি.) পার হলো। এইখানেই হাঁটা রাস্তা
আর গাড়ির রাস্তা মিশে যাচ্ছে। অবশ্য এর পরেও হাঁটার রাস্তা
অনেক জয়গাতেই আলাদা আছে। এই বিষয়টার কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন
আছে। পোখরা থেকে আমরা বেনি আসবার জন্যে পাকা রাস্তায় এসেছি।
বেনি দিয়ে না এসেও ঘর্খোলায় পৌঁছানো যায়। হাঁটবার জন্যে
যাত্রী এই পরিবর্তি পথই ব্যবহার করেন। তা ছাড়া ‘অন্নপূর্ণা
পরিক্রমা’ করার জন্যেও পরিক্রমাকারীরা এই পথে পা বাড়ান।
প্রচুর সংখ্যক বিদেশিরা এই পরিক্রমা করে থাকেন। অবশ্য নেপালে
বিদেশিরা আরও অনেক নির্ধারিত পথেই ট্রেক করে থাকেন। যাই
হোক, পোখরা-ঘর্খোলা পথের বিশেষতা সম্পর্কে আরও কিছু কথা
না জানালে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পোখরা থেকে পশ্চিম
দিকে প্রায় ২০কিমি দূরে নয়াপুল (১০৭০মি.) থেকে উত্তর দিকে
পায়ে চলা রাস্তা, বিরেথান্টি (১০২৫মি.) মোদিখোলা (খোলা মানে
পাহাড়ি নালা বা ছোট নদী) পার হয়েই এক কিমি দূরেই। এর পর
৬কিমি মোটামুটি চড়াই পথে টিখেধুঙ্গা (১৫০০মি.)। এবার ৪কিমি
হাঁপাতে হাঁপাতে উলেরির (২০১০মি.) বিখ্যাত চড়াই পার হয়ে
ঘোরেপানি (২৮৭০মি.)। এখানেই শেষ নয় কষ্টের, মাত্র ৩কিমি
পথেই আরও উঠতে হবে ৩২০০মি. উচ্চতার পুন্-হিলে। পুন্ ,
মনে হয় পুন্যের অপভ্রংশ। এই যে ৭কিমি পথে টিখেধুঙ্গা থেকে
পুন্-হিলে ১৭০০মি. চড়াই, আমাদের জানা তীর্থযাত্রার পথে
সবথেকে কঠিন চড়াই। আপনারা নিচে দেওয়া সারণিটি পড়লেই বুঝতে
পারবেন আমার কথার মর্মার্থ।
বড়
করে দেখার জন্যে ছবির ওপর ক্লিক করুন
এই রাস্তা এর পর উতরাইয়ে
চিত্রে (২৩৫০মি.), শীখা (১৯৩৫মি.), ঘারা (১৭০০মি.) হয়ে
ঘর্খোলার কাছে ১০কিমি আরও এসে গাড়ির রাস্তায় মিশছে। এই
পায়ে চলা পথের মোট দৈর্ঘ্য ২৪কিমি.। এই পথের বিশেষতার এখানেই
শেষ নয়। পুন্-হিল থেকে বেশ কয়েকটা শৃঙ্গ দেখা যায়। পৃথিবীর
১০ম উচ্চতম শিখর অন্নপূর্ণা ১, অন্নপূর্ণা দক্ষিণ, মচ্ছপুচ্ছারে
(৬৯৯৮মি.) তাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়। তা ছাড়া
অনেক জায়গা থেকেই নিচের উপত্যকার বিহঙ্গম দৃশ্য নাকি অপূর্ব।
আমরা তো আর এই পথে যেতে পারবো না, শারীরিক সামর্থের অভাবে,
তাই কল্প-চক্ষে সেই দৃশ্য দেখে নিলাম। পরে আমি অন্নপূর্ণা
পরিক্রমা পথের স্থানের দূরত্ব-উচ্চতার এক সারণি পেয়েছিলাম।
সেই সারণির চিত্র আমি উপস্থিত করছি পাঠকের সুবিধার্থে (চিত্র-৬)।
বড়
করে দেখার জন্যে ছবির ওপর ক্লিক করুন
আবার আমাদের যাত্রার
কথায় ফিরে আসি। বৃষ্টি পড়ার প্রমান ভালই পাওয়া যাচ্ছিল।
চলন্ত বাস থেকে কালী-গণ্ডকীর ধারা সমানে দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ
আগে থেকে লক্ষ্য করছি কালী-গণ্ডকীর জলের রং গাঢ় কালো। চলন্ত
গাড়ি থেকেই ভিডিও নিলাম, তাই ছবি খুব ভাল হলো না
এখান থেকে চলতে শুরু
করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো ৫:১৫
মিনিটে, জায়গার নাম দেখে বেশ আনন্দ হলো। উমাপ্রসাদবাবু,
অশোকবাবু আর বৈতালিক, তিন লেখকের বইএ এই জায়গার কথা বিশেষ
ভাবে উল্লেখ আছে, তাতোপানি (১২০০মি.), বা তপ্তপানি। এর খ্যাতি
এখানকার উষ্ণ-প্রস্রবণের কারণে। চলন্ত গাড়ি থেকেই লক্ষ করলাম
যে উষ্ণ-প্রস্রবণের ঘেরা জায়গা খুবই নোংরা,আশ-পাশও তথৈবচ।
স্নান করার জন্যে আবার ৪০ নেপালি টাকা প্রবেশ (স্নান?) মূল্য
দিতে হবে। বাস-স্ট্যান্ড, কুণ্ড থেকে কিছুটা এগিয়ে। এখানে
যাত্রার কিছুক্ষণ বিরতি। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল আর তার
সঙ্গে হিমেল বাতাস, হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। আমরা আবার হাতের
কাছে গরম জামা রাখিনি, সমস্ত বাক্সে বা ব্যাগে, যা বাসের
মাথায় তোলা। তাই উষ্ণ প্রস্রবণের জায়গায় যাওয়া সম্ভব হলো
না আমাদের। বাস-স্ট্যান্ডের আরও উত্তর দিকে তাকিয়ে পড়ন্ত
আলোয় (যদিও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন)পাহাড়ের অপূর্ব শোভা মুগ্ধ হয়ে
দেখতে থাকলাম, পাহাড়ের গায়ে এমন ভাবে বরফ জমে আছে যেন মনে
হয় জটাজুট ধারী ধ্যানরত কোনও ঋষি (চিত্র-৭)।
চিত্র
৭ তাতোপানি বাস স্ট্যান্ড থেকে। ছবি - লেখক
কালী-গণ্ডকী এখানেও
বাস স্ট্যান্ডের সামনে দিয়েই বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে চোখ ফেরাতেই
সে কী দৃশ্য, কালী গণ্ডকীর জল আর কালো কালির কিছুমাত্র পার্থক্য
নেই (চিত্র-৮ ও ৯)।
চিত্র
৮ তাতোপানি বাস স্ট্যান্ডের কাছে কালী-গন্ডকীর জল ১। ছবি
লেখক
চিত্র
৯ তাতোপানি বাস স্ট্যান্ডের কাছে কালী-গন্ডকীর জল। ছবি -
অচিন্ত্য পাল
তার উপর
ভীম বেগে উত্তাল জল-রাশি বয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে ভয়ঙ্কর গর্জন।
বুঝতে পারা গেল উপরে প্রচণ্ড বৃষ্টির ফলে এই জল-স্ফীতি।
আশ-পাশের মাটির রং কালো, সেই মাটি বৃষ্টির জলে ধুয়ে এসে
নদীতে মিশে জলের এই রং। অন্য সময়ে নদীর জলের রং ভাগীরথীর
জলের রং-এর সঙ্গে মিল দেখতে পেয়েছি। বেশ কিছুক্ষণ ভিডিও
ছবি নিলাম সেই দুই অভূতপূর্ব দৃশ্যের।
বাস চলেছে এখন সম্পূর্ণ
উত্তরমুখি, নদী আমাদের ডান দিকে। বাঁ দিক পাহাড় বেয়ে বৃষ্টির
জল অনেক জায়গাতেই রাস্তার উপর দিয়ে গিয়ে ডান দিকে খাদে নেমে
নদীতে মিশে যাচ্ছে। রাস্তায় কোনও বাস বা আর কোনও যান-বাহন
নেই। এক জায়গায় রাস্তার উপর বেশ কিছু বড় বড় পাথর পড়ে থাকতে
দেখা গেল। বাসের ক্লিনার, দেখে মনে হয় বছর পনের বয়স হবে,
নেমে গিয়ে একে একে পাথরগুলো সরিয়ে দিলো। তার ক্ষমতা যে কতটা,
বেশ বোঝা গেল ।
ঘন মেঘে আকাশ ভরে আছে,
তাই বেশ তাড়াতাড়িই অন্ধকার নেমে আসছে। সময় সময় অল্প বৃষ্টিও
পড়ছে।
বোল্ডার সরানোর পর বাস আবার আমাদের নাচাতে নাচাতে এগিয়ে
চলল। মাত্র কয়েক মিনিট চলার পর হঠাৎ এক জায়গায় বাস আটকে
গেল। জানালা দিয়ে দেখি বাসের নিচে রাস্তা দিয়ে ভীষণ বেগে
জল ডান দিকে নদীর খাদে পড়ছে। আমি ড্রাইভারের পিছনে বসে ছিলাম।
আমার বাঁ দিকেই বাসের দরজা। কিশোর ক্লিনার ইতিমধ্যেই দরজা
খুলে নিচে জলের মধ্যে রাস্তায় নেমে গিয়ে পাথর সরাবার চেষ্টা
করছে। আমি বহু পাহাড়ি পথে গিয়েছি কিন্তু এই প্রথম ভয় করতে
লাগলো, এই বোধ হয় আমাদের বাস জলের স্রোতে খাদে পড়ে যাবে।
কয়েকবার চেষ্টা করে ড্রাইভার গাড়ি এগিয়ে নিতে পারলো না।
চাকা জলের নিচে গর্তে আটকে গেছে, তাই কেবলিই ঘুরে যাচ্ছে,
গাড়ি এগোচ্ছে না। ড্রাইভার নেমে গিয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল,
আমরা ভাবলাম সাহায্যের জোগাড়ের জন্যে যাচ্ছে বোধহয়। কিন্তু
কয়েক মিনিট পরে ফিরে এসে জানালো যে সামনেই গ্রাম এবং আমাদের
হেঁটে চলে যেতে উপদেশ দিয়ে বাস থেকে নেমে যেতে নির্দেশ দিলো।
কিন্তু জলের মধ্যে কি করে নামবো? আমার স্ত্রী, ভারতী, ড্রাইভারের
বাঁ দিকে সাইড-সিটে বসে ছিল। সে ড্রাইভারের পাশের দরজা দিয়েই
নিচে লাফিয়ে নামলো। তার দেখাদেখি, যদিও সেদিকেই খাদ, আমি
ও বেশ কয়েকজন ওই রকম করেই নামলাম। প্রধান দরজা দিয়েও, জল
পার করতে বেশি দূরত্বে যেতে হলেও বাকিরা ওই দরজা দিয়েই নেমে
গেল। ফাঁকা গাড়িও ড্রাইভার চালাতে পারলো না। ক্লিনার তারপরেই
বাসের মাথা থেকে আমাদের জিনিস-প্ত্র আমাদের গ্নতব্য পথের
বিপরীত দিকে নামিয়ে দিতে আরম্ভ করলো। ইতিমধ্যে বেশ কিছু
স্থানীয় মানুষ এসে গেছে। তাদের সাহায্যে জিনিস গুলো জল পার
করে এগিয়ে আনা হলো। তার পর নিজেরাই সেই পাহাড় করা মাল-পত্র
নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ি চড়াই পথে এগোতে আরম্ভ করলাম।
সেই কষ্টের মধ্যেও আমি এই ঘটনা আর আমাদের অবস্থা ভিডিও রেকর্ড
করলাম কিছুক্ষণ।
এমন ভাবে প্রায় ১৫/২০
মিনিট হাঁটার পর পাশাপাশি দুটো ছোট হোটেল দেখা গেল (চিত্র-১০)।
চিত্র
১০, অন্নপূর্ণা লজ ও রেস্তোঁরা, দানা, ম্যাগ্দি। ছবি -
শ্রী অজয় মান্না
আমরা আকাশের চাঁদ
যেন হাতে পেলাম। একটা হোটেলে আমাদের সকলকার জায়গা হলো না।
দুই জায়গায় ভাগাভাগি করে আমরা মাথা গুঁজলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা
৭:৩০। আমাদের হোটেলে জায়গার নাম দেখলাম দানা (১৪০০মি.),
এবং জানলাম এখান থেকে আমাদের আজকের গন্তব্য টিটারের দূরত্ব
৭০০/৮০০মি. আন্দাজে।