বেনি ছাড়াবার পর থেকেই ছোট ছোট বসতি আর তার
লাগোয়া প্রধানত তেমনই ছোট ছোট সব্জির বাগান দেখতে পেয়েছি।
দানায় পুরণ বাহাদুরের হোটেলের পাশেও তেমন বাগান দেখেছিলাম।
স্ট্যান্ডে পৌঁছবার একটু আগেই বাড়ি গুলোর কাছেই দেখতে পেলাম
বেশ বড় জায়গা নিয়ে বাঁধা কপির চাষ।
চিত্র
২০ ঘাসায় বাঁধা কপির চাষ ছবি - লেখক
দানা
থেকে ঘাসা পৌঁছাতে যে ৯কিমি হাঁটতে হলো, আগেই বলেছি তার
প্রথম দিকে বেশ কিছুটা পথ প্রায় সমতল। এই দূরত্বে মোট চড়াই
৬১০মি. সেই চড়াই আবার প্রায় সবটাই ঘাসার অল্প আগে থেকে।
তাই ঘাসা প্রায় পৌঁছে গেছি এই আনন্দের মধ্যে বেশ কিছুটা
নিরানন্দও এসে গেল হাঁটার শেষ সময়ে কষ্টের কারণে। এই সুজোগে
পাঠককে মনে করিয়ে দিই যে এই হাঁটার ব্যাপার সাময়িক, দান-ঘাসা
রাস্তা সারানোর কাজের জন্য এই সময়ে রাস্তার এই অংশে বাস
চলাচল বন্ধ ছিলো।
আমরা ২০ জন কিছু আগে পরে হাঁটা আরম্ভ করেছিলাম, পথে যে যার
সামর্থ অনুযায়ী হেঁটে শেষ পর্যন্ত ১:৩০-এর আশ পাশে একে একে
দানা থেকে ঘাসায় (২০১০মি.) পৌঁছলাম। বাস দাঁড়িয়ে আছে দূর
থেকেই দেখা গিয়েছিল, তবে বাস পরিসেবা চালু কি না সেখান থেকে
বোঝা সম্ভব হয়নি। তাই দোলায়মান মনে এই বিষয়ে খবর নিলাম অনেক
আগে চলে আসা কল্যাণের কাছে। যাত্রীর অপেক্ষায় বাস আছে জেনে
নিশ্চিন্ত হলাম।
চিত্র
২১ ঘাসা বাস স্ট্যান্ডে এক দোকানের সামনে বিশ্রাম রত ছবি
- লেখক
বেশ
কিছু সময় এখানে বিশ্রাম নেওয়া হলো (চিত্র-২১। অনেকে ভাত
খেলেন। অল্প পরিমাণ ভাত আর কিসের যেন তরকারি, দাম ১২০ নেপালি
টাকা। আমরা যে দোকানের সামনে বসেছিলাম, সামনেই তার রান্নার
জায়গা। উমাপ্রসাদবাবু আর অশোকবাবুর বইএ কাঁচা মাংসের লম্বা
টুকরো সার দিয়ে উনান থেকে কিছুটা উপরে ঝুলিয়ে রাখার কথা
পড়েছিলাম, এখানে তা চাক্ষুস করলাম।
ঝোলানো
মাংসের টুকরোর সারের নিচে উনানে চাপানো কেতলিতে চায়ের জল
গরম হচ্ছে বা তরকারি রাঁধাও হচ্ছে। এই রকম দেখে ওই দোকানে
অনেকে খেলেন না। জানি না অন্য দোকানে তাঁরা ওই রকম ব্যাপার
দেখতে পেয়েছিলেন কি না, আমি জিজ্ঞাসা করে তাঁদের অস্বস্তিতে
ফেলে দিতে চাইনি। ঘাসার এই বাস-স্ট্যান্ড অঞ্চলে অনেক দোকান
বাড়ি-ঘর রয়েছে। পুলিস আউট-পোস্টও দেখতে পেলাম। এই প্রথম
সরকারি বদান্যতায় তৈরি খাবার জলের এক কল রয়েছে দেখা পেল।
সেই কল থেকে জল তো খেলামই আবার বোতল-বন্দীও করলাম। এক দোকান
ঘরের সামনে সম্ভবত মার্ফা উপজাতীর ধূমপান রত এক মহিলা বসে
আছেন চোখে পড়লো। এই উপজাতীর ধূমপান রত মহিলা দেখতে পাওয়ার
মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই, কারণ এনারা অনেকেই ধূমপানে
অভ্যস্ত, তবে অচিন্ত্য এনার একটি ছবি নেয়, সেটা বেশ অদ্ভুত
হয়েছিল তাই আপনাদের সেই ছবি দেখতে দিলাম (চিত্র-২২)।
চিত্র
২২ ধূমপান রতা ছবি - শ্রী অচিন্ত্য পাল
বিশ্রাম
শেষে বাসে চাপলাম টিকিট কেটে। জন প্রতি লাগলো নেপালি টাকা
৪৫০। আমাদের আসন্ন গন্তব্যের দূরত্ব কিন্তু মাত্র ৩০কিমি।
আমরা যাবো এখন জোমসোম এবং সেখানেই হবে আমাদের রাত্রিবাস।
জোমসোমের উচ্চতা বেশ ভালই, ২৭২০মি.। তা ছাড়া আকাশে এখন বেশ
মেঘ রয়েছে অর্থাৎ জোমসোমে নিশ্চয় ঠান্ডা থাকবে। সেই কারণে
সঙ্গের পিঠের ব্যাগে রাখা হলো কিছু গরম জামা, মাফলার ইত্যাদি,
বাসের মাথায় রাখা বাক্স থেকে বার করে। আমার সহকর্মী ও আমার
থেকে মাস তিনেকের বড় ভ্রমণ-সঙ্গী হীরামোহনের কাছে জানতে
চাইলাম যে সে তার বিখ্যাত হনুমান টুপি নিয়েছে কি না। হীরামোহন
সঙ্গে সঙ্গে তার টুপি বাসের সিটে বসেই হাতে করে তুলে দেখিয়ে
দেয়। আমরা হেসে উঠি। যাই হোক, মনে হয় এই ৩০কিমিতে ৭১০মি.
চড়াই ভাঙ্গতে হবে বলেই বাস ভাড়া এত বেশি।
আমরা ২০ জন আর স্থানীয় ৫/৬ জন যাত্রী নিয়ে বাস ছাড়লো ৩:১০
মিনিটে। মিনিট ১৫ বাস চলার পর “অন্নপূর্ণা কনজার্ভেসন এরিয়া
প্রজেক্ট”-এর চেক্পোস্টে (চিত্র-২৩)।
আমাদের
কাছে এই অঞ্চলে প্রবেশের ছাড়পত্র দেখতে চাইলো। ভারতের বিভিন্ন
জাতীয় পার্কে যেমন অনেক সময় ছাড়পত্র অঞ্চলের প্রবেশদ্বারেও
পাওয়া যায়, আমাদের জানা ছিল না যে এখানে তা নিতে গেলে দ্বিগুন
মূল্য দিতে হয়। আমাদের জন প্রতি ৪০০ নেপালি টাকা প্রবেশ
মূল্য দিয়ে অঞ্চলে প্রবেশ করতে হলো। তবে সত্য-কথা হলো যে
তাতোপানির আগে বিরেথান্টিতেই এই প্রজেক্ট এরিয়ায় প্রবেশ
করে গেছি আমরা, অবশ্য চেক্-পোস্ট এই পথে এই প্রথম। পোখরা
বা কাঠমান্ডু থেকে এই প্রবেশ প্ত্র নিলে নেপালি ২০০ টাকায়
পাওয়া যেতো। আমাদের অবশ্য এই দুইয়ের কোন জায়গা থেকেই ছাড়পত্র
নেওয়া সম্ভব ছিল না। পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে পোখরায় আমাদের
অবস্থানের সময়ের কথা?
বেশি মূল্য দেওয়ার দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসে চেপে
কিছুটা এগোতেই রাস্তায় ধসের কারণে বাস এগোতে পারলো না। তবে
সকলে নেমে গিয়ে বাস ফাঁকা করে দিতে ড্রাইভার ধসের এলাকার
উপর দিয়ে বাস পার করে নিতে পারল, এবং আমরা বাসে যে যার জায়গায়
আবার উঠে বসলাম আর বাসের চলা আবার আরম্ভ হলো।
ভীষণ
চড়াই রাস্তা। এখানে জঙ্গল এ পর্যন্ত যা দেখেছি তার চাইতে
অনেক ঘন। সেটা অবশ্য ঘাসায় ঢোকার আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম।
রাস্তার অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। ১ ঘন্টায় মাত্র ৭কিমি দূরের
‘লেটে’ (২৫৩৫মি.) পৌঁছলাম। এখানে ঝির-ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে
আর তার সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস। বাস স্ট্যাণ্ড বৃষ্টি ও প্রচুর
সংখ্যক ঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকার কারণে খুবই নোংরা। পাশে ভেড়ার
খাটালও রয়েছে। স্ট্যাণ্ডের পাশেই সিমেন্টের এক উঁচু জায়গা
আর সেখানে কয়েকটা টেব্ল-চেয়ার রয়েছে। টেব্লের তলায় বৃষ্টি
থেকে রক্ষা পাবার জন্যে কয়েকটি ছেলে মেয়ে বসে চেঁচামেচি
করে খেলছে। বাসে আমাদের দেখতে পেয়েই সেখান থেকে হাত পাতছে,
সম্ভবত লজেন্সের আশায়। তার মধ্যে একটি ছেলে সময় সময় একটু
দূরে এক মহিলা, মনে হলো তার মার দিকে তাকাচ্ছে আর হাত গুটিয়ে
নিচ্ছে। তাই দেখে আমাদের বেশ মজা লাগলো।
পরবর্তী
১৮কিমি পথ ১ ঘন্টা ১০ মিনিটেই লার্জুঙ, কোবাঙ ও টুকুচে পার
হয়ে মার্ফা (২৬৭০মি.) পৌঁছে গেল বাস, চড়াই বেশ কম তাই। তা
ছাড়া বাস অনেক সময়েই কালী গণ্ডকীর সমতল চরের উপর দিয়ে চলেছে
বলেও সময় কম লাগলো। এই রাস্তায় যেতে যেতে আমার লাদাখের সমতল
ও ধু ধু করা মরুভুমির উপর দিয়ে গাড়ি চলার কথা মনে পড়ছিল।
তফাৎ কেবল মাত্র সেখানে মেঘহীন আকাশ আর জলশুন্য প্রান্তর
ছিল আর এখানে বৃষ্টির মেঘে ভরা আকাশ, সময় সময় বৃষ্টি আর
চারিদিকে জলের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
মার্ফা
বেশ বড় গ্রাম, প্রচুর বাড়ি আর বাড়ি ও লাগোয়া বাগান ঘিরে
উঁচু পাঁচিল। মনে হয় যেন প্রত্যেকটি বাড়ি এক একটি দূর্গ
বিশেষ। বৃষ্টি জোরেই আরম্ভ হলো আর চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল
দেখতে দেখতে। পাথরের পাঁচিলে ঘেরা গম, বার্লি আর বাঁধাকপির
ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সমতল পথ বেয়ে জোমসোম পৌঁছলাম সন্ধ্যা
৬:১০ মিনিটে, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে। তখনও ঝির ঝিরে
বৃষ্টি পড়েই চলেছে ।
জোমসোম
বাস-স্ট্যান্ড শহরে ঢোকার মুখেই। বাস-স্ট্যান্ড বলতে আলাদা
করে কোনও জায়গা নেই। রাস্তার পাশেই পাথর বিছানো একটু চওড়া
জায়গা। সেই স্ট্যান্ডের লাগোয়াই কয়েকটা হোটেল ও লজ রয়েছে।
বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যেই কল্যাণ, অচিন্ত্য, শৈলেনবাবুরা
নেমে গেল সুবিধা মতো মাথা গোঁজার স্থান খুঁজতে। বাকিরা বাসের
মধ্যে বসে রইলাম। কল্যাণরা বেশ কয়েকটার মধ্যে পছন্দ করলো
ভাড়া আর ব্যবস্থাপনার বিচার করে পাশেই রবীন্দ্র গৌচনের ‘হোটেল
ধৌলাগিরি।’ তখনও বাস থেকে সকলে নামিনি, এক মশাল মিছিল তাদের
নেতাদের জয়ধ্বনি দিতে দিতে হোটেলের সামনে দিয়ে গেল, আমি
সেই মশাল-মিছিলের ভিডিও ছবি নিতে ভুলিনি।
আর হোটেলে
ঢুকতে না ঢুকতেই শুনতে পেলাম আগামি কাল এখানে মাওবাদী দলের
ডাকা অনির্দিষ্ট কালের বন্ধ আরম্ভ হচ্ছে সকাল থেকেই। যাই
হোক, হোটেলের ভাড়া ঘরের অনুযায়ি নয়, জন প্রতি নেপালি ১০০
টাকা। সংলগ্ন স্নান-ঘর নেই, তবে এখানেও মনে হলো আমরা ছাড়া
মাত্র একজন বিদেশি রয়েছেন, কাজেই বাইরে স্নান-ঘর হলেও চলে
যায়। এই পথে হোটেল ও লজে থাকতে গেলে অন্তত কয়েকজনকে ওখানে
খেতেই হবে। অবশ্য রাতে আর কিছুই পাওয়া যাবে না, চারখানি
রুটি আর কেবল মাত্র এক নতুন ধরনের তরকারি, পালংশাক লবন দিয়ে
সিদ্ধ করা। তবে পরে জেনেছিলাম, পালংশাক নয় স্থানীয় এক প্রকারের
ফার্ণ। স্বাদ যে খারাপ, অন্তত আমার মনে হয়নি। তবে যদি বিস্বাদ
হতোও উপায় আর কিছু নেই, তাই খেলাম কয়েকজন। দাম? নেপালি ১০০
টাকা প্রতি থালা।
শুনলাম মুক্তিনাথ যাবার এই শেষ চরণের যাত্রার জন্যে এখান
থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কালী গণ্ডকী পার করে পুরানো
জোমসোম থেকে জিপ ছাড়ে সকাল ৮টা থেকে। নদীর এপারে নতুন চকচকে
জোমসোম গড়ে উঠেছে। উমাপ্রসাদবাবুও এই জায়গাকে নতুন জোমসোম
বলেছেন সেই ১৯৬৫ সালেই। তবে তখন জিপ চলার স্বপ্নও কেউ দেখতো
না। মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে যখন শুতে গেলাম, তখন রাত ১১টা,
বৃষ্টি অল্প-স্বল্প পড়েই চলেছে।