আমরা ১০ জন যে হোটেলে
উঠলাম, তার নাম ‘অন্নপূর্ণা লজ এণ্ড রেস্তোঁরা।‘ মালিকের
নাম পুরণ বা পূর্ণ বাহাদুর। তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে হোটেল
চালান, আর আছে ভদ্রলোকের কিশোরী ভাইঝি, পূর্ণিমা। দোতলা
বাড়ি। কাঠ ও পাথরের। পাশেই দোকান, হেন জিনিস নেই যা সেখানে
পাওয়া যায় না। জুতোর সংগ্রহ বেশ ভাল, পাঁউরুটি, কেক্, বিস্কিট,
মুড়ি, লজেন্স, প্যান্ট, স্কার্ট, সার্ট, ব্লেড, মোমবাতি,
নেল পলিশ, সেন্ট, আপনি চান আর পুরণ আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করে
দেবে। ঘরগুলো বাথরুম সংলগ্ন নয় তবে বেশ কয়েকটা বাথরুম রয়েছে,
তা ছাড়া কেবল মাত্র আমরা ক’জনই রয়েছি আর রয়েছেন এক বিদেশিনি,
অন্নপূর্ণা পরিক্রমায় চলেছেন। দোকান-ঘরের পিছনেও লাগোয়া
দোতলা বাড়ি, কিছুটা পুরানো এবং এখানেই মালিকের পরিবার থাকেন,
রান্নাঘর, খাবার ঘর আর ভাঁড়ার রয়েছে। পরে জেনেছিলাম যে পুরণ
এই সম্পত্তি এই গ্রামের এক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কিনেছিলেন।
ব্রাহ্মণ পোখরায় চলে গেছেন তাঁর এখানকার বাস উঠিয়ে। আমদের
মধ্যে কয়েকজন মাত্র রাতে রেস্তোঁরায় খেলাম, ভাত, রুটি, আলু-বীনের
তরকারি আর কিসের জানি না, অপূর্ব স্বাদের এক আচার। আমার
কন্যা, শুভ্রমালা আচারের উপাদানগুলির নাম জানতে চাইলো। পুরণ
বাহাদুর যা বলল তার কোনও মাথা-মুন্ড বোঝা গেল না। এই প্রথম
দেখলাম নেপালি মহিলা পিছনে থাকছেন, পুরুষই রান্না ছাড়া সমস্ত
কাজই করছেন। খাবার স্বাদে ভালই তবে থালি হিসাবে অর্থাৎ পেট
ভরা নয়, দাম, নেপালি ১০০ টাকা। ভারতী আর আমার ভগিনিসমা গীতা,
সঙ্গে আনা ছাতু, মুড়ি, চিঁড়া এই সব দিয়েই রাতের খাওয়া সাঙ্গ
করলো। হ্যাঁ, বলা হয়নি, দ্বিসজ্জা ঘর, নেপালি ২০০ টাকা দৈনিক
ভাড়া।
পরদিন ২ মে আমরা আমাদের
সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বাকি সমস্ত কিছু অন্নপূর্ণা
লজে একটা ঘরে রেখে দিলাম। তার পর সকাল ৮:১৫ মিনিটে ঘাসার
উদ্দেশে হাঁটা আরম্ভ করলাম ।
চিত্র
১১ দানা থেকে হাঁটা আরম্ভের ঠিক আগে। ছবি - শ্রী অজয় মান্না
চিত্র
১২ হাঁটা শুরুর কয়েক মিনিট পরে। ছবি - শ্রী অজয় মান্না
আধ ঘন্টার মধ্যেই
টিটার পার করে এলাম। এই জায়গায় কেবল মাত্র একটা বড় রেস্তোঁরা
রয়েছে, থাকার কোনও জায়গা দেখতে পেলাম না। তখন মনে হলো গত
কালের বিপদ আমাদের উপকারই করেছে। না হলে এখানে বাস থেকে
নেমে আমাদের আবার নিচে নেমে গিয়ে দানাতেই থাকতে হতো। এও
মনে হলো যে মুক্তিনাথ আমাদের সামর্থ পরীক্ষা করলেন, আমরা
কি তাঁর দুয়ারে পৌঁছাতে সক্ষম?
রাস্তা খুব একটা চড়াই নয়, প্রায় সমতলই বলা যায় প্রথম দিকে।
পথের দৃশ্য যেমন পাহাড়ি পথে হয় তেমনই, আমাদের বাঁ দিকে পাহাড়
আর ডান দিকে কালী গণ্ডকী দক্ষিণ দিকে নেমে যাচ্ছে তার নৃত্যময়
ভঙ্গিমায়, কথকের নৃত্যাঙ্গনা যেন যুগলবন্দিতে তবলচির দ্রূত
লয়ে বাজানো তিন তালের উত্তর দিচ্ছে। জায়গা জায়গায় খাদ অত্যন্ত
গভীর। নেপালের ট্যুরিস্ম ডিপার্টমেন্টের কাগজে লেখা যে
দানা অঞ্চলে কালী-গণ্ডকীর Gorge নাকি পৃথিবীর গভীরতম। তবে
গভীরতার পরিমাণ জানানো নেই। আমার অবশ্য মনে হয়েছে, যমুনোত্রীর
কাছে যমুনার খাদ অনেক জায়গায় এর থেকে বেশি।
মাঝে মাঝে ছোট গ্রাম, কখনও এই পারে আর কখনও ওই পারে। অনেক
স্থানে তারের ঝোলা পুল নদীর দুই পারের মধ্যে সংযোগ রেখেছে।
পাটাতন লোহা বা কাঠ দুইএরই হয়ে থাকে।
চিত্র
১৪ ঝোলা পুল, কাঠের পাটাতন সহ। ছবি - শ্রী অচিন্ত্য পাল
ভারতের কুমায়ুঁ বা
গাড়োয়ালে এই অঞ্চলের মতো এতো বেশি সংখ্যক ঝোলা পুল নেই।
তার বদলে অবশ্য সিমেন্ট কঙ্কৃটের অথবা লোহার পুল অনেক বেশি
আছে। এখানে, অন্তত এই রাস্তায় যা একেবারেই নেই। তীর্থযাত্রী
বা অন্নপূর্ণা পরিক্রমারত যাত্রীদের জন্যে পথে কোনও পরিসেবার
সরকারি ব্যবস্থা এই সাময়িক হাঁটা পথে বা গাড়ি চলা পথে দেখতে
পাইনি। দূরত্বের নিশানা একদম নেই আর গ্রামের নাম লেখা বোর্ড
দুই এক জায়গায় রয়েছে তা অবশ্যই দোকানিরা ব্যবস্থা করেছেন,
দোকানের ঠিকানা লেখার প্রয়োজনে। উমাপ্রসাদবাবু সেই ১৯৬৫
সালের অক্টোবর মাসে তাঁর যাত্রার সময়ের কথা ‘মুক্তিনাথ’-এ
লিখেছেন, “... রাস্তা ভালই। তবে নেপাল সরকারের তরফ থেকে
যাত্রীদের সুখ-সুবিধার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা আছে বলে
মনে হোল না। এমনকি পথে কোথাও মাইল-পোস্ট বা পথ-নির্দেশক
কোন চিহ্ন নেই,-চটী বা ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা।
... খবর পাই, কিছুকাল থেকে এই যাত্রাপথের উন্নতির ও সমুচিত
ব্যবস্থাদির চেষ্টা চলেছে, ...।” কাঁচা হলেও বাস রাস্তা
তৈরি হয়েছে অবশ্য তা মাত্র বছর কয়েক আগে কিন্তু অন্যান্য
পরিসেবার কোনও চিহ্ন এখনও, যেমন আগেই বলেছি, এই প্রায় অর্ধ-শতাব্দী
পরেও হয়নি।
টিটার থেকে কিছুটা এগোবার পর এক অপরূপ দৃশ্য দেখা গেল। ‘রুপসে’
ঝর্ণা, তার সুদীর্ঘ ও সুডৌল দেহ নিয়ে বাঁ দিকের পাহাড় থেকে
ধাপে ধাপে নেমে এসে কালী গণ্ডকীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
চিত্র
১৫ রূপসী 'রুপসে'। ছবি - লেখক
‘রুপসে’ সত্যই রূপসি
অপরূপা। শুনেছি, মুক্তিনাথের সমগ্র পথে রুপসে অনন্যা, এই
সুদীর্ঘ পথে রুপসে একাই রাজত্ব করছে। স্থির ছবিতে এর সৌন্দর্য
ঠিক মত প্রকাশিত হয় না, এই ভিডিওতে দেখুন।
ভাঙ্গা রাস্তার সারানোর
ব্যবস্থা চলছে দেখতে পেলাম। তবে তাড়াতাড়ি কাজ করার কোনও
লক্ষণ দেখা গেল না। রাস্তা তৈরির কয়েকটা যন্ত্র রয়েছে আর
কয়েকজন মাত্র কর্মচারি পাথর ফাটাবার ব্যবস্থায় ব্যস্ত।
চিত্র
১৬ ভাঙ্গা রাস্তা সারানো। ছবি - শ্রী অজয় মান্না
কে জানে হয়তো ‘বন্ধ’-এর
কারণে। ছোট বড় সদ্য ভাঙ্গা ধারালো পাথরের টুকরোয় ভরা হওয়ার
কারণে রাস্তার এই অংশ দিয়ে হাঁটা বেশ কষ্টকর।
চলার পথে আমার চেষ্টা
ছিল আমরা যারা শেষের দিকে বেরিয়েছি দানা থেকে, তাদের থেকে
২০/২৫মি. এগিয়ে থাকতে। এতে পথের মধ্যে বাকিদের নিয়ে ছবি
তোলার সুবিধা হয়। তাই আমি সময় সময় পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম
আর ভাল মনে হলে স্থির বা ভিডিও ছবি তুলছিলাম। এই রকমই এক
বার পিছনে তাকিয়ে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেলো অপূর্ব সূন্দর
এক দৃশ্য দেখে। আপনারাও দেখুন, আর কী মনে হয়?
এক জায়গায় হাঁটা রাস্তাই
কিছুটা চওড়া হয়ে গেছে আর কয়েকটা পাকা বাড়ি রয়েছে দোকান সহ।
মনে হয় আশপাশে কোনও বড় গ্রাম আছে। তবে তা দেখতে পেলাম না।
বাস চলা কালে নিশ্চয় এখানে কিছুক্ষন বিস্রাম নেয়। এখানে
দোকান ঘরেও কোনও নাম বা জায়গার নাম লেখা নেই।
চিত্র
১৭ আঃ, বাঁচলাম! ছবি - শ্রী অজয় মান্না
বেশ কিছু দূর থেকে
চলন্ত গম-কল চলার শব্দের মতো শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল।
এই বার দেখলাম জাঁতা-কল চলছে তবে বিদ্যুতে নয়, জলের তোড়ে
।
চিত্র
১৮ জলের তোড়ে চলা জাঁতা কল। ছবি - শ্রী অজয় মান্না
ছোট্ট এক ঝোরার জলের
ওপরে এই কল এমন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে জাঁতা ঘুরতে
পারে এবং জাঁতার মাঝে গর্ত দিয়ে হাতায় করে একজন ভুট্টার
দানা ফেলে পেষাই করছে। আমরা এখন হাতে ঘোরানো জাঁতার ব্যবহার
আর দেখতে পাই না। এর বদলে জলে ঘোরানো জাঁতা দেখেই বেশ ভালো
লাগলো।
এর কিছু পরেই সামনে
কয়েকটা বড় ও পাকা বাড়ি দেখা গেল। বুঝতে পারলাম যে ওই জায়গাই
ঘাসা গ্রাম।
চিত্র
১৯ গ্রাম 'ঘাসা' পৌঁছে গেছি। ছবি - লেখক
বাড়ি গুলোর পিছনে
কিছু দূরেই বাস দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল । গাড়ির
রাস্তা ও এই পায়ে চলা রাস্তায় গাছ-পালা ভালই আছে। তবে কোনও
বিশেষ গাছের আধিক্য আমার এই অ-শিক্ষিত চোখে এ পর্যন্ত ধরা
পড়েনি। এখানে দূর থেকেই বোঝা গেল বাস-স্ট্যাণ্ডের পিছনেই
বেশ কিছু পাইন গাছ রয়েছে। শুধু রয়েছেই নয়, স্ট্যাণ্ডের দুদিকেই
অনেকটা জায়গায় জুড়ে রয়েছে অন্ধকার করে ঘন পাইনের জঙ্গল।